দিন বদলের গল্প
ব্রতী ঘোষ
অপর্ণা সাতে পাঁচে থাকতে ভালোবাসেন না৷ সংসারটা গুছিয়ে করেছেন বরাবর। তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সৌম্যদেব সেন গুপ্তকে সুখী করতে কোন ফাঁক রাখেন নি৷ছেলেকে মানুষ করতে নিজের চাকরি ছেড়েছেন৷যতোদিন শ্বশুর শাশুড়ি ছিলেন তাদের যত্ন করেছেন৷এখনও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্বামীর খেয়াল রাখেন৷ঠিক সময়ে প্রেশার,সুগারের ওষুধ তার হাতে তুলে দিতে ভোলেন না৷অপর্ণার এতো সব গুণের মধ্যে ও একটি ভারি দোষ।তিনি মুখে কথা বলেন খুব কম৷যা করার কাজের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করেন৷সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজের মধ্যে দুপুর বেলাটা ওর নিজের জন্য বরাদ্দ।এই সময়টুকু উনি যত্ন করে তুলে রাখেন একান্ত নিজের করে৷এই সময় মনের জানালাটি উনি হাট করে খুলে দেন৷দক্ষিণের বারান্দায় বসে মনের সব গ্লানি ডায়েরীর পাতায় লিখে রাখেন কখনো কবিতায়,কখনো তা গদ্যে৷ সৌম্যদেব একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ছিলেন। বত্রিশ বছর চাকরি করে সবে দুবছর হলো অবসর নিয়েছেন ৷ অপর্ণাও একটি বেসরকারী সংস্থায় উচ্চ পদেই চাকরি করতেন। ঋত্বিক হবার সময়ই স্ত্রীকে চাকরি ছাড়তে একপ্রকার বাধ্য করেছিলেন তিনি। অবশ্য সৌম্যদেব অপর্ণার কোন অভাব রাখেন নি৷যে কোন উৎসবে স্ত্রী কে শাড়ি কিনে দিয়েছেন। বিবাহ বার্ষিকীতে গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিবছর। প্রত্যেক বছর স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনদিন জানতে চান নি~শাড়িটা স্ত্রীর পছন্দ হয়েছে কিনা? জানতে চাননি যেখানে বেড়াতে যাচ্ছেন সেখানে অপর্ণা ও যেতে চান কিনা?আজ দিন তিনেক হলো সোমদত্তার বিয়ে হয়েছে ঋত্বিকের সাথে ৷ ঋত্বিক খুবই ভালো ছেলে ৷ দুজনেই আই টি সেকটরে কাজ করে~একই কোম্পানীর সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ৷ সোমদত্তা কোনদিন ভাবেনি-এতো মনের মতো বন্ধুকে ও স্বামী হিসাবে পাবে ৷ এখানে ওর যত্নের কোন ত্রুটি হয় না ৷ ও দেরি করে ঘুম থেকে উঠলেও শাশুড়িমা কিচ্ছুটি বলেন না ৷ বিয়ের প্রথম কটা দিন ও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে শ্বশুরবাড়িতে একটু মানিয়ে নেবার জন্য ৷ কিন্তু শ্বশুরমশাই ব্যস্ত থাকেন নিজের লাইব্রেরী ঘরে ৷ আর শাশুড়িমা পারতপক্ষে ওর সঙ্গে কথা বলেন না ৷ অথচ খেয়াল রাখেন সবকিছু ৷ একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব আছে ওনার মধ্যে ৷ নিজের জগতেই থাকতে ভালোবাসেন ৷ এই নিয়ে সোমদত্তার ভারী দুঃখ৷ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে ও ভেবেছিল,যে ওর শাশুড়ি হবে তাকে ও মায়ের মতো ভালোবাসবে ৷ কিন্তু ভালোবাসা দূরে থাক ও ওনার কাছে যেতেই সাহস পায় না৷
মাস ছয়েক পরের কথা-আজ হঠাৎই অপর্ণার খেয়াল পড়ে সোমদত্তার দিকে ৷ মুখ তুলে তাকান ছেলের বৌয়ের দিকে ৷ মেয়েটার মুখটা বড্ড মায়া মাখানো ৷ ছেলের পছন্দের প্রশংসা নিজের মনেই করলেন ৷ কিন্তু একি? ওর মুখটা আজ এতো শুকনো লাগছে কেন? যে মেয়েটা ডাইনিং টেবিলে বসে এতো কথা বলে ঋত্বিকের সাথে সে আজ একটাও কথা কেন বলছে না? তবে কি মাসখানেক ধরে অপর্ণা যা সন্দেহ করছিলেন সেটাই কি সত্যি হলো? তবে কি পরিবারের উত্তরাধিকারী আসতে চলেছে?
নাহ !! ও নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না ৷ যদি কিছু বলার থাকে ওরাই বলবে ৷ দুজনেই চুপচাপ রাতের খাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে যায় ৷ রাতে অপর্ণা ওদের ঘর থেকে কিছু কথা কাটাকাটির শব্দ শোনেন ৷ কিন্তু অন্য অনেক শাশুড়ির মতো ছেলের ঘরের দরজায় কান পেতে কথা শোনার মনোবৃত্তি ওর নেই ৷ তবে এটা অপর্ণা বুঝতে পারেন কিছু একটা চাপান উৎরাই চলছে ওদের মধ্যে সপ্তাহ খানেক ধরে ৷ পরদিন সকাল নটার মধ্যেই দুজনেই একসাথে অফিসে বেরিয়ে যায় ৷ সন্ধেবেলা দুজনেই ফেরে আলাদা আলাদা সময়ে ৷ অপর্ণার কিছুই চোখ এড়ায় না ৷ কিন্তু নিজে থেকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে ওর ইচ্ছা করে না ৷ যে যার মতো থাকবে,প্রত্যেকের নিজস্ব স্বাধীনতা আছে-তাতে হস্তক্ষেপ করতে ওর ভালো লাগে না ৷ রাতে ডাইনিং টেবিলে ঋত্বিক খেতে এলেও সোমদত্তা আসে না ৷ খানিকটা বাধ্য হয়েই অপর্ণা ঋত্বিককে জিজ্ঞাসা করেন,”সোমা এলো না খেতে?”
“নাহ! ছাড়ো তো খেলে খাবে না খেলে না খাবে ৷ ওর জেদটাই সব নাকি? আমার কথার কোন দাম থাকবে না? “অপর্ণা কোন কথা না বলে ঋত্বিকের মুখের দিকে তাকান ৷” ওর প্রেগনেন্সির রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে৷ আমি ওকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে থেকে বিশ্রাম নিতে বলেছি ৷ কি দরকার ওর চাকরি করার? আমাদের কোন অভাব আছে? বাচ্চা হলে মানুষ করবে কে? ওর চাকরিটাই বড়ো হলো? প্রত্যেকদিন এই নিয়ে অশান্তি হচ্ছে৷ও চাকরি ছাড়বে না ৷ আমাকে বলে কিনা~তুমি চাকরি ছেড়ে দাও ৷ কি আব্দার!! মেয়ে হয়ে জন্মেছে অথচ মা হবে না? গতকাল রাতে কি বলছে জানো? বলছে-ও চাকরি তো ছাড়বেই না~উপরন্তু এই সন্তানকেই ও পৃথিবীতে আনবে না ৷ বলছে~দায়িত্ব যদি নিতেই হয় দুজনকেই তা সমান ভাবে নিতে হবে-নাহলে ও মা-ই হবে না ৷”
এতোক্ষণে সৌম্যদেব মুখ খোলেন,”ওর স্পর্ধা তো কম নয় ৷”
ঋত্বিককে কোন কথা অপর্ণা বলেন না।শুধু মনে মনে ভাবেন সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ৷ একই রকম মানসিক চাপ ৷ কি কষ্টটাই না সইতে হয়েছিল অপর্ণাকে ৷ তিনিও পড়াশোনায় ভালো ছিলেন,নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন ছোট থেকে ৷ আর মোটামুটি একটা ভালো চাকরি তিনি নিজের যোগ্যতাতেই যোগাড় করেছিলেন কিন্তু ঋত্বিক হবার সময় শাশুড়ি,সৌম্যদেব এদের মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি চাকরিটা ছেড়েছিলেন ৷ একটা মেয়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তার চিন্তা ও চেতনার মুক্তির পথ খুলে দেয় ৷ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে মানুষ হিসাবে ৷ যে পথে সে অপর একটি মেয়েকেও তার দেখানো পথে চালিত করতে পারে,উদ্বুদ্ধ করতে পারে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ৷ মেয়েরা শুধুমাত্র স্বামী ও সংসারকে সুখী করতেই জন্মায় না-তারও এই সমাজকে কিছু দেবার থাকে ৷ এ কথা কি কেউ কোনদিনও বুঝবে না? এক এক সময় অপর্ণার মনে হয় মেয়েরা আজ থেকে একশো বছর আগে যেখানে ছিল এখনো সেখানেই আছে। সামাজিক কোন উন্নতিই হয়নি।
“ওর খাবার টা ঘরে নিয়ে যা ৷” ঋত্বিক নিজের খাওয়া সেরে সোমদত্তার খাবার নিয়ে ঘরে চলে যায়। সারারাত অপর্ণা দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না ৷ আজ থেকে আঠাশ বছর আগের ঘটনাগুলো একের পর এক ওনার মনে আসতে থাকে ৷ নিজের বিছানাতেই ছটফট করতে থাকেন তিনি ৷ সকাল হতেই অপর্ণা ঋত্বিকের ঘরের দরজায় টোকা মারেন ৷ একটু বাদে টলোমলো পায়ে ঋত্বিক দরজা খোলে।দরজা খুলে মাকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যায় ও ৷ ওর বিয়ের পর থেকে মা কোনদিন ওর ঘরে ডাকতে আসেনি। “সোমা রাতে খেয়েছিল?”
“না-আর বোল না ৷ জেদ করে খেলোও না রাতে ৷ ওই তো খাবার পড়ে আছে টেবিলে ৷” এতোক্ষণে অপর্ণার গলা শুনে সোমদত্তাও রীতিমত অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসেছে ৷ আজ পর্যন্ত যে মানুষটা ওর সাথে কোনদিন নিজে থেকে কথা বলেননি তিনি এসেছেন কিনা ওর খোঁজ নিতে ৷
“সোমা~জলখাবার খাবে ৷ টেবিলে এসো”। সোমদত্তা নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না ৷ একটু পরেই ডাইনিং টেবিলে ওরা চারজন জলখাবার খেতে বসে৷ অপর্ণা নিজের হাতে আজ চিঁড়ের পোলাও রেঁধেছেন ৷ সোমদত্তার সামনে খাবার পরিবেশন করে পরম মমতায় নিজের ডান হাতটা সোমদত্তার মাথার উপর রাখেন ৷ বলেন “খেয়ে নাও ৷ রাতে খাও নি ৷ শরীর খারাপ হবে ৷” সোমদত্তার চোখে জল এসে যায় ৷ ও অপর্ণার হাতটা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে ৷ অপর্ণা ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরেন ৷ “পাগলি মেয়ে !! তোর ইচ্ছা হলে মা হবি~না হলে হবি না ৷ কিন্তু চাকরি ছাড়ার কথা মনেও আনবি না ৷” অপর্ণা কথা গুলো বলেন সৌম্যদেবের চোখে চোখ রেখে ৷ তিনি নিজে একবার সবকিছু মেনে নিয়ে হেরে গেছেন কিন্তু আর না~সোমদত্তাকেও একই ভাবে হেরে যেতে উনি দেবেন না ৷
********************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷ এই পত্রিকাতেই তার লেখার পথ চলার শুরু।
ব্রতী,ভালো লাগলো যথারীতি।সময় পেলেই লেখ।
একেবারে যুগোপযোগী ছবি এঁকেছ গল্প বলার চলে। এমনি করেই এদিনের সমস্যা তুলে ধর,বলে তাও❤️
Khub sundor lekha Brati…amader purush shashito samaj er ekta chotto..
Ei bhabe aro anek lekha asha korbo