Shadow

শান্তিনাথবাবুর বোধোদয় – চন্দ্রকান্তি দত্ত

শান্তিনাথবাবুর বোধোদয়

চন্দ্রকান্তি দত্ত

শান্তিনাথবাবু ও আদিনাথবাবু। এঁরা পাশাপাশি দুটি ঘরে বাস করেন। তবে এঁরা দুজন একে অপরের আত্মীয় নন। শান্তিনাথবাবুর আদি বাড়ি ঢাকা জেলার বারদি গ্রামে। আদিনাথবাবুর বাড়ি বহরমপুরে। দুজনেই কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন এবং যদুনাথ পুততুন্ড সেকেন্ড বাই লেনের বিখ্যাত সমাজসেবী শ্রীবনোয়ারীলাল তম্বাকুওয়ালার বাড়ির চারতলায় পাশাপাশি ভাড়ায় থাকেন। এঁদের বাসাদুটি আলাদা,কিন্তু সামনে বেশ বড় একটা খোলা ছাদ আছে যেটা দুভাগে ভাগ করা নেই। ছাদের এই খোলা অংশটা শুধু এঁরাই ব্যবহার করেন। অন্য বাসিন্দারা এই ছাদে আসতে পারেন না। কারণ,ছাদে আসতে হয় এঁদের কারও বাসার মধ্য দিয়ে। অন্য কোন পথ নেই। শান্তিনাথবাবু বন্দরে ঠিকাদারী করেন। অগাধ পয়সা করেছেন। তবে বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে গেলেও দার পরিগ্রহ করেন নি। কারণটা দ্বিবিধ-অল্প বয়সে পয়সা রোজগারের যুদ্ধে সময় হয়ে ওঠে নি। পরে যখন সময় হল, তখন মা-বাবা হারানো একমাত্র ভাগ্নীটিকে মানুষ করার দায়িত্ব এসে পড়ল। বয়স তার মাত্র পাঁচ। শান্তিনাথবাবু ভেবেছিলেন, এ দায়ভার বহন করা তাঁর পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলেন, একটি অত্যন্ত সুন্দর সম্পদ তিনি পেয়েছেন,যার কথায়,আচার-ব্যবহারে তিনি প্রতি মুহূর্তে মোহিত হয়ে যান। সংসারে এই একটিমাত্র মানুষকেই শান্তিনাথবাবু পছন্দ করেন,অন্তর থেকে স্নেহ করেন। সমাজের,বিশেষতঃ কলকাতা শহরের আর কাউকেই তিনি পছন্দ করেন না। বন্দরে তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা অকারণে ফাঁকি দেয়-এদের তিনি অপছন্দ করেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁর পাওনা-গন্ডা সময়মতো দেয় না-এদের প্রতি তিনি বিরক্ত। দোকানদার,মাছ-সব্জি বিক্রেতারা ওজনে ফাঁকি দেয়,আবার বেশী দামও চায় – এদের পছন্দ করা মানে এদের অসততাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কলকাতা শহরের গাড়ি-ঘোড়া,লোকজন কোন নিয়মের তোয়াক্কা করে না-এরা তো সভ্য সমাজের যোগ্যই নয়। এই সব কারণে কলকাতার গোটা সমাজটার সাথেই তাঁর একটা বৈরিতা গড়ে উঠেছে। পাশের বাড়ির আদিনাথবাবু যেহেতু এদেরই একজন,তাই সেখানেও শান্তিনাথবাবুর এই বৈরিতা সংক্রমিত হয়েছে। এক কথায়,আদিনাথবাবুকেও তিনি পছন্দ করেন না। সেদিন সন্ধেয় বাইরের খোলা ছাদে বসে চা খাচ্ছিলেন শান্তিনাথবাবু। সাথে ভাগ্নী করুণাও আছে। করুণা এখন বড় হয়েছে। কলেজে পড়ে। আদিনাথবাবু এখনও ফেরেন নি। তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ। কথায় কথায় আদিনাথবাবুর কথা উঠল।
করুনা বলল,”মামা! একটা কথা বলব? রাগ করবে না তো?”
শান্তিনাথবাবু চায়ের কাপটা হাত থেকে টেবিলে নামাতে নামাতে বললেন,”কেন রে মা,রাগ করব কেন? মায়ের কথায় ছেলে কি রাগ করতে পারে?”
– “বলছিলাম কি,পাশের বাড়ির কাকা তো বেশ ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। আমাদের খোঁজখবরও রাখেন। তাহলে ওকে তুমি পছন্দ করো না কেন?”
– “দূর বোকা! বাইরের ব্যবহারেই কি মানুষকে সবটুকু চেনা যায় নাকি? আরে ওরা হল এদেশি। রান্না-খাওয়া, চাল-চলন, সবই উদ্ভট ধরনের। এরা আবার সমাজে ভদ্রলোক হল কবে।”
– “এদেশি ওদেশি এসব নিয়ে আজকাল আর কেউ চর্চা করে না মামা। তাছাড়া,এদেশি বলে তো আর কাউকে ছোটলোক বলা যায় না,তাই না।”
শান্তিনাথবাবু চা খাওয়া ভুলে এক দৃষ্টে করুণার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর ছোট্ট ভাগ্নীটি যে এখন সপ্রতিভ আধুনিকা হয়ে উঠেছে, সেটা তিনি এতকাল বুঝতেই পারেন নি। তার বড় হয়ে ওঠাটা যেন আজই উপলব্ধি করলেন। কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললেন, “না! ঠিক তা নয়। তবে এই লোকটির জীবনযাত্রা কি খুব ভাল মনে হয় তোর? শুনেছি সংসার আছে। অথচ,এখানে ভূতের মতো একা থাকে। নিজেই তো দেখি রান্না-বান্না করে। আচ্ছা তুই-ই বল,যার সংসারের কেউ দেখা করতেও আসে না,এমন কি,একটা চাকর পর্যন্ত রাখে না,তাকে তোর খুব সুবিধের লোক বলে মনে হয়? আমার তো বাপু ব্যাপার-স্যাপার ভাল ঠেকে না।”
করুণা  কিছু না বলে শুধু হাসল। বলল,”দ্যাখো,কথায় কথায় তোমার চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেল। ছেড়ে দাও। আমি চা করে নিয়ে আসছি।”
– “না রে মা। এখনও ঠাণ্ডা হয় নি। বেশ লাগছে। তুই আমার কাছে একটু বোস।”
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে শান্তিনাথবাবু ভিতরে গেলেন। এসময়টা বৈঠকখানার লাগোয়া ছোট্ট অফিসঘরটায় বসে তিনি দিনের কাজের হিসেব-নিকেষ করেন। সাড়ে সাতটা নাগাদ করুণা কিছু জলখাবার দিয়ে আসে। কাজ সেরে উঠতে শান্তিনাথবাবুর প্রায় এগারোটা বেজে যায়। করুণাও শান্তিনাথবাবুর সাথেই চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। এখনও ভাল করে সন্ধে নামে নি। করুণা বেণী দুলিয়ে মৃদুস্বরে গান গাইতে গাইতে ছাদে পায়চারী করতে লাগল।
আদিনাথবাবুর দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। করুণা এগিয়ে এসে বলল,”কাকা! আজ দেরী হল যে বড়?”
করুণার কথার মধ্যে যে একটা উৎকণ্ঠা লুকিয়ে আছে সেটা টের পেয়ে আদিনাথবাবুর ভাল লাগল। বললেন,”একটু বাজার করে ফিরলাম রে মা। তোর এই বুড়ো ছেলেটাকে দেখাশোনার তো কেউ নেই। সব নিজেকেই করতে হয়। তাই দেরী হয়ে গেল। বড্ডো গরম পড়েছে। দ্যাখ না,কেমন ঘেমে নেয়ে উঠেছি।”
– “চা খাওয়া হয়নি তো?”
– “না। এই চান করেই খাব।”
– “আপনি চান করে আসুন। আমি ততক্ষণ চা বসাচ্ছি।”
– “বসাবি? তোর রাগী মামাটা আবার কিছু বলবে না তো?”
– “আমার মামা মোটেই রাগী নন। আপনি ওঁকে ঠিকমতো জানেনই না। কিন্তু আর দেরী করবেন না। বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি চানটা সারুন।”
– “ও হ্যাঁ! একটা নতুন চা এনেছি। দার্জিলিং। খাওয়ার টেবিলে রাখলাম। ওটা দিয়েই বানিয়ে ফেল। আর তোরও এক কাপ বসাতে ভুলিস না।” করুণা মৃদু হেসে আদিনাথবাবুর রান্নাঘরে প্রবেশ করল। গত দুদিন ধরে ঘূর্ণীঝড়ের দাপটে কলকাতা শহর প্রায় বিপর্যস্ত। প্রবল বৃষ্টি, সাথে ঝোড়ো হাওয়া। ফলে ঠান্ডাটাও বেড়েছে। সব বাড়ির জানালা দরজা বন্ধ। পথে লোকজনও কম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে পা রাখছে না। শান্তিনাথবাবু আজ সকাল সকাল ফিরেছেন। করুণা খিচুড়ি রান্না করেছিল। সাথে ফুলকপির বড়া। শান্তিনাথবাবু প্রায় গলা পর্যন্ত খেয়ে একটা লম্বা দিবা-নিদ্রা দিয়েছেন। এখন চা পর্ব চলছে। আদিনাথবাবু এই আবহাওয়াতেও কাজে গিয়েছিলেন। দরজা খোলার শব্দে জানা গেল তিনি ফিরেছেন।
করুণা কোনক্রমে চা-টুকু শেষ করে বলল,”কাকা এসেছেন। নিশ্চয় ভিজে গেছেন। দেখি গিয়ে।”
শান্তিনাথবাবু বিরক্তি প্রকাশ করলেন,”হ্যাঁ! দ্যাখ গিয়ে আবার অসুখ বাধালেন কিনা। আরে,এই দুর্যোগের দিনে একদিন কাজ থেকে ছুটি নিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? যতসব উদ্ভট কান্ড-কারখানা।”
করুণা কোন কথা না বলে আদিনাথবাবুর ঘরে গিয়ে ঢুকল। আদিনাথবাবু নিজে তো ভিজেছেনই,সাথে চুপচুপে ভেজা একটা পায়রার ছানাকেও নিয়ে এসেছেন। করুণাকে দেখে বললেন,”এসেছিস মা! দ্যাখ্ না,আসার সময় দেখি, সরখেলদের রোয়াকের পাশে পড়ে আছে। ওড়ার শিক্ষা হয় নি এখনও। মনে হয় ঝড়ের দাপটে বাসা থেকে পড়ে গেছে। ওখানে থাকলে কুকুর বেড়ালে খেয়ে নিত। তাই তুলে আনলাম।”
করুণা ছানাটাকে নিজের হাতে নিল। ছানাটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে যেন নিশ্চিন্ত। মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করছে আর ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছে।
“একটু আসছি” বলে করুণা ছানাটাকে নিয়ে শান্তিনাথবাবুর অফিসঘরে গিয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলল। তারপর ফিরে এসে পায়রার শুুশ্রূষায় লেগে গেল। আদিনাথবাবুকে বলল,”কাকা,আজ আপনি নিজেই চা তৈরী করুন। আমি ব্যস্ত আছি। আর হ্যাঁ! রাত্রে রান্না করবেন না। খিচুড়ি আর ফুলকপির বড়া খাওয়াব। কেমন।”
আদিনাথবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে পোষাক পাল্টে এসে রান্নাঘরে ঢুকলেন।
করুণার যত্নে পায়রা সুস্থ হয়ে উঠল। দিন দশেক পরে একদিন আদিনাথবাবু নিজের হাতে পায়রাকে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। পায়রা ডানা মেলে নীল আকাশে অন্তর্হিত হল। ওড়ার আনন্দে সে আত্মহারা। আদিনাথবাবু শান্তি পেলেন,কিছুটা নিজের ও বাকিটা করুণার শুশ্রূষার ফল দেখে। অন্যদিকে,শান্তিনাথবাবুর মানসিক শান্তিও কিছু কম হল না।
করুণার মুখে খবর পেয়ে বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললেন,”যাক! আপদ বিদেয় হয়েছে তাহলে।”
বিকেলে চা খাওয়ার সময় করুণা কথায় কথায় বলল, “আচ্ছা মামা! ছানাটা সকালে সেই যে উড়ে গেল,আর তো একবারও দেখতে পেলাম না। গেল কোথায় বলো তো?”
শান্তিনাথবাবু বললেন,”ওদের আবার যাবার জায়গার অভাব! সারা আকাশটাই তো ওদের জায়গা। তাছাড়া,এতক্ষণে পায়রাটা নিশ্চয় একটা দল খুঁজে নিয়েছে। দল ছাড়া ওরা থাকতে পারে না,জানিস তো!”
-“যাক বাবা! সেই ভাল। সঙ্গী-সাথী না পেলে বেচারা মরেই যাবে।”
মামা-ভাগ্নীর কথোপকথন পায়রাছানার কানে পৌঁছেছিল কিনা জানা গেল না। তবে এঁদের কথাবার্তার মাঝে,যখন সূর্য অস্ত গেল,প্রায় সেই একই সময়ে ছাদের পশ্চিমমদিকের কার্নিসে গোটা চারেক পায়রার আবির্ভাব ঘটল। ওদের বক-বকম শুনে করুণা দ্রুত চোখ তুলে দেখল,সারাদিনের ওড়াউড়ি সেরে ছানাটা ফিরে এসেছে। সাথে এনেছে আরও গোটা তিনেক সাথীকে। এরা মনে হয় আজ এখানেই আস্তানা গাড়বে। কারণ,অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ওদের ওড়াউড়ির সময়ও শেষ। করুণা এগিয়ে যেতে অন্য তিনটে পায়রা একটু তফাতে সরে গেল। কিন্তু ছানাটা করুণার কাঁধে এসে বসল। করুণা ওকে নিজের হাতে নেওয়ামাত্র ছানাটা চোখদুটো বুজে ফেলল।
করুণা কপট ধমক দিল,”এখন যে খুব আদর খাচ্ছিস,সারাদিন কোথায় ছিলি? আবার সঙ্গী জুটিয়ে আনা হয়েছে,না!”
করুণা কলকাতায় নেই। কলেজ থেকে এক্সকার্সনে গেছে রাজস্থান। ফিরতে এখনও বারো-তেরোদিন দেরী আছে। আদিনাথবাবু রোজকার মত পায়রাদের খাবার দিয়ে কাজে চলে গেছেন। শান্তিনাথবাবু আজ সকালে বন্দরে যান নি। এখন,বেলা প্রায় বারোটায় বেরিয়ে বনোয়ারীলালের গদিতে হাজির হলেন।
“আরে শান্তিনাথবাবু যে,নোমোস্কার। আসেন আসেন। বোসেন। বোলেন হোঠাত্ কি দোরকার পড়ল।” শান্তিনাথবাবুকে দেখামাত্র বনোয়ারীলাল উচ্চস্বরে বললেন।
-“এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম,একটু দেখা করে যাই। অনেকদিন সাক্ষাত হয় নি।”
-“বহুত ভালো কোরেছেন। একটু চা পিয়েন। এ রঘুনন্দন। শান্তিবাবুকে লিয়ে ফটিককা দুকান সে ইস্পেশাল চায় লে আও।  তুরন্ত।”
তারপর শান্তিনাথবাবুর দিকে ফিরে বললেন,”হাঁ। আউর বোলেন। কাম-ধন্ধা সব ঠিকমোতো চলছে তো?”
-“হ্যাঁ। কাম ধান্দা ঠিকই আছে। ঠিক নেই শুধু বাড়ির অবস্থা।”
-“কেনো কোনো? বাড়িতে কি হোলো? কেউ বিমার হোলো কি?”
“আজ্ঞে না। এখনও হয় নি। তবে এবার হবে। ঘর-দোর যা নোংরা করছে পায়রার দলটা,তাতে বিমারীর আর দেরী নেই মনে হচ্ছে।”
-“পায়রা,মতলব কবুতর? হামার বাড়িতে? ক্যায়সে হোলো? রঘু তো পয়সা লিতে হর মাহিনা ওখানে যায়। হমাকেতো কুছু বোললো না।”
-“আমার পাশের ভদ্রলোকটি,মানে আপনার ওই আদিনাথবাবু,একদিন কোথা থেকে একটা পায়রা কুড়িয়ে নিয়ে এলেন। মাত্র মাস দেড়েকের মধ্যে সে পায়রার সংখ্যা বেড়ে প্রায় গোটা তিরিশেক হয়েছে। আদিনাথবাবু সবকটাকেই খাওয়াচ্ছেন। এদিকে পায়রারা ঘর-দোর কি পরিমাণ নোংরা করছে আপনি না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। আমি তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আপনি এর একটা বিহিত করুন।”
-“হাঁ হাঁ! জরুর কোরবো। কেনো কোরবো না। আপনি হমাকে ভাড়া দেন। আপনার কোনো কোষ্ট হোলে তো হমার ভাল লাগবে না। হামি আজই সোনঝাবেলা আদিবাবুর সাথে কোথা বোলবো। বেয়স্থা একটা কোরতেই হোবে। আপনি কুছু ভাববেন না।”
সন্ধেবেলা রঘুনন্দন এসে আদিনাথবাবুকে ডেকে নিয়ে গেল। বনোয়ারীলাল গদিতেই ছিলেন। আদিনাথবাবুকে দেখে বললেন,”আসেন আদিবাবু,আসেন! নোমোস্কার। কেমন আছেন? বোহোরোমপুরের খোবোর সব ভালোতো?”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ। তারা সব ভালই আছে। রঘুনন্দনজী বললেন আপনি আমাকে ডেকেছেন। বলুন,আমি কি করতে পারি।”
-“হাঁ! বোলছিলাম কি,আপনি নাকি ঘোরে কবুতর পুষছেন?”
-“না! ঠিক তেমন নয়। কতকগুলো পায়রা ছাদে এসে বাসা করেছে। ওদের একটু গম-টম দিই আর কি।”
-“লেকিন আদিবাবু! জানেন তো,এই জংলী কবুতরগুলো বহুত বাড়ে। আর ঘর-দোর এতো নোংরা কোরে কি বাস কোরা যায় না। ফির,এগুলো তো বিমারীভী ফ্যায়লায়।”
-“না বনোয়ারীজী! এরকম পায়রা অনেক বাড়ির ছাদেই আছে। কই,রোগ-অসুখ কিছু এনেছে বলে তো শুনিনি।”
-“আপনি শুনেননি তো কি হোয়েছে। হামি তো শুনেছে। দেখেন আদিবাবু! হমার টেনান্টদের ওসুবিধা হোলে হমাকেই তো দেখতে হোবে। তাই বোলছি। আপনি কবুতরগুলোকে ভাগান।”
-“এতগুলো পায়রা আমি এখন কিভাবে তাড়াব বনোয়ারীজী? ওরা ওদের মতো থাকে। কারও ঘরেও ঢোকে না।”
-“দেখেন আদিবাবু! এক তো আপনি হমাকে বিনা পুছে কবুতর পুষছেন। ফির এখোন বোলছেন,ওদের তাড়াতে পারবেন না। তোবে তো আপনাকেই জবাব দিতে মজবুর কোরছেন। তাই বোলছি,আপনাকে হামি ঘর ছোড়াতে চাই না। লেকিন ওই কবুতরগুলোকে আপনাকে ভাগাতে হোবে।”
বিচক্ষণ আদিনাথবাবু ইঙ্গিতটা বুঝলেন। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন,”তাহলে ওই কথাই থাক। আমাকে দিন সাতেক সময় দিন। আমি অন্য বাড়ি খুঁজে উঠে যাচ্ছি। আচ্ছা নমস্কার।”
আদিনাথবাবু উঠে চলে এলেন। আসার সময় শুনলেন,তম্বাকুওয়ালা রঘুনন্দনকে ডেকে বেশ উচ্চস্বরেই বলছেন,”এ রঘুনন্দন,কল আগরওয়ালজী কো খবর দেনা। একঠো ঘর খালি হো রহা হ্যায়।”
করুণা আজ ফিরছে। শান্তিনাথবাবু তাই একটু সকাল সকাল বন্দর থেকে ফেরার ব্যবস্থা করলেন। করুণা না থাকায় কয়েকদিন ঘরটা খালি হয়ে গিয়েছিল। শান্তিনাথবাবু খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। এদিকে,আদিনাথবাবুও হঠাৎ করে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কোথায় গেছেন কিছু বলে যাননি। বলার কথাও হয়ত ছিল না। কারণ, তাঁর যোগাযোগ বা সম্পর্ক সবই করুণার সাথে। তার মামার সাথে নয়। ওঁর ছেড়ে যাওয়া ঘরে পরদিনই নতুন বাসিন্দা চলে এসেছে। এরা আবার অবাঙ্গালী। শান্তিনাথবাবুর উৎকণ্ঠা করুণাকে নিয়ে। কি বলবেন তিনি ওকে? বলবেন কি যে,এই অঘটনটা তিনি নিজেই ঘটিয়েছেন। না,তা তিনি বলতে পারবেন না। একমাত্র ভাগ্নীর কাছে এতটা অপ্রিয় হওয়া পোষাবে না। শান্তিনাথবাবু সাত-পাঁচ ভেবেও যুৎসই জবাব ঠিক করতে পারলেন না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখলেন, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ-করুণা এসে পড়েছে।
শান্তিনাথবাবু ঘরে ঢোকার পর,পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া শেষ হতেই,শান্তিনাথবাবুর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে করুণার দিক থেকে প্রশ্নবান উড়ে এল,”মামা,এরা কারা? এরা কবে এল? কাকা কোথায়?”
শান্তিনাথবাবু হাত তুলে করুণাকে শান্ত করলেন,”বলছি বলছি,দাঁড়া। তোর কাকা কোথায় গেছেন জানি না। হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা দেখলাম, উনি ফেরেন নি। ভাবলাম,হয়ত বাড়ি গেছেন। কিন্তু পরদিন বুঝলাম,উনি ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। কেন না, এরা সেদিনই এই ঘরে বাস করতে এলেন। উনি যে কখন গেলেন, কোথায় গেলেন, কেনই বা গেলেন, কিছুই জানিয়ে গেলেন না। তোকে বলেছি না,মানুষটা অদ্ভুত ধরনের,মানে বেশ রহস্যময়।”
শান্তিনাথবাবু ওঁর প্রতিবেশীর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে কথা বললেও করুণা কিন্তু অন্য কথা ভাবতে লাগল,’কি এমন ঘটনা ঘটল যে কাকা এভাবে চলে যেতে বাধ্য হলেন! ওঁর মত নির্বিরোধী ভালমানুষকে কে এভাবে চলে যেতে বাধ্য করতে পারে। বাড়িওয়ালা কি? তাই হবে হয়ত। নাহলে,পরদিনই নতুন ভাড়াটিয়া চলে আসত না। কিন্তু কেন? একবার দেখা হলে জানা যেত। কাকা আমার কাছে কিছু লুকোতেন না।’
বিমর্ষ করুণা নিঃশব্দে সংসারের কাজে লেগে গেল। শান্তিনাথবাবু করুণার মনের ভাব উপলব্ধি করতে পারলেন,কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না।
শান্তিনাথবাবুদের মামা-ভাগ্নীর সংসার আগের মতোই চলতে লাগল। বাইরে থেকে ছন্দপতনের কোন আভাস-ইঙ্গিত চোখে পড়ছে না। কিন্তু সেটা আপাতদৃষ্টিতে। কারণ,সামান্য হলেও,অশান্তির একটা চোরা স্রোত ফল্গু ধারার মতই দুটি মানুষের মধ্যে বয়ে চলেছে। বিগত কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বে শান্তিনাথবাবু কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। করুণা প্রথম দিনের পর থেকে কথাচ্ছলেও আদিনাথবাবুর কথা বলে না। তবে কি করুণা আদিনাথবাবুর চলে যাওয়াটাকে কোন গুরুত্বই দেয় নি? হতেও পারে। কিন্তু তবু শান্তিনাথবাবু করুণার এই শান্ত,নিরুদ্বিগ্ন মূর্তি দেখে প্রতিনিয়ত অশান্তির আগুনে পুড়ছেন। যে হাসিখুশী প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েকে প্রতিদিন দেখতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন,আজ সেই মেয়েই এক পরিবর্তিত নারীরূপ দেখাচ্ছে। শান্তিনাথবাবুর কাছে করুণার এই পরিবর্তন স্বাভাবিক নয়,সময়োপযোগীও নয়। যে করুণা প্রতিবেশী আদিনাথবাবুর সাথে প্রায় পিতা-পুত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল,সেই করুণাই পাশের নতুন আবাসিকদের সাথে আলাপটুকুও করেনি। এমন কি,অত সাধের পায়রাদের দেখাশোনা বা খাওয়ানোর কিছুই সে করে না। পায়রাদের ভার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নতুন বাসিন্দারাই নিয়েছে। আদিনাথবাবুর হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণটা শান্তিনাথবাবু আজও সঠিক বুঝতে পারেন নি। কিন্তু এটা বিলক্ষণ জানেন যে,মাঝে যা-ই ঘটুক,এই অবাঞ্ছিত ঘটনার সূত্রপাত তিনি নিজেই করেছেন। আজ উপলব্ধি করছেন যে,কাজটা বোধহয় ঠিক হয় নি। তিনি আদিনাথবাবুকে কিছুটা জব্দ করতে চেয়েছিলেন ঠিকই,কিন্তু একেবারে বাড়িছাড়া করতে চান নি। এর প্রভাব যে করুণার উপরেও পড়তে পারে,সে কথাটা তখন একবারও মাথায় আসে নি।
বাড়ি ফিরছিলেন শান্তিনাথবাবু। কন্ডাক্টার ভাড়া চাইল। ভাড়া দিয়ে টালিগঞ্জের নাম করতেই কন্ডাক্টার বলল,”এ বাস তো টালিগঞ্জ যাবে না কাকা। আপনি ভুল বাসে চেপেছেন। এটা বরানগর যাবে।”
“অ্যাঁ! তাই?” বলেই শান্তিনাথবাবু জানালা দিয়ে বাইরে দেখলেন। সত্যিই তো! রোজকার চেনা পথের বাইরে অন্য পথ দিয়ে বাসটা যাচ্ছে।
“থাক! ভাড়া দিতে হবে না। আপনাকে সামনের স্টপে নামিয়ে দিচ্ছি। উল্টোদিক থেকে সাঁইত্রিশের ‘বি’ পাবেন। ওটা টালিগঞ্জ যাবে।” কন্ডাক্টার ছেলেটি বলল।
-“না না! তুমি এ পর্যন্ত ভাড়াটা নাও।”
-“না কাকা! থাক না! আপনাকে এমনিতেই বেশী ভাড়া দিতে হবে।” কন্ডাক্টার ছেলেটি অন্যদের থেকে আলাদা।
শান্তিনাথবাবু রাস্তা পার হয়ে যথাস্থানে দাঁড়ালেন। সতর্ক তাঁর দৃষ্টি। এবার আর ভুল করা চলবে না। একটা বাস দাঁড়িয়ে আবার ছেড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। শান্তিনাথবাবুর মতোই কেউ হয়ত ভুল বাসে চড়েছিল। আজ কি সবারই ভুল করার দিন? কিন্তু না। ঘটনাটা মনে হচ্ছে অন্যরকম। এক ভদ্রলোক বাস থেকে নেমে সোজা তাঁরই দিকে হাসিহাসি মুখে আসছেন। কাছে আসতেই শান্তিনাথবাবু চিনতে পারলেন-আদিনাথবাবু।
“দাদা নমস্কার! ভাল আছেন? আপনাকে দেখেই বাস থামিয়ে নেমে এলাম। এদিকে কোন কাজে এসেছিলেন বুঝি?” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আদিনাথবাবু থামলেন।
আদিনাথবাবুর হঠাৎ আবির্ভাবে হতচকিত শান্তিনাথবাবু একটু আমতা আমতা করতে লাগলেন,”না মানে,ভালই আছি। এদিকে আসাটা,মানে একরকম হঠাৎ করেই। তা,আপনি ভাল আছেন?”
-“আমি ভালই আছি। আপনার হাতে কি একটু সময় আছে? তাহলে আসুন না আমার ওখানে। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। আমি কাছেই থাকি। পরের স্টপেই নামতাম।”
-“না,মানে সময় খুব একটা নেই। তবু —–চলুন। আপনার বাসাটা দেখেই যাই।”
যেতে যেতে আদিনাথবাবু প্রশ্ন করলেন,”আচ্ছা দাদা! আমার মায়ের খবর কি? কেমন আছে সে?”
এবার শান্তিনাথবাবুর কথার ব্যাপ্তি বাড়ল। বললেন,”তার কথা আর জিজ্ঞাসা করেন কেন? এদিকে মা বলছেন,আবার সেই মাকেই কিছু না জানিয়ে চলে এলেন। এরপর আর সে কেমন থাকতে পারে বলুন!”
আদিনাথবাবু লক্ষ্য করলেন,শান্তিনাথবাবুর কথাগুলো আজ যেন ঠিক মুখ থেকে নয়,তাঁর অন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে। রুক্ষ স্বভাবের বাইরে তাঁর এই অন্য রূপ আদিনাথবাবু আগে প্রত্যক্ষ করেন নি। শান্তিনাথবাবু কি কোন বিষয়ে চিন্তিত?
আদিনাথবাবু বললেন,”জানি খুব খারাপ হয়েছে কাজটা। হঠাৎ করেই চলে আসতে হল। কেন জানি না,বনোয়ারীজী খুবই রূঢ়ভাবে বাড়ি ছেড়ে দিতে বললেন। তাছাড়া,করুণা তখন কলকাতায় ছিল না। আর আপনাকে বলতে সাহস হয় নি। আপনি তো আমাকে পছন্দই করেন না।”
দুজনে আদিনাথবাবুর বাসার কাছে পৌঁছে গেলেন। চকমেলানো পুরনো এক বিশাল বাড়ি। উঁচু দাওয়া,উঁচু ছাদ। তবে পুরনো হলেও,নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের গুণে প্রায় নতুনের মত দেখাচ্ছে। আদিনাথবাবু একতলাতেই থাকেন। একতলার অন্য অংশে আরও এক পরিবার আদিনাথবাবুর মতই ভাড়ায় থাকেন। বাড়ির মালিক থাকেন দোতলার পুরো অংশটা নিয়ে। ভিতরে ঢুকে শান্তিনাথবাবু চমৎকৃত। কোথায় বনোয়ারীজীর চারতলার ঘুপচি ঘর আর কোথায় আদিনাথবাবুর নতুন বাসা। দুটোতে কোন তুলনাই চলে না। আদিনাথবাবুর বাসায় দুটি বড় ও একটি ছোট কামরা। ছোট কামরার আয়তনই বনোয়ারীর ঘরের প্রমাণ মাপের কামরার সমান। এরপর যখন শুনলেন যে,মাসিক ভাড়ার পরিমাণ আগের বাসার চেয়ে কিছু কম, তখন শান্তিনাথবাবুর বিস্ময়ের আর সীমা-পরিসীমা থাকল না। বললেন,”বলেন কি মশায়! এত অল্প ভাড়ায় একটা আস্ত জমিদার বাড়ি নিয়ে আছেন দেখছি। তা,আমাকেও একটা দিন না।”
-“এ বাড়িতে তো আর ঘর খালি নেই। ল্যান্ড লর্ড বাড়ির নীচটা দুভাগে ভাগ করলেও উপরটা করেন নি। সপরিবার সেখানেই থাকেন। কিন্তু আপনি কি সত্যিই বাসা খুঁজছেন? তম্বাকুওয়ালা কি আপনাকেও কিছু বলেছে?”
-“না,সেরকম কিছু নয়। ও বাড়িতে আর মন টিকছে না। তাছাড়া,বয়স হচ্ছে তো। রোজ রোজ  ওই চারতলায় ওঠাটাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
-“তাহলে চলুন না,উপরে মিত্রবাবুকে বলি। উনি এখানকার পুরনো লোক। এ অঞ্চলটা খুব ভাল চেনেন। হয়ত কোন খালি বাসার সন্ধান দিতে পারবেন।”
-“না না। এখন আর ওঁকে বিরক্ত করব না। চেনাজানা নেই। হঠাৎ গিয়ে বাড়ির খোঁজ করলে কি ভাববেন?”
-“না দাদা! সে চিন্তা নেই। ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুব ভালমানুষ ও মিশুকে। আসুন না,ভাল লাগবে।”
“প্রভা। চায়ের জলটা আরও দুকাপ বাড়িয়ে দাও। আদিদা এসেছেন,সঙ্গে অতিথি। দরজায় আদিনাথবাবু ও শান্তিনাথবাবুকে দেখামাত্র মিত্রবাবু স্ত্রীকে জানালেন। তারপরই শোনা গেল তাঁর অতিথি সম্ভাষণ,”আসুন আদিদা,আসুন।”
শান্তিনাথবাবুকে দেখে একগাল হেসে বললেন,”নমস্কার! আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আদিদার পুরনো প্রতিবেশী! কি,ঠিক বলেছি তো?”
শান্তিনাথবাবু যেন অবাক হতেও ভুলে গেলেন,”আপনি আমাকে চেনেন?”
-“চিনি মানে। বিলক্ষণ চিনি। আর শুধু আপনাকেই নয়,আপনার ভাগ্নী,কি যেন নাম,করুণা-ওকেও জানি। তা সে কই? তাকে আনেন নি?”
চমৎকৃত শান্তিনাথবাবু কোনক্রমে বললেন,”না! আমি তো কর্মক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে এসেছি।”
-“তা এসেছেন বেশ করেছেন। আবারও আসবেন। তবে এবার যখন আসবেন,আপনার ভাগ্নীকেও সাথে আনবেন, কেমন!”
আদিনাথবাবু সুযোগটা ছাড়লেন না। বললেন,”মাঝে মাঝে কেন! দাদা তো ওবাড়ির পাট চুকিয়ে এদিকেই আসতে চাইছেন। আছে নাকি আপনার সন্ধানে কোন বাড়ি?”
“তাই নাকি? তবে তো ভালই হবে। এক বাড়িতেই সকলে থাকা যাবে।” মিত্রবাবু সোৎসাহে জবাব দিলেন।
“সে কি মিত্রদা! আপনার এখানে জায়গা কোথায়? আপনি কি নতুন লোক দেখে আমাকেই উৎখাত করতে চান নাকি?” আদিনাথবাবু কপট গাম্ভীর্যে বললেন।
“আরে না না দাদা,আপনি না। আপনার পাশের ভটচাজবাবুর কথা হচ্ছে। মাস দুয়েক হল উনি রিটায়ার করেছেন। সেদিন যা বলছিলেন,সামনের মাসের প্রথম দিকেই হয়ত আসানসোলের বাড়িতে ফিরে যাবেন। আজ হল গিয়ে বারো তারিখ। তা মোটামুটি মাস খানেকের মধ্যেই ঘরটা খালি হচ্ছে। শান্তিদা তখন চলে আসুন না এখানে।” মিত্রবাবুকে বেশ উৎসাহী দেখাচ্ছে।
চা এসে গিয়েছিল। সঙ্গে কিছু টাও। মিত্রবাবুর স্ত্রীও আলোচনায় যোগ দিলেন,হ্যাঁ! সে-ই ভাল। আপনারা তিন বুড়োতে যত খূশী আড্ডা দেবেন। আমি আমার নতুন মেয়েকে নিয়ে থাকব। বাড়িতে একটা ছেলেপুলে পর্যন্ত নেই যে দুটো কথা বলি। কেমন যেন খেতে আসে বাড়িটা। করুণা এলে আমি অন্তত একটা সঙ্গী পাবো।”
শান্তিনাথবাবু এঁদের উৎসাহের ঘটা দেখে বেশ পুলকিত। ঠোঁটের কোণায় এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন,”তাহলে চলেই আসি, কি বলেন। আর হ্যাঁ। অগ্রিম কত লাগবে আর মাসে কত করে দিতে হবে যদি বলেন!”
“আরে দূর মশায়! কিসের অগ্রিম? ওসব আমার লাগে না। ভগবান আমাকে জীবনে দুহাত ভরে দিয়েছেন। ভাড়াটাও না নিলে হত। তবে এতবড় বাড়ি,রক্ষণাবেক্ষণের খরচও তো অনেক। তাই ওটুকু নিতে হয়। আর মাসিক ভাড়ার পরিমাণ আপনি আপনার বন্ধুর কাছেই জেনে নেবেন।” মিত্রবাবু সহাস্যে জবাব দিলেন।
* * *
না। আজ আর সাঁইত্রিশের ‘বি’ নয়। একটা ট্যাক্সিই ধরলেন উৎফুল্ল শান্তিনাথবাবু। যাত্রাপথে ভাবছিলেন,’বড় সুন্দর একটা দিন আজ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল আজকের ভুল বাসে উঠে পড়ার ঘটনাটা। ঘটনাটাকে এখন আর নিছক ভুল বলা যাচ্ছে না। সবই যেন বিধি নির্ধারিত। প্রত্যেকটি ঘটনার মধ্যে অদ্ভুত একটা যোগসূত্র আছে। ভুল বাসে না চাপলে অমন অসাধারণ মনের কন্ডাক্টার ছেলেটির সাথে দেখা হত না। আবার ছেলেটি এখানে না নামালে আদিনাথবাবুকে খুঁজে পাওয়া যেত না। আর,আদিনাথবাবুকে না পেলে নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত টুকুও বাকি থেকে যেত। হ্যাঁ! প্রায়শ্চিত্তই বটে। আদিনাথবাবুর পাশে ফিরে এসে করুণাকে শান্তি দেবেন তিনি। বড় ভুল হয়ে গেছে একটা।’ শান্তিনাথবাবু যেন আজ সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্ত। অশান্তির আগুনটা কখন নিভে গেছে,জানতেও পারেন নি। ‘বাড়ি ফিরে করুণাকে সব বলতে হবে। ওর মনের কষ্টটা আজই কমানো দরকার’।
ট্যাক্সিটা ময়দানের প্রায় নির্জন রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে। শান্তিনাথবাবুর মনে একটু দুষ্টুমির ছোঁয়া-‘আচ্ছা,করুণাকে কথাটা আজকে না বলে একটা চমক দিলে কেমন হয়! হ্যাঁ,সেই ভাল। চমকই দেওয়া যাবে ওকে। এতে মনে হয় কষ্টটা খুব একটা বাড়বে না’
চলমান ট্যাক্সিতে বসে সময়ের বহমানতার উল্টোদিকে ফিরে চাইলেন শান্তিনাথবাবু। ছেলেবেলাটা উঁকি দিচ্ছে কি? শান্তিনাথবাবু অনেকদিন পরে আজ প্রাণভরে নির্মল আনন্দে হেসে উঠলেন।
****************************************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে, তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও, শারীরিক অসুস্হতার কারণে  লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন, চাকরী থেকে অবসরের পরে, প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
মোবাইল – ৮৩৩৫৯৯৫৫৬৯।

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!