শেষ চিঠি
দেবলীনা দে
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কোনো স্বপ্ন দেখা এভারেস্ট জয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে সেখানে ঘাত প্রতিঘাত ত্যাগ অনেক কিছুই সইতে হয়। রোহিণীকেও করতে হয়েছে,সইতে হয়ছে অনেক ঝড়। বাংলা ভাষার প্রতি টান ভালবাসা তার অনেক দিনের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার গুলে খাওয়া। বাবার গ্রামে ছোটো কেরানীর দোকান। মায়ের অধীনে বাড়ির বাকি দায়িত্ব। রোহিণীর এক বোন আছে, ঋতিকা। চারজনের এই ছোট্ট সংসারে অভাব অনটন চিরদিনের। তাও সব বাধা অতিক্রম করে জীবন নিজ নিয়ম মেনে চলতে থাকে।বাবার স্বল্প আয়ের কথা দুই বোনেই খুব ছোটো থেকে অবগত। তাই সেভাবে দুজনের কোনো আবদার বা বায়না ছোটো থেকেই নেই।কিন্তু চোখে স্বপ্ন আছে অনেক। দুই কন্যা নিয়ে রথীনবাবু ও রমাদেবীর ছোটো সংসার ভালই চলছিল।
মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র। সুখ দুঃখের খেলা লেগেই থাকে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো সুখ আর দুঃখ সহজে চেনা যায় না। কেরানীর দোকানে রোজ নানা লোকের নিত্য যাতায়াত লেগেই থাকে। নিত্য গ্রাহকের তালিকায় প্রথমেই তারিণী বাবুর নাম। গ্রামের অত্যন্ত সজ্জন ব্যাক্তি। এককালে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। গ্রামের সবাই মাস্টারমশাই নামেই এক ডাকে তাকে চেনে। রোহিণী তাকে খুব শ্রদ্ধা করে। বাংলায় তার যা জ্ঞান এই গ্রামে আর কারো নেই। তিনিও রোহিণী ও ঋতিকাকে কন্যার থেকে কম কিছু মনে করেন না।
একদুপুরে হঠাৎ রথীনবাবুর দোকানে হাজির তিনি।
“কী রে রথীন, আমার মায়েদের কী খবর। অনেক দিন হলো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। বাড়িও আসে না আর।”,বলতে বলতে তারিণীবাবু দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে এসে বসলেন। রথীনবাবুর মনের শ্রদ্ধা তার কথায় ও ব্যবহারে প্রকাশ পেলো যখন তিনি নিজের হাতের কাজ ফেলে মাস্টারমশাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন,“আরে মাস্টারমশাই যে। তা আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো। কী লাগবে আমাকে বলতে পারতেন আমিই বাড়ি যাবার পথে আপনাকে দিয়ে আসতাম।”
“আরে না না। অনেক দিন বাড়িতে বসে বসে ভালো লাগছিল না তাই ভাবলাম যাই একটু ঘুরে আসি। ঘোরাও হবে,কেনাও হবে,আর খানিক গল্প গুজবও হবে। কী বলিস?”
“সে আর বলতে”,বিনয়ী হয়ে উত্তর দিলেন রথীন বাবু।
“তা বল,কোথায় মেয়েরা? কেমন আছে সব?”
“ভালই আছে মাস্টারমশাই। আসলে রোহিণীর বিশ্ববিদ্যালয় এর পরীক্ষা চলছে,তাই আপনার ওখানে কদিন যেতে পারেনি। আর তার বোনকে তো চেনেন। দিদিকে ছাড়া কারো বাড়ি যায়না।”
“হ্যাঁ,সেতো সেই ছোট্ট থেকে দেখছি। দিদি বলতে প্রাণ। তা দিদির বিয়ে হলে কি করবে সে। বুঝলি রথীন এক বাড়িতেই দুই মেয়ের হিল্লে করে দিস।”
“তা মন্দ বলেননি। রোহিণীর পরীক্ষা শেষ হলে ভাবছি বিয়ের কথা টা একবার বলবো।”
রথীনবাবুর মুখে বড় মেয়ের বিয়ের কথা শুনে একটু অবাক হলেন তিনি,“সেকি? এখনই? ও না বলছিল পি.এইচ.ডি করবে,চাকরি করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তোদের নিয়ে ওর কত স্বপ্ন। বুঝলি,তোর কষ্টের কথা সে খুব ভালো জানে। আমাকে বলে তোদের জন্য অনেক কিছু করতে চায়।“
“পি……কি যেন বললেন? সেটা আবার কি। কই আমি তো শুনিনি।”
“সে আছে, তুই বুঝবি না।“
“সে নাই বুঝি। ও যা বলে,আমাদেরকে বড্ড ভালোবাসে তাই বলে। কিন্তু আমাদের এই সমাজে ইতিমধ্যেই অনেক কানাঘুষো শুনছি। এতো বড়ো মেয়ে,আর কবে বিয়ে হবে। ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না আর দেরী হলে।”
“উফফ,তোদের সেই এক চিন্তা। তোর কাছে তোর মেয়ে আগে না সমাজ? আর মেয়েকে একটা সুযোগ দে। অত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখালি,একটা চাকরি পেলে তোরও কত ভালো লাগবে বলতো।”
মাস্টারমশাইকে খুব শ্রদ্ধা করেন রথীন বাবু, কিন্তু নিজের মেয়ের বিয়ের চিন্তা আজ হয়তো শ্রদ্ধার থেকে বড়ো হয়ে গেছে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে হাত জোড় করে তিনি বলেন,“তা,আপনি যাই বলুন মাস্টারমশাই। মেয়েদের বিয়েতেই সব। বিয়ে না হলে কিছুই হয়না।”
রথীন বাবুর কথায় আজ মাস্টারমশাই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা এক চরম সত্যির আভাস নতুন করে পেলেন। সব পরিচয় ছেড়ে একসময় সবাই মেয়ের বাবা হয়ে উঠেন। সেই মেয়ে যার স্বাধীনতা,ইচ্ছা,আকাঙ্ক্ষার থেকে অনেক বড়ো বিয়ে। সেই পরিণতিই মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরিণতি। যার ওপরে আজও সমাজ উঠতে পারেনি।
রোহিণীর কথা ভেবে মাষ্টারমশাইয়ের বুকের ভিতরটা কেমন নিভে এলো। কিছুটা ব্যথার সুরে বললেন,“তবে মেয়ের ইচ্ছার মান একটু রাখিস বুঝলি। আমাকে এক কেজি আটা দে আমি উঠি এখন।”
“আরে, আপনি তো চেনেন ওকে আমাদের অবাধ্য ও একেবারেই নয়।”,মাস্টারমশাইয়ের কথায় গভীরতা উপলব্ধি না করেই রথীনবাবু বললেন।
“হুম। তবে রথীন কথাটা যে বাধ্য অবাধ্যের নয়।” মাস্টারমশাই আপন মনে বললেন।
কিছু মাস বাদে রোহিণীর জন্য এক সম্বন্ধ এলো। দায়িত্ব পড়ল তারিণীবাবুর কাঁধে,প্রথমে তিনিই যেন রোহিণীকে সেই কথা বলে।
“কি? বিয়ে! এখন?”,রোহিণী তার প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের কাছে কথাটা শুনে অবাক হলো।
পাশ থেকে রমাদেবী বলে উঠলেন,“এখন নয়ত কখন শুনি। দেখ মা সব জিনিসের একটা সময় থাকে। আর তোর পড়াশোনা তো শেষ। আবার কি?”
“তোমাদের সাথে এই তর্কে আমি আর জিততে পারবো না।”
সারা পৃথিবীর সাথে লড়ার ক্ষমতা থাকলেও রোহিনী বাবা মার কাছে চিরকাল মাথা নামিয়ে এসেছে। তার সবসময় মনে হয় বাইরের লোকের সাথে লড়াই অনেক সহজ কিন্তু নিজের বাবা মার কাছে জিতও হারের সমান।
“আমাদের কথা রাখ মা।”,মিনতি করলেন রথীন বাবু।
“কিন্তু বাবা, আমার এখনও অনেক কিছু করা বাকি। তুমি কি চাও,অত কষ্ট করে যে আমাকে পড়ালে সেই সব জলে যাক?”
“আহা,জলে যাবে কেন? তুইতো বিয়ের পরও সব করতে পারবি।”,পাশ থেকে আশ্বস্ত করলেন রমাদেবী।
“কেন তোমরা বিয়েটাকেই অত বড় করে দেখছো? যদি আমি আগে নিজের পরিচয় গড়তে চাই তাতে ক্ষতি কি বাবা?”
“বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ই নিজের পরিচয় হয় মা।” রমাদেবীর এই যুক্তির সামনে রোহিণী কিছুটা নিরুপায় হয়ে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকালো।
“দেখ রথীন…”
“মাস্টারমশাই অপরাধ নেবেন না। আজ আপনাকে আমার সঙ্গ দিতেই হবে। ও তো ছেলেমানুষ। আপনি তো জানেন সব। অনেক কষ্ট এমন এক বাড়ি পেয়েছি। ও ভালো থাকবে ওখানে।”,রথীনবাবুর অনুরোধে আজ মাস্টারমশাই নিজেকে নিরুপায় মনে করলেন। আজ তিনি একপ্রকার হেরে গেলেন। নিজে এতবড়ো ব্যক্তিত্ব হয়েও আজ জেদ,চিন্তা ও ভুল মানসিকতার কাছে হেরে গেলেন। রোহিণী মা বাবার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলো। তারিণীবাবু নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে।
মা বাবার চিন্তা ও চোখের জলের কাছে হার মানলো রোহিণীর স্বপ্ন ও ইচ্ছা। শহর থেকে রোহিণীর জন্য আসা সম্বন্ধ পাকা হয়। ছেলে সুপ্রতিষ্ঠত,বড়ো MNC তে চাকরী করে। ধনী পরিবারের একমাত্র ছেলে। শাশুড়ির ইচ্ছা ঘরোয়া বউমা।
“তোমরা এই প্রস্তাবে রাজি হলে কেন? আমি তো বলেছিলাম কথা বলে নেবে। আমার চাকরী করা নিয়ে কোনো আপত্তি যেন না থাকে।”
“তোর আর চাকরীর কি দরকার,দেখলি না পরিবার কত ধনী,ভালো। আর ছেলেও তো ভালো চাকরী করে,মোটা টাকা মাইনে।”
“মা,শুধু টাকার জন্য কি আর চাকরী করতে চাইছি। অন্তত তুমি বাবাকে বোঝাও।”
“কী বোঝাই বলতো? দেখছিস তো কত কষ্টে এই বিয়েটা ঠিক হয়েছে। খুব বিশেষ দাবী দাওয়া নেই ওদের।”
“বিশেষ কিছু নেই? আমার থেকে আমার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া,আমার স্বাধীনতা বন্ধক রাখা শুধু মাত্র বাড়ির বউ বলে পরিচয়–এই গুলো তোমার বিশেষ কিছু মনে হয় না?”
মা ও মেয়ের কথার মাঝে হঠাৎই রোহিণীর এক কাকিমা বলে উঠলেন,“বলেছিলাম মেয়েকে এতো লেখাপড়া শিখিও না। দেখো এখন তার ফল। বলি এতো যে লেখাপড়া শিখলি তা মা বাবার কথা রাখতে শিখলি না। আমরা লেখাপড়া জানিনা কিন্তু আজ পর্যন্ত মা বাবার ওপর একটা কথা বলিনি।”
কথাগুলো রোহিনীর বুকে তীরের মতো বিঁধল। রোহিনীর আজ নিজেকে বোঝা বলে মনে হলো। যথা সময়ে মা বাবার বোঝা কাঁধ থেকে নামাতে পারলেই হলো।
বিয়ের পর দেড় মাস কেটে গেছে। এই দেড় মাসে অনেক চেষ্টা করেছে রোহিণী তার স্বামীকে বোঝানোর কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ‘চাকরি তুমি করতে পারবে না’,এই একটাই জবাব পেয়ে এসেছে বারেবারে। অন্য দিকে গরীব ঘর থেকে এসেছে,যৌতুক হিসেবে বাবার বাড়ি থেকে সামান্য কিছু আনার খোঁটা তাকে দিনরাত্রি শুনতে হয়,কখনো শাশুড়ি মা বা কখনও আবার আত্মীয় স্বজনদের কাছে। মাঝে মধ্যেই সে রবীন্দ্রনাথের নিরূপমার সাথে কিছুটা নিজের মিল খুঁজে পায়। কিন্তু তার গল্পের শেষ টা ছিল অন্য রকম।
“কী? বিবাহ বিচ্ছেদ? কী বলছিস এইসব?” রথীন বাবু আর রমাদেবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
“দিনের পর দিন কটু কথা শুনে,নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে আমি ও বাড়িতে থাকতে পারবো না মা।”
“রমা মেয়েকে বোঝাও। এই বিয়ে দিতে গিয়ে আমরা প্রায় সর্বশান্ত হয়েছি। এখন ও যদি এই রকম কথা বলে ……”
রমাদেবী মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন,“দেখ মা,সব মেয়েকেই একটু সহ্য করতে হয়। সবে তো ৩মাস। আর তাছাড়া সমাজে কি বলবে। আমাদের গ্রামে থাকা দুষ্কর হয়ে যাবে। ছোটো বোনের কথাটা একবার ভাব। ওর বিয়ে কি ভাবে দেবো।”
সব কিছু শুনে ঋতিকা হঠাৎ বলে উঠলো,“দিদি,আমার কথা ভাবিস না। তুই তোর কথা ভাব।”
বোনের এই কথায় মনে সাহস পেলো রোহিণী।
“তোমাদের সমাজের চিন্তা আছে কিন্তু আমার চিন্তা নেই?”
“তোর চিন্তা আছে বলেই তো বলছি,একটু সহ্য করে নে। বিয়ের পর নতুন বাড়ি গিয়ে একটু ওই রকম সব মেয়ের সাথেই হয়।”
বাবা মার কথা শুনে রোহিণী বুঝলো যুদ্ধ তার একার,কারণ স্বপ্ন দেখার সাহস করেছে সে।
“অনেক আশা নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছিলাম যে অন্তত ও বাড়ির লোকের আমাকে করা দিনের পর দিন অপমান হয়তো তোমরা বুঝবে। স্বপ্ন ভুলে গেলেও আত্মসম্মান হয়ত ভুলতে বলবে না। আমিই ভুল ছিলাম।”,এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোহিণী বেরিয়ে গেলো। তার কানে শুধু ভেসে এলো দূর থেকে তার মায়ের কথা,“যাস না,কথা শোন। একটু সহ্য করে নে মা।”
বছর পাঁচেক পরে গ্রামের পোস্টমাস্টার রথীনবাবুর হাতে দিয়ে যান একখানা চিঠি । বয়সের ভার ও লজ্জায় জর্জরিত তিনি। বড়ো মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে গ্রামের মানুষের চক্ষুশূল তার পরিবার। ঋতিকা বাবার হাত থেকে চিঠি নিয়ে খুশীতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো,“বাবা এটা তো দিদির চিঠি।”
“চিঠি? রোহিণীর?”,রমা দেবীর চোখের জল বাঁধ মানলো না। এতো দিন পর মেয়ের তাদের কথা মনে পড়েছে।
“পড় পড় মা। কি লিখেছে পড়।”,রথীনবাবু চোখের জল মুছে বলে উঠলেন।
বাবা মা,
আশা করি ভালই আছ তোমরা। বিবাহ বিচ্ছেদের পর অন্তত আমাকে চোখের সামনে দিন রাত দেখতে হয়নি। দেখলে হয়তো বারবার নিজেদের ওপর রাগ আরও বেশি হতো। অনেক লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে নিশ্চয়ই আমার জন্য। কিন্তু কি করবো। আমি নিরূপায় ছিলাম। আমি নিজেও বুঝিনি কবে আমার কাছে আত্মসম্মান ভালবাসার থেকেও বড়ো হলে উঠলো। ও বাড়িতে সহ্য করে থাকলে তোমাদের ভালবাসা হয়তো পেতাম কিন্তু নিজের চোখে চোখ মেলতে পারতাম না কোনো দিন। আজ তোমাদের ভালোবাসা নেই,দুঃখ হয় কিন্তু আজ আমি আত্মনির্ভর। একজন শিক্ষিকা। অনেক ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের নির্ভেজাল ভালোবাসায় আপ্লুত আমি। জানিনা এইটা শুনে তোমরা খুশি হবে কি না। এতদিন আমার দেওয়া টাকাও তোমরা নিয়েছ কিনা জানা নেই আমার। ভাবছো এতো দিন পর আজ আবার চিঠি কেনো। বড্ডো মনে পড়ছিল যে তোমাদের কথা। রোজই পড়ে। মায়ের হাতের বানানো শুক্তোটা খেতে খুব ইচ্ছা করে। মনে হয় ছুটে চলে যাই তোমাদের কাছে। কিন্তু সেই পথ আজ আমার জন্য বন্ধ। জানি তোমরা হয়তো মেনে নেবে এবার সব,নিজের মেয়ে কিনা। কিন্তু আমি যে মানতে পারবো না যে তোমরা তোমাদের রোহিণীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখো নি। তোমাদের প্রত্যেক পদক্ষেপে আমি প্রতিশ্রুতির আভাস পেতাম। কিন্তু আমাকে সহ্য করতে বলা যেন সেই সব প্রতিশ্রুতি মিথ্যে করে দিয়েছে। ছোটো থেকে আগলে রেখেছিলে তোমরা। জানিনা বড় হবার পর কেন মনে হলো এবার আমাকে অন্য কেউ আগলে রাখবে। ছোটবেলায় স্কুলে,পাড়ায়,কোনো বন্ধুদের সাথে কিছু মনোমালিন্য হলে চুপটি করে বসে আমার কথা শুনতে। বড় হবার পর কেন যে সেই ধৈর্য্য হারালে? ছোটো আঘাতেও যখন রাতের পর রাত জেগে আমাকে সারিয়ে তুলতে,বড়ো হবার পর মনের আঘাতের টেরও পেলে না! ছোটো থেকে বড়ো হতে হতে কত কিছু পাল্টে গেলো। চেনা তোমরা কেমন যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে গেলে। আগে কেমন আমার না বলা কথা বুঝে নিতে এখন আমার বলা কথাও কানে নিলে না,বুঝলে না আমাকে,আমার ইচ্ছাকে। সারা পৃথিবী হয়ত আজ আমাকেই গালি দিচ্ছে। কেমন মেয়ে আমি! এই প্রশ্ন আমিও নিজেকে করি। কিন্তু তারপর ভাবি সমাজ সারা জীবন কারো মেয়ে,কারো স্ত্রী,কারো বউমা করেই ভাবলো। মাঝে মাঝে নিজের পরিচয় দিতে পারিনা নিজেকেই। কিন্তু সেই পরিচয় খুঁজতে যে এত বড়ো ত্যাগ করতে হবে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। মা,তুমি বলতে না মেয়েদের সব কিছু সহ্য করতে হয়। আজ মনে হচ্ছে তুমি ঠিক। আমার পরিচয় গড়তে আমাকে ত্যাগ সহ্য করতে হলো। সে হয়তো কম বেশি সবাইকেই করতে হয় কিন্তু আমাকে মেনে নিতে হলো আপনজনের থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা।
মা বাবা আমি তোমাদের কাছে ফিরে যেতে পারবো না। ফিরে যাওয়া আমাকে আমার ত্যাগের কথা বারবার মনে করিয়ে দেবে,মনে করিয়ে দেবে যখন চেয়েছিলাম তোমরা ছিলে না পাশে। আর আমি মনে এই শিকল নিয়ে হয়তো বাঁচতে পারব না। চিন্তা করো না,আমি এখানে বেশ ভালই আছি। জানি প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে মেয়ের দায়িত্ব শেষ হয়না,কিন্তু ঋতিকা আছে তোমাদের কাছে। ও আমার থেকে অনেক গুণে ভালো। আমার থেকেও অনেক বেশি খেয়াল রাখবে তোমাদের। শুধু একটাই অনুরোধ ওকে এই রকম ত্যাগ করতে দিও না। নিজের পরম গুরুজনের সাথে লড়াই এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন লড়াই,যে লড়াইয়ে হার জিত থাকে না। থাকে শুধু ত্যাগ,সহ্য আর মেনে নেওয়া।”
লোকে বলে সময় জলের মতো বয়ে চলে। দেখতে দেখতে সাত সাতটা বছর অতিক্রান্ত। ঋতিকা আজ শুধু কারো মেয়ে কারো স্ত্রী বা বউমা না। একজন স্বনাম ধন্য ডাক্তার। রোহিণী শুধু নিজেই বড়ো হয়নি,বড়ো করেছে আদরের বোনকেও। আজ ঋতিকার জন্মদিন। আজকের দিনে সে নিজের দিদির অভাব বড্ডো অনুভব করছে। তার জন্মদিনে আসার অনুরোধটুকুও রোহিণী রাখেনি। ঋতিকার বাড়িতে আজ অনেক আয়োজন। কিন্তু এই সব তার কাছে ফিকে মনে হচ্ছে। মন শুধু অপেক্ষা করছে দিদির উপহারের জন্য।
ঋতিকার অপেক্ষা রথীনবাবু ও রমাদেবীর জীবনে নিয়ে এলো নতুন এক সূর্য। লাল কাগজে মোড়া উপহারটা ঋতিকা স্পর্শ করে দিদির ভালবাসা অনুভব করল। সেই উপহারের ওপরে লেখা ‘প্রিয় বোনের জন্য’। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ঋতিকা সবার উপস্থিতিতে উপহারটি খুললো। একটা বই,যার উপরে জ্বলজ্বল করছে বইয়ের ও লেখিকার নাম–‘প্রতিশ্রুতি’,লেখিকা রোহিণী মজুমদার। রথীন বাবু ও রমাদেবীর চোখে আজ আনন্দাশ্রু। ঋতিকা মা বাবার দিকে একপলক তাকিয়ে বইয়ের প্রথম পাতাটা তাদের সামনে তুলে ধরলো। ‘মাতা পিতার আশীর্বাদ’-মোটা অক্ষরে লেখা এই তিনটি শব্দ রথীন বাবু ও রমাদেবীর সামনে যেন এক আশার আলো। মেয়েকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি না রাখতে পারার আক্ষেপ,তার ইচ্ছার সম্মান না করতে পারার যন্ত্রণা যেন নিমেষে দূর হল। মেয়ে আজও তাদেরকে বড্ড শ্রদ্ধা করে।
তারা বুঝলেন মেয়ে আজ অভিমানে দূরে গেলেও ভালোবাসা দূর হয়ে যায় নি।
****************************************************************
দেবলীনা দে পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতা শহরে কিন্তু বড় হয়ে ওঠা হুগলী জেলার এক গ্রামে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে M.A. কল্পনার জগতে গল্পের মালা গাঁথা অবসর সময়ের শখ ও ভালবাসা দুইই। পড়াশোনার পাশাপাশি সুরের ভক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে চর্চা বেশ কয়েক বছরের।