ইউরোপ ভ্রমণ (অষ্টম পর্ব): পিসা আর ফ্লোরেন্স
বিজিত কুমার রায়
ওই নিয়ম মেনে সকাল সকাল তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ৮টার সময় বাস চালু। প্রায় চার ঘন্টার জার্নি পিসার দিকে। রাস্তার দুইধারে নানা ফলের বাগিচা আর মাঝে মাঝে মার্বেল পাথরের কোয়ারী।
পিসার ছবি বহুবার আগেও দেখেছি কিন্তু সাক্ষাতে দেখে আর পিসা সহ ক্যাথিড্রাল দেখে সেই সময়ের পাথরের কারিগরী দেখার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হলো।
ভূমি থেকে অষ্টতলাবিশিষ্ট এ মিনারের উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার। এর সর্বমোট ওজন প্রায় ১৪,৫০০ টন। বর্তমানে এটি প্রায় ৩.৯৯ ডিগ্রী কোণে হেলে রয়েছে। এর ২৯৪টি সিঁড়ি আছে।
১১৭৮ সালে মিনারটির তৃতীয় তলা নির্মাণের পর এটি হেলতে শুরু করে। নরম মাটিতে মাত্র তিন মিটার গভীরতায় এর ভিত্তি গড়ে তোলাই মিনারটির হেলে পড়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া মিনারের নকশাও এজন্যে কিছুটা দায়ী। অবকাঠামোটির নির্মাণকার্য শতাধিক বছর বন্ধ ছিল। কারণ পিসার অধিবাসীরা প্রায়শঃই জেনোয়া, লুক্কা এবং ফ্লোরেন্সের সাথে যুদ্ধকর্মে লিপ্ত থাকতো।
পিসার হেলানো মিনারটির প্রকৃত স্থপতি কে ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেক বছর ধরেই গাগলিমো এবং বোনানো পিসানোকে এর নকশাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে বোনানো পিসানো ছিলেন দ্বাদশ শতকের সুপ্রসিদ্ধ পিসা নগরীর অধিবাসী ও শিল্পী। তিনি ব্রোঞ্জ দিয়ে গড়া পিসা দুমো’র জন্যেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ১১৮৫ সালে পিসা ত্যাগ করে সিসিলি’র মনরিলে এলাকায় চলে যান এবং নিজ শহরে ফিরে আসা মাত্র দেহত্যাগ করেন। ১৮২০ সালে টাওয়ারের পাদদেশে তাঁর নামাঙ্কিত এক টুকরো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এটি ১৫৯৫ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ক্যাথেড্রেলের ব্রোঞ্জের দরজার সাথে সম্পর্কিত ছিল। এছাড়াও, সাম্প্রতিককালের গবেষণায় দেখা গেছে যে, দিওতিসালভি নামক এক ব্যক্তি পিসার হেলানো মিনারের প্রকৃত স্থাপত্যবিদ। নির্মাণকার্যের সময়কাল, দিওতিসালভির কাজ-কর্ম, স্যান নিকোলা মিনারের ঘণ্টা ইত্যাদিতে এর প্রতিফলন ঘটেছে। সচরাচর তিনি তাঁর কাজগুলোয় স্বাক্ষর করতেন কিন্তু মিনারের ঘণ্টায় তিনি কোন স্বাক্ষর করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী জার্মান সেনাদেরকে মিনারের অভ্যন্তরে দেখতে পায় যা তারা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতো। মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন সার্জেন্ট জার্মান বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করতে মিনারটিতে যান। তিনি মিনারের শৈল্পিক দক্ষতায় অভিভূত হন এবং ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্য্য উপভোগ শেষে সেনাবাহিনীকে মিনার আক্রমণ না করতে নির্দেশ দেন। এভাবেই মিনারটি নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি থেকে রক্ষা পায়।
১৯৮৭ সালে পিজা ডেল ডুমো ও তার পার্শ্ববর্তী ক্যাথেড্রাল,বেপ্টিসটেরি এবং সিমেট্রিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয়া হয়।
সকলের ছবি তোলা শেষ হলে রওয়ানা দিলাম এক ভারতীয় রেস্টুরেন্টের দিকে। লাঞ্চের পর রওয়ানা দিলাম ফ্লোরেন্সের দিকে যেটি দুই ঘণ্টার রাস্তা। বলতে ভুলে গেছি আমরা এই লম্বা জার্নির একঘেয়েমি কাটাতে সবাই মিলে জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া শুরু করেছিলাম। বিশেষ করে অন্য দেশের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ধন ধান্য পুষ্পে ভরা গাওয়ার আনন্দই আলাদা।
ফ্লোরেন্স মধ্য ইতালির তুস্কানি (তুস্কানা) অঞ্চল ও ফ্লোরেন্স প্রদেশের প্রধান শহর হিসেবে খ্যাত। রোমের উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে এ শহরের অবস্থান। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত মেয়াদকালে এ শহরটি আধুনিক ইতালি রাজতন্ত্রের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। আর্নো নদীর তীরে অবস্থিত ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে জনবহুল,যার সংখ্যা প্রায় ৩,৭০,০০০জন।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ ও শহরের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনেস্কো ১৯৮২ সালে এ শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। সুপ্রাচীন ভবনগুলোয় চিত্রিত শিল্পশৈলীর মাধ্যমে ফ্লোরেন্সের জনগণের ধর্মীয়, শিল্পকলা, শক্তিমত্তা, এমন-কি অর্থ-প্রাচুর্য্যের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এ শহরের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, দাঁন্তে, ম্যাকিয়াভেলী, গ্যালিলিওসহ সুপরিচিত মেডিসি পরিবারের শাসকদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ফ্লোরেন্সের রাস্তাতে বাসে ঘোরার অনুমতি না থাকাতে হেঁটে হেঁটেই ঘোরা হলো প্যালেস, সিনোরিয়া স্কোয়ার, পিয়াজা ডেল দুওমো, পন্টে ভেকিও ইত্যাদি স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন । মাইকেলেঞ্জেলোর তৈরি বিখ্যাত স্থাপত্য ডেভিড, মেদুসা, হারকিউলিস ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হলো ।
মাঝখানে এক চত্বরে সারা পৃথিবীর লোকের যেন এক মিলন মেলা মনে হচ্ছিল। সবাই আনন্দে মগ্ন, বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, খাওয়া দাওয়া চলছে। এরপর রওয়ানা হলাম আমাদের রাত্রিকালীন থাকার জায়গা হোটেলের দিকে যেটি রোমের খুব কাছে। চারদিকে পাহাড় ঘেরা ভ্যালির মধ্যে সুন্দর একটি হোটেল। যথারীতি ইন্ডিয়ান ডিনার সেরে ঘরে যাওয়া বিশ্রামের জন্য। কাল আছে রোম আর ভ্যাটিকান সিটি।
তবে এবার মনটাও খারাপ লাগছে এই ঐতিহাসিক আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বেড়ানোর যেটি বহুদিন ধরে দেখার ইচ্ছা ছিলো সেটি শেষ হয়ে এলো বলে। আবার তো সেই ফিরে গিয়ে অফিসের কাজের চাপ আর সাইটে সাইটে কাজ ঠিকমতো না হওয়ার চিন্তা। তবে ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার হেড কে যিনি একমাত্র আমার এখানকার ফোন নম্বর জানতেন উনি এই দীর্ঘ সময়ে একবারও ফোন করেন নি।
*********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।