Shadow

দ্বিতীয়া‌

woman-মৃগাঙ্ক‌‌ ‌‌ভট্টাচার্য‌

–  আপনার স্ত্রীর অসংলগ্ন আচরণ আপনি প্রথমবার লক্ষ করেছিলেন গত বছর পয়লা জানুয়ারি কী তাই তো ? সেদিন একজ্যাক্টলি কী হয়েছিল আর একবার শুরু থেকে বলুন প্লিজ

-ডুয়ার্সে গতবার পয়লা জানুয়ারির ভোর থেকে শুরু হয়েছিল ধুন্ধুমার বৃষ্টি আমি গভীর ঘুমে ডুবে ছিলাম আমাকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলেছিল বিপাশা আমি ধড়মড় করে উঠে ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হচ্ছে দু’এক মুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম বাড়ি দুলছে না কাঁচের জানলার বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে একটু ধাতস্থ হয়ে দেখি বিপাশা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ? বিপাশা নার্ভাস গলায় বলল আর বেঁচে নেই

 – বেঁচে নেই মানে ?

-প্রথমে ভেবেছিলাম ঠাট্টা করছে কিন্তু পরমুহূর্তে বুঝলাম যে তা নয় বিপাশার চোখেমুখে একটা বিহ্বল ভাব ভাবলাম বাজে স্বপ্ন দেখেছে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললাম, রিল্যাক্স একটু জল খেয়ে এসো উত্তরে বিপাশা অস্ফুটে বলল, মাঝরাত থেকেই ওর মনে হচ্ছিল ওর শরীরের সমস্ত অর্গান অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে৷ পায়ের পাতা দিয়ে শুরু হয়েছিল তারপর দুটো হাঁটু তারপর এক এক করে উবে গেছে বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

–  তারপর ?

–  বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছিল বিপাশা তাকিয়ে দেখে আয়নার কাঁচে ওর প্রতিবিম্ব পড়ছে না তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলেছিল প্রথমে ভেবেছিলাম মজা করছে কিন্তু সিরিয়াস টাইপ মেয়ে ভোরবেলা স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে ইয়ার্কি করার মেয়ে নয়

–  সেদিন থেকেই কি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন উনি ?

ওটা একদিনে ছাড়েনি, গ্র্যাজুয়ালি ছেড়েছে তবে সেদিন থেকেই বিপাশা ভাবতে শুরু করে যে ওর শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গায়েব হয়ে গেছে কিন্তু যখন নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ পাচ্ছে তার মানে বিদেহী অবস্থায় আছে আর শরীরই যখন নেই তখন খাওয়ার প্রয়োজন নেই

আপনার ফ্ল্যাটে কে কে থাকে ?

–  আমরা দুটি মাত্র প্রাণী একজন কাজের মাসি আছে

আপনার স্ত্রীর দু‘-দুবার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে বলছিলেন সেজন্য ট্রিটমেন্ট করাননি ?

একজন ইনফার্টিলিটি স্পেশালিস্টকে দেখান হয়েছে তার আন্ডারেই ট্রিটমেন্ট চলছিল এদিকে এমন একটা সমস্যা বাধিয়ে বসল…  আচ্ছা স্যার ওর এই রোগটা কী কারণে ?

জুল কোটার্ড নামে এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ  ১৮৮০ সালে এই রোগ আবিষ্কার করেছিলেন এর নাম দ্য ডিলিরিয়াম অফ নিগেশন অর্থাৎ যে রোগে সবকিছু অস্বীকার করার মতো মানসিক পরিস্থিতি তৈরি হয় এর মুল কারণই হল ডিপ্রেশন আপনার স্ত্রী গভীর ডিপ্রেশনে ভুগছেন সন্তানহীনতা তার একটা কারণ হতে পারে

এই রোগে কি মৃত্যু অবধি হতে পারে ?

সরাসরি মৃত্যু হয় না কিন্তু এই রোগ মানুষকে এমন এক মানসিক অবস্থায় ঠেলে দেয় যে কোনও না কোনও ভাবে মৃত্যু অপরিহার্য হয়ে ওঠে পশ্চিম দেশে একে বলে জন্বি রোগ এমন এক রোগ যাতে মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটেকিন্তু তার হাতপা সচল থাকে সর্বগ্রাসী এক খিদে নিয়ে সে রোগে আক্রান্ত মানুষের বোধ বুদ্ধি লজ্জা ঘেন্না ভয় কিছুই থাকে না। চরম পর্যায়ে গেলে একজন রোগী বাইরের জগৎ থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেদিক দিয়ে সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে এর খানিকটা মিল আছে।

-বিপাশার কি এই রোগই হয়েছে?

জন্বি বা কোটার্ড ডিজিজে আক্রান্ত মানুষের প্রধান উপসর্গ হল নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার এটাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় রোগের গতিপ্রকৃতি হয় আক্রান্ত মানুষ নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, নয়তো সে মনে করে তার শরীরের কোনও অংশ অদৃশ্য হয়ে গেছে ঘাবড়াবার কিছু নেই আপনি একদিন ওঁকে আমার চেম্বারে নিয়ে আসুন

ইয়ে মানে আমি বিপাশার জন্য আপনার কাছে আসিনি স্যার আমি এসেছি নিজের জন্য জানি অবাক হচ্ছেনহয়তো বিরক্তও হচ্ছেন।কিন্তু ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই আপনি বুঝবেন।বিপাশাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখে আমি নিজেই মানসিক রূগি হয়ে গিয়েছি এই জটিলতা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই আপনার কাছে এসেছি

আই কান্ট গেট ইউ আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না আপনার সমস্যাটা একজ্যাক্টলি কী ?

অসুস্থ হবার পর বিপাশা প্রথম প্রথম তাও আমার সঙ্গে কথা বলত পরের দিকে হাজার ডেকেও সাড়া পেতাম নাকোনও কথা জিজ্ঞেস করলে চুপ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত আমার কথা শুনছে কি শুনছে না কিছুই বোঝা যেত না মনে হত মড়া মানুষের সঙ্গে ঘর করছি যতদিন সুস্থ ছিল ততদিন সংসারের সমস্ত ঝক্কি সামলাত বিপাশাকিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমি জলে পড়ে গিয়েছি।

কোয়াইট ন্যাচারাল তাহলে এখন কী করে সংসার সামলাচ্ছেন ?

কাজের মাসিকে টাকা বাড়িয়ে দিয়েছি ঘর গেরস্থালি এখন সে সামলায় অন্য লোক হলে কী করত জানি না আমি কঠিন সিচ্যুয়েশনটা শক্ত হাতে হ্যান্ডল করেছি আমি বরাবর রাফ অ্যান্ড টাফ টাইপ কলেজে ইউনিয়নবাজি করতাম দু’-দুবার জিএস হয়েছিলাম বড় লিডারদের ফোন আসত মোবাইলে বেশ ডাকাবুকো ছিলাম কোমরে ওয়ানশটার গুঁজে ঘুরতাম ঘাঁটাত না কেউ একটা সময় পেটো পর্যন্ত বেঁধেছি নিজে হাতে কিন্তু মানুষের সহ্যশক্তির তো একটা লিমিট আছে আমার নার্ভ আর লোড নিতে পারছে না৷

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার আলাপ কি কলেজ থেকে ?

হ্যাঁ  স্যার বিপাশার চেহারায় একটা আলগা চটক ছিল আমি ইউনিয়নবাজি করলেও পড়াশোনাতে খারাপ ছিলাম না ইডিওলজিফজি যে ফালতু কথা, নিজের স্বার্থটা যে নিজেকেই দেখতে হবে সেটা তখন থেকেই বুঝতাম কলেজ থেকে বেরিয়ে পার্টির সোর্সে একটা চাকরি জুটিয়ে নিই একটু সেটল হবার পর বিপাশাকে বিয়ে করি

এখনও পলিটিক্সের সঙ্গে যুক্ত আছেন ?

এখন রাজনীতি নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই বয়সও হয়েছে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার উৎসাহ নেই আর তবে শেষ অবধি লড়ে যাওয়ার মানসিকতা আমার যায়নি বিপাশার এই সমস্যা শুরু হবার পর আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি চোয়াল শক্ত করে বিপাশার পাশে দাঁড়িয়ে স্বামীর দায়িত্ব পালন করে গিয়েছি ওকে ভাল ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কোনও ডাক্তার কিছু করতে পারেনি

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ?

আমার জীবনে বিপাশাই সবটুকু এক্সট্রাম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের কোনও গল্প আমার নেই বিপাশার জীবনেও কোনও দ্বিতীয় পুরুষ নেই তার কারণ আমরা দুজনে একে অন্যের মনের দোসর

তাই বুঝি ?

আমাদের রুচি পছন্দ সব এক ঘর গেরস্থালির কেজো কথা ছাড়াও দিনের মধ্যে অন্তত দু্’ঘন্টা সময় আমরানিজেদের জন্য রাখতাম বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আমাদের গল্প হত রান্নাবান্না থেকে ফ্যাশন, সিনেমা থেকে সাহিত্যসব মাসে অন্তত দুটো সিনেমা দেখতাম আইনক্সে গিয়ে ফেরার সময় ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়া হত কিন্তু অসুস্থ হবার পর ছবিটা পালটে গেল বিপাশা কথা বলা কমিয়ে দিল পরের দিকে তো সারা দিনে দু’-একটার বেশি কথা বলত না মৃতপ্রায় বিপাশাকে আমি দূর থেকে দেখতাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম

এমন পেশেন্টকে তো খাওয়ানটাও কঠিন ফোর্স ফিডিং করাতে হয়

রাইট স্যার না খেয়ে না খেয়ে ওর শরীরের অবস্থা এখন কঙ্কালসার বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না মুখে টুঁ শব্দ নেই, চোখ বুজে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে শুয়েই থাকে জড় পদার্থের মতো নিঃশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না বোঝা যায়না এসব কারণে মনটা খারাপ হয়ে থাকে সারাক্ষণ কোনও কাজে মন বসে না এভাবেই চলছিল রিসেন্টলি একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে

অদ্ভুত ঘটনা ?

আমাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের সঙ্গে লাগোয়া একটা পার্ক আছে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ বসানো বাচ্চাদের নাগরদোলা, স্লিপ-টিপ আছে বিকেলবেলা বাচ্চারা ওখানে হুটোপুটি করে সেদিন যথারীতি অফিস থেকে ফিরে এসেছি চা খেতে খেতে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ছিলাম কচিকাঁচারা যে যার বাড়ি ফিরে গেল হঠাৎ চোখে পড়ল দুরের বেঞ্চে, বসে থাকা বেগুনি শাড়ি পরা একজনকে বসার ভঙ্গিটা চেনা চেনা বেগুনি শাড়িটা মনে হল কোথাও দেখেছি

তারপর ?

ভেতরে এসে দেখি বিপাশা ঘুমোচ্ছে ওকে শিশুর মতো লাগছে দেখতে ঠোঁটের কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুখের লালা চোখের নিচে গাঢ় কালি একটা শ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ভূতে পাওয়া মানুষের মতো এগোতে লাগলাম পার্কের দিকে আলো মরে আসছে ক্রমশ দ্রুত পায়ে খানিকটা হেঁটে ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম

কে সেই ভদ্রমহিলা ?

বিপাশা ! এবার বুঝলাম বেগুনি শাড়িটা এত চেনা লাগছিল কেন ! বেগুনি বালুচরিটা প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে বিপাশাকে উপহার দিয়েছিলাম আমি

উনি অবাক হলেন আপনাকে দেখে ?

একটুও না স্বাভাবিক গলায় বলল, তোমার আসতে এত দেরি হল ? অফিসে কাজের চাপ ছিল? বোসো, এখানে বোসো আমি প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওর পাশে বসলাম অনেক গল্পগুজব হল শিবপ্রসাদের সিনেমা নিয়ে, শ্রীজাতর কবিতা নিয়ে, বিনোদ ঘোষালের নতুন উপন্যাস নিয়ে কথা বললাম আমরা।বিয়ের পর প্রথম প্রথম যেমন হত গল্পে গল্পে সন্ধে গাঢ় হল আমি বললাম, এবার বাড়ি যেতে হবে বিপাশা বলল, তুমি যাও আমি আর একটু বসে থাকি

আপনি ফিরে এলেন ?

আমি ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিলাম চুপচাপ বসে রইল বেঞ্চে আমার শরীরের সমস্ত শিরাউপশিরা চঞ্চল হয়ে উঠল মাথাটা অস্থির অস্থির করছিল ভয় হচ্ছিল, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি ? আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম আর বুক ধকধক করছিল দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলাম হুড়মুড় করে দেখি বিপাশা যথারীতি চিত হয়ে শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আছে চোখে কোনও দৃষ্টি নেই তখনই গায়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেল আমার এতক্ষণ পার্কে তাহলে কার সঙ্গে কথা বললাম আমি !

আর কখনও দ্বিতীয় বিপাশাকে দেখেছেন?

সপ্তাহখানেক বাদে সেদিনও অফিস থেকে ফিরে ব্যালকনিতে দাঁডিয়ে পার্কটার দিকে নজর রাখছিলাম হঠাৎ মনে হল অন্ধকারে বিপাশা বসে রয়েছে আগের দিনের বেঞ্চটায় জোরকদমে হাঁটা দিলাম পার্কের দিকে পার্কে গিয়ে দেখি জংলা প্রিন্টের শাড়ি পরা বিপাশা বসে আছে চিনেবাদামের ঠোঙা হাতে নিয়ে আমাকে দেখে ক্যাজুয়াল গলায় বলল,নাও, বাদাম খাও

–  আপনি বসলেন ওঁর পাশে ?

হ্যাঁ বিপাশা বাদামের খোলা ভাঙছিল মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে বলল, কী চেহারা করেছ তুমি ! কতদিন দাড়ি কামাও না বলো তো!চুল বড়ো হতে হতে বনমানুষের মতো হয়ে গেছে।কাল সকালে সেলুনে গিয়ে চুল ছোট করে ছেঁটে আসবে আর এখন থেকে রোজ স্নানের আগে শেভ করবে কথাটা মনে থাকে যেন

–  সেদিন কতক্ষণ ছিলেন পার্কে ?

–  ঠিক বলতে পারব না বোধ হয় ঘন্টাখানেক একসময় বিপাশা বলল, সন্ধে ঘন হয়েছে৷ ফ্ল্যাটগুলোর জানলার আলো জ্বলতে শুরু করেছে এবার তুমি যাও আমি বললাম, তুমি আমার সঙ্গে চলো বিপাশা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার যাওয়া সম্ভব নয় তুমি ফিরে যাও, আমি এখানেই আছি

তারপর ?

ফিরে এসে দেখি বিপাশা মড়ার মতো শুয়ে আছে বিছানায় চোখদুটো বোজা গা থেকে উৎকট চিমসে গন্ধ বেরোচ্ছে বহুদিন স্নান না করলে যেমন গন্ধ বেরোয় তেমন গন্ধ প্রতিদিনই এই গন্ধটা পাই কিন্তু এই প্রথম বিপাশার গায়ের গন্ধে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল অসহ্য লাগল ওকে সেদিন ওর সঙ্গে একটাও কথা বললাম না কথাটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল আমার সঙ্গে আসতে চাইল না কেন ! আপনার কাছে অস্বীকার করব না, সেদিন প্রথমবার আমি বিপাশার মৃত্যুকামনা করলাম

এমন ঘটনা আবার ঘটেছে ?

একদেড় সপ্তাহ পরপরই ঘটেছে এভাবেই ধীরে ধীরে আমার মধ্যে একটা বদল এল অফিসে কাজে ভুল হওয়া শুরু  হল এতদিন ঠিকমতো স্নানখাওয়া করতাম না, পোশাক আশাকের ঠিক ছিল না কিন্তু মাঝবয়সে আসার পর জীবনের বাঁকে আমার জন্য এমন রহস্য অপেক্ষা করছে সেটা আমি কল্পনাও করিনি।

একটা কথা বলি ভাল করে ভেবে উত্তর দেবেন ওই পার্ক ছাড়া দ্বিতীয় বিপাশাকে আর কোথাও দেখেছেন কি ?

না দেখিনি ওই পার্কেই দেখেছি সন্ধেবেলা করেই দেখেছি

সেটাই স্বাভাবিক আপনাকে একটা কথা বলি মন দিয়ে শুনুন আপনার যেটা হয়েছে তাকে বলে ডিলিউশন অব পারসিকিউশন আপনার স্ত্রী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছেন বেশ কয়েক মাস ধরে আপনি তাকে ভালবাসেন খুব তার ওপর আপনি চূড়ান্ত নির্ভরশীল তাঁকে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে বুঝতে পেরেছেন সহজে এই রোগ ভাল হবার নয় হতাশ হতে হতে আপনি ভেঙে পড়েছেন ঠিক তখন আপনার মস্তিষ্কের নিউরন আপনার স্ত্রীর একটি রেপ্লিকা তৈরি করেছে আপনার জন্য দুজন বিপাশা চলে এসেছে আপনার জীবনে ভিজুয়াল অডিটরিদুরকমে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আপনার

তার মানে স্যার আপনি বলতে চাইছেন যে আমার অবচেতন মনই এই খেলাটা খেলছে ?

রাইট সে কারণে আপনি যখন পার্কে দ্বিতীয় বিপাশার সঙ্গে দেখা করতে যান তখন সেখানে আর কেউ থাকে নাআপনি আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নেবেন, তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন না

সেটা আমি নিজেই কিছুটা আঁচ করেছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমার বিয়ে করা রুগ্না অসুস্থ বউ যতক্ষণ আছে ততক্ষণ দ্বিতীয় বিপাশা আমার ফ্ল্যাটে আসবে না কাজেই দুজনের মধ্যে যে কোনও একজনকে সরে যেতে হবে আমার জীবন থেকে একটা কিছু করতে হবে আমাকে সেই চরম সিদ্ধান্ত নিতেই দ্বিধা করছিলাম এতদিন

চরম সিদ্ধান্ত মানে ?

ফার্ম ডিসিশন একটা এসপার ওসপার করা ডিসিশন একটা জিনিস প্রয়োজন পড়লে আমি কখনও কখনও ক্যারি করি এটা আমার পুরনো অভ্যাস সেই ছাত্র রাজনীতি করার সময় থেকে বদভ্যাসটা রয়েই গেছে এই দেখুন .. এটাএই যন্ত্রটার কথা বলছিলাম দানা ভরা আছে কিন্তু ফুললি লোডেড

মাই গড .. তো পিস্তল

চাইনিজ জিনিস লাইসেন্স নেই সাইলেন্সার লাগানো আছে যন্ত্রটায় গুলি চললে যে শব্দটা হয় সেটা অলমোস্ট শোনা যায় না আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে একটা গা গরম করে দেওয়া ব্যাপার আছে হাতে নিলেই ট্রিগার চাপতে ইচ্ছে করেসপ্তাহে একদিন জিনিসটায় তেল দিই সেদিন হঠাৎ জিনিসটাকে তেল খাওয়াতে খাওয়াতে আঙুল নিশপিশ করে উঠলমনে হল চুড়ান্ত কিছু চাইছে এটা সময় হয়েছে সব কিছুর শেষ টানার

-কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন তো!

বলছি সেটা বলব বলেই তো আপনার কাছে আসা গত কয়েকদিন ধরেই তৈরি হয়ে ছিলাম আজ সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে অবশেষে তার দেখা পেলাম দেখতে পেলাম পার্কের কোনের বেঞ্চটায় বসে আছে আমি ফ্ল্যাট থেকে বেরোলাম সিঁড়ি দিয়ে নামলাম ঝড়ের মতো পার্কে ঢুকে হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে আমাকে দেখে হাসল আমি পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ট্রিগার টেনে দিলাম গুলিটা ওর কপাল ফুঁড়ে দিল মাছের মতো নিষ্প্রাণ চোখে দেখল আমাকে তারপর লুটিয়ে পড়ে গেল আমি আর পেছন ফিরে দেখিনিসোজা চলে এসেছি আপনার চেম্বারে

খুব সাহসিকতার কাজ করেছেন তবে টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি আপনার কথা শুনে আমি একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম

আমি যাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, তার প্রতি আমার একটা কমিটমেন্ট আছে।বিপাশাকে সুস্থ করে তোলার ভার আমার। কল্পনার ফানুস ফুটো করে এসেছি আমি রক্তমাংসের বিপাশাকে নিয়ে সংসার করতে চাই

আপনাকে বুঝিয়ে বলি, জন্বি রোগ তিন পর্যায়ে বিভক্ত জার্মিনেশন স্টেজ,ব্লুমিং স্টেজ এবং ক্রনিক স্টেজ জার্মিনেশন স্টেজে থাকলে তো চিন্তা নেই ব্লুমিং স্টেজে থাকলেও আমরা চেষ্টা করব আমি আশাবাদী, আপনার স্ত্রী সুস্থ হয়ে যাবেন

থ্যাংকস লট ডক্টর আমি জানতাম আপনি আমাকে ফেরাবেন না 

নিজের স্বার্থেই ফেরাবো না সত্যি বলতে কী আমার ক্যারিয়ারে এমন কেস আমি পাইনি কখনও।।

*********************************************************************  

লেখক পরিচিতি:

mriganca-bhattacharyaমৃগাঙ্ক‌‌ ‌‌ভট্টাচার্য‌ – প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি তুলনায় নবীন যাঁরা শূন্য দশকের পর উঠে এসেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। থাকেন জলপাইগুড়িতে। তাঁর অজস্র গল্প প্রকাশিত হয়েছে  ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’, ‘সানন্দা’, ‘গৃহশোভা’, ‘ফেমিনা’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘দু-কূল’ (আমেরিকা), আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন ইত্যাদি প্রথম সারির পত্র-পত্রিকাতে। তাঁর বেশ কিছু গল্প অনুদিত হয়েছে সর্বভারতীয় হিন্দি পত্রিকাতে।

কিশোর সাহিত্যেও তিনি সমান আগ্রহী।  ‘আনন্দমেলা’, ‘কিশোর ভারতী’ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য কিশোরপাঠ্য গল্প। এছাড়াও নিয়মিতভাবে লেখেন  ট্রাভেলগ।
প্রথম প্রকাশিত বই ‘চংক্রমণ‘। তার পর ক্রমান্বয়ে  প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লাল ডায়েরি, বসন্তপথ, মেঘের পর রোদ, সূর্যাস্তের নদীর তীরে ইত্যাদি উপন্যাস ও গল্প সংকলন। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ভ্রমণের বই — ‘বাংলার উত্তরে টই টই‘।
লেখালেখির পাশাপাশি ক্রিকেট তাঁর প্যাশন। নিজে দীর্ঘদিন জেলা স্তরে ক্রিকেট খেলেছেন। জলপাইগুড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে পেয়েছেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার।
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!