ফুটো
দীপাঞ্জন মাইতি
মাকে ফুটোর মনে পড়ে না। আট বছর হলো-জন্ম ইস্তক্ ভোলাকেই চিনেছে বাপ বলে। ভোলার সাথে ফুটোর কোনো মিল নেই। আমিনা চাচী বলে,ফুটোর নাকি মায়ের সাথে খুব মিল তবে আয়নায় ফুটো দেখেছে ওর চোখের কটা রংটা ঠিক রকির মত। রেলগেট থেকে স্কুল মোড় এলাকার সত্তরটা ট্রাফিক মোড়ের সর্বেসর্বা রকি। রকি হল ফুটোর ফেভরিট,ফুটো বড় হয়ে রকির মত হতে চায় কারণ আর লোকে বলে ফুটো নাকি জন্মের আগে থেকেই রকির ফেভরিট। তখন কত হবে বয়স মাস ঘুরেছে হবে বড় জোর…প্রথম দেখাতেই রকির জহুরী নজরে পড়েছিল ফুটো। তখন ফুটোর সে কি ফুটেজ…। তবে সে সব কিছুই ফুটোর মনে নেই সবই আমিনা চাচীর কাছে শোনা। চাচীই নাকি সব থেকে বেশী কাটে,বেশীদিন কোলে পাততো ফুটোকে…শ টাকায় ৪০ রকির,৩৫ চাচীর আর ২৫ ফুটোর। এতদিন কোলে পেতেছে,চাচীর গায়ের গন্ধটাই তাই বোধহয় ফুটোর সবচে চেনা। বেশী জড়িয়ে পড়লে ধান্ধা চৌপাট হয়ে যাবে তাই রোজ রাতে রকির অর্ডারে ভোলার এক হাতে নোট আরেক হাতে ফুটোকে জমা করতে হত। ভোলার দায়িত্ব ছিল ফুটোর চোখে মুখে খিদেটা আরো আরো আরো স্পষ্ট করে তোলা।
এখন ট্রাফিক মোড়ে ভোলা ফুলঝাড়ু বেচে আর ফুটো বেচে ফুল। রকির দয়ায় টিনের চাল আর ভাতের চাল জুটে যায়। এমনিতে এদিক ওদিক পকেটমারকে ভিড় করে বার করলে দিনে পার পিস ত্রিশ টাকা,সাথে শয়ে দশ কমিশন,তার কামাইয়ের ওপর। নিজে পকেট মারলে টোটালে শয়ে ষাট। আর একটা ঠিকঠাক অ্যাক্সিডেন্ট নামাতে পারলে মোটা বখরা সাথে এক প্যাকেট বিরিয়ানী। ফুটো থালায় ঠাকুর নিয়ে ঘোরা ছেড়ে পকেটে লেগেছে বছর পাঁচেক বয়সে। রকির খাস বলে শুরু থেকেই ফুটোর পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট চলছে। এখন অ্যাক্সিডেন্টের ট্রেনিং নিচ্ছে ভোলার কাছে।
গত ক’দিন ফুটো পকেট ভালোই নামিয়েছে। কিন্তু ভোলা ঠিক সুবিধে না করতে পারায় ফুটো পাবলিকের আর ভোলা রকির প্যাঁদানি খেয়েছে পরপর দু’দিন। ভোলার ভাগের টাকাও ফুটোকে দিয়ে দিয়েছে রকি। কিন্তু আজকের অ্যাক্সিডেন্টটা ঠিক নামাতে পারে নি ফুটো। গাড়িটায় গিয়ে ধাক্কা খাওয়ার আগেটাই হঠাৎ কেমন যেন ভয় লেগে গেসলো… ব্যাস্। সবটাই হিসেবের খেল… ভোলা দূর থেকে গাড়ি বেছে ইশারা করলেই ফুটো ছুটে গিয়ে গাড়ির গায়ে ধাক্কা খায়। সাথে সাথে ভোলা এসে সোজা চার্জ করে। …কিন্তু আজকে কি যে হলো আবার ভোলা দেরী করে দিলো। আমিনা চাচী ব্রীজের মাথা থেকে দেখেছিলো ভাগ্যিস,না হলে…। জ্ঞান ফিরে থেকে ফুটো দেখলো রকি নেই,ভোলা নেই,কেবল আমিনা চাচী মাথা কোলে পেতে বসে আছে। মাথাটা খুব দপদপ করছে- তবু ফুটো খুব মনে করার চেষ্টা করছে ভোলার ইশারাতেই তো…চোখটা বোজার আগে শেষ যা দেখেছিল ফুটোর দৃঢ় বিশ্বাস ইতস্তত ভোলার পিছিয়ে যাওয়া দু’পা। আমিনা চাচীর চেনা গন্ধটা ছুঁয়ে ফুটো অবিশ্বাস করার চেষ্টা করে খুব। কিন্তু রকির অনুপস্থিতির হতাশাটা যেন হাসপাতালের তীব্র গন্ধে মিশে অ্যাক্সিডেন্টের শেষ দৃশ্যটা ফুটোর নাক মুখ কান সব দিয়ে মাথায় গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ আমিনা চাচীর চেনা কোলে শেষবারের মত মুখ গুঁজে ফুটো প্রতিজ্ঞা করে একদিন ফুটো রকির থেকেও বড় হবে। ঠিক তারপরেই ধান্ধা চৌপাট হওয়ার ভয়ে কোল ছেড়ে মাথা নামিয়ে ফুটো চোখ বুজে বিরিয়ানীর গন্ধ অনুভব করার চেষ্টা করে। চাচী বলে জাফরানে ভালো ঘুম দেয়…
*****************************************************
দীপাঞ্জন মাইতি পরিচিতি –
পেশায় ভূ-বিজ্ঞানী দীপাঞ্জনের কবিতা প্রচেষ্টা – জীবনের ছড়ানো ছেটানো অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। নারীজীবনের প্রাত্যহিকতার আবরণ ভাঙা যাপনের সান্নিধ্য,চুনী কোটাল সাহিত্য সম্মানে সম্মানিত দীপাঞ্জনের লেখনীকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। নিজস্ব সংকলন ‘পুনশ্চাত্মানুসন্ধানে’,‘তেরো’,’চারবাক’ ছাড়াও বাংলা,হিন্দি,ইংলিশ একাধিক কাব্য সংকলনে কবিতা এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে ফিচারও নিয়মিত প্রকাশিত হয় দীপাঞ্জনের। দীপাঞ্জনের লেখা একাধিক নাটক অভিনীতও হয়েছে। লেখালিখির পাশাপাশি সমাজসেবার কাজে ব্রতী দীপাঞ্জন দূর্গাপুর উমেনস্ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এবং অমৃতম্ এর সদস্য; এছাড়াও বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক সংগঠনের কাজের সাথে যুক্ত।
মোবাইলঃ ৭৭৯৭৬০০৫২৮