ভাষা আন্দোলনে চেমন আরা
শিরীন হোসেন
বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য পটভূমি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে “ভাষা আন্দোলন”। বাঙালি বরাবরই এক সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি, যার স্বাক্ষ্য ইতিহাসের পাতায় পাতায় অমলিন ও আলোকিত। মাতৃভাষা মানে শুধু নিজের ভাষাই নয়, এতে প্রকাশিত হয় নিজ স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য। জাতীয়তা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ইতিহাস, রাজনীতি অনেকটাই প্রভাবিত ও মিশ্রিত থাকে নিজ ভাষার সাথে; কারণ জাতির আন্দোলনে ও পরিচয়ে ভাষার প্রতি সম্পৃক্ততা নিবিড়।
আমাদের অহংকারের ও গর্বের মাস ফেব্রুয়ারি, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একটি জাতির পটভূমির পেছনে তার অবদান কতোটা বিশাল ও অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বসাধারণের সম্পৃক্ততা ছিলো নিঃস্বার্থ ও নিরপেক্ষ। সকল বাঙালি শ্রেণীর একত্রিত হওয়ার সূচনা এই সময়ে শুরু হয়েছিলো, যার পরিণতিতে সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় ছিলো মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় অর্জন।
এ লেখার শিরোনামে উল্লেখিত মহীয়সী ও বিদূষী নারী চেমন আরা একজন ইতিহাসখ্যাত ভাষাকন্যা। যিনি তাঁর জীবনের সিংহভাগই যুক্ত ছিলেন ভাষা ও শিক্ষার প্রসারে। একুশ শতকের এ প্রজন্ম তো বটেই,গত শতাব্দীরও অনেক প্রজন্ম হয়তো জানেনা এই নারীর কর্ম ও জীবন সম্পর্কে। এ লেখার মাঝে তাঁর সাফল্যমন্ডিত জীবনের অনেকটাই আলোকপাত করার সদিচ্ছা পোষণ করছি।
ভাষাসৈনিক,শিক্ষাবিদ ও লেখিকা চেমন আরা ১৯৩৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও উপজেলার মৌলবী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এ.এস. এম. মোফাখখার তৎকালীন সময়ে কলকাতা হাইকোর্টের অগ্রগণ্য মুসলমান আইনজীবীদের একজন ছিলেন। তিনি ওকালতি পেশার পাশাপাশি মুসলিম লীগের প্রথম সারির একজন নেতাও ছিলেন। মা দোরদানা খাতুন একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন। চেমন আরা কিশোরী বয়স থেকেই দেশ ও রাজনীতি সচেতন কর্মী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত পাকিস্তান “তমদ্দুন মজলিস” নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনে ১৯৪৮ সালে ৮ম শ্রেণিতে থাকাবস্থায় যোগ দেন। ১৯৫১-তে কামরুন্নেছা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫২ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে থাকাকালীন ইডেন কলেজের সাধারণ ছাত্রীদের সাথে সম্মিলিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে সম্মুখসারির শহীদদের রক্তাক্ত জামা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের আমতলায় তাৎক্ষণিক চেমন আরা প্রতিবাদ আজো স্মরণীয়। এই প্রতিবাদের কারণে তাঁকে “ভাষাকন্যা বা ভাষা সৈনিক” উপাধি দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হয়ে আসেন। ১৯৫৪ সালে ডানপন্থী ছাত্রীদের সমন্বয়ে ফরমান উল্লাহ খানের তত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্রী পরিষদ’ গঠন করেন। পরবর্তীতে বাংলা বিভাগ হতে ১৯৫৬ সালে বি.এ ও ১৯৫৭ সালে এম.এ পাশ করেন।
কবি ও লেখিকা হিসেবেও চেমন আরা সাহিত্যমহলে সুপরিচিত। ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন সময় থেকে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একাধিক সাপ্তাহিক ও দৈনিকে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম লেখা “সাপ্তাহিক সৈনিক” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর পিতার জীবনীগ্রন্থও তিনি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত কিশোর উপন্যাস ইসলামিক ফাউন্ডেশনের “অগ্রপথিক” পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় এদেশের বরেণ্য সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হোন। কিছু ভ্ৰমণ কাহিনীও দৈনিক ইনকিলাবের সাহিত্য সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
চেমন আরা রচিত গ্রন্থাবলীগুলো হলোঃ
গল্পগ্রন্থ :
হৃদয় নামের সরোবরে
সত্তরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
কিশোর উপন্যাস :
তানিয়ার যতো কথা
ভ্রমণ কাহিনী :
নিরুদ্দেশের অভিযাত্রী
সম্পাদনা :
চন্দগাঁও মৌলবী বাড়ির ইতিকথা
এম এম মোফাখখার
শিশুতোষ রচনা :
সিলমির প্রথম স্কুল
বাবুর ফুলের বাগান
ইমনের ফুলের বাগান
চেমন আরার লেখনীর বিশেষ কিছু আছে। তাঁর গদ্যসাহিত্য আমাদেরকে অনেক দেশ বিদেশের বিচিত্র জীবনধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তিনি স্বরচিত সাহিত্যের বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধে, ভ্রমণকাহিনীতে, কবিতায় তাঁর জীবনবোধ ও কাব্যিক সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত করেছেন। গদ্যের আড়ালে নিজ কবিমন স্বত্ত্বাকেও তৈরি করে তুলেছিলেন। তাঁর “নির্বাচিত কবিতা” কাব্যগ্রন্থ পাঠক মনকে অকৃত্রিম ভাষায় কাব্যিক সৌন্দর্যে সজাগ করে তুলেছে। বিভিন্ন ধরনের কবিতায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ সমৃদ্ধ।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হলো-“অগ্রজ স্মরণে”,”আমার বাবা”,”দুঃখ আমার”,”মাকে যেমন দেখেছি”,”অতীত কথা কয়”। ধর্মীয় বিশ্বাস,ইসলামিক জীবনবোধের মেলবন্ধন তাঁর দ্বিধাহীন চিত্তের প্রকাশ। এগুলোর প্রমাণ মেলে “আল্লাহ স্মরণে”,”প্রিয় নবীজি আমার” কবিতার চরণে।
১৯৬৩ সালে শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে ‘সবুজ সেনা’ গঠন করেন এবং ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম মহিলা কলেজে ‘ইসলামী পাঠচক্র‘ নামে মহিলাদের জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার পর মুসলিম নারীদের নিয়ে ‘নারী অধিকার আন্দোলন” নামে একটি সংগঠন গঠিত হলে তিনি সেখানে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। সূচনালগ্ন থেকে তিনি এ সংগঠনের চেয়ারপার্সন। ১৯৮০ সনে তিনি ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিনিধি হয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপের সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ সফর করেন। ১৯৮৭ সালে তার স্বামী ভাষাসৈনিক কথাশিল্পী শাহেদ আলী, ড. কাজী দীন মুহম্মদ. ড. এম শমশের আলী, জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় ‘তামরিন’ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে চেমন আরা এই স্কুলের পরিচালনার ভার নেন। ভাষাকন্যা চেমন আরার ৩৬ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে অজস্র ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার করে গেছেন নিরন্তর। তাঁর সুনাম ও সাফল্য জড়িয়ে আছে কর্মজীবনে নিযুক্ত নানা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে তিনি তাঁর শিক্ষাদান করেছেন মেধা প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার দ্বারা।
এক নজরে আমরা দেখে নিতে পারি তাঁর কর্মস্থল ও কার্যমেয়াদ, যার ফলে সহজেই অনুধাবনযোগ্য তিনি কতোটা সফল ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাঁর শিক্ষক জীবনের সার্বিক চিত্র নিম্নরূপ-
১৯৫৯-প্রধান শিক্ষিকা,নবীগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল,নারায়ণগঞ্জ।
১৯৫৯-চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু।
১৯৫৯-৬১-প্রাতঃকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষিকা, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি স্কুল, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।
১৯৬২-অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইডেন কলেজ, ঢাকা।
১৯৬৭-৬৮- অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।
১৯৭০- ইডেন কলেজ, ঢাকায় পুনরায় অধ্যাপনার পাশাপাশি নতুন ছাত্রী হোস্টেলের তত্ত্বাবধান (১৯৭২-৮০) করা।
১৯৮২-৮৬-অধ্যক্ষ,চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ,চট্টগ্রাম।
১৯৯৩-সর্বশেষ তিতুমীর কলেজ,ঢাকায় শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর গ্রহণ।
চেমন আরাকে তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে, ভাষা আন্দোলনে অবদান স্বরূপ বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়। “আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৮” উপলক্ষে “দৈনিক ভোরের কাগজ” এ সম্মাননা দেয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে তৎকালীন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এমপি এ সম্মাননা তুলে দেন, এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন “দৈনিল ভোরের কাগজ” সম্পাদক শ্যামল দত্ত। উল্লেখ্য যে, সম্মাননা প্রদানের তারিখটি ছিলো ৯ মার্চ ২০১৮। এছাড়াও ৯ জানুয়ারি ২০১৫ সালে “মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট” ১৯তম বর্ষপূর্তিতে “প্রবীণ পেশাজীবী নারী সম্মাননা” প্রদান করে। কীর্তিময়ী এ নারী আরো ভূষিত হোন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য “তমদ্দুন মজলিস ভাষা সৈনিক পদক” (২০০৪),জালালাবাদ ফাউন্ডেশন কর্তৃক নারী নেতৃত্বের জন্য “হাসন রাজা স্মৃতি পদক” (২০০৬)।
*****************************************
শিরীন হোসেন পরিচিতি
সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশের ইত্তেফাক আজকে খবরের কাগজে। এখন ব্যাবসা করেন,পাশাপাশি লেখা লিখি নিয়েও আছেন।