দুটি খুন ও পপা মাসীর গোয়েন্দাগিরি
প্রত্যুষ সেনগুপ্ত
।।এক।।
পমপম এক মনে ফাইলে চোখ বোলাচ্ছিল। গত সাতদিন ধরে যা ধকল গেলো। আরডিএক্স পাচারকারীদের ধরতে একরাত ধানক্ষেতে জল কাদা আর মশার মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল। পাশেই বাংলাদেশ বর্ডার। জলাজমি ছাড়ালেই আত্রেয়ী নদী। ওটা পেরোলেই পগার পার।
পমপম আজ অফিসে যাবেনা। বাড়িতে বসেই তাই কিছু কাজ এগিয়ে রাখছিলো। মুনের সঙ্গে দুপুরে একটা ছবি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে। মুন হলো পমপমের দিদির মেয়ে। ক্লাস ইলেভেন। মাসীর মতন গোয়েন্দা হতে চায়। আর মাসীর পয়েন্ট নাইন রিভলভার দিয়ে মনে মনে গুলি চালায় বদমাশদের উপর।
মোবাইলটা বেজে উঠলেই পমপম দেখলো ডিআইজি সাহেব তলব করেছেন। এক্ষুনি যেতে হবে। সিকিউরিটিকে ডেকে দ্রুত গাড়ি বের করতে বললো। ঝটপট জিনসের উপর সাদা টি শার্ট গলিয়ে ওয়ালেট আর বন্দুকটা নিয়ে বেরোতে যাবে তখনই ডাক,
– “পপা মাসী? পপা মাসী আজ যাবেনা?”
পমপমের মনটা একটু খারাপ হলো।
এই ফুটফুটে ভাগ্নীটি ছোট থেকেই ওর বাধ্য। যখন আধোআধো কথা ফুটেছে,তখন থেকেই পপা মাসী। পমপম বিশ্বাসের ডাক নাম আসলে পম্পা। ক’দিনের জন্য পপা মাসীর কাছে এসেছে। কোভিডের জন্য স্কুল বন্ধ অনেকদিন। আজ মাসীর সঙ্গে একটা সিনেমা ও কিছু মার্কেটিং করার কথা। মাসী ওর কাছে আদর্শ মানবী।
রাস্তার পাশে ঢালু ঝোপঝাড়ের মধ্যে বডি দুটো পড়েছিল। বালির চড়া আর আগাছাময় ঢালু জমি নেমে গেছে নীচের একটা বড়সড় নালায়। এ জায়গাটার জমি একটু বালুময়। এখান থেকে পঁচিশ ত্রিশ কিলোমিটার দূরেই হিমালয়ান রেঞ্জ। ওপরটা কিন্ত বেশ ঠান্ডা। প্রায় হাজার মিটার নীচে এই এলাকা আবার নাতিশীতোষ্ণ। তবে জুলাইয়ের দশ তারিখেই বেশ গরম লাগছে!
লাশ দুটো পলিথিন প্যাকেটে মোড়া। প্রায় পচাগলা অবস্থা। শরীরের অর্ধেকের মতন বালির ভিতর ঢোকানো। মনে হয় পুঁতে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো। কোনও কারণে হয়তো হয়নি। এখন সুরতহাল করতে হবে। বডি তুলতে বোঝা গেল যে দুটোই মেয়ে। পোকা থিকথিক করছে সর্বত্র, কয়েক মাসের এই দুটি পুরনো মৃতদেহতে। পমপম মনে মনে বললো প্রথমে দেখতে হবে খুনটা কবে হয়েছে। পলিথিনের মধ্যে দিয়ে ঝাপসা দেখা গেলো একজনের চুলের গোছায় গিজগিজে মাছির ডিম! পমপমের মনে হলো, এটা ওর তদন্তে সুবিধা করবে। জুওলজির পিএইচডি টা ওর আই.পি.এসে কাজে লাগবে এবার !
দুই।।
দুজনেরই চুলের ডগা থেকে প্রচুর মাছির ডিম পাওয়া গেল। সেগুলো আলতো ভাবে ফরসেফে তুলে ফর্মালিনে ডুবিয়ে দেওয়া হলো। নাক,মুখ ও চোখের ভিতর থেকে পাওয়া ম্যাগট (শূককীট) গুলো পমপম আলাদা ভাবে চেক করে নিলো। দুজনেরই হাইট পাঁচ সাড়ে পাঁচের কাছাকাছি। পমপম ভাবলো,ওর মতোই হাইট। ফরেনসিক রিপোর্টে লেখা রয়েছে একজনের উপরের পাটির ক্যানাইন ও পাশের প্রিমোলার দাঁত দুটি বসানো। এর বয়স বত্রিশের কাছাকাছি। আর এক জনের বয়স বছর চব্বিশের মতন হবে। দুজনেরই মৃত্যুর কারণ সাফোকেশন। মুখে বালিশ জাতীয় কিছু চাপা দিয়ে মারা হয়েছে। শ্বাসনালীতে কারও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। কোনও র্যাপচার নেই অর্থাৎ গলায় ফাঁসটাস কিছু হয়নি। তবে ভিসেরায় তীব্র সেডেটিভ মিলেছে।
পমপম একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলো না যে লাশ দুটো কোথা থেকে এনে ফেলা হয়েছে? ঠিক কতদূর থেকে? পাশেই তো হাইওয়ে।
মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে দেখা গেল চোখ মুখ নাক থেকে পাওয়া ম্যাগট গুলোর মাপ মোটামুটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ মিলিমিটার। পরীক্ষা করে দেখা গেল এগুলো “হাইপোনোমিউটা ম্যালিনেলাস” প্রজাতির মথ। সাদা পিউপাগুলিকে পাঠানো হলো মাইক্রোবায়োলজিকাল ইনস্টিটিউটের ল্যাবে যাতে এদের জীবনচক্র সম্পূর্ণ করা যায়,অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ মাছিতে রূপান্তরিত করা যায়।চোদ্দ দিন লাগলো এ কাজে! মৃতদেহে মাছির বৃদ্ধি শুরু হয়েছিলো পনেরো জুনের আগে। সম্ভবত জুন মাসের এক দুই তারিখে। জুওলজিকাল মিউজিয়াম অব হেলসিঙ্কি ইউনিভার্সিটির ডঃজুন্নিক্কালার বইয়ে পমপম দেখলো,এই প্রজাতির মথেরা মে মাসের একদম শেষ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ডিম পাড়ে।এই প্রজাতির মাছিরা মৃতদেহর প্রতি আকৃষ্ট হয় মৃত্যুর ছ’সাত ঘন্টার মধ্যে,অর্থাৎ রিগর মর্টিস (দেহ শক্ত হতে থাকা) শুরু হওয়ার পর পরই।
– আচ্ছা পপা মাসী,কোনও কমন মাছি একাজে লাগেনা?
-কেন লাগবেনা। মাছি প্রজাতির এটা একটা ধর্ম। স্যাঁতসেতে,রান্নাঘরে বোঁ বোঁ শব্দে ওড়া গাঢ় খয়েরী রঙের সারকোফ্যাজিডি পরিবারের এই মাছি বা মিষ্টির দোকানে গুড়ের ওপর ধুসর রঙের মাসকিডি পরিবারের ম্যুসকা নেবুলা বা ম্যুসকা ভেণট্রোসা মাছিগুলো তো দেখে থাকবি। এই মাছিরা কিন্তু মৃত দেহে ডিম পাড়ে সত্তর থেকে নব্বই দিনের মধ্যে,বুঝলি?
চুলের মধ্যে পাওয়া ডিমগুলি ক্যালিফোরা এরিথ্রোকেফালা প্রজাতির। ল্যাবেরটরিতে ডিমগুলি থেকে পিউপা ও পরের পর্যায় শেষ হতে সময় লাগলো চার দিনের মত। এই মাছিরা মৃতদেহে আসে কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ দিন পর।পমপম খুশীতে হাততালি দিয়ে উঠলো। এবার খুনীর খোঁজ করা সহজ হবে। কারণ মথের প্রজাতি মৃত্যুর প্রথম সপ্তাহেই মরদেহে আসে।
তা’হলে খুনটা হয়েছে জুনের প্রথম সপ্তাহে। আর ক্যলিফোরা মাছিরা এসেছে মাস খানেক পর। ডিম থেকে ম্যাগট হতে লাগে এক সপ্তাহ। এখানে লাগলো চার দিন। অর্থাৎ আরও তিন দিন আগে মাছিরা দেহতে ডিম পেড়েছে। আরেকটা ব্যাপার পমপমের মনে হলো,ক্যালিফোরা সাধারণত একটু হাই অলটিচুড পছন্দ করে,যা এখান থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরের জনবসতি এলাকায় হতেও পারে। আর এই মথ্ এখানেই মেলে। জুলাইয়ের দশ তারিখে দেহ দুটি পাওয়া গেছে। অঙ্কের হিসেবে খুন হয়েছে জুনের প্রথম সপ্তাহে আর মৃতদেহে মথ ঢুকেছে জুলাইয়ের ছ’সাত তারিখে। এর অর্থ খুন হয়েছে অন্যত্র। এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে প্রায় সপ্তাহ পাঁচ পরে! তা’হলে খুনী দেহগুলোকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল,কিন্তু কোথায় ?
।।তিন।।
সাড়ে তিন হাজার ফুট উচ্চতার এই আধা মহকুমা শহরে একটি মহিলা থানা সহ মোট আটটি থানা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখানে প্রায় সব কিছুই বর্তমান। শান্তিপ্রিয় অধিবাসীদের জন্য এখানে অপরাধ খুব কম। অ্যাডিশনাল এস পি (হেড কোয়ার্টার্স) পঙ্কজ শ্রীবাস্তব পমপমের ব্যাচমেট। পঙ্কজ জানিয়েছেন, গত তিন মাসে তাঁর এলাকায় চারটি থানায় মোট সাতটি নিখোঁজের ঘটনার এফ আই আর হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচজন মহিলা আর দু’জন পুরুষ। দুই বোন একসঙ্গে নিখোঁজ একটি থানায়। আর তিনটি মহিলা আলাদা ভাবে আরও দুটি থানায়।এফ আই আরের ডিটেইলড রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে,একসঙ্গে নিখোঁজ দুই বোনের বয়স পঞ্চাশের উপর। নিখোঁজ অন্য তিন মহিলার একজনের সঙ্গে বয়স, হাইট মিলে যাচ্ছে একটি মৃতদেহের। কিন্তু আরেক জন তাহলে কে?
-পপা মাসী,কী ভাবছো একমনে?
— একটা জিনিস মাথায় আসছেনা রে! দুটি দেহ পাওয়া গেলো একসঙ্গে, একজনের পরিচয় হয়তো জানা যাবে,কিন্তু..
— হয়তো অন্য কোথাও থাকে ওই জন। বন্ধু, আত্মীয়, ছাত্রী বা কোনও পরিচিতাও তো হতে পারে? মুনের স্মার্ট জবাব।
—ঠিক বলেছিস,আমিও সেটাই ভাবছি !
মহিলার পরিচয় জানা গেল। বছর পঁয়ত্রিশ।একটি কলেজের অধ্যাপিকা। বিবাহিতা মাধুরীর দাঁতের চিকিৎসা হয়েছিলো মাস ছয়েক আগে। স্বামীর ব্যবহার সন্দেহ জনক।মাধুরী নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ বাবদ দু’কোটি টাকা পেয়েছিলেন। এর ভাগ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় উনি অন্যত্র চলে যান।
-আপনি স্ত্রী কে খুন করলেন কেন?
-আমি খুন করিনি স্যার।
-টাকাগুলো কোথায় রেখেছেন?
-কিসের টাকা?
-না জানার ভান করছেন? এই টাকার ভাগ দাবী করে আপনি স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার মারধোর করেছেন।একবার এই নিগ্রহে ওঁর একটা দাঁত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই না?
(জবাব নেই)!
-আপনি স্ত্রীকে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন কেন?
(জবাব নেই)!
-সঙ্গের মেয়েটি কে? ওকে কেন খুন করলেন? দেখুন,মোটিভটা জলের মতন পরিষ্কার। টাকার জন্য খুন করেছেন স্ত্রীকে। কিন্তু অন্যজন কে?
ম্যাডাম,স্বপনবাবুই খুন করেছেন। আরেক জনের পরিচয়টা আর টাকাগুলো কি করেছেন,ওঁকে দু ঘা দিলেই তা বেরিয়ে আসবে। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার ইন্সপেক্টর ঝা একটানা বলে গেলেন। পমপমের কোনও উত্তর না পেয়ে বলতে থাকলেন,
-ম্যাম,হি ইজ ভেরী হার্ড নাট টু ক্র্যাক। ওঁর এগেনস্টে বরং 365,300,201,120,378,ধারা টারা দিয়ে একটা স্যুয়োমোটো কেস রেজিস্টার্ড করে কোর্ট থেকে পি এ কে দিয়ে আমাদের কাস্টডিতে নিয়ে নিই।এরপর জামাই আদরের ঠেলায় মুখ না খুলে যাবে কোথায় বাছাধন? পমপম নীরব থাকায় ইন্সপেক্টর ঝা নিশ্চিত হলেন।
সার্ভিস প্রোভাইডরের দেয়া কল লিস্টে দেখা গেলো মাধুরীর ফোনে গত ছয় মাসে তিনশো নব্বই টি কল এসেছিলো। এগুলোকে ঝাড়াই বাছাই করে মোট তিনটি নম্বর পাওয়া গেলো গত তিন মাসে যেগুলো থেকে প্রায় দু’শো কল এসেছে। এর মধ্যে অবশ্যই স্বপন আছেন। আর আছে মাধুরীর কলেজের অরিন্দম। তৃতীয় জন একটি মেয়ে। ঠিকানা খুঁজে দেখা গেলো তিনি হলেন পাশের জেলা সদরের বাসিন্দা এবং একান্ন বছর বয়সী স্বামী হারা এক প্রৌঢ়া পারমিতা।
।।চার।।
অদ্রিজা বেশ জেদী আর একগুঁয়ে। সম্পন্ন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হলে যা হয়। গত ফেব্রুয়ারীতে বাইশে পড়েছে। মাস্টার্স কমপ্লিট হতে না হতেই প্রেম। ছেলেটি নাকি কলেজে পড়ায়। প্রায় মাস আড়াই হতে চললো বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছে অদ্রিজা।
-আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতো?
-হ্যাঁ। নিজের ফোনে,কখনও বা ওর ম্যাডামের ফোনে।
-ম্যাডামের?
-ওর প্রাক্তন শিক্ষিকা।
-আপনার সঙ্গে ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে কখনো। আপনি চিনতেন?
-বহু বার। তবে সামনা সামনি দেখা হয়ে ওঠে নি। তবে…..
-তবে কি ?
-তবে চলে যাবার পর গত আড়াই মাস হলো কেউই ফোন ধরছে না। ওর স্বভাবটাই এমন। দীর্ঘ দিন কথা বন্ধ করে থাকতে পারে। তাই অবাক হইনি।
– একথা কাউকে জানান নি? মানে আত্মীয়, বন্ধু বা পুলিশকে?
– আসলে খুব ছোট বেলায় ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ও খুব একরোখা হয়ে যায়। আর কে কি ভাববে এইভেবে একথা পাঁচ কান করি নি। আমার মেয়ের কি কিছু হয়েছে স্যার? ফোনে কথা কাটাকাটি হলে ও দশ পনের দিন ফোন ধরতো না,কিন্ত ম্যাডাম ধরতেন!
– শেষ কবে মেয়ের সঙ্গে কথা হয়?
-ওই মাস আড়াই আগে। বললাম যে তারপর থেকে দু’জনে কেউই আর ফোন ধরছে না।
-অদ্রিজার কোনও টাকা পয়সা বা গয়নাগাটি কিছু ছিলো?
– হ্যাঁ।একটা ফিক্সড,ওর দাদুর দেওয়া,ম্যাচিওর করলে প্রায় ছাব্বিশ লাখ টাকা ও পায়, সেটাকা ও ব্যাঙ্কে রেখেছে। আর ওর ঠাকুমার প্রায় ত্রিশ ভরি সোনা ওর লকারে রাখা। ওর বিয়ের সময় লাগবে।
-নিখোঁজ ডায়েরীর পর থানা কি বলছে?
-ইনভেস্টিগেশন চলছে। কোনও ব্রেক আপ পেলে আমাকে জানানো হবে। তবে আজ পর্যন্তও কিছু জানানো হয়নি আমাকে থানা থেকে।
-আপনার কন্যার ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টটা দরকার। লকারটা কী শুধু ওঁর নামেই ছিলো?
-না,আমার সঙ্গে জয়েন্ট।
মে’মাসের শেষ সপ্তাহে অ্যাকাউন্ট থেকে পনেরো লাখ টাকা তোলা হয়েছে। লকারে প্রায় কিছুই নেই। রেজিস্টার থেকে দেখা গেলো ওই একই দিনে অদ্রিজা লকার রুমে এসেছিলো মাত্র দশ মিনিটের জন্য! এদিকে মাধুরীর ব্যাঙ্ক থেকে খবর পাওয়া গেলো ওর অ্যাকাউন্ট থেকে কোনও টাকা তোলা হয়নি! তাহলে?
।।পাঁচ।।
প্রিন্সিপাল আচার্য সাহেব জানালেন অরিন্দম ছুটিতে রয়েছেন। জুনের তিন তারিখ থেকে! আগস্টের দু’তারিখ জয়েনিং। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। দু বছর হলো কাজে যোগ দিয়েছেন। আঠাশ বছরের অরিন্দম রায় ছাত্র ছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয়। ওর বাড়ি সার্চ করে সন্দেহ জনক কিছু পাওয়া গেলোনা। কিন্ত রেলের চার্ট অনুযায়ী ওই দিন আর্য এক্সপ্রেসের এসি টু টায়ারে অরিন্দমের সঙ্গে অদ্রিজা ও মাধুরীরও কনফার্মড টিকিট ছিলো! একটি টিম তৈরি করে অরিন্দমকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসা হলো।
-আপনি ওদের খুন করে রেহাই পেয়ে যাবেন ভেবেছিলেন?
-কাদের কথা বলছেন?
-যাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে যেতে টিকিট কেটেছিলেন?
-সে কী? ওদের কি হয়েছে? কথাটা শেষ না হতেই আই ও এস আই পান্ডের সপাট চড়ে চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লো অরিন্দম!
-ন্যাকা সাজা হচ্ছে? রাগে কাঁপতে কাঁপতে পান্ডে বললো,
-ম্যাডাম,পারমিশন দিন। থার্ড ডিগ্রি দরকার শয়তানটার। দু’জন কে খুন করে,টাকা গয়না লোপাট করে এখন ভালো মানুষ সাজা হচ্ছো!
অরিন্দম হাউ হাউ করে কাঁদছিলো। পমপম দেখলো ওর ডান হাতে কনুইয়ের উপরে আঁচড়ের স্পষ্ট দাগ!
-এটা কীসের দাগ?পমপম এবার প্রশ্ন করে।
-অদ্রিজার আঁচড়!
-কীভাবে হলো?
-ম্যাডাম,ও খুব জেদী ও একরোখা। একটু মতের মিল না হলেই..! আরও দেখবেন?অরিন্দম একটু ইতস্তত করে জামা তুললো। দেখা গেল ওর ফর্সা পিঠ ও বুক জুড়ে প্রচুর আঁচড়ানোর চিহ্ন।
প্রায় বারো ঘন্টা ধরে টানা জেরা চলছে। এর মধ্যে অর্ধেক সময় ওকে বসিয়ে রাখা হয় একা। মানসিক চাপ বাড়ানোর খুব সাধারণ প্রচলিত কৌশল এটা। এর পর একজন মারমুখী ও পরেই আরেকজন খুব মিষ্টি করে,যেন কত আপনজন আর হিতাকাঙ্ক্ষীর মতন প্রশ্ন করবে। অনেক বড় অপরাধী এতে ভেঙে পড়ে। অথচ,এই ম্যারাথন জেরায় নতুন কিছুই জানা যায়নি। শুধু বলে চলেছে ও কিছু জানে না আর অদ্রিজারা সেদিন ওর সঙ্গে যায়নি! পমপমের হঠাৎ মনে পড়লো,একটা দিক তো জানা হয়নি। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে! ডকুমেন্টারি এভিডেন্স বা সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স সব সময় ঠিক কথা বলে না। সুতরাং আবার প্রশ্ন,
-সে দিন আপনাদের কি প্রোগ্রাম ছিলো? কী ভাবে যাবার কথা ছিলো?
।।ছয়।।
সুখেন শেষে সব কথা স্বীকার করলো। প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা আর ত্রিশ -পঁয়ত্রিশ ভরি সোনা একটি বড় পলিথিন ব্যাগে ওর ফ্ল্যাটের সেপ্টিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করলো পুলিশ।
সেদিন বেলা একটা নাগাদ অদ্রিজা মাধুরীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্যাঙ্কে যায়। টাকা ও গয়নাও তোলে ব্যাঙ্ক থেকে। এই করোনা পরিবেশে এই কাজে ঘন্টা তিনেক লেগে যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাঙ্কের কাজ মিটে যায় সেদিন। অরিন্দমের গাড়িতে ওরা এর পর একটা মলে কিছু মার্কেটিং করে। ফুড কোর্টে খাওয়াদাওয়া সারে। অরিন্দম স্টেশনে আসবে বিকেল পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু ওদের সব কাজ সারা হয় তিনটে সাড়ে তিনটের মধ্যে। গরম পড়ে যাওয়ায় মাধুরীর হঠাৎ শরীর খারাপ লাগে,আর এটাই ওদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মধ্য চল্লিশের সুখেন খুব বিশ্বাসী এবং লেখাপড়া জানা। ও যখন অদ্রিজাদের বললো যে দিদিরা ওর ফ্ল্যাটে বিশ্রাম নিতে পারেন,ওখানে এসিও রয়েছে কেউ আপত্তি করেনি। দিনদুপুরে কীসের আপত্তি? ওখানে পৌঁছালে সুখেন ওদের জল খেতে দেয়। ঠান্ডা জলে ছিলো তীব্র সেডেটিভ মেশানো। সুখেনের যা রোজ রাতে না খেলে ঘুম হয়না। পুলিশ ওর ঘর থেকে গোটা দশেক ওই ওষুধের পাতা বাজেয়াপ্ত করে। এই ডকুমেন্টারি এভিডেন্স অপরাধ প্রমাণে কাজে লাগবে। সুখেন জানিয়েছে, ওদের কাছের টাকা ও সোনাদানা ও দেখেছিলো। খরুচে সুখেনের কয়েক লাখ টাকা দেনা হয়েছিল বাজারে। অরিন্দম অদ্রিজা বা মাধুরীদের বিষয়টা অজানা ছিলো না। ওরা বলেছিলো একটু একটু করে সাহায্য করবে। কিন্তু নিজের ফ্ল্যাটে ওদের সঙ্গে এতগুলো সোনাদানা আর টাকা পয়সা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। ঠান্ডা হাওয়া আর ওষুধের তীব্রতায় ওরা ঘুমিয়ে পড়লে বালিশ চাপা দিয়ে ওদের খুন করতে হাত কাঁপেনি সুখেনের। ওদের এভাবেই ঘরে তালাবন্ধ করে স্টেশনে গিয়ে অরিন্দমকে জানায় অদ্রিজা দিদি বাড়ি ফিরে গেছে। ওরা আসবেনা। মাধুরী দিদির বাড়িতে ওদের নামিয়ে তবে স্টেশনে আসছে। আগেও বেশ কয়েক বার অদ্রিজা এমন করেছে। অরিন্দম তাই আশ্চর্য হয়নি। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ও ট্রেনে ওঠে এবং এই সম্পর্কে ইতি টানার চিন্তা ভাবনা করতে থাকে,তাই ফোনটোনও আর করেনি। সে রাত অন্যত্র কাটিয়ে পরদিন ফ্ল্যাটে ফেরে সুখেন। বডি দুটি মুড়ে ভাঁজ করে ওর বড় ফ্রিজে ঠেসেঠুসে রেখে দেয়। সোনাদানা টাকাকড়ি পলিথিন ব্যাগে করে সেপ্টিক ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখে। দেহ লোপাটের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সুযোগের। অবশেষে সুযোগ আসে মাস খানেকেরও পর। সুখেনের সঙ্গে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের অনেকেরই সেদিন ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিলো। এদিকে অরিন্দমের গাড়ির ছোট্ট একটু কাজ ছিলো। বিকেলে সাহেবকে বাড়ি পৌঁছে ও চলে যায় নিজের ফ্ল্যাটে। বড় দুটো পলিথিন ব্যাগে দেহ দুটি ভরে গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে লাশ দুটো ফেলে আসে। রুকস্যাক ফিরিয়ে আনে। পুঁতে রাখার প্ল্যান ছিলো,কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে নি। ইচ্ছে ছিলো কিছু দিন পর কোনও নতুন জায়গায় পালিয়ে গিয়ে নতুন ভাবে সব কিছু শুরু করবে।
খুব ফুরফুরে লাগছিলো পমপমের। মুন অসম্ভব খুশী। অনেক দিন পর পপা মাসী গাইছে। পপা মাসী কী সুন্দর সিন্থেসাইজার বাজায়,কবিতা লেখে। এই সকালে পপা মাসী স্নান করে একটা হলুদ শাড়ি পরেছে। কপালে ছোট্ট একটা কাঁচপোকা টিপ। চুলের ডগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে পড়ছে। মাসী সেই শান্তিনিকেতনে পড়বার সময় যখন রবীন্দ্রনাথের গান গাইতো,মনে হতো কোকিল ডাকছে। জুঁই ফুলের গন্ধ আসছে। মুন গলা মেলালো.. “আজ নিখিলের আনন্দ ধারায়..”! গান শেষ হলে মুন বলে উঠলো,
-পপা মাসী,তোমাকে না একদম মা সরস্বতীর মতন লাগছে! ঝটিতি পমপমের কপট রাগের উত্তর,
-পাকামো হচ্ছে?
।শেষ।
****************************************************
প্রত্যুষ সেনগুপ্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।