প্রিন্স
সুস্মিতা কর্মকার
চারিদিকে সাদা। একহাত দূরেও পরিস্কার কিছু দেখা যাচ্ছেনা। তুষার ঝড়ের মধ্যে বীথিমা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে। হাতে ধরা সেই পোর্সিলেনের পুরুষ পুতুলটা। আমি চিৎকার করে বলছি বীথিমা কোথায় যাচ্ছো? বীথিমাআআ…কিন্তু আমার গলার আওয়াজ কেউ শুনতে পাচ্ছেনা। বীথিমা কে আর খুঁজে পাচ্ছিনা! শুধু বরফের উপর পড়ে আছে পুতুলটা। হঠাৎ বিপবিপ আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। এলার্মটা অফ করে পর্দা সরিয়ে দেখলাম আজকেও বরফ পড়েছে। একেই সকালে অফিস যাওয়ার তাড়া। তার মধ্যে আবার বরফ পরিস্কার করো! একরাশ ব্যস্ততার মধ্যে একহাতে কফি আরেকহাতে বাবলিনের স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে বেরোবার সময় একবার হাচের কাচের দরজার পিছনে পুতুলটার দিকে তাকালাম। হ্যা আজকেও পুরুষ পুতুলটা ডানদিকে ঘুরে গেছে। হাতে ভায়োলিন, হাসিমুখে তাকিয়ে আছে নৃত্যরতা নারী পুতুলটির দিকে।
***
গাড়ি চালাতে চালাতে শুধু বীথিমা আর সেনদাজেঠুর কথা মনে পড়ছিল। নিঃসন্তান বীথিমা আর সেনদাজেঠু না থাকলে মায়ের চাকরিটা হয়ত ছাড়তে হত আর আমার দুপুরবেলাগুলোও ওরকম গান, গল্প, খেলা আর ভালবাসায় ভরাট থাকতনা। আমি দেশ ছেড়ে চলে আসাতে বীথিমাই বোধহয় সব থেকে একা হয়ে গিয়েছিল। আরও একা হয়ে গিয়েছিল সেনদাজেঠু এরকম সাত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ায়। দুবছর আগে বীথিমার সাথে শেষ দেখা হল, বললো,
– জানিস তোর সেনদাজেঠুর সাথে কিন্তু আমি রোজই কথা বলি। ঐ যে দেখছিস পোর্সিলেনের পুতুল দুটো? ও আমাকে হানিমুনে কিনে দিয়েছিল। বলেছিল, এটা আমি, প্রিন্স আর ওটা তুমি, আমার প্রিন্সেস। যখন আমি দূরে থাকব তখন প্রিন্সতো থাকবে। মনে কোরো আমিই আছি।তাই এখন আমি ওর সাথেই কথা বলি। ও আমার দিকে তাকিয়ে শোনে। যখন আমিও থাকবনা তখন আমিও ঐ প্রিন্সেস হয়ে যাব।
বীথিমার কথা শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। বলেছিলাম – কক্ষনো না! তুমি সবসময় থাকবে। জানো আমার অফিসের ডেস্ক সবার ছবি দিয়ে কি সুন্দর সাজিয়েছি। তোমার আর সেনদাজেঠুর ছবিও আছে। বীথিমা শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল-পাগলি!
***
গতবছর কলকাতা গিয়ে আর বীথিমাকে দেখতে পাইনি। বড্ড তাড়াহুড়ো করে বীথিমাও সেনদাজেঠুর কাছে চলে গেল। শুনলাম বীথিমার ভাইপো, অভিজিৎদা ওদের ফ্ল্যাটটা ফাঁকা করে দিয়েছে। বিক্রিও হয়ে যাবে শীগগিরই। আমি কলকাতা গিয়েছি শুনে অভিজিৎদা একটা বাক্স আমাকে দিয়ে গেল। তাতে বাবলিনের জন্য রাখা বীথিমার একজোড়া সোনার ঝুমকো আর সেই পুতুলদুটো।
প্রিন্স আর প্রিন্সেসকে আমি নিয়ে এসেছি। সাজিয়ে রেখেছি আমার হাচে। ন্যান্সি আমার হাউজকিপিং সাহায্যকারী। সপ্তাহে একদিন ঘর পরিস্কার করে দেয়। যতবার আমি প্রিন্সকে সোজা করে রাখি, ন্যান্সি ধুলো ঝাড়াপোঁছার পর আবার প্রিন্সেসের দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়। যেন প্রিন্সেসের দিকে তাকিয়ে হাসছে। পর পর তিন সপ্তাহ এই কান্ড হবার পর ন্যান্সিকে বললাম,
– তুমি কেন পুতুলটাকে ঘুরিয়ে রাখো বলোতো?
-কোথায় আমি তো রাখিনা! ওরকমই তো রাখো তোমরা!
মনে মনে বললাম-আমি রাখি? আশ্চর্য!
যাইহোক,আর কথা বাড়ালামনা।
****
গতসপ্তাহে ন্যান্সি মন্ট্রিয়েল গিয়েছিল। সেদিন সপ্তাহান্তের ঝাড়াপোঁছা আমাকেই করতে হল। প্রিন্সকে যথারীতি সোজা করে রাখলাম। যাক, এই সপ্তাহে আর কেউ ওকে ঘুরিয়ে রাখবেনা। পরদিন সকালে উঠে অফিস যাওয়ার সময় হাচের দিকে তাকিয়ে আমার বুক কেঁপে উঠলো! প্রিন্স ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে প্রিন্সেসের দিকে। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বাবলিনকে জিজ্ঞেস করলাম,
– হ্যারে হাচের পুতুলে হাত দিয়েছিস কেন? যদি ভেঙে যেত?
-নো মাম্মা, দিইনিতো!
সিঞ্চন তো গতকাল থেকে কনফারেন্সে শহরের বাইরে। ফিরতে এখনো দুদিন! তাহলে? বাবলিনকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরত এলাম। আজ আর অফিস যাবনা। ভাল লাগছেনা। আজ বাড়ি থেকেই কাজ করব। কাঁপা হাতে প্রিন্সকে আবার সোজা করে রেখে ল্যাপটপ অন করলাম। পরপর মিটিং আর ব্যাস্ততা। বাবলিনকে স্কুল থেকে এনে তাড়াহুড়ো করে খেতে দেওয়া৷ সকালের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ হাচের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা আবার কেঁপে উঠলো। দেখলাম প্রিন্স আবার ঘুরে গেছে প্রিন্সেসের দিকে। হাসিমুখে দেখছে নৃত্যরতাকে।
***
আজ সিঞ্চন ফিরেছে। দেখতে দেখতে সপ্তাহ কেটে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে সবজি কাটছিলাম। হঠাৎ সিঞ্চনের গলার স্বরে সম্বিত ফিরল।
-কিহল কিছু বললে না?
– কি বলবো?
-আরে এতক্ষণ যা বললাম! কিছু শোনোইনি? কি হয়েছে বলোতো তোমার? সারাক্ষণ কি ভাবছো?
সিঞ্চনকে পুতুলটার কথা বলতেই হল। সিঞ্চন শুরুতে একটু হেসে উঠলেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। রাতে শুতে যাওয়ার আগে দেখলাম সিঞ্চন প্রিন্সের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিযেন ভাবছে। ভাবছিলাম ওর সাথে বসে আরেকটু কথা বলব, ইতিমধ্যে বাবলিনের লাফালাফির আওয়াজে আবার উপরে ছুটলাম জোর করে ধরে ওকে বিছানায় শোওয়াতে। এদেশের বাড়ি ঘরের যা ছিরি! কাঠের মেঝেতে হাটাচলা করলেই মচ মচ করে আওয়াজ হয়ে বাড়ি কাঁপতে থাকে। বাবলিন লাফালে মনে হয় একতলার ছাদটাই ভেঙে পড়বে!
***
আজ সিঞ্চন আমার থেকে অনেক আগে ফিরেছে। আমি অফিস থেকে ফিরতেই দেখলাম মুখে মুচকি মুচকি হাসি।
– আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
শুনে আমার প্রাণটা নেচে উঠলো। নিশ্চই আজকে তাড়াতাড়ি ফিরে বিরিয়ানি বানিয়েছে। হাসিহাসি মুখে বললাম – বিরিয়ানি বানালে নাকি? গন্ধ পাচ্ছিনা তো? ও তাহলে কিছু কিনে এনেছ?
– নানা ওসব নয়। খেয়ে না্ও, বলছি।
হতাশ হলাম খানিকটা। খাওয়া পর্ব মিটলো।
– কোথায় তোমার সারপ্রাইজ?
-বলছি। তুমি আগে ঐ হাচের সামনে গিয়ে দাঁড়াও আর তোমার পুতুলটাকে সোজা করে রাখো। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে থাকো।
আমি এক সেকেন্ড থমকালাম। মনে হল এই সামান্য কাজটা করতে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।
প্রিন্সকে সোজা করে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।
-এবার লক্ষ্য করো।
সিঞ্চন খাওয়ার টেবিলের পাশদিয়ে এক পা এক পা করে হাটতে লাগলো। সিঞ্চনের প্রত্যেক পদধ্বনি আর আমাদের কাঠের মেঝের মৃদু কম্পনের সাথে সাথে প্রিন্স অল্প অল্প করে ঘুরছে। প্রিন্সেসের দিকে ঘুরে যাওয়ার পর একটা কিছুতে ঠেকে গেল। তারপর আর ঘুরছেনা,অল্প কাঁপছে শুধু।
-বুঝলে কিছু? মেঝে কাঁপলেই ঐ পুতুলটা নড়ে,নীচে একটা অমসৃণ জায়গা আছে। তাই খানিকটা গিয়ে ঠেকে যায়। ওদিকে সামান্য কাত হয়ে আছে পুতুলটা। তাই প্রিন্সেসকে সরিয়ে নিলেও ওটা ওদিকেই ঘুরবে।
***
আজ মাথাটা অনেক হালকা। অফিসে পৌঁছে সকালের কফিটা নিয়ে ডেস্কে গিয়ে বসলাম। সামনে জ্বলজ্বল করছে সেনদাজেঠু আর বীথিমার হাসিমুখে ছবিটা। মনে হল সেনদাজেঠুর চোখে যেন আজ একটু বেশী দুষ্টুমি। স্পষ্ট শুনলাম বীথিমার গলা,যেন বলে উঠলো-পাগলি!
(সমাপ্ত)
************************************************
সুস্মিতা কর্মকার পরিচিতিঃ
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যার থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। টোরন্টো,ক্যানাডায় ডেটা এনালিটিক্স পেশায় কর্মরতা। দুই সন্তানের মা। প্রিয় বিনোদন-সময় পেলে ছেলেমেয়ের পছন্দের নানারকম খাবার বানানো আর ফেসবুকে টুকটাক লেখা পোষ্ট করা।
ফোনঃ ১ ৬৪৭ ৫২২ ৪৮০৬
সুন্দর গল্প।
অসংখ্য ধন্যবাদ
অসাধারণ… ছোট্ট সাবলীল লেখায় রহস্যকে জিইয়ে রাখা এবং উন্মোচন দুটোই মনকে স্পর্শ করে গেলো। অপেক্ষায় রইলাম।ধন্যবাদ গার্গীকেও,লিংক শেয়ার করার জন্য।👍👍