ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দির,মহারাষ্ট্র
বিজিত কুমার রায়
জ্যোতির্লিঙ্গ হল শিবপুরাণ গ্রন্থে উল্লিখিত ১২টিজ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অন্যতম। ঘৃষ্ণেশ্বরকেই সর্বশেষ জ্যোতির্লিঙ্গ মনে করা হয়। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের দৌলতাবাদ থেকে ১১ কিলোমিটার ও আওরঙ্গাবাদ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বেরুল গ্রামে এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটি ইলোরা গুহার কাছে অবস্থিত।
আমি আমার কাজের সুবাদে বহুবার আউরঙ্গবাদ যেতাম। তারই মধ্যে একবার এই মন্দির দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল। মন্দিরের গাত্র-অলংকরণে প্রাগৈতিহাসিক মন্দির প্রথা ও প্রাগৈতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়। মন্দিরে রক্ষিত শিলালিপিটি এখানকার পর্যটকদের কাছে একটি বিশেষ আকর্ষণ। মন্দিরটি লাল পাথরের তৈরি। এতে পাঁচটি চূড়া দেখা যায়। বর্তমান মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত। এর গাতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদিত আছে। কথিত আছে, বেরুলের শিবভক্ত উপজাতি-প্রধান ঘৃষ্ণেশ্বরের কৃপায় এখানে গুপ্তধনখুঁজে পেয়েছিলেন। এই টাকায় তিনি মন্দিরটির সংস্কার করান ও শিখরসিঙ্গনপুরে একটি হ্রদ প্রতিষ্ঠা করেন। গৌতমীবাল (বায়জাবাই) ও অহল্যাবাই হোলকারও ঘৃষ্ণেশ্বরের মন্দির সংস্কার করিয়েছিলেন।মন্দিরের উপরে লাল পাথরে দশাবতারের মূর্তি খোদিত হয়েছে। দরবার কক্ষটিতে ২৪টি স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভগুলিতেও সুন্দর চিত্র খোদাই করা আছে। দরবার হলে নন্দিকেশ্বরের মূর্তিও আছে। গর্ভগৃহের আয়তন ১৭ ফুট X ১৭ ফুট। লিঙ্গমূর্তিটি পূর্বমুখী।
ঔরঙ্গাবাদ থেকে উত্তর- পশ্চিম দিকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বেরুল গ্রামেই আদি অনন্তকাল ধরে বিরাজমান ভগবান ঘৃশনেশ্বর মহাদেব। বিখ্যাত ইলোরা গুহা (কৈলাশ টেম্পল) এখান থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার। উঁচু প্রাচীর ঘেরা এই মন্দির। নানা দেবদেবীর মূর্তিতে অলংকৃত বিশাল বড় বড় পাথরের থাম ছাদকে ধরে রেখেছে, এইটি নাটমন্দির। নাটমন্দির পার হয়ে গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। এই মন্দিরে গর্ভগৃহে প্রবেশ করার সময় পুরুষদের জামা খুলে খালি গায়ে যেতে হয়। খুবই ছোট গর্ভমন্দির, ৫/৬ টি সিঁড়ি নেমে মহাদেবের সামনে বসে নিজে হাতে ফুল, বেলপত্র,ঘি, মধু, গঙ্গাজল ও ফল ইত্যাদি দেওয়া যায়। পুরোহিত দ্বারা রুদ্রাভিসেক পূজাও করা যায়, গর্ভমন্দিরের ভিতরে বাবার সমনে বসিয়ে। লিঙ্গের বামদিকের দেওয়ালের গায়ে দণ্ডায়মানা দেবী পার্ববতীর কস্টি ও শ্বেত পাথরের দুটি বিগ্রহ লাল পট্টবস্ত্র ও ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। নাটমন্দিরের সামনে নহবতখানা আছে, দিনে দুবার আরতির সময় নহবত ও নাকাড়া বাজানো হয়। এখানে মন্দিরের বাইরে নাটমন্দিরে একবিংশ গণেশপিঠের অন্তর্গত লক্ষবিনায়ক বিরাজমান। মন্দিরের ভিতরে মোবাইল ও ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ, তার জন্য মন্দিরের ভিতরের ছবি দিতে পারলামনা।
ছবিটি অন্তর্জাল থেকে
একটি সংযোজন।
জ্যোতিরলিঙ্গ যেগুলি দর্শনের ইচ্ছা এখনো আছে :
১) শ্রী মল্লিকার্জুন-এটি অন্ধ্র প্রদেশের শ্রী শৈলম পর্বতমালাতে অবস্থিত। এটি শক্তিপীঠ হিসাবেও প্রসিদ্ধ। এই স্থানের ভৈরব মল্লিকার্জুন আর মাতা ভ্রমরম্বা।
২) শ্ৰী বৈজনাথ : এই স্থানটি হিমাচলের পালামপুর থেকে ১৬ কিমি দূরে।
বৈদ্যনাথ ধাম দেওঘর বা বৈজনাথ কোনটি জ্যোতিরলিঙ্গের মধ্যে পরে এই নিয়ে মতভেদ আছে।
এছাড়া যে বিখ্যাত শিবমন্দির গুলি আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেগুলি :
১) পশুপতিনাথ : নেপালে কাঠমান্ডুতে অবস্থিত এই মন্দিরে পঞ্চমুখী শিব আছেন।
২) সুন্দরেশ্বর : তামিলনাড়ুর মাদুরাইতে শ্রী মীনাক্ষী মন্দিরের কাছে এই মন্দিরটি।
৩) বৃহদেশ্বর : তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লী থেকে ৪০ কিমি দূরে থানজাভুরে এই বৃহৎ গ্রানাইট পাথরের মন্দির যেখানে শিবলিঙ্গটি দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ লিঙ্গ।
৪) পক্ষিতীর্থম : চেন্নাই থেকে কিছুদুরে চিঙ্গেলপেটে অবস্থিত এই মন্দির। এখানে প্রতিদিন দুইটি শ্বেত বর্ণের পক্ষী ভোগ নিবেদন করলে এসে খেয়ে যায়।
৫) মহাবালেশ্বর : পুনে থেকে কিছু দূরে একটি প্রসিদ্ধ শৈলসহরে এই মন্দিরটি।
৬) তারকেশ্বর : পশ্চিমবঙ্গের এই প্রসিদ্ধ বাবার ধামটি প্রায় সকলেই দর্শন করা।
৭) ভুবনেশ্বর : ওড়িশার রাজধানীতে প্রসিদ্ধ লিঙ্গরাজ মন্দির যারা পুরী যান প্রায় সকলেই দর্শন করেছেন।
৮) মধ্যমেশ্বর : কাশী ধামে বাবা বিশ্বনাথ মন্দির পরিসরেই এই মন্দির।
৯) সর্বেশ্বর : রাজস্থানের চিত্তরগড় ফোর্টের মধ্যেই এই মন্দির।
১০) স্তম্ভেশ্বর : চিত্তরগড়ে জয়স্তম্ভে এই মন্দিরটি।
১১) জম্বুকেশ্বর : তিরুচিরাপল্লী তে একটি সরোবরের মধ্যে এই মন্দিরটি যার নাম ঐখানে অপপুলিঙ্গম। লিঙ্গটি সব সময় জলের নীচে থাকে।
১২) বৈদ্যনাথ ধাম : ঝাড়খণ্ডের মধুপুরের কাছে এই প্রসিদ্ধ মন্দিরটি অনেকে জ্যোতিরলিঙ্গের মধ্যে ধরে থাকেন।
১৩) অচলেশ্বর : এই মন্দিরটি রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে।
১৪) দক্ষিনেশ্বরের শিব মন্দির
দ্বাদশ শিবমন্দিরের শিবলিঙ্গগুলির নাম–চাঁদনীর উত্তরদিকের মন্দিরসমূহের যথাক্রমে–যোগেশ্বর, যত্নেশ্বর, জটিলেশ্বর, নকুলেশ্বর, নাকেশ্বর ও নির্জরেশ্বর, আর চাঁদনীর দক্ষিণদিকের মন্দিরগুলির শিবলিঙ্গের নাম যথাক্রমে যজ্ঞেশ্বর, জলেশ্বর, জগদীশ্বর, নাগেশ্বর, নন্দীশ্বর ও নরেশ্বর।
এছাড়া প্রসিদ্ধ শিবমন্দির যেগুলি দেখা হয়নি তা হলো :
১) অমরনাথ : বরফানি বাবার মন্দির কাশ্মীরে গুহার মধ্যে অতি দুর্গম অঞ্চলে।
২) কুম্ভেশ্বর – তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনামে অবস্থিত।
৩) বৈজনাথ : এটি কাংরা জেলাতে অবস্থিত।
৪) কোন্দরিয়া শিব : এটি মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহতে।
৫) একলিঙ্গেশ্বর : চিতোরের রাস্তাতে পরে এই মন্দিরটি চিতোরের রানাদের পূজ্য মন্দির। আমরা অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও যেতে পারিনি।৬) গৌরিশংকর : মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে এই মন্দিরটি।
৭) হরিশ্বর – দুর্গম মানস সরোবরের কাছে এই মন্দিরটি।
৮) ব্যাসেশ্বর : বারাণসী কাশীধামের কাছে।
৯) মধ্যমেশ্বর : এই মন্দিরটিও কাশীধামে।
১০) হাটকেশ্বর : বরণগরু (?) কোথায় জানিনা।
১১) মুক্ত পরমেশ্বর : এই মন্দিরটি অরুণাচল প্রদেশে।
১২) প্রতিগেশ্বর : ক্রউঞ্চ পর্বত (কোথায় জানা নেই)
১৩) কপালেশ্বর : ক্রউঞ্চ পর্বতে।
১৪) কুমারেশ্বর : ক্রউঞ্চ পর্বতে।
১৫) অজয় অমরেশ্বর : মহেন্দ্র পর্বতে (কোথায় জানা নেই)
১৬) একামব্রনাথ : শিবকাঞ্চি তামিলনাড়ু।
১৭) তেজলিঙ্গ : চিদাম্বরম তামিলনাড়ুর ভিললুপুরমে।
১৮) কলহস্তিশ্বর : অন্ধ্র প্রদেশের তিরূপতি মন্দিরের কাছে।
এছাড়াও আরো অনেক বিশেষ প্রদেশের বিখ্যাত শিব মন্দির আছে যেগুলি অন্য কোনো সময়ে চেষ্টা করবো লিপিবদ্ধ করার।
******************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।