Shadow

কৌশলী কবি – অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য

কৌশলী কবি

অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য

প্রায় চল্লিশ বছর আগে প্রখ্যাত শিল্পী শ্রীবিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় রচিত “চিত্রকর” গ্রন্থটি পড়বার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
শ্রী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় তাঁর শিল্পকলার শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে শিল্পাচার্য্য নন্দলাল বসুর কাছে এবং তিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষাগুরু। সত্যজিৎবাবু তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জীবন অবলম্বনে “The inner eye” তথ্যচিত্র নির্মাণ করে।
বিনোদবিহারী “চিত্রকর” গ্রন্থে তাঁর জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন যার থেকে সেকালের শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায়। এইসব তথ্যের সাথে সাথে,একটি বিশেষ ঘটনার কথা সেইসময় আমার মনে বিশেষ ভাবে দাগ কেটেছিল। সেই ঘটনার বিবরণ আমি শিল্পী বিনোদবিহারীর বয়ানেই নিবেদন করছি;
“রবীন্দ্রনাথের খুব নিকটে আসবার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি। আবার তিনি আমার জীবন থেকে কখনো দূরেও চলে যান নি। জীবনের আনন্দ কেউ কাউকে কখনো বিলিয়ে দিতে পারেনা। তবু বলতে হয় জীবন যে আনন্দময়, সৃষ্টির পথে অবসাদ অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে যে মুক্তি পাওয়া যায়, সেকথা উপলব্ধি করার সার্থক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে উপস্থিত করেছিলেন তাঁর গানের ডালি। প্রকৃতির শোভা-সৌন্দর্য ও তার গান একত্রে যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার স্মৃতি শান্তিনিকেতনের কোন ছাত্রছাত্রীর মন থেকে বোধহয় মুছে যায় নি।
বর্ষার দিনে শান্তিনিকেতনের ছাত্রাবাসগুলি প্রায় জলে ডুবে যেত,ফুটো ছাদ,ভাঙ্গা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে অনেক সময় বিছানাপত্র ভিজিয়ে দিয়েছে। বর্ষার এইরকম এক রাত্রি অনিদ্রায় কাটিয়ে আমরা কয়েকজন ছাত্র অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাদের অসুবিধার কথা জানিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ধীরকণ্ঠে বললেন,’তোরা বোস। দ্যাখ,আমারও রাত্রে এই খড়ের ঘরে জল পড়েছে,আমিও সারারাত ঘুমোতে পারিনি। বসে বসে একটা গান লিখেছি। শোন,কিরকম হয়েছে।’ এই বলে রবীন্দ্রনাথ গান শুরু করলেন–‘ওগো দুখজাগানিয়া,তোমায় গান শোনাব,তাইতো আমায় জাগিয়ে রাখ—‘। গান শেষ করে রবীন্দ্রনাথ বললেন,
‘আর্টিস্ট, কবি—-আমাদের একই দশা। কেউ আমাদের দ্যাখে না’। রবীন্দ্রনাথের ঘরে জল অবশ্য সামান্যই পড়েছিল। আমরা পরম আনন্দে রবীন্দ্রনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজেরাই বলাবলি করলাম,’কই আমরাতো এরকম পারি না।’ আজ একথা নিশ্চই স্বীকার করব, কই রবীন্দ্রনাথ তো ঘর মেরামতের কোনো ব্যবস্থা করলেন না! রবীন্দ্রনাথ ঘর মেরামতের কোনো ব্যবস্থা করেছিলেন কিনা আজ আমার স্মরণ নেই,তবে সেদিন রাত্রের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গানে।”

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়
PC: Jehangir Nicholson Art Foundation

বিনোদবিহারী বর্ণিত এই ঘটনাটির উল্লেখ আমি বহুবার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সমাবেশে বহু মানুষের কাছে করেছি,বিশেষতঃ যখনই এই বহুশ্রুত রবীন্দ্রসঙ্গীতটি কোন স্থানে গীত হয়েছে। এই অজানা তথ্যটি বহু মানুষকে কেবল মুগ্ধই করে তোলেনি, সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার এক নূতন দিগন্তকে উন্মোচিত করেছে। বছর সাতেক আগে,কলকাতার এক প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কন্ঠে সেই গানটি শোনার পর তাঁকে কথাপ্রসঙ্গে এই গানটির রচনার ইতিহাস জানাই। তিনিও গানটির নেপথ্যের এই ঘটনার বিষয়ে অবহিত ছিলেন না। রবীন্দ্রভক্ত শিল্পী যথারীতি এই নূতন তথ্যে আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং শান্তিনিকেতনে তাঁর পরিচিত এক রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞের সাথে এই ঘটনাটির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে শান্তিনিকেতনে সংরক্ষিত গানটির পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায় যে “তোমায় গান শোনাব” গানটির রচনাস্থল  সুদূর আমেদাবাদ শহরে! অর্থাৎ বিনোদবিহারী বর্ণিত সেই বর্ষণমুখর রাতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ওই গানটি রচনা করেননি এবং গানটি পূর্বেই  রচিত হয়েছিল!
এই তথ্য সামনে আসার পর আমি বিস্মিত ও হতচকিত হয়েছিলাম! এতদিনের বর্ণিত সকল ঘটনাপ্রবাহ পথ পরিবর্তন করে সহসা এক নূতন মাত্রা পেল। স্পষ্টতই বোঝা গেল,প্রত্যুত্পন্নমতি রবীন্দ্রনাথ তার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জমে ওঠা ক্ষোভকে আশু প্রশমিত করবার উদ্দেশ্যেই এই আপাত ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সুকৌশলের সাথে তিনি তা সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর পূর্বেই রচিত এক প্রাসঙ্গিক অর্থবহ গানের তৎক্ষণাৎ পরিবেষণের মাধুর্যে!
কিন্তু এই ঘটনা আমাকে অন্যদিক থেকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল! সেই সময়ের শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা প্রতিনিয়ত রবীন্দ্রনাথের নবরচিত গান, কবিতা, নাটকের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত ছিল বলেই আমার ধারণা ছিল। তাই তাঁর  পূর্বেই রচিত এই গানটির সম্বন্ধে বিনোদবিহারী ও তার সঙ্গীরা কি ভাবে অনবগত ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে শুনবার পর সেটিকে সদ্যরচিত সঙ্গীত বলে ভুল করলেন,এই প্রশ্নের উত্তর  আমি বহুদিন খুঁজে পাই নি। সেই সাথে মনের অঙ্গনে আরও এক প্রশ্নের জন্ম নিয়েছিল সঙ্গত কারণেই! রবীন্দ্রনাথ কি অন্তর্যামী ছিলেন? তিনি কি ভাবে একদল আশ্রমের ছাত্রদের সামনে তাঁর পূর্বরচিত গানকে সদ্যরচিত বলে নিঃসংশয়ে উপস্থাপন করবার ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন? এই প্রশ্নের ব্যখ্যা চেয়ে বেড়িয়েছি বিগত সাত বছর ধরে, সঠিক উত্তর পাইনি।

বলাইচাঁদ  মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
PC: বাংলাপিডিয়া

ঠিক সাতদিন আগে এই প্রশ্নের সঙ্গত উত্তর খুঁজে পেলাম যখন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র স্নেহধন্য বলাইচাঁদ  মুখোপাধ্যায় (বনফুল) রচিত “রবীন্দ্র-স্মৃতি”বইটি কলেজষ্ট্রীট থেকে এনে পড়তে শুরু করলাম। এই গ্রন্থটিতে বনফুল তাঁর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকারের, কথোপকথনের,চিঠিপত্রের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। শান্তিনিকেতন ভ্রমণকালের একটি অভিজ্ঞতার কথা বনফুলের লেখনীতে তুলে দিলাম;
“এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ছে। কি একটা সভা হচ্ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের। রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় তাঁর’বসন্ত’কবিতাটি পড়েছিলেন বই থেকে। আমিও ছিলাম। দেখলাম তিনি দুটো stanza বাদ দিয়ে পড়ে গেলেন। সভা শেষ হয়ে যাবার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনি কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন একটু?’
‘না। কেন?’
‘আপনি কবিতার দুটো stanza বাদ দিয়ে দিলেন কি না, তাই মনে হচ্ছিল …’
প্রদীপ্ত হয়ে উঠলো তাঁর চোখের দৃষ্টি।
‘তুমি ধরতে পেরেছ?’
‘ও কবিতাটা আমার মুখস্থ আছে।’
‘এখানে কেউ ধরতে পারে না। প্রায়ই আমি বাদ দি—‘
বললাম——‘ বাইরে আপনাকে আমরা পেতে চেষ্টা করি আপনার লেখার ভেতর দিয়ে। এরা এখানে আপনাকে খুব কাছে পেয়েছে, তাই বোধহয় আপনার লেখা পড়ে না।”
আশা করছি যাঁরা আমার এই লেখাটি ধৈর্য ধরে পড়ছেন,তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সতত তাঁর আশ্রমের ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও গভীরতার পরীক্ষা নিতেন সুকৌশলে এবং তাদের শিক্ষার পরিধির পরিমাপ ও মূল্যায়ন ছিল তাঁর করায়ত্ত। সেদিন একহাতে কবি সুদক্ষ আশ্রম প্রশাসক রূপে আশ্রমিক ছাত্রদের সম্মিলিত ক্ষোভের আগুনকে নিমেষে প্রশমিত করেছিলেন সুকৌশলে। অপরহাতে,কবি এক শিক্ষকের ভূমিকায় তাঁর ছাত্রদলের জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়েছিলেন তাদের অজান্তে!
************************************************

অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য পরিচিতিঃ 

জন্ম,স্কুল,কলেজ সবই কলকাতা। কর্মজীবন কেটেছে অবশ্য বিশাখাপত্তনম,অন্ধ্র প্রদেশে। সঙ্গীত প্রিয় ও রবীন্দ্রানুরাগী!

7 Comments

  • বন্দনা মিত্র

    প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ এর ওপর নতুন আলেকপাত। ঝরঝরে ভাষায় তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি অত্যন্ত সুস্বাদু। আরো এমন লেখা চাই।

    • Madhumita Mitra

      কৌশল প্রশাসনের অন্যতম অঙ্গ তা সর্বজনবিদিত,বহু ধারার প্রতিভা সমন্বিত রবীন্দ্রনাথ যে অতি দক্ষ প্রশাসক ছিলেন তা উপরিলিখিত প্রবন্ধের দৃষ্টান্ত গুলির মাধ্যমেই সুপ্রকাশিত❤️

  • সুমিতা ভাদুড়ি

    বহুচর্চিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্বন্ধে এখনো যে নতুন করে জানার আছে তা লেখকের এই লেখাটি সাগ্রহে পড়ে জানলাম। বুঝলাম লেখক কবিকে গবেষণার চোখে দেখেন আর সেই কারণে প্রচুর পড়েন। তাঁর কাছে আরো অজানা কে জানার অপেক্ষায় রইলাম।

  • সৌমিত্র সিনহা

    বাহ্, সুন্দর একটা গল্প, যেটা কখনোই জানা হতো না ۔সেটা আজ জানলাম ۔۔۔রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণতা অসাধারণ ছিল তা এই গল্পটি পড়লেই জানা যায় ۔۔۔

  • PARAMITA GOSWAMI

    নতুন ধারার রবীন্দ্রচর্চায় সমৃদ্ধ হলাম। লেখকের কাছে এমনই আরো নতুন কিছুর প্রত্যাশায়…

  • Brati Ghosh

    রবীন্দ্র জীবন চর্চায় আরো একটি তথ্য সংযোজিত হলো ৷ সম্বৃদ্ধ হলাম ৷

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!