রাঙিয়ে দিয়ে যাও
স্মৃতিকণা রায়
প্রায় কুড়ি মিনিট ইউনিয়ন রুমে বসে আছে। শঙ্খদার সঙ্গে দেখা করবে। শেষ দুটো অনার্সের ক্লাস হয়নি। আড্ডা না মেরে ক্যারাম খেলছিল। শঙ্খদা সাধারণত বিকেলের দিকে আসে। তাই একটা গেম শেষ করেই চলে এসেছে। আজ দেখা করতেই হবে। প্রায় ৩৫ মিনিট হয়ে গেল। একটা ছেলে প্রথম থেকেই ইউনিয়ন রুমে রয়েছে। আপাতত ইউনিয়ন রুমে আর কেউ নেই। তারা দু’জন। এখনও পর্যন্ত তারা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি। সে উঠে বইয়ের আলমারির কাছে দাঁড়াল। সব কবিতার বই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি, সুনীল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এখনও পড়া হয়নি। তার চোখটা আটকে রয়েছে বইটার দিকে। যদি পাওয়া যেত—! কিন্তু আলমারিতে তালা। বাইরে থেকে দু’বার হাত বোলাল বইটার ওপর।
—‘‘পড়বে?’’
—‘‘চাবি দেওয়া তো!’’
—‘‘নেবে কিনা বলো?’’
—‘‘দিন।’’
—‘‘আপনি–আজ্ঞে করলে দেব না।’’
একটু হেসে বলল, ‘‘দাও।’’
—‘‘গুড গার্ল।’’
বইটা পেয়ে সে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। গোটা ঘর জুড়ে একটা টেবিল। তার চারদিকে চেয়ার। ঘরে বই ভর্তি চারটে আলমারি। একটা সামনের ঘর, ভেতরে আরও একটা ঘর আছে। সেটা দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি। দেওয়ালে বেশ কয়েকটা ছবি। চে, লেনিন আর সুকান্ত ভট্টাচার্য। সে স্থির দৃষ্টিতে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, আচ্ছা, এঁদের কি মহাপুরুষ ভাবা যায়?
—‘‘কী হল?’’
—‘‘ভাবছিলাম—।’’
—‘‘জানতে পারি?’’
—‘‘এই যে দেওয়ালের ছবিগুলো, তাঁদের কি মহাপুরুষ বলা চলে?’’
—‘‘ভাবার বিষয়। আলোচনার বিষয়। তর্কেরও বিষয়।’’
—‘‘তা হলে থাক।’’
—‘‘বেশ, থাক ধামাচাপা।’’
হেসে ফেলল দু’জনে। একজন–একজন করে নাইট সেকশনের ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করেছে।
ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ‘‘কোন জেলা?’’
—‘‘মানে?’’
—‘‘কোন জেলায় থাকা হয়?’’
—‘‘হুগলী।’’
চেয়ারটা কাছে টেনে এনে বলল, ‘‘মারাত্মক ব্যাপার।’’
—‘‘কেন?’’
—‘‘আমিও হুগলী। ধনেখালি। তুমি?’’
—‘‘শেওড়াফুলি।’’
যদিও টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিল। তা–ও চেয়ারটা আরও একটু টেনে মুখটা কাছে এনে জিজ্ঞেস করল, ‘‘নাম কী?’’
—‘‘চিনিয়া।’’
—‘‘চিনিয়া?’’
—‘‘হ্যাঁ , ডাকনাম।’’
—‘‘আমি অনি। ডাকনাম।’’
দু’জনেরই মুখে হাসি।
—‘‘অনার্সের ক্লাস নেই?’’
—‘‘ছিল। তবে ম্যাম আসেননি।’’
—‘‘ইউনিয়ন রুমে বসে কী হচ্ছে?’’
—‘‘শঙ্খদার জন্য বসে আছি।’’
—‘‘কেন জানতে পারি?’’
—‘‘আমার দিদিকে জোড়াসাঁকোতে ভোকাল মিউজিকে ভর্তি করতে হবে।’’
—‘‘তার জন্য তো পরীক্ষা দিতে হবে।’’
—‘‘দিয়েছিল তো!’’
—‘‘তা হলে?’’
—‘‘শরীর খারাপ ছিল। তাই প্র্যাকটিক্যাল দিতে পারেনি।’’
—‘‘ওরেব্বাস।’’
—‘‘শঙ্খদা বলেছে, হয়ে যাবে।’’
—‘‘বুঝলাম। আজ শঙ্খদা আসবে না।’’
—‘‘এমা, এতক্ষণ বলেননি!’’
—‘‘জিজ্ঞেস করেছিলেন?’’
—‘‘না, তা অবশ্য করিনি। —এবার কী হবে?’’
—‘‘বাড়ি যাওয়া।’’
—‘‘বাড়ি গেলে কী করে হবে?’’
—‘‘তা হলে থেকে যান ইউনিভার্সিটিতে!’’
—‘‘আপনি–আপনি করছেন কেন?’’
—‘‘আপনিও তো করছেন।’’
—‘‘তাই তো! আচ্ছা তুমি।’’
—‘‘তা হলে চলো।’’
—‘‘বাড়ি?’’
—‘‘হ্যাঁ।’’
—‘‘কী বলব দিদিকে গিয়ে?’’
—‘‘বলবে অনিমেষ কুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি বলেছেন কেসটা সলভ করার চেষ্টা করবেন।’’
—‘‘তিনি কী এমন মহাপুরুষ?’’
—‘‘তিনি রবীন্দ্রভারতীর বি টি রোড ক্যাম্পাসের নাইট সেকশনের জি এস।’’
—‘‘বোঝা গেল।’’
তারা ইউনিয়ন রুম থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পাশেই বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। তখনও দুটো ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীরা একই পথে আসা–যাওয়া করে। স্টপে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাস এসে গেল। উঠতেই হবে। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। চাপাচাপি করে উঠে পড়ল চিনিয়া। একবার পিছন ফিরে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না। সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে যেতে না যেতেই বাস ছেড়ে দিল। ধাক্কাধাক্কি করে নিজের অস্তিত্ব সঠিক রাখতেই বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। অনেক কষ্টে লেডিজ সীটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে থেকে এক ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়াতেই সে ধপাস করে ব্যাগটা সেখানে ফেলে দিল। এই হল সীট রাখার কৌশল। গত এক বছরে সে এটা শিখে ফেলেছে। একটু কাত হয়ে তিনি বেরিয়ে যেতেই নিজের সরু বডিটা টুক করে প্লেস করে দিল সেখানে। আর তখনই শুনতে পেল, ‘‘চিনিয়া, টিকিট কেটে নিয়েছি।’’
—‘‘আমার কাছে তো কুপন আছে।’’
—‘‘তাতে কী? রেখে দাও। পরে কাজে লাগবে।’’
চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এই লং রুটের বাসে এমনিতেই খুব ভিড় হয়। তার পর যদি একটা বসার জায়গা—! মিউজিক্যাল চেয়ারের মতোই। ডানলপ আসতে বাসটা একটু হালকা হল। দেখা গেল তাকে। বাদুড়ের মতো ঝুলছিল। পিছন দিকে এগিয়ে এলো।
—‘‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’’
—‘‘তোমার সঙ্গে।’’
—‘‘আমার সঙ্গে!’’
—‘‘হ্যাঁ। —আমার জেলার মেয়ে। আমার তো একটা দায়িত্ব থাকে তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার।’’
—‘‘বেশ বেশ।’’
দক্ষিণেশ্বর আসতেই বাসে আবার ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে।
—‘‘চিনিয়া— চিনিয়া।’’
ঘাড় ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে দেখল।
—‘‘নেমে এসো।’’
—‘‘কেন?’’
বাস ছাড়ছে। তাই কথা না বাড়িয়ে সবাইকে ঠেলে নেমে এলো চিনিয়া।
—‘‘এ ভাবে হঠাৎ?’’
—‘‘হঠাৎ করেই সব কিছু হয় বস।’’
—‘‘আমি মন্দিরে যাব না কিন্তু।’’
—‘‘না বাবা, হাঁটব।’’
একটু এগিয়ে গেল। খুব অন্ধকার। বোধ হয় কোনও কারণে লোডশেডিং হয়ে গিয়েছে।
—‘‘অন্ধকার তো!’’
—‘‘কী হয়েছে?’’
—‘‘অন্ধকারে এতটা পথ হাঁটব!’’
—‘‘উপর দিকে তাকাও।’’ মুখটা ধরে ঘাড় উঁচু করে দিল চিনিয়ার।
—‘‘কত তারা! —কী দারুণ!’’
—‘‘নক্ষত্ররাও আছে। আধখানা চাঁদ। চারদিকে বুনো গাছ! আর—।’’
—‘‘আর?’’
—‘‘এই তুমি আর আমি।’’
—‘‘ধ্যাৎ। এই এত বড় ব্রীজটা হাঁটব!’’
—‘‘ইয়েস ম্যাডাম। শুধু হাঁটব না, গল্প করব। আকাশ দেখব।’’
—‘‘বোঝা যাচ্ছে বাবা এতক্ষণে থানা–পুলিশ করে ফেলেছে হয়তো!’’
—‘‘অ্যাডভেঞ্চার করতে গেলে এমনই হয়।’’
—‘‘মায়ের প্যাদানি খেয়েছ?’’
—‘‘বহুবার।’’
ব্রীজের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে অনি।
— ‘‘দ্যাখো, বোধ হয় জোয়ার এসেছে। নৌকোগুলো সব বাইতে শুরু করেছে। একদিন এই অন্ধকার রাতে নৌকোর ছইয়ে শুয়ে থাকব। সারারাত নৌকো বয়ে চলবে। ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ হবে। আর আমি—!’’
— ‘আর আমি?’’
—‘‘স্বপ্ন দেখব।’’
ব্রীজের অন্যদিক থেকে কতকগুলো লোক হেঁটে আসছে। সরে এলো চিনিয়া অনির কাছে। অনি তাকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিজে পিছনে গিয়ে দুই হাত গ্রীলে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। এমন ভাবে বুকের মাঝখানে চিনিয়ার ছোট্ট শরীরটাকে ঢেকে রেখেছে যে, এই অন্ধকারে বোঝাই যাবে না সেখানে একটা মানুষ, না দুটো মানুষ!
কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘‘এই অমুক চন্দ্র, তমুকের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না বুঝি!’’
হঠাৎই আলো জ্বলে উঠল। অনি বলল, ‘‘বড্ড দেরি করে দিলাম তোমার। চলো তোমায় ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি।’’
একটু হেঁটে এসে স্টেশন পাড়ার মুখ থেকে রিকশা করে তারা বালি স্টেশনে এলো। ট্রেন আসছে। লেডিজ কম্পার্টমেন্টের কাছে দাঁড়িয়ে চিনিয়া পেছন ঘুরে অনিদাকে দেখতে পেল না।
—‘‘গেল কোথায় ছেলেটা? চলে গেছে বোধ হয়।’’ ভাবল, ‘‘পাগল একটা!’’
এই সময়ের ট্রেনেও খুব ভিড়। সকলকে ঠেলে ট্রেনে উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোথা থেকে ছুটে এলো অনি। হাতে একটা ঠোঙা ধরিয়ে দিল।
—‘‘নাও শাখালু। নুন দিয়ে—।’’
—‘‘নুন দিয়ে শাখালু!’’
—‘‘দারুণ লাগে। —কাল চলে এসো কিন্তু। আর দিদিকে বোলো, ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। চিন্তা না করতে।’’
হু–হু করে হাওয়া আসছে ট্রেনের দরজা দিয়ে। চোখের সামনে গাছপালাগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে। বিশাল হিন্দমোটর কারখানা। সাঁই সাঁই করে ট্রেন চলেছে। চিনিয়া ভাবছিল, অনিদা কী অদ্ভুত! বোঝাই যাচ্ছিল না আজকেই প্রথম আলাপ!
স্টেশনে বাবা দাঁড়িয়ে। সে জানত, এ রকমই কিছু হবে। বাড়িতে মা কোন মূর্তিতে কে জানে! সে ঠিক করল, মা শত চেঁচালেও চুপ করে থাকবে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তার মধ্যে যেন কাজ করছিল।
মা বোধ হয় ভালো মুডেই আছে। খুব বেশি বকুনি খেতে হল না। চেঞ্জ করে ঘরে এসে দেখল, দিদি ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। দিদিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘‘আবার কী হল?’’
—‘‘কী হবে?’’
— ‘ভালো খবর।’’
—‘‘হয়ে যাবে?’’
—‘‘মনে হয়। দেখা যাক।’’
নীচ থেকে খেয়ে এসে দিদির পাশে একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল দিদির ডাকে। তাকে ফোনে কে যেন খুঁজছে! দিদি খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘‘একটা ছেলে!’’
—‘‘এত রাতে! কে সে?’’
—‘‘হ্যালো।’’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এলো যে গলাটা, তার সঙ্গে আজই পরিচয় হয়েছে।
— ‘বলো।’’
—‘‘কাল কখন আসছ?’’
—‘‘কাল কোনও ক্লাস নেই তো—!’’
—‘‘তো কিছু না। চলে এসো। ক্লাস নেই তো কী? দিদির ব্যাপারে কাজ করতে হবে তো। জোড়াসাঁকো যাব।’’
—‘‘তাই? —আচ্ছা। আমার নম্বর পেলে কোত্থেকে?’’
—‘‘ম্যাজিক। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।’’
—‘‘বোঝা গেল।’’
—‘‘শোনো— চলে এসো। রাখি।’’
চিনিয়া ভাবছিল, একদিনের আলাপে মানুষ এত সহজ কী করে হয়! আর এত আপনই বা কী করে হতে পারে? পরের দিন এটা–সেটা কিছু সমস্যা হওয়ায় ইউনিভার্সিটি পৌঁছতে বেশ দেরীই হল। ক্লাসে কেউ নেই। সামনেই দোল। তাই সবাই নিজের নিজের প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। চিনিয়া ইউনিয়ন রুমে গেল। অনিদা বসে আছে।
—‘‘স্যরি, একটু দেরি হয়ে গেল!’’
—‘‘আমি তো অপেক্ষায় অপেক্ষায় ফসিল হয়ে গেলাম!’’
—‘‘কী যে বলো!’’
—‘‘চলো বেরিয়ে পড়ি।’’
—‘‘কোথায়?’’
—‘‘ওই ক্যাম্পাসে যেতে হবে।’’
—‘‘জোড়াসাঁকোতে?’’
—‘‘হ্যাঁ। আগে কোনওদিন যাওনি?’’
—‘‘না গো।’’
—‘‘সত্যি!’’
জোড়াসাঁকো গিয়ে আহ্লাদে আটখানা চিনিয়া।
—‘‘এত মজার কী?’’
—‘‘দারুণ লাগছে আমার।’’
—‘‘এখানে তোমায় কেন নিয়ে এলাম বলো তো?’’
—‘‘দিদির ব্যাপারে—।’’
—‘‘সেটা তো সেকেন্ডারি।’’
—‘‘তা হলে?’’
—‘‘তুমি কাজল পরো না কেন?’’
—‘‘কাজল? পরি না তো!’’
—‘‘এখানকার মেয়েদের দেখো,কী সুন্দর সেজে থাকে এরা! কী সুন্দর ড্রেস পরে! নিজেকে এ ভাবে সাজাতে হবে। নিজেকে ভালবাসতে হবে।’’
অনিদা তাকে একটা গাছের তলায় বসাল।
—‘‘এখানে চুপ করে বসে থাকবে। কেউ ডাকলে কোথাও যাবে না। কারও সঙ্গে কথা বলবে না।’’
—‘‘আমি ওই–ওই ওপরটা ঘুরে দেখব না?’’
—‘‘মিউজিয়াম দেখব তো! তার আগে কাজটা সারি।’’
—‘‘বেশ।’’
প্রায় আধঘণ্টা বাদে এলো অনিদা।
—‘‘হয়ে গেছে চলো। আমি আর একবার সন্ধ্যের দিকে আসব।’’
—‘‘যাব তো মিউজিয়ামে?’’
—‘‘আজ না। আজ একটু অন্য জায়গায় যেতে হবে।’’
—‘‘কোথায়?’’
অনিদা বলল, ‘‘ইউনিভার্সিটি আসতে গেলে একটু মেকআপ করা দরকার।’’
—‘‘কোনও দিন না।’’
—‘‘সব সময় হ্যাঁ।’’
—‘‘কেন?’’
—‘‘নিউ মার্কেটে গেছ কোনও দিন?’’
—‘‘না।’’
—‘‘চলো নিউ মার্কেটে।’’
নিউ মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে অনি বারবার চিনিয়াকে বলল ড্রেস কেনার জন্য।
—‘‘না গো,আমার অনেক ভালো ভালো ড্রেস আছে।’’
শেষে তারা একটা রেস্তোরাঁয় খেল।
—‘‘আকাশবাণী ভবন দেখেছ?’’
—‘‘না।’’
—‘‘চলো, আজ হাওড়া দিয়ে বাড়ি ফিরব।’’
—‘‘আমি হারিয়ে যাব।’’
—‘‘আরে বাবা, আমি থাকব তো!’’
পরের দিন শনিবার কোনও ক্লাস নেই। চিনিয়া খুব আশা করছিল, নিশ্চয়ই একটা ফোন পাবে। বিকেলের দিকে আকাশ কালো করে এলো। সন্ধ্যের পর ঝমঝম করে বৃষ্টি। তিনতলার সিঁড়ির জানলার কাছে বসে চিনিয়া সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘জেলখানার চিঠি’ পড়ে সে কেঁদে ফেলল। দিদি এসে বসেছে পাশে।
—‘‘কাঁদছিস কেন?’’
—‘‘এমনিই। কবিতা পড়ে। —পড়ে শোনাব তোকে?’’
—‘‘পড়।’’
সে কবিতা পড়তে শুরু করল। রবিবারও সারাদিন বৃষ্টিতে কাটল। এ রকম বৃষ্টি থাকলে সোমবার ইউনিভার্সিটি যাবে না ঠিক করল। এই বৃষ্টিতে এতদূর যাওয়া যায় না।
রাত দশটা নাগাদ ফোনটা এলো।
—‘‘কাল আসছ তো?’’
—‘‘এত বৃষ্টিতে?’’
—‘‘বৃষ্টি হলে ভাত খাও না? জলখাবার?’’
—‘‘ধ্যুস।’’
—‘‘তা হলে ইউনিভার্সিটি আসবে না কেন?’’
—‘‘আসব।’’
—‘‘মনে আছে তো চোখে কাজল পরবে। চুলটা খুলে রেখে জাস্ট একটা ক্লিপ দেবে। আর—।’’
চিনিয়া কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল অনির গলা শুনে! কোনও কথা শুনছিল না। শুধু ভাবছিল, নিজেকে এ ভাবে ভালবাসতে সে এতদিনে শিখেছে! শেষ রাতের দিকে বৃষ্টিটা ছেড়ে গেল। অতএব ইউনিভার্সিটি যাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। সেদিন স্যার একটা এক্সট্রা ক্লাস নেবেন বলেছেন। ক্লাসটা দুটো পিরিয়ড নিয়ে হবে। চিনিয়া ক্লাসে ঢুকতেই সবাই হইহই করে উঠল। অমিতাভ ক্লাসের সব থেকে মজার ছেলে। সে তাকে ‘সুটকি’ বলে ডাকে। দৌড়ে এসে দুই হাত দিয়ে তাকে উঁচুতে তুলে ধরল।
—‘‘সুটকি,কী দিয়েছিস রে!’’
—‘‘কেন? তোরা কলকাতার ছেলেমেয়েরা খালি দিবি,আর আমরা মফস্সলের ছেলেমেয়েরা শুধুই দেখব—!’’
কানের কাছে মুখ এনে মহুয়া বলল,‘‘কার জন্য এত রে? নাইটের জিএস–এর জন্য?’’
—‘‘তোরা আমাকে ক্লাসে ইন করতে দিবি, না আউট হয়ে যাব?’’
কখন যেন স্যার চলে এসেছেন! —পেছনে দাঁড়িয়ে স্যার। তারা হুড়মুড়িয়ে ক্লাসের ভেতর চলে এলো।
—‘‘কী হচ্ছিল?’’
বনানী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‘‘স্যার, চিনিয়াকে দেখুন।’’
—‘‘যার নাম চিনিয়া, সে তো মিষ্টি মেয়ে হবেই!’’
—‘‘না স্যার, দেখুন কী সেজেছে!’’
চিনিয়া উঠে দাঁড়াল। বলল,‘‘স্যার, সবাই কী–সব বলছে!’’
বনানী হঠাৎ বলল,‘‘দোলের পরের দিন তো চিনিয়ার বিয়ে।’’
স্যার চিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘‘সত্যিই সুন্দর লাগছে। —এত কম বয়সে বিয়ে! পড়াশোনা? কী হবে? সামনেই তো পরীক্ষা!’’
চিনিয়া বলল,‘‘পড়ব স্যার, পরীক্ষা দেব। কোনও কিছুর বিনিময়ে পড়াশোনা ছাড়ব না।’’
—‘‘গুড।’’
—‘‘চলো শুরু করি।’’ স্যার পড়ানো শুরু করলেন। পড়ানো শেষ করে স্যার রোল কল করেন। চিনিয়ার রোল ১। স্যার ওয়ান ডেকে তার দিকে একবার তাকিয়ে হাসলেন।
বের হওয়ার আগে চিনিয়াকে বললেন,‘‘টিচার্স রুমে এসে একবার দেখা কোরো।’’
তার মাথায় প্রথম চিন্তা,দিদিকে যা করে হোক ভর্তি করতে হবে। সে ইউনিয়ন রুমে এসে দেখল,সেখানে অনিদা রয়েছে। আরও অনেকে পবনদা,শোভনদা,আজ আবার শঙ্খদাও রয়েছে। এই ক’দিনে ইউনিয়ন রুমে এসে সে এদের সবাইকেই চিনে ফেলেছে। চিনিয়া ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত করছিল। পবনদা তাকে দেখতে পেয়েছে।
—‘‘কী রে? বাইরে কেন? আয়।’’
সে ভেতরে এলো। অনিমেষদা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
পবনদা বলল,‘‘অ্যাঙ্কারিং করতে পারস?’’
—‘‘এ ভালো আবৃত্তি করতে পারে,আর অ্যাঙ্কারিং করতে পারবে না?’’ বলল শঙ্খদা।
—‘‘তা হলে আর কাউকে ঢুকাইতে হইব না। তুই করিস।’’
অনিদা চোখ নাচিয়ে বলল,‘‘কেমন?’’
শঙ্খদা বলল,‘‘শোন,তোর দিদির প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দিন যে শরীর খারাপ করেছিল,তার ডাক্তার সার্টিফিকেট আনতে পারবি তো?’’
—‘‘হ্যাঁ,অবশ্যই।’’
—‘‘ডীনের সঙ্গে কথা বলেছি। কাল নিয়ে আসিস। আর একবার প্র্যাকটিক্যালে বসতে হবে।’’
সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অনিদা পেছন থেকে ডাকল,‘‘দাঁড়াও। আমিও বের হব।’’
পবনদা বলল,‘‘কী করস তুই? পিছু পিছু যাস ক্যান?’’
শঙ্খদা হাসতে হাস পবনদার দিকে তাকিয়ে বলল,‘‘ওরে আসামের পোলা,তুই অত কিছু বুঝবি না। এখানে বোস।’’ চিনিয়ার নাম ধরে ডেকে বলল,‘‘চিনিয়া,আজ তোকে দারুণ লাগছে!’’ সাদা কর্ড,লাল শার্ট। লম্বা চুলে সুন্দর করে খেজুরছরী বেণী,চোখে কাজল। ঠোঁটে কফি কালারের লিপস্টিক। পায়ে স্নিকার। আর একটা অন্য রকম ব্যাগ,কেমন বটুয়া টাইপ। হেঁটে অনেকটা এগিয়ে গেছে চিনিয়া। কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। অনি বেশ কিছুটা দূরে। সে আস্তে হাঁটছে। কোথায় যেন তার মনে হচ্ছে,তার জন্য না দাঁড়িয়ে কেন এগিয়ে যাচ্ছে! মনে মনে একটা অভিমান হচ্ছে তার।মনে মনে ভাবল,এই কয়েকদিনের মাত্র আলাপ। তাতে এটা মানায় না। সে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখল,চিনিয়া এগিয়ে এসেছে তার কাছে।
—‘‘চলো যাবে না?’’
—‘‘এই তো,চলো।’’
আজও তারা দু’জন বাসে উঠল। চিনিয়া জানত,অনিমেষ তার সঙ্গে যাবে। তাই হল। তারা আজও দক্ষিণেশ্বরে নেমে পড়ল। ব্রীজে হাঁটবে। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ বলল,‘‘কোনও কোনও জায়গায় নিজেকে চিনিয়ে দিতে হয়!’’
—‘‘তাই?’’
—‘‘একদম। এই যেমন নিজের প্রকাশ ঘটালে!’’
—‘‘কিন্তু আমি তো এখানে পড়তে এসেছি!’’
—‘‘সেটা তো তোমার অন্তরের—। অন্তরে কী আছে,কী দরকার বাইরে দেখানোর?’’
—‘‘তা হলে তোমারও অন্তরে অন্য রকম। বাইরে যা দেখি,তা নয়!’’
—‘‘তাই,একদম তাই। দ্যাখো,কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এই যে তুমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখলে,কেউ কোনও দিন আমার সঙ্গে চাঁদ দেখেনি। নদীর ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ শোনেনি।’’
—‘‘তাই বুঝি? এতদিনে সে রকম কাউকে জোগাড় করতে পারোনি?’’
—‘‘আমি তো চেষ্টাই করিনি। কেউ কেউ আমাকেই খুঁজে বার করেছে। তবে জানো,সবার সঙ্গে অন্তরের মিল হয় না। কারও কারও সঙ্গে সেটা হয়।’’
— ‘‘জানি।’’
—‘‘আমি জানতাম,তুমি বুঝবে।’’
—‘‘আমার কিন্তু খিদে পেয়েছে।’’
—‘‘ইস, আমারই ভুল। কিন্তু এখানে আমাকে ছাড়া খাওয়ার তো কিছু নেই।’’
—‘‘আছে মশাই।’’ সে ব্রীজের একদিকে হাত দেখিয়ে একটা ফুচকাওয়ালা দেখাল।
—‘‘আজ কিন্তু আমি খাওয়াব।’’
—‘‘তুমি যে লটারী পেয়েছ,আমি তো জানতাম না!’’
—‘‘সব কিছুই কি জানা যায়? কিছু বুঝে নিতে হয়।’’
তারা আবার হাঁটতে শুরু করল। অনিমেষই শুরু করল।
—‘‘আমাকে যদি কোনও দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়,আমি কী চাইব জানো?’’
—‘‘কী?’’
—‘‘কিছু পছন্দসই বই আর তোমাকে।’’
—‘‘মাথাটা গেছে।’’
—‘‘বোধ হয়। চলো আজ হাঁটতে হাঁটতে এমন কোথাও চলে যাই, যেখান থেকে আমাদের কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না।’’
—‘‘আমারও খুব ইচ্ছে করছে জানো। কিন্তু—।’’
—‘‘কিন্তু?’’
—‘‘তা হওয়ার নয়।’’
দাঁড়িয়ে পড়েছে চিনিয়া।
—‘‘কেন নয়?’’
—‘‘নয় বলে।’’
সে ব্যাগে হাতড়াচ্ছে।
—‘‘কী খুঁজছ?’’
একটা কার্ড বার করে অনির হাতে দিল।
—‘‘কী এটা?’’
—‘‘আমার বিয়ে। দোলের পরের দিন।’’
অনিমেষ ব্রীজের গ্রিলের ওপর তাকে চেপে ধরেছে!
—‘‘পড়ে যাব অনিদা।’’
—‘‘পড়ে যাও। আমি চাই তুমি পড়ে যাও।’’
অদ্ভুত ভাবে অনি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
—‘‘যাব না আমরা?’’
—‘‘না,কোথাও যাব না।’’
—‘‘এইখানেই সারারাত থাকব বুঝি?’’
চিনিয়ার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে রইল অনি।
দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নদী তার আপন গতিতে বয়ে চলেছে। দূরে কোথায় গান হচ্ছে—‘পরদেশী পরদেশী জানা নেহি,মুঝে ছোড়কে’।চিনিয়াই বলল,‘‘চলো হাঁটি।’’
—‘‘আমার হস্টেলে যাবে?’’
—‘‘এখন? তা ছাড়া সেটা তো ছেলেদের!’’
—‘‘সব মেয়েরাই যায়।’’
—‘‘তাই বুঝি। বেশ মজা তো! কিন্তু কেন?’’
—‘‘আমি কী খাই? কী ভাবে থাকি? কী করে স্বপ্ন দেখি,তা তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?’’
—‘‘ইচ্ছে তো অনেক কিছুই হয়। কিন্তু উপায় কী?’’
—‘‘উপায় নেই বলছ! তা হলে চলো হাঁটি।’’
তারা দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের কাছে চলে এসেছে। সেদিন কেউ কারও হাত একটুর জন্যেও ছাড়েনি।
প্ল্যাটফর্মে উঠে অনি বলল,‘‘এক্ষুণি চলে যাবে? আর একটু থাকলে হয় না?’’
চিনিয়া ভাবছিল,আর কোনও দিন কি…! হয়তো আজই শেষদিন। যদি একটু দেরীই হয় ক্ষতি কী?
চিনিয়া বলল,‘‘বাড়িতে একটা ফোন করে বলতে হবে।’’
স্টেশনে কয়েন ফেলার বুথ থেকে সে বাড়িতে ফোন করল। ফিরতে একটু দেরি হবে বলল।
অনির দিকে তাকাতে সে বলল,‘‘বলো জোড়াসাঁকোতে আছি। হাওড়া দিয়ে ফিরব।’’
সেদিন তারা বহুক্ষণ প্ল্যাটফর্মে বসে রইল। এক সময় অনিই বলল,‘‘চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’’
চিনিয়ার হাতটা একবারের জন্যেও অনি ছাড়েনি। তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,‘‘তোমাকে আজ এস এন ডেকেছিলেন না? কী বললেন?’’
—‘‘আজ বলব না। অন্য কোনও সময়ে—।’’
—‘‘তাই হোক।’’
চিনিয়াকে বাড়ির সদরে ছেড়ে অনি বলল,‘‘আমার কিন্তু খুব শীত করছে। বোধ হয় কাল জোড়াসাঁকো যেতে পারব না। তুমি কিন্তু ঠিক সময়ে দিদিকে নিয়ে চলে যেও।’’
চিনিয়া ব্যাগ থেকে হলুদ রঙের শালটা বের করে অনিদাকে দিয়ে বলল,‘‘এটা নাও।’’
—‘‘ফেরত পাবে না কিন্তু!’’
—‘‘চাইও না।’’
অনি চলে যাচ্ছে। চিনিয়া তাকিয়ে আছে তার চলে যাওয়া পথের দিকে।
পেছন ফিরল অনি। এগিয়ে এলো চিনিয়ার কাছে। বলল,‘‘অনিমেষের বুকের দরজা কিন্তু চিরকাল তোমার জন্য খোলা থাকবে। সময় ও সুযোগ হলে চলে এসো।’’
চিনিয়ার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
— ‘দূর বোকা,কাঁদতে নেই।’’
চলে গেল অনিমেষ। চিনিয়া জানত,তার বিয়েতে সে আসবে না। তাই আবারও সে কথা মনে করাল না। দোলের আগের দিন বাড়ি ভর্তি লোক। রাত তখন দশটা–সাড়ে দশটা। দিদি এসে বলল,‘‘মরার মতো ঘুমোচ্ছে দ্যাখ! —যা,তোর ফোন। মনে হয় অনি।’’
চিনিয়া দৌড়ে গিয়ে ‘‘হ্যালো’’ বলল।
—‘‘অনি বলছি।’’
—‘‘বলো।’’
—‘‘কাল তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’’
—‘‘কাল?’’
—‘‘হ্যাঁ,কাল। তোমার বাড়ি যাই?’’
—‘‘না–না,বাড়িতে এসো না। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন।’’
—‘‘তা হলে?’’
চিনিয়া তাকে একটা জায়গার নাম বলল।
—‘‘তুমি বেরোতে পারবে?’’
—‘‘হ্যাঁ।’’
অনি ফোন রাখল। এক দাদা চিনিয়াকে খাওয়াবে বলেছিল। কথা হয়েছিল,খাবার আসবে হোটেল থেকে। চিনিয়া বায়না ধরল,না,সে খেতে যাবে হোটেলে। বাড়ির সকলে এক কথায় না করে দিল। কিন্তু সে যাবেই। বাবা বললেন,‘‘যাক না মেয়েটা যেতে চাইছে যখন।’’
বিকেল তখন সাড়ে পাঁচটা। সে নিজেকে সুন্দর করে সাজাল। তার পর দাদার সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। খানিকটা গিয়ে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গাড়ি থামাতে বলল।
গাড়ি থামলে সে দাদাকে জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে বলল,‘‘এখানে খুব ভাল সিঙাড়া ভাজে! বসে খাও। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত বাড়ি যেও না যেন!’’
দাদা কিছু বলার আগেই সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ি থামিয়ে সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল গঙ্গার দিকে। একদৃষ্টে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনি।
চিনিয়া তার পাশে গিয়ে ডাকল,‘‘অনিদা—।’’
হেসে বলল অনি,‘‘আসতে পারলে?’’
—‘‘পারলাম কি,পালিয়ে এসেছি?’’
চিনিয়ার মুখে সব ঘটনা শুনে অনি বলল,‘‘এই গুনটাও যে তোমার আছে জানতাম না তো!’’
—‘‘আমি তো কোন ছোটবেলা থেকে গাড়ি চালাতে জানি! শুধু এতদিন লাইসেন্স ছিল না। বসবে,না দাঁড়িয়ে থাকবে?’’
—‘‘দাঁড়ানোই ভালো। এই পালানোর গুনটাও–ও–ও বেশ। এক মিনিট দাঁড়াও,আসছি।’’ চলে যেতে যেতে অনি ফের দাঁড়াল। বলল,‘‘সুন্দরীদের সুন্দরই লাগে। কিন্তু তা–ও কীসের একটা অভাব যেন—!’’
—‘‘নিশ্চয়ই সিগারেট আনতে যাচ্ছ? তাড়াতাড়ি এসো।’’ চিনিয়া নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
…অনি কখন এসেছে টের পায়নি চিনিয়া। পেছন থেকে তাকে আবীরে রাঙিয়ে দিল। সে–ও ছাড়বার পাত্রী নয়। আবীরের রঙে অনিকে রঙিন করে দিল।
অনি বলল,‘‘আসলে এই অভাবটা বোধ করছিলাম।’’
—‘‘সঙ্গে এনেছিলে,তাই না?’’
—‘‘হ্যাঁ, কী করে বুঝলে?’’
—‘‘তোমার গায়ে আবীরের গন্ধ!’’
অনি এক ব্যাগ বই তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,‘‘তোমার জন্য।’’
—‘‘এগুলো সব!’’
—‘‘সব। আর একটা কথা,সময় পেলে চিঠি লিখবে।’’
চিনিয়া বলল,‘‘দ্যাখো,ঠিক একদিন তোমাকে আমি চিঠি লিখব।… অনেক কথা,যেগুলো বলা হল না,বলতে হবে তো!’’
থার্ড ইয়ারের ফাইনাল। হঠাৎই দেখা হল তার সঙ্গে। এতদিনে একদিনও দেখা হয়নি। তাকে দেখে চিনিয়া থমকে দাঁড়াল।
—‘‘ভুলেই গেছ বলো?’’
—‘‘একদম না।’’
—‘‘তা হলে? কতদিন দেখিনি তোমায়—!’’
—‘‘সখী,রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’’ অনি বলল,‘‘একটু আড়ালে গেলে হয় না?’’
চিনিয়া বলল,‘‘আড়ালে কেন?’’
—‘‘চলো না,বলছি।’’
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াল তারা।
অনি তাকে বলল,‘‘সাহস আছে আগের মতো?’’
—‘‘দেখার ইচ্ছা বুঝি?’’
—‘‘তা হলে চলো পালাই।’’
—‘‘এই—।’’
হাসতে হাসতে অনি একটা গাছের ডাল চেপে ধরেছে। বোধ হয় কেউ কোনও দিন সেখানে পেরেক পুঁতেছিল। একটা আঙুল অনেকটাই কেটে গেল তার। রক্ত বের হচ্ছে। চিনিয়া তাড়াতাড়ি তার আঙুল নিজের মুখে নিল।
কোথা দিয়ে ২১টা বছর কেটে গেছে! তার সাততলার ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে চিনিয়া চিঠি লিখছে। ঠিকানাটা আজও মনে আছে ধনেখালির বাড়ির। কিন্তু,সে কি সেখানে—? তবু—তবু—।
প্রিয় অনিদা,
কী জানি তুমি কেমন আছ,কোথায় আছ! মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে দৌড়ে তোমার কাছে চলে যেতে। আচ্ছা,তুমি কি আগের মতোই আছ? না,বহু বদল ঘটেছে তোমার?
তোমার কথা আমার এই ২১ বছরে প্রত্যেকদিন একবার,দু’বার,তিনবার,আরও আরও কতবার যে মনে পড়েছে,তার ঠিক নেই। তোমার চিনিয়ার এত সাহস কৌটোবন্দি হয়ে গেছে। আচ্ছা,সত্যিই যদি সেদিন আমরা পালাতাম! থাক সে কথা,তুমি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না,এস এন কী বলল? স্যার ভেবেছিল,বিয়েটা তোমাকেই করছি। তাই বলেছিল,তোমার মতো ভালো ছেলে হয় না। আমরা খুব সুখী হব।
আচ্ছা,বলতে পারো সুখ কী? কোথায় কিনতে পাওয়া যায়? সন্ধান থাকলে জানিও।
আরও একটা কথা,যা তোমাকে তখন বলা হয়নি। সেদিন তুমি আমাকে গাছের তলায় বসিয়ে চলে যাওয়ার পর,—মনে আছে তো? ওই সেদিন জোড়াসাঁকোতে গাছের তলায় বসিয়ে তুমি যেন কোথায় চলে গিয়েছিলে! সেদিন কোথা থেকে একদল মেয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে একজনের নাম বলেছিল ‘টিঙ্কু’। সে বলেছিল,‘‘এই মেয়ে শোন,খুব অনিমেষের সঙ্গে ঘোরাঘুরি হচ্ছে! অনিমেষ শুধু আমার। ওর দিকে হাত বাড়াস না।’’ আরও কাছে এসে বলেছিল,‘‘অনিমেষকে ছাড়া আমি মরে যাব বিশ্বাস কর। সত্যি বলছি।’’ আমি সেদিন তার চোখে সত্যিই তোমার জন্য ভালবাসা দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো।
আর কী? তোমার চিনিয়ার সাহস ছিল তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার। —কী? তা হলে তো আর আজকের এই চিঠি লেখা হত না! আর টিঙ্কুদিকে কথা আমি দিয়েছিলাম,তার অনিমেষ তারই থাকবে। তাই সাতদিনের মধ্যে নিজের বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছিলাম। বেশি দেরি করা উচিত হবে না বলেই তখন মনে হয়েছিল।
আর—আর যে রঙে তুমি আমায় রাঙিয়েছ,তা কি ভোলা যায় বলো?
ইতি
তোমার চিনিয়া
********************************************************
স্মৃতিকণা রায় পরিচিতি
জন্ম ১১ ফেব্রয়ারি ১৯৭১, কলকাতা। আদ্যন্ত সংস্কৃতি মনোভাবাপন্না। শিক্ষা,সাহিত্য,উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত—সমস্ত ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম এ। এ ছাড়া নাটক নিয়েও এম এ করেছেন রবীন্দ্রভারতী থেকেই। পড়াশুনো করেছেন মনস্তত্ত্ব নিয়েও। বর্তমানে একজন সাইকোথেরাপিস্ট। এক সময় ইন্টিরিয়র ডেকরেশন (গৃহ–অন্দর সজ্জা) নিয়ে পড়াশুনো ও কাজ করেছেন। একজন সেতারশিল্পীও। তালিম নিয়েছেন পণ্ডিত মণিলাল নাগের কাছে। নেশা সাহিত্য চর্চা। কবিতা লেখার মধ্য দিয়েই সাহিত্য জগতে প্রবেশ। অনেক বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজও করেছেন। আকাশবাণী কলকাতায় স্বরচিত কবিতা পাঠ করে থাকেন। শিখেছেন স্পেনীয় ভাষাও। শখ ভ্রমণ। ঘুরতে অসম্ভব ভালবাসেন। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অথবা অন্যকিছু’, ‘তারাদের দেশে’, ‘স্বপ্নভঙ্গুরতা ও নিশাচরী’, ‘শূন্যতা থেকে সৃষ্টি’, ‘ইছামতী’, ‘কল্পনার নটরাজ’, ‘তার পর, তৃতীয় পাঠ’, ‘হৃদয়ে কারও নাম নেই’, ‘রং বদলায়’ প্রভৃতি।
যোগাযোগ: Mobile: (+91) 82960 33313, (+91) 033-2663-5523.
ঠিকানা: Smritikana Roy, 88B GT Road, WBGH Complex, Flat no. 2D/1, Post: Bhadrakali, Dist: Hooghlly, PIN 712232.
West Bengal. India.
e-mail: smritikanaroy55555@gmail.com