অজানা অচেনা গিরিবর্ত্মের পথে পথে
বিজিত কুমার রায়
কাশ্মীর হয়ে লেহ লাদাখ আর হিমাচল হয়ে ফেরত।
স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা আছে এখানে।
২০১৬ সালে বেরিয়ে ছিলাম শ্রীনগর হয়ে লেহ লাদাখের পথে প্রান্তরে।
কলকাতা থেকে আমাদের ২২ জনের দল বেরিয়েছে কয়েক দিন আগে ট্রেনে পাঠানকোট পাটনিটপ হয়ে তারা আজ শ্রীনগর পৌঁছোবে । আর আমরা এসেছি আজ সকালের বিমানে কলকাতা দিল্লী শ্রীনগর।
লাদাখ বেড়াতে গেলে কিছু বিষয় অবশ্যই চিন্তা ভাবনা করতে হবে৷ প্রথমতঃ আপনি কোথা থেকে শুরু করবেন? লাদাখ তিন দিক দিয়ে শুরু করতে পারেন৷
১) জম্মু থেকে জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক ধরে শ্রীনগর হয়ে বা দিল্লী -শ্রীনগর ফ্লাইটে গিয়ে শ্রীনগর হয়ে
২) দিল্লী – লেহ ফ্লাইটে গিয়ে
৩) মানালী -লেহ জাতীয় সড়ক ধরে ৷
মনে রাখতে হবে শ্রীনগর লেহর রাস্তা মে মাসের মাঝামাঝি খুললেও মানালীর রাস্তা মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের আগে খোলে না৷ এটা নির্ভর করছে ঐ বছর কি পরিমাণ বরফ পড়েছে তার উপর ৷ কারণ অনেকগুলো পাসে বরফ কেটে রাস্তা তৈরি হবার পরে খুলে দেওয়া হয়৷ এছাড়া ঐ সময় রোদের তাপ বেশী থাকায় বরফ গলতে শুরু করে,ফলে কোথাও বরফ-কাদা মিশে রাস্তা কর্দমাক্ত (slush) হয়ে ওঠে বা শুকিয়ে প্রচুর ধুলো ওড়ে ৷ আর শ্রীনগর থেকে মানালীর দিকের উচ্চতা বেশী হবার কারণে মানালী দিয়ে শুরু করলে আবহাওয়ায় অভ্যস্ত (acclamatization) না হবার কারণে পর্বতপীড়া বা mountain sickness বেশী হতে পারে৷ একই সমস্যা হতে পারে বিমানে সরাসরি দিল্লী থেকে লেহ গেলে৷ সবদিক বিচার করে শ্রীনগর দিয়ে ঐ সফর বা সাফারি শুরু করাই ভাল৷ এতে ধীরে ধীরে বেশী উচ্চতায় গেলে অসুবিধা কম হবে৷ আমার মনে হয় একে শুধু ভ্রমণ না বলে দুঃসাহসিক ভ্রমণ (adventure tour) বলাই ভাল। চাইলে শ্রীনগরে দু -একদিন থেকে কাশ্মীরটাও ঘুরে নিতে পারেন৷
হোটেল প্যারাডাইস ডাল লেকের ধারে ব্যবস্থা করাই ছিল৷ অগ্রবর্তী কর্মী দল দুইদিন আগেই এসে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে৷
পৌঁছানোর পর মধ্যাহ্ন ভোজন তৈরি ছিল। খেয়ে বিশ্রাম করে পদচারণা ডাল লেকের ধার বরাবর। তারপর সূর্যাস্তের পর হোটেলে ফিরে এলাম।
আমাদের পাঁচটি টেম্পো ট্রাভেলার বাস এসে পৌঁছালো। এতেই আমাদের যাত্রা সোনমার্গ জোজিলা পাস দ্রাস কার্গিল হয়ে লেহ। তারপর লেহ থেকে সাতদিন ঘুরে সারচু রোটাং পাস ও মানালির রাস্তা দিয়ে কালকা ফেরত। সে গল্প পরে।
এখন রাতের খাবার সেরে বিশ্রাম নিতে হবে। কালকের লম্বা যাত্রা সেরে বিশ্রাম কার্গিলে।
যাদের শ্বাসকষ্ট বা হৃদয় দুর্বলতা বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা তারা নিজেদের ডাক্তারকে দেখিয়ে কিছুদিন আগেই পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
সাধারণ ভাবে তারা চেষ্টা করবেন বেশি দ্রুত না হাঁটতে বা না দৌড়াতে বা বেশি সিঁড়ি ভাঙতে কার্গিল বা লেহ পৌঁছানোর পর। একটু কম খাবেন৷ জল খাবেন একটু বেশি।
একটু বয়স যাদের বেশি তারা যদি এ্যলোপ্যাথিক ওষুধ খেতে চান তাহলে যাওয়ার তিনদিন আগে থেকে diamox ট্যাবলেট একটি করে খাবেন রোজ। আর যারা হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেতে চান তারা কোকা ৬ বা ৩০ শ্রীনগর পৌঁছানোর পর সকালে খালি পেটে দুই ফোঁটা বা চার ছয়টি গুলি খাবেন।
ওপরের পরামর্শ আমার নিজ অভিজ্ঞতার। অন্যদের অন্যান্য পরামর্শ থাকতেই পারে। আমাকে আমাদের ট্র্যাভেল গাইড ও ডাক্তার এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত আমার শ্বাসকষ্ট উচ্চ রক্তচাপ ও মধুমেহ তিনটিই আছে ও বয়স ছিল তখন ৬৪।
প্রয়োজনীয় তথ্যঃ-
কখন যাবেন
জুন থেকে সেপ্টেম্বর লাদাখের বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল। ভ্রমণের আদর্শ সময়। এই সময় লেহ থেকে মানালী ও শ্রীনগরের রাস্তাও খোলা পাওয়া যায়।
ইনারলাইন পারমিট
লে শহর সংলগ্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখতে কোনো সরকারী অনুমতি লাগে না,তবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ শহর থেকে দূরে বেশির ভাগ জায়গাগুলোতে যেতে ইনারলাইন পারমিটের প্রয়োজন। লে-র ডিসি অফিসে পরিচয়পত্র ও ফটো জমা দিলে পারমিট পাওয়া যাবে। এর ৬-৭টা ফটোকপি যাত্রাপথে সাথে রাখুন। এগুলো যাত্রাকালে মিলিটারী চেকপোস্টে জমা দিতে হবে।
মনে রাখবেন
লে শহরে পৌঁছে ১-২ দিন বিশ্রাম নিয়ে,উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। সাথে রাখুন হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোকা-৬। প্রায় সবুজহীন লাদাখে অক্সিজেনের মাত্রা বেশ কম থাকায় উচ্চতাজনিত সমস্যা (যেমন মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, বমি ইত্যাদি) হয়। এখানে গরম জামাকাপড়ে সাথে নিতে হবে রোদটুপি,সান প্রোটেকশন ক্রীম,রোদচশমা ও ভেসলিন। ইনারলাইন পারমিটের জন্য প্রত্যেক সদস্যের ৬ কপি সচিত্র পরিচয়পত্র ও ভোটার কার্ড সাথে রাখা একান্ত আবশ্যক।
অনেকেই লাদাখ -‘The cold desert’ বেড়াতে যেতে চান৷ হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতের মাঝের উপত্যকা যা কিনা ভারতের জম্মু -কাশ্মীর রাজ্যের মধ্যে পড়ে ! কিন্তু লাদাখ নামটা শুনেই একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন৷ এত উঁচু পর্বতময় এলাকা প্রায় দুর্গম রাস্তা আর তীব্র ঠান্ডা তারপরে কম অক্সিজেন থাকায় শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা-সব মিলিয়ে এক অজানা আশংকা তৈরী হয়৷ সর্বোপরি বাজেট একটা বড় বিষয়ও বটে ৷ এই কথাগুলো সব সত্যি৷ কিন্তু ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এসব কোন বাধাই বাধা হয় না ৷ ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়৷ Where there is a will there is a way.
একটা কথা ভুলবেন না। এখানে চরম আবহাওয়া৷ ভীষন শুষ্ক| প্রচুর পরিমাণ জল খেতে ভুলবেন না৷ এখানে প্রথম এক দু দিন বিশ্রাম নিলে খুবই ভাল হয়৷ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভাল৷ তবে প্রথম রাতে খুব ভাল ঘুম নাও হতে পারে৷ চিন্তার কোন ব্যাপার নেই৷ বিশ্রাম ও প্রচুর জল খেলে ঠিক হয়ে যাবে৷ সম্ভব হলে সাথে ও .আর .এস . বা ইলেকট্রল রাখুন ও বারে বারে খান৷
পরের দিন সকালে লেহ লাদাখ ঘোরার ILP বা পারমিশন নিতে হবে ডি .সি .অফিস থেকে৷ সকালে ডি সি অফিসে খুব ভিড় হয়৷ এখানেই পাওয়া যায় লেহ বা লাদাখ ঘোরার ছাড়পত্র| প্রথমে অনলাইন ফর্ম ফিলাপ করে এখানে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে ফর্ম জমা করতে হয়৷ সময় বাঁচাতে চাইলে কাছেই লেহ মার্কেটে একটু বেশী টাকা দিয়ে করিয়ে নিতে পারেন বা হোটেলেও কথা বললে ওরা করিয়ে দেয়৷
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ র্বিষয় :—–
১) প্ল্যান ও গ্রুপ করুন অনেক আগে৷ ছয় জনের গ্রুপ হলে ভাল হয়৷ দশ বছরের কম বাচ্ছা ও হাঁপানি আছে এমন মানুষকে না নিয়ে যাওয়াই ভাল৷
২) ট্রেন বা বিমানের টিকিট আগেভাগে বুক করুন|
৩) কোন নেতিবাচক কথায় কান দেবেন না৷ মনে রাখবেন লাদাখে অনেক মানুষই যাচ্ছে৷ এমনকি ছেলেরা ছাড়াও প্রচুর মেয়েরা বাইক ট্যুর করছে ৷ আপনিও পারবেন৷ মনের জোর আর আত্মবিশ্বাস রাখুন |
৪) সাথে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার;হেলথ ড্রিংক;টি ব্যাগ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সাথে রাখুন| সাথে মধু রাখতে ভুলবেন না৷ একটা কৌটায় কিছু কর্পূর রাখুন| এটা সব সময় কাছে রাখবেন৷ এছাড়া diamox 250 একটা ওষুধ আছে,যেটা পর্বতপীড়ায় ভাল কাজ দেয়৷ তবে যাঁদের সালফার ড্রাগ অ্যালার্জি আছে তারা এই ওষুধ ব্যবহার করবেন না৷ আপনার ডাক্তারবাবুই সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন৷ আবার বলছি সাথে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার রাখুন| মুড়ি,লাড্ডু ,কেকও রাখুন,কাজে দেবে৷ ছোলা ভিজিয়ে মশলা-ছোলা খুব কার্যকরী৷
৫) আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে ইনহেলার নিতে পারেন৷ সাথে নেবেন দরকারী ওষুধ|
৬) লেয়ারিং পোশাক পরুন মানে পাতলা কিন্তু গরম পোশাক অনেকগুলি রাখুন| যাতে প্রয়োজনে সহজে খোলা বা পরা যায়৷ সাথে টুপি ও সানগ্লাস (পোলারযেড হলে ভাল হয়) এবং ট্রেকিং শু ও সাথে মোটা মোজা নিতে ভুলবেন না৷ সানগ্লাস খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ খালি চোখে বরফের ঝলকানিতে চোখের ক্ষতি হতে পারে৷ সান স্ক্রীন লোশন বা lip guard ও নিয়ে নেবেন৷
৭) পারলে একটা ইলেকট্রিক কেটলী ও ফ্লাস্ক নিয়ে নিন৷ সহজে জল গরম করে নিতে পারবেন৷
৮) মনে রাখবেন এখানে অনেক জায়গায় এখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি৷ সোলার সিস্টেমে ইলেকট্রিক আলো জ্বলে বা জল গরম হয়৷ রাত ১০ টার পরে আলো পাবেন না৷ তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হবে৷ আগে থেকে এই অভ্যাস তৈরী করে নেওয়া ভাল৷ যদিও ভৌগলিক নিয়মে ওখানে সন্ধ্যা হয় দেরীতে৷
৯) বুঝে খাবার খান৷ কারণ এখানে খাবারের দাম প্রচুর,সহজপাচ্য খাবার খাওয়াই ভাল৷ সাথে ফ্লাস্কে গরম চা বা কফি নিতে ভুলবেন না৷ গাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিস ছোট ব্যাগে হাতের কাছে রাখুন।
১০) ঠান্ডার কারণে গাড়ির কাঁচ পুরো না আটকানোই ভাল কারণ অক্সিজেন এমনিই কম৷ গাড়ির মধ্যে এটা আরও কমে গেলে মুশকিল৷ সম্ভব হলে শ্রীনগর বা লেহ থেকে ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার সাথে রাখতে পারেন৷ আর সাথে নেবেন মাস্ক| ধুলো বা ঠান্ডা হাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবেন নিজেকে৷ পারমিটের কাগজপত্র ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড ও ছবি হাতের কাছে রাখুন| আসলের সাথে বেশ কয়েক কপি জেরক্স রাখতে হবে৷
১১) ড্রাইভারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন| যদিও মনঃসংযোগ রাখার জন্য ওঁরা কম কথা বলেন তাই আগেই সব বিষয়ে জেনে নেবেন৷ তবে যত সকাল সকাল বেরোতে পারবেন ততই সুবিধা৷ তবে তাড়াহুড়ো করবেন না৷ ওতে ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে৷ হোটেল চেক আউট করার আগে সব জিনিসপত্র নিয়েছেন কিনা খেয়াল রাখুন আর হোটেল ছাড়ার আগে বিল পেমেন্ট করে দিন৷
১২) আগে ভিউ পয়েন্টগুলো জেনে নিন৷ সেখান থেকে সম্ভব হলে প্রকৃতিকে দেখে নিন৷ দ্বিতীয়বারের জন্য ফেলে রাখবেন না৷ কারণ আপনি পরে আবার যেতে নাও পারেন৷ দুচোখ ভরে দেখুন৷ ছবি তোলার নেশায় এই দেখাটা কম হয়ে না যায়৷ মানুষের চোখের লেন্স শ্রেষ্ঠ লেন্স। মনের স্মৃতিতে গেঁথে রাখুন।
১৩) লেহ -লাদাখের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা আর্মির উপর৷ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি ও আবহাওয়া উপেক্ষা করে আত্মীয় পরিজন ছেড়ে তাঁরা আমাদের দেশের সীমান্ত রক্ষা করে চলেছেন৷ ওঁদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করুন৷ ওঁরাও আপনাকে শুভেচ্ছা জানাবেন৷ শুধু তাই নয় কোন অসুবিধা হলে বা কেউ অসুস্থ হলে ওঁরা সবরকম সহযোগিতা করেন৷
১৪) জম্মু -কাশ্মীরে একমাত্র BSNL ও AIRTEL Postpaid SIM কাজ করে৷ যদিও সব জায়গায় network পাওয়া যায় না৷
১৫) এখানে ATM পাবেন না৷ তাই সাথে প্রয়োজন মত ক্যাশ কাছে রাখুন| শ্রীনগর থেকেই এটা করে নেওয়া ভাল৷
এখানে আমি লাদাখ সম্বন্ধে কিছু কথা জানাব–
লাদাখের উত্তরে কারাকোরাম রেঞ্জ তারও উত্তরে বিস্তৃত কুনলুন মাউন্টেন রেঞ্জ আর দক্ষিণে গ্রেট হিমালায়ন রেঞ্জের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে লাদাখ বলে। তারমধ্যে একদিকে জাসকার পাহাড় শ্রেণী ও লাদাখ পাহাড় শ্রেণী ও পাংগং পাহাড় শ্রেণী। লাদাখ হচ্ছে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল কারণ মৌসুমী বায়ু হিমালয়ান পর্বতমালা অতিক্রম করে লাদাখে ঢুকতে পারেনা। কারাকোরাম রেঞ্জ হচ্ছে অফুরন্ত জলের ভান্ডার যেটা ভারতীয় উপমহাদেশকে চীন থেকে আলাদা করেছে। কিন্তু ২০১০ সালের বন্যার পর (গ্লোবাল উষ্ণতার কারণ) লাদাখের জলের চাহিদা মেটায় শীত কালের স্নোফলস / তুষারপাত ও সিন্ধু নদের জল। এখানে বৃষ্টি হয় জুলাই আগস্ট মাসে। এই সময়ে লাদাখে গেলে উইন্ডচিটার লাগবে৷ বাল্টিক ভ্যালি, এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমে; upper ইন্ডাসভ্যালি,নুব্রা উত্তরে; দুর্গম জানস্কর ভ্যালি, দক্ষিণে; নগরী, রুদক গুজে পূর্ব দিকে,আঁকসাই চীন উত্তরপূর্বে; সিয়াচিন গ্লেসিয়ার পূর্বে ও কনটেম্পরারী তিব্বত বর্ডার পূর্বে। এই মধ্যবর্তী অঞ্চল হচ্ছে বিস্তৃত লাদাখ। লাদাখের ২ টি জেলা শহর লেহ ও কার্গিল। জনসংখ্যা তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও শিয়া মুসলিম। কার্গিল অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বেশী এবং লেহ অঞ্চলে তিব্বতী বৌদ্ধ বেশী। লেহ জেলা হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম, আয়তন ৪৫১১০ স্কোয়ার কিমি, লে’হর জনসংখ্যা ১৪৭১০৪ তারমধ্যে বৌদ্ধ ৬৬.৪%,হিন্দু ১৭.১%,মুসলিম ১৪.৩% । কার্গিলের জনসংখ্যা১৪৩৩৮৮।তারমধ্যে ৭৭%মুসলমান,১৪.৫%হিন্দু, ৮% আঞ্চলিক। শিক্ষিতের হার ৮০.৪৮% লেহ জেলায়।
লাদাখের ভাষা লাদাখী, তিব্বতী, উর্দু, হিন্দী ও বাল্টি। সংস্কৃতি-তিব্বতী সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে। প্রধান শস্য হচ্ছে বার্লি ও গম। লাদাখী খাদ্যের সাথে তিব্বতের খাদ্যের অনেক মিল রয়েছে, থুকপা (নুডুল স্যুপ) এবং ঝাম্পা নামের খাবার অত্যন্ত সুপরিচিত। কঠোরভাবে লাদাখী একটি ডিশ যা আউকু, রুটি সবজি দিয়ে একটি পাস্তা ডিশ। লাদাখে চা ঐতিহ্যগতভাবে শক্তিশালী সবুজ চা, মাখন এবং লবণ দিয়ে তৈরি হয়। এটি একটি বৃহৎ মশলা মিশ্রিত করা হয় এবং gurgur cha নামে পরিচিত। লাদাখের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ice হকি,তীরন্দাজী / ধর্নুবিদ্যা গ্রামীণ খেলা। প্রথম শতাব্দীতে লাদাখ কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে পশ্চিম লাদাখে প্রবেশ করেছিল কাশ্মীর থেকে। তিব্বতে ও পূর্ব লাদাখে বন সাম্রাজ্য। তারপর সপ্তম শতাব্দীতেও লাদাখে তিব্বতী বৌদ্ধ উপস্থিত ছিল না। ৮৪২ শতাব্দীতে তিব্বত সাম্রাজ্যের পতন হয় গ্ল্যাং-দার-মার এর পৌত্র স্ক্যিদ-ল্ডে-ন্যিমা-গোন লেহ শহর লাদাখ ও পশ্চিম তিব্বতের বহু শহর ও দূর্গ নির্মাণ করেন। ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে বাসগোর রাজা ভগ্ন লেহ রাজাকে পরাজিত করে ন্যামগ্যাল বা বিজয়ী উপাধি গ্রহণ করে লাদাখকে একত্রিত এবং বিস্তৃত করেন। নুতন ন্যামগ্যাল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন ১৫৫৫ থেকে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা তাশি ন্যামগ্যাল, প্রথম রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, লেহ প্রাসাদ তিব্বতের লাসার পাটোলা রাজপ্রাসাদের অনুকরণে। ১৬১২ থেকে ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে সেংগে ন্যামগ্যাল রাজত্ব করেন লাদাখে,সেই সময়ে লাদাখ ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ডোগরা মহারাজ রঞ্জিত সিংয়ের সেনাপতি জোরাওয়ার সিং লাদাখ বিজয় করেন এবং সেপাল ন্যামগ্যাল কে পরাজিত করেন। ১৮৪২ সালে ডোগরা স্টেট জম্মু কাশ্মীরের অধীন হয় লাদাখ। লাদাখের ন্যামগ্যাল রাজপরিবার জায়গীর পান লাদাখের বাৎসরিক খাজনার পরিবর্তে। স্টক প্যালেসে ন্যামগ্যাল রাজপরিবারের স্থানান্তর হয়, এখনো রয়্যাল ফ্যামিলি স্টক প্যালেসে বাস করেন। ১৯৪৭ ডোগড়া রুলার হরি সিং জম্মু কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন, এই ভাবেই লাদাখ ভারতে আসে এবং ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়। ১৯৭৯ সালে লাদাখ অঞ্চল কার্গিল ও লেহ ডিস্ট্রিক্টে ভাগ হয়। ১৯৯০ সালে লাদাখে অটোনমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল গঠিত হয়। লাদাখ এখন সামরিক সেনা ছাউনি কারণ প্রতিরক্ষার কারণে পাক অধিকৃত কাশ্মীর,পাকিস্তান,তিব্বতের দখল নেওয়া চীনের সঙ্গে মোকাবিলা করা দুর্গমপার্বত্য এলাকা পাহারা দেওয়ার জন্যে।
আমাদের যাত্রা হলো শুরু
———————————–
২৪শে জুন ২০১৬ তে সকাল বেলা হালকা জলখাবার খেয়ে সকাল নয়টা নাগাদ আমরা টেম্পো ট্রাভেলার বাসে উঠলাম। প্রতি গাড়িতে ৬-৭ জন ভ্রমণার্থী আর কয়েক জন কুক ও অন্যান্য হেল্পার ও খাবার ইত্যাদি। সঙ্গে থাকতো কাঁচা বাজার, রাস্তাতে লাঞ্চের জন্য রান্না করা খাবার ইত্যাদি। আমাদের লাগেজ থাকতো গাড়ির ছাদে বাঁধা ও প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। উল্লেখ করি এই লোকজনেরা যাত্রার দিন ভোর তিনটাতে উঠে রান্না বসিয়ে সকালের মধ্যে সব সেরে রাখতো আর খাবার যেখানে ব্যবস্থা সেখানে দরকার মতো গরম করে ১০ মিনিটের মধ্যে খাইয়ে দিত। অদ্ভুত সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। আর সামনের গাড়ি আর শেষের গাড়িতে সামনের সিটে ম্যানেজার ও তার ডেপুটি। আমরা ছিলাম সামনের গাড়িতে। আমরা দুইজন। আর এক ফ্যামিলির চারজন। আর ছিলেন এক সত্তর ঊর্ধ্ব মহিলা যিনি সেই বার নিয়ে সপ্তম বার লেহ লাদাখ এলেন। গাড়ী চললো শ্রীনগর ছেড়ে সোন মার্গ ছাড়িয়ে। নীচে দেখলাম বালতাল দিয়ে রাস্তা অমরনাথ যাওয়ার। রাস্তার একদিকে চললো উচ্ছ্বল নদী। মাঝে পাহাড়ী গ্রাম। আর পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। সকালেই ম্যানেজারের কথা শুনে খেয়ে নিয়েছি দুই ফোঁটা কোকা ৩০। আর গাড়ীতে লোকাল ড্রাইভার বাজাচ্ছেন স্পিকারে নিম্নস্বরে ওঁম মনিপদমে ওঁম। বেশ কিছুটা পাহাড়ি রাস্তাতে যাওয়ার পর দেখা গেলো দূরে লাইন দিয়ে গাড়ির সারি। এখানে চেক পোস্ট পার করে এসে পড়লাম দুর্গম যোজিলা পাসে। ১২-১৪ ফুট চওড়া রাস্তা একপাশে বোল্ডারের পাহাড় আর অন্য দিকে বহু নীচে নদী বা ক্ষেত। সমগ্র পাসটি ওপরের থেকে জলের ধারাতে পিচ্ছিল। প্রসঙ্গত এই পাসটিই পাকিস্তানী হানাদাররা বহু ওপরের পাহাড়ের থেকে গোলা ফেলে বন্ধ করে দিয়েছিল কার্গিল যুদ্ধের সময়ে। যে পাসটি আমাদের বীর যোদ্ধারা লড়াই করে পরিষ্কার করে। ছবি তোলা বারণ তাই দুর্গমতা বোঝানোর জন্য নেট থেকে একটি ছবি দিলাম। দুর্গমের যে গা ছমছমে আনন্দ সেটা এই পাস থেকেই শুরু হয়। কিছুদূর গিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন হলো দ্রাসে। এই স্থানটি শীতকালে দ্বিতীয় শীতলতম স্থান। কিছুটা হাত পা ছড়ানো হলো। ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর মাছের ঝোলের মধ্যাহ্ন ভোজন। আহার করলাম যৎকিঞ্চিত ডাক্তারের পরামর্শে। দ্রাসে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিকাল ৩টা নাগাদ রওনা হলাম কার্গিলের দিকে যেখানে রাত্রিবাস।
দ্রাস থেকেই দেখা যাচ্ছিলো দূরে সীমান্তের পাহাড় যার ওপরেই পাকিস্তানের ঘাঁটি। কিছুটা এগিয়ে এলাম,কার্গিল বিজয় স্থলে পৌঁছলাম। গেট দিয়ে ঢুকে এক মিউজিয়ামে ওই সময়ের যুদ্ধের স্মারক রাখা আছে। মডেল দিয়ে দেখানো কিভাবে যুদ্ধজয় হয়েছিল। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল টাইগার হিল। রয়েছে শত শত অমর শহীদদের স্মারক স্থল যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তাদের সম্মানে রয়েছে এক বিশাল জাতীয় পতাকা যেটি নাকি পাহাড়ের ওই দিকের ঘাঁটি থেকে দেখা যায়।
এরপর আমরা পৌঁছলাম কার্গিলের হোটেলে রাত্রিবাসের জন্য। অল্প ঠান্ডা। সেখানে বিকালে মুড়ি চানাচুর কফি দিয়ে নাস্তা হলো। রাতে রুটি ডাল তরকারি আর ডিমের ঝোল। প্রথম বিপত্তি। আমারই বয়সী এক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। পোর্টেবল অক্সিজেন দিয়ে কিছুটা ম্যানেজ হলো। তাঁর বাড়িতে ডাক্তার ছেলেকে খবর দেওয়া হলো। নেট প্রায় চলছিল না। টিভিও তথৈবচ। তাই আড্ডা মেরে সময় কাটলো। তারপর আরামের ঘুম। কাল সকালে বেরোনো হবে লেহ এর দিকে।
একদম সকাল পাঁচটাতে ঘুম ভাঙল বেড টি দেওয়ার ঠকঠকানীতে। চা বিস্কুট খেয়ে স্নান করে তৈরি হওয়া। সকাল ৬টা তে লাগেজ নিয়ে গেলো বাসে লোডিংয়ের জন্য আর ৬.৩০,তে ঘরেই ব্রেকফাস্ট। সকাল ৭টাতে প্ল্যান মতো বেরোনো হলো লেহ শহরের দিকে ২১৪ কিমি দূরে। আমরা বাসে নিজেরাই সিট ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। আমাদের জন্য সামনের সিট। তারপরের দুটি সিট আরেক ফ্যামিলির চারজনের। আর আমাদের অভিজ্ঞ দিদি সামনের বাম দিকের সিঙ্গল সিট। এতো বন্ধুত্ব ভালোবাসা হয়ে গিয়েছিলো আমাদের ৭ জনের, মনে হতো একই বাড়ির। কারগিল শহরে লে-লাদাখের প্রথম দিনে পৌঁছে হোটেল জোজিলাতে খুব সুন্দর কাটল। খুব পরিচ্ছন্ন শহর| শহরের মাঝ বরাবর নদী বয়ে চলেছে৷ এখানে এত সুন্দর হোটেল পাওয়া যাবে আগে ভাবিনি৷ হোটেলের রেস্টুরেন্টটাও খুব ভালো৷ সবরকম খাবার পাওয়া যায়৷ জিরা রাইস ও সাথে আলুর দম খেয়ে খুবই তৃপ্তি পেলাম৷
দ্বিতীয় দিনে তৈরী হয়ে বেরোতে হবে লেহ শহরের উদ্দেশ্যে৷ রাস্তায় আজ রয়েছে বেশ কিছূ স্পট৷ দেখার আছে অনেক কিছু৷ আর অনেকটা রাস্তা পেরোতে হবে| সেইমত সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে নিলাম৷ গতকাল আমাদের ড্রাইভার ভাই আমাদের হোটেল খোঁজার জন্য অনেক সাহায্য করেছিল৷ আসলে ওঁর বাড়ি কাছাকাছি কোথাও৷ ফলে বিকেলে আমাদের হোটেলে ড্রপ করে বাড়ি চলে গিয়েছিল৷ সকাল নটার মধ্যে ও তৈরী হয়ে চলে আসতেই আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম৷ রাতে ভাল ঘুম হওয়ায় শরীর মন বেশ চনমনে লাগছিল৷ গতকাল কারগিল শহর ঘুরতে ঘুরতে দারুণ কলা আর অ্যাভাকাডো কিনে নিয়েছিলাম৷ ব্রেকফাস্ট বেশ ভাল হল৷ বেশ সুন্দর রাস্তা আর মনোরম রং বেরংয়ের পাহাড়৷ কোথাও সোনালী তো কোথাও বাদামি তো কোথাও ধূসর৷ পাহাড়ের উপর হালকা মেঘের ছায়া পড়ে ব্যাপারটা বেশ সুন্দর লাগছিল৷ যেতে যেতে প্রথমে পড়ল রাস্তার পাশেই মুলবেক৷ (একটা জরুরী কথা শেয়ার না করে পারলাম না৷ রাস্তায় যেতে যেতে ভেড়ার পাল নিয়ে অনেক লাদাখবাসীকে দেখতে পাওয়া যায়৷ ওরা খুবই গরিব৷ সম্ভব হলে একটু খাবার ওদের জন্য রাখবেন৷)
এখানকার রক কাট বৌদ্ধমূর্তি এক অনবদ্য সৃষ্টি। পাহাড় কেটে তৈরী করা হয়েছে ভগবান বুদ্ধর দন্ডায়মান মূর্তি৷ বেশ অন্যরকম লাগল৷ এখানেই পরিচয় হল থাইল্যান্ড থেকে আসা তিন তরুণীর সাথে। তারা এসেছে লেহ যাবে বলে৷ বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে এবং ছবি তুলে রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্যে৷ এবার আরো বেশী উচ্চতা। পাহাড়ও বড় বড় কিন্তু রাস্তা খুব সুন্দর। মুলবেক পেরিয়ে প্রথমে নামিকলা পাস (12198 ফুট) এলাম তখন পাঞ্জাব থেকে আসা এক বাইক বাহিনীর সাথে দেখা হল৷ এখানে দাঁড়িয়ে দিগন্তের পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করলাম৷ অনেক ছবি তুলে আবার পরের গন্তব্য। নামিকলা পাস পেরিয়ে চলেছি তো চলেছি৷ পাহাড়ের রূপ দেখার মত৷ পাহাড়ের পর পাহাড়৷ তার কি রং আর কি রূপ৷ দেখতে দেখতে এসে পড়লাম আরও একটা পাস ফটুলা পাস (13478 ফুট)। সোনালী পাহাড়ের এই পাস পেরিয়ে এবার যেখানে এলাম সেই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এবং রঙ সম্পূর্ণ অন্য রকম৷ মনে হয় কাদা মাটির প্রলেপ দেওয়া পেলব মসৃণ সব পাহাড়৷ হ্যাঁ এটাই লামায়ারু৷ যা কিনা মুনল্যান্ড অফ লাদাখ বা আর্থ নামে পরিচিত৷ হ্যাঁ ঠিক মনে হবে যেন চাঁদের দেশেই এসেছি৷ অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম৷ এখানে কয়েকশো বছরের পুরানো একটা বৌদ্ধ টেম্পল রয়েছে৷ 50 টাকা এন্ট্রি ফি দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এই মন্দিরে। বেশ মুগ্ধ হয়ে গেলাম সব দেখে৷ কাছের এক রেস্টুরেন্টে চাউমিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ কিছুদূর পেরিয়ে এবার উৎরাই যাওয়া৷ নাম হাঙ্গরো লুপ৷ 18 টা হেয়ার পিন লুপ আছে এখানে৷ বেশ মজার। আমাদের ড্রাইভারের হাত খুব ভাল৷ সুন্দরভাবে এই রাস্তা পেরোতে কোন অসুবিধা হল না৷
এবার পেলাম ‘খাটসে’ বলে একটা জায়গা৷ খাটসে পেরিয়ে নিমু৷ এখানেই রাস্তার ডান দিকে আছে indus-zanskar নদীর সঙ্গম স্থল৷ দুটো নদী আলাদা ভাবে এসে মিশেছে৷ দুই ধারার রঙ সম্পূর্ন আলাদা৷ এখানে গাড়ি থামিয়ে ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখলাম৷ অনবদ্য এক পাহাড় ও নদীর সে রূপ৷ আরো কিছুটা দূরে এক বিস্তীর্ণ সমতল জায়গায় এসে পৌঁছলাম। কালো ফিতের মত রাস্তা অনেক অনেক দূরে চলে গেছে৷ এখানেই একটা জায়গা হল ম্যাগনেটিক হিল৷ ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে এখানে গাড়ী নিউট্রাল অবস্থাতেই নিচু থেকে উঁচু দিকে যেতে থাকে৷ একটা ছবি দিলাম যেটা ওই ম্যাগনেটিক হিল এ তোলা৷ ব্যাপারটা খুব অদ্ভূত৷ বেশ এনজয় করা যায় বিষয়টা।
প্রথমে এলাম মুলবেক বলে একটি জায়গাতে যেখানে পাথর খোদাই করা মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি, ফিউচার বুদ্ধ, প্রায় নয় ফুট উঁচু। এর পরেই আশ পাশের দৃশ্যই পাল্টে গেলো। নিচু নিচু বিভিন্ন রঙের গোল পাহাড়ের সারি। আমরা দাঁড়ালাম ম্যাগনেটিক হিল বলে লেখা আছে রাস্তার ওপরে সেইখানে। গাড়ি নিউট্রালে রেখে ইঞ্জিন বন্ধ রাখলে নিজেই চলতে শুরু করে।
এরপরে নামিকালা বলে ১২৬০০ ফুটের একটি পাস পেরিয়ে একটি বড় গ্রাম আর আর্মি বেস,নাম বোধ খারবু তে এলাম। এরপরে একটি রাস্তা আছে ফতুল্লা পাস ১৩৭৪৯ ফুট উঁচু পেরিয়ে তারপর প্রচুর হেয়ারপিন বেন্ড দিয়ে নেমে বিখ্যাত মনাস্ট্রি লামায়ারু যাওয়ার। এটা আমাদের প্ল্যানে ছিলোনা প্রচুর সিঁড়ি ভাঙতে হয় বলে। আমরা অন্য রাস্তা দিয়ে চলে পৌঁছলাম মুন ল্যান্ডে। যেখানে অদ্ভুত রঙের মুলতানি মিটটির পাহাড়।
এরপর প্রায় ৪০০০ ফুট নেমে আমরা সিন্ধু নদী বা নদ পেরোলাম। এরপর পৌঁছলাম সাসপোল বলে একটি জায়গাতে যেখানে রাস্তার ধারে একটি বিশাল ধর্মচক্র। এরপর এলো বাসগো যেটি আগে লাদাখের রাজধানী ছিল। তারপর নিম্মো যেখানে সিন্ধু আর জাসকর মিলেছে। এখানেই আমাদের কোম্পানি ভেল(BHEL) তৈরি করেছে একটি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিম্মো বাসগো। ২০১১ থেকে ২০১৩ এই লাদাখ অঞ্চলের সমস্ত জল বিদ্যুৎ প্রকল্প আমার অধীনে হলেও কোনোদিন আর টুরে আসিনি।
এখান থেকেই রাস্তা বেরিয়েছে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে যাওয়ার। দেখা যায় দূরে সেই রূপোর মতো ঝকঝকে পাহাড় চূড়া। এখানেই বিদ্যুৎ সাব স্টেশন আমার অধীনে থাকলেও সাহস করে টুরে আসতে পারিনি। আমরা গুরদ্বারা পথথর সাহেব,যেখানে নানকজি এসেছিলেন,সেটা পেরিয়ে লেহ ভ্যালিতে ঢুকলাম। প্রথমে লেহ বিমানবন্দর তারপর হল অফ ফেম (এখানে পরে এসেছিলাম),আর্মি ক্যাম্প,আর্মি হাসপাতাল (যাত্রীদের প্রধান ভরসা অসুস্থ হলে) পেরিয়ে ১১০০০ ফুট উচ্চতায় লেহ শহরে পৌঁছলাম। এখানেই আমাদের থাকা আগামী ৭ দিন।
আমাদের হোটেলের নাম ছিলো হোটেল গোয়ালিং ইন্টারন্যাশনাল যার মালিক এক বাঙালি মুসলিম জাকির ভাই। ২০১০-১১ সালে একবার এখানে ক্লাউড বার্স্ট হয়ে চারিদিক জলে ডুবে যায়। হোটেলটি একটু উঁচুতে হওয়াতে উনি যতজনকে পারেন হোটেলে নিয়ে আসেন ও চার পাঁচ দিন রাখেন খাবার খিচুড়ি আর ম্যাগী খাইয়ে। তারপর ওনার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে যোগাযোগের ফলে বিশেষ বিমান আসে ও যাত্রীরা দিল্লী বা শ্রীনগর পৌঁছান। আমরাও ওনার অতিথেয়তাতে মুগ্ধ ছিলাম। উনি নিয়ম করে নিজে রোজ সকালে যখন ব্রেকফাস্ট করতাম তখন নিজের অক্সিমিটার দিয়ে মাপতেন ও দরকার হলে সতর্ক করতেন। ওনার ও আমাদের ট্র্যাভেলের ব্যবস্থাতে যিনি কার্গিলে অসুস্থ হয়ে যান ওনাকে আর্মি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। (উনি ও ওনার স্ত্রী আর বেড়াতে পারেন নি । চারদিন পরে প্লেনে ফিরে যান)
নিয়ম মেনে সেই দিন আমাদেরকে বলা হলো বিশ্রাম নিতে রুমে। যার যা দরকার ট্র্যাভেলের ম্যানেজার কে জানালে উনি নীচের বাজার থেকে আনিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা হাত মুখ ধুয়ে তারপর মধ্যাহ্ন ভোজন করলাম ভাত ডাল আলুভাজা আর মাছের ঝোলের। বাকি সারাদিন আমরা বিশ্রামে ছিলাম । সময় মতো চা জলখাবার ও ডিনার রেস্টুরেন্টে আমাদের কুকেরা সার্ভ করছিল। অবশ্য অতি উৎসাহী কয়েকজন বিশেষ করে কম বয়সীরা বিকালে চলে গেলেন লেহ বাজারে কেনাকাটা করতে। ডিনারের সময় বলা হলো পরের দিন হালকা ঘোরা ফেরা হবে লেহ শহরের মধ্যেই।
এই লেহ ডিস্ট্রিক্ট প্রায় ৪৫০০০ স্কোয়ার কিমি বড়ো কিন্তু ভারতের সবথেকে কম জনবহুল জায়গা। এখানকার অধিবাসীরা দ্রোগপা আর চাগপা। লাদাখ নামটাই এসেছে লা দাগস তিবেটিয়ান কথা থেকে যার মানে পাহাড়ী গিরিবর্ত্মের দেশ। ভারতের সব থেকে উচ্চতার ডিস্ট্রিক্ট আর সব থেকে ঠান্ডা আর শুকনো জায়গা। শীতকালে লেহতে মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রী অবধি ঠান্ডা পড়ে৷ বছরে ১০ সেমির বেশি বৃষ্টি হয় না। এখানে বেরোবার সময় সান ব্লক ক্রিম যার এসপিএফ ৫০ এর বেশি ব্যবহার আবশ্যিক। এখানে কারও কারও নাক শুকিয়ে যায় আর রক্ত পড়ে (আমার হয়েছিল)। এর জন্যে ওট্রিভিন উইথ স্যালাইন ব্যবহার করতে হয় যাদের প্রবলেম থাকে।
ব্যস আবার আগামী কাল। প্রসঙ্গত রাতে আমার ঘুম হয়নি নাক শুকিয়ে বন্ধ হয়ে। এইদিন ও কোনো দৌড় ঝাঁপ লম্বা জার্নি রাখা হয়নি। সকালে ৭টাতে উঠে বাইরের বাগান ঘুরে চা খেয়ে তারপর তৈরি হওয়া। ৯টাতে জলখাবার সেরে বেরোনো হলো শহর ঘুরতে।
প্রথমে বিখ্যাত হেমিস গুম্ফা। ১৬৩০ সালে প্ৰতিষ্ঠিত লাদাখের এই সর্ব বৃহৎ গুম্ফা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে। একটি মাঝারি সাইজের পাহাড়ের ওপরে বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে ওঠা এই মনাস্ট্রিতে ।একটি বিশাল প্রাঙ্গণ ঘিরে তিনদিকে তিন তলার বাড়ি। এই প্রাঙ্গনেই বিখ্যাত মুখোশ নৃত্য হয় বছরের বিশেষ সময়ে। মূল মন্দিরে আছে ১২ মিটার উচ্চতার তামার তৈরি হলুদ বস্ত্রে সজ্জিত পদ্মের ওপর প্ৰতিষ্ঠিত পদমসম্ভব বুদ্ধ মূর্তি। পুরো গুম্ফাতে ধ্যানগম্ভীর ভাব। ধূপের গন্ধ,ভিক্ষুরা ধ্যান করছেন আর হাল্কা ভাবে ভেসে আসছে ওঁম মনিপদমে ওঁম মন্ত্র। যারা ইচ্ছুক নীচে একটি অপূর্ব দোকান আছে সেখানে নানা স্মারক কিনতে পারেন।
এরপর যাওয়া হলো থিকসে গুম্ফা ও মনস্ট্রি। একটি হেলানো পাহাড়ের গায়ে ধীরে ধীরে উঠেছে এই সুন্দর মনাস্ট্রি। তিব্বতের লাসার পোটালা প্রাসাদের অনুকরণে তৈরি এই গুম্ফা। প্রচুর সিঁড়ি ভেঙে ও তীব্র রোদে এই গুম্ফাতে ওঠা আমাদের মতো বয়স্কদের পক্ষে কঠিন। তবে ধীরে ধীরে বিশ্রাম নিয়ে উঠলে অসুবিধা হয় না। ওপরে সুসজ্জিত কক্ষে মৈত্রেয় বুদ্ধের ১৫ ফুট উঁচু মূর্তি আছে। এই মনাস্ট্রি যাওয়ার রাস্তাতেই দেখা যায় বিখ্যাত শে প্যালেস। যদিও আমরা সেখানে যাই নি।
এরপর যাওয়া হলো Rancho র স্কুলে,থ্রি ইডিয়ট সিনেমা খ্যাত। এই স্কুলটি একটি সাধারণ তিব্বতি স্কুল ছিল যেখানে আমির খানের সিনেমার শুটিং হয় ও পরে আমিরের অর্থ সাহায্যে স্কুলটি সুন্দর করে তৈরি হয়। সিনেমার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই দেখার নেই এখানে। শুনেছি আজকাল টুরিস্টদের নিয়ে যাওয়া হয় না। এর পর ফেরার সময় সিন্ধু নদ দর্শন করে চলে এলাম হোটেলে কিছু বিশ্রাম আর মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য। আবার কিছু পরে যাওয়া হলো হল অফ ফেম আর্মি মেমোরিয়াল দেখতে। অপূর্ব সুন্দর মিউজিয়ামে ১৯৪৮ থেকে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের নানা স্মৃতি আছে । আর আছে লাদাখি সামাজিক জীবনশৈলীর নানা নিদর্শন। আমি ক্যামেরা নিয়ে যাই নি কিন্তু পরে আফসোস হয়েছিল। তারপর শেষ গন্তব্য আজকের শান্তি স্তুপ । জাপানী বুদ্ধিস্টদের তৈরি এই স্তূপটি দলাই লামা উদ্বোধন করেন ১৯৮৩ সালে। স্তুপের ওপরে রয়েছে স্বর্ণকান্তি বুদ্ধের মূর্তি। পড়ন্ত বিকেলে ওই স্তুপের ওপর বসে থাকলে চারিদিকের দৃশ্যে মনে প্রশান্তির ভাব নেমে আসে।
ফিরে এলাম হোটেলে ভগ্নপ্রায় লেহ প্যালেসের পাশ দিয়ে। ফিরে এসে গরম গরম সিঙ্গারা ও কফি খাওয়া হলো বাগানে আরাম করতে করতে। তারপর লাউঞ্জে বসে জমিয়ে আড্ডা সব যাত্রী মিলে।
এবার লিখি এই লাদাখ প্রদেশের কিছু বিশেষ খাবারের বিবরণ । যদিও সব কটি আমি খাওয়ার সুযোগ পাইনি কারণ রোজ ৮-১০ঘন্টার ঘোরাঘুরি আর টুর ম্যানেজারের বারণে । তবুও যতটা খেয়েছি অথবা ওখানকার লোকের কাছে জেনেছি সেই থেকেই এই লেখা।
১) ইয়াকের দুধের চিজ, নাম হচ্ছে চুপরি । এটা মেন মার্কেটে পাওয়া যায় । শক্ত আর নোনতা মিষ্টি স্বাদ এই চিজটার । দেখতে ক্যালসিয়ামের ডিপোজিট এর মতো । সহজে খারাপ হয় না । শরীর গরম করে । হজম করতে সময় লাগে ।
২) #তিগমো বা # টিমো হচ্ছে ফার্মেন্ট করে স্টিম করা বানের মতো । চাইনিজ বাওয়ের মতো । স্টু জাতীয় ঝোল দিয়ে খায় । খুব নরম ও সুস্বাদু এই টিমো ।
৩) #মাখন #চা। এই চা কোনো রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় না । আমাদের হোটেলে বিশেষ অনুরোধে এক দুই বার করে দিয়েছে । দলা দলা মাখন অল্প নুন আর চায়ের এই মিশ্রণ হয় এক বিশেষ পাত্রে । লাদাখে সব বাড়িতে এইটি থাকে । খেতে স্বাদ একদম নোনতা আর রংটা পিঙ্ক । এই চা খেলে অলটিচুড সিকনেস হয় না ।
৪) #মোমো। এটা তো সব থেকে চালু খাবার এখানে । আমরা কলকাতাতে যেমন খাই সেই রকমই স্বাদ তবে ভাজা বা বেকড পাওয়া যায় না আর সাধারণত বাঁধাকপির পুর দিয়ে তৈরি ।
৫) #থুকপা বা #থেনটুক। এটা একটা ক্লিয়ার সুপ নুডুলস আর সব রকম তরকারি দিয়ে হয় । নুডুলস ছাড়া থুকপা আর নুডুলস দিয়ে থেনটুক। এই তিব্বতী খাবারটি সব জায়গাতে পাওয়া যায় । ছোট চায়ের দোকানে । যেমন ম্যাগীও পাওয়া যায় সব খানে । প্রচন্ড ঠাণ্ডাতে গরম গরম খেতে খুব ভালো লাগে । খারদুঙলা পাসে ১৮৩৫০ ফুট ওপরে মিলিটারি ক্যান্টিনে খেয়েছি শীতে হি হি করতে কাঁপতে কাঁপতে ।
৬) #মোকটুক। থুকপার মতোই যদি মোমো কে ক্লিয়ার ভেজিটেবল সুপ দিয়ে খান তাহলেই ওটা মোকটুক । কলকাতাতে টেরিটি বাজারে চীনা জলখাবারেও পাওয়া যায় অন্য নামে ।
৭) #কাহাওয়া। এটি হচ্ছে দারুচিনি আর জাফরান দিয়ে তৈরি এক সুস্বাদু পানীয় । এটি এই দেশে এক অবশ্য পানীয় মিশ্রণ । খুব ঠাণ্ডাতে শরীরে আরাম দেয় আর শরীর গরমও রাখে । লোকাল মুদির দোকানে এর পাউডার ফর্ম পাওয়া যায় । কলকাতাতে আজকাল শীতকালের মেলাগুলিতে স্টল দিয়ে বসে । খুবই সুস্বাদু পানীয় ।
৮) #কুলচা। না না এই খাবারটিকে এর উত্তর ভারতের একই নামের খাবারের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না । এটি বিবিধ শস্যের একটি শক্ত বান বিশেষ যেটি বহুদিন ঠিক থাকে । তবে খেতে হলে এদের মতো পরিশ্রম করতে হবে । এরা দেখেছি লাঞ্চে চায়ে বা কাহাওয়া তে ডুবিয়ে খায় এই রুটি । আর কী,এবার লাদাখ গেলে এর একটি দুটি অবশ্যই খেয়ে দেখুন। কাহাওয়া তো অবশ্যই খাবেন।
ম্যানেজার জানালেন যে আগামী কাল বেশ সকালে আমরা রওনা হবো বিখ্যাত খারদুঙলা পাস (টুরিস্টদের জন্য খোলা সব থেকে উঁচু গিরিবর্ত্ম।) হয়ে শীতলতম মরুভূমি নুব্রা ভ্যালীর দিকে। সেখানে একরাত্রি থেকে আবার ফিরে আসা। তাই ভারী মালপত্র হোটেলে ছেড়ে একটি করে ব্যাগ নিয়ে যাত্রা। তবে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্য দিয়ে যাওয়া তাই ভারী শীতবস্ত্রের দরকার হবে।
রাত্রি ৯টা নাগাদ রুটি মাংস খেয়ে নাকে ড্রপ দিয়ে ঘুম। কালকে রোমাঞ্চকর যাত্রা যেটা বয়স্কদের কাছে অভিযান ।
লেহ থেকে ৫০ কিলোমিটার দুর্গম পথ পেরিয়ে খারদুংলা টপ। বিশ্বের উচ্চতম যানোপযোগী পথ (টুরিস্টদের জন্য) বলে খ্যাত সেই স্থানের হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডাও মনে থাকে বহুদিন। খারদুংলা পেরিয়ে একে একে খালসার, হুন্ডার, পানামিক। খালসারের কাছেই নুব্রা নদী স্বচ্ছতোয়া শিয়ক নদীর সাথে মিশেছে । শিয়ক নদীর ওপর সেতু পেরোলেই শীতল মরুভূমি। সেখানকার দু’কুঁজো উট, সবুজ মরূদ্যান, উষ্ণপ্রস্রবণ সব মিলিয়ে এ এক অচিন দেশের ভ্রমণকথা। আমাদের লাদাখ ভ্রমণের একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল এই খারদুংলা গিরিবর্ত্ম ভ্রমণ ৷ অনেক অনেক সকালে বাসে রওনা দিলাম আমরা ২০ জন চারটি বাসে নুব্রা ভ্যালির উদ্দেশ্যে,পথে পড়বে এই হাড় কাঁপানো পাস বা লা। বলে রাখি যে আমাদের দলের ২০ জনের মধ্যে ১৬ জন ষাটোর্ধ্ব। শুরুতেই ম্যানেজার আমাদের বলে দিলেন মনে করে শ্বাসকষ্ট জনিত অসুবিধা আটকানোর ওষুধ খাওয়ার কথা। প্রচন্ড ঠান্ডার সময় পড়ার জন্য শীতের কাপড় হাতের কাছে রাখার কথা। ব্রেকফাস্ট প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিল।
সময়ের সাথে সাথে বাদামি ধূসর পাহাড়গুলো ক্রমে অদৃশ্য হয়ে গেল ও তুষারশুভ্র পাহাড় তার জায়গা নিতে থাকল। বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ের গায়ে তৈরি সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে আমাদের গাড়িটা ধীরগতিতে এগিয়ে চলল । রাস্তার ওপর এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে থাকা পেঁজা তুলোর মতো বরফ সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে জলের ধারার সৃষ্টি করছে। রাস্তার পাহাড়ের দিকের অংশে পাহাড় চুঁইয়ে গড়িয়ে আসা জল জমাট বেঁধে স্ফটিকের আকার নিয়েছে, আর তার ওপর সকালের সূর্যকিরণ বিচ্ছুরিত হয়ে রামধনু রঙ ছড়াচ্ছে । রাস্তার অন্য দিকে অর্থাৎ খাদের দিকের অংশে প্রকৃতি বরফের হরেকরকম স্থাপত্য রচনা করেছে। উত্তরে কারাকোরাম আর দক্ষিণে জাঁসকারের শ্বেতশুভ্র পর্বতমালা। পরিষ্কার নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে চলেছে, আর বরফ-মোড়া পাহাড়ের ওপর সূর্যরশ্মি পড়ে ঠিক যেন সাদা ক্যানভাসে এক চিরসুন্দর ছবি এঁকে চলেছে। প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করতে একহাতের গ্লাভস খুলে ক্যামেরার শাটার টিপছিলাম, কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম হাতের আঙুলগুলো ক্রমে অবশ হয়ে আসছে। তাপমাত্রা এখানে হিমাঙ্কের নিচে নেমে গিয়েছে। এই অঞ্চলে দিনের বেলা সানগ্লাস ছাড়া চলাচল বিপজ্জনক, কারণ বরফের ওপর সূর্যালোকের তীব্র প্রতিফলন চোখের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক। পাশেই সিয়াচেন চোখে পড়ল ভারতীয় সেনাবাহিনীর তাঁবু ও সেনাদের নিঃশব্দ চলাচল। খারদুংলা পৌঁছানোর আগে থেকেই শুরু হলো গায়ে গরম কাপড় চাপানো। ওখানে পৌঁছে ধীরে ধীরে বাস থেকে নেমে পাশের রাস্তাতে দাঁড়ালাম। শরীরটাকে সইয়ে নেওয়া ঠান্ডা আর কম অক্সিজেনে। আমাদের সহযোগী দুই যাত্রী অসুস্থ বোধ করাতে নামতে পারলেন না। নেমে প্রথমেই টয়লেটের খোঁজ। কারণ এই ঠাণ্ডাতে দরকারটা একটু বেশি হয়। আর্মি থেকে একদিকে লাইন করে প্রচুর বায়ো টয়লেট রেখে দিয়েছে। তারপর কর্তা গিন্নি হাত ধরাধরি করে গ্লেসিয়ারের দিকে এগোলাম । প্রচুর ভিড়। তবুও ছবি ইত্যাদি তোলা হলো। অতি উৎসাহীরা গ্লেসিয়ার বেয়ে উঠতে লাগলেন। দেখাদেখি আমার সহধর্মিনীও কিছুটা উঠলেন। ছবিও তোলা হলো। তারপর উচ্চতম আর্মি ক্যান্টিনে গরম নুন চা খাওয়া হলো। ম্যাগি আর থুকপাও পাওয়া যাচ্ছিল। এরপর আস্তে আস্তে বাসের দিকে। কারণ উচ্চতাগত কারণে ৩০ মিনিটের বেশি বাইরে ঘোরা বারণ করা হয়। নোটিস বোর্ডেও লেখা আছে। তবুও লোকে বাড়াবাড়ি করে আর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর সবাই জড়ো হলে নুব্রা যাত্রা। খারদুংলার ১৫ কিলোমিটার উত্তরে নর্থ পুল্লু, আর ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সাউথ পুল্লু। দু’টোই সেনা শিবির। সাউথ পুল্লু হয়ে আমরা টপে উঠেছি। উতরাই পথে নর্থ পুল্লু, খারদুংলা গ্রাম হয়ে এবার আমাদের গন্তব্য নুব্রা ভ্যালি,প্রায় ১০০ কিলোমিটার যাত্রাপথ। শুরুর রাস্তা বেশ খারাপ । যেখানে-সেখানে ধস নেমে রাস্তা ভেঙেছে । পাশের পাহাড় প্রমাণ বরফ গলে জলপ্রবাহ তৈরি হয়েছে আর সেই জল-ভরা গভীর গর্তময় পথে গাড়ির চাকার পক্ষে এগনো বেশ কষ্টকর । নর্থ পুল্লুতে আসতে চোখে পড়ল সাদা পাহাড়ের গা-বেয়ে মিলিটারি সাঁজোয়া গাড়ির লম্বা সারি ধীর গতিতে আমাদের দিকে আসছে । এখানে রাস্তা একমুখী । তাই তাদের যাওয়ার জায়গা করে দিতে আমাদের গাড়িটাকে সেনা শিবিরের কাছে দাঁড় করাল। ১৯৭৩ সালে পাসের ওপর এই রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন কিছু ভারতীয় জওয়ান । এই রাস্তা ধরে আরো ১৬৪ কিলোমিটার চললে সিয়াচেন বেসক্যাম্প পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র । আর সেই বেসক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রসদ যায় এই পথ ধরেই। তাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই রাস্তার গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা নামে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তখন রাস্তা ঢেকে যায় ১০ ফুট পুরু বরফের চাদরে। অতন্দ্র প্রহরারত এই ফৌজিদের দিনযাপন তখন হয়ে ওঠে আরো কঠিন ও দুর্বিষহ। মিলিটারি গাড়ির সারি চলে যেতে বাস্তবের এই নায়কদের সালাম জানিয়ে আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। পাস থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার উত্তরে খারদুং গ্রামে কয়েকটা দোকান পাওয়া গেল এর পরের রাস্তা অপেক্ষাকৃত ভালো। চারপাশের বরফের সাম্রাজ্য কমে ক্রমে সবুজের উপস্থিতি বাড়তে থাকল। পথে দেখা মিলল ইয়াক, ভেড়া ও কিয়াং বা বন্য গাধার। এ ছাড়া পথের ধারে তৃণভূমির মধ্যে ভোঁদর-সদৃশ হিমালয়ান মার্মটের দেখা পাওয়া উতরাই পথের বিশেষ প্রাপ্তি। খারদুংলা থেকে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার রাস্তা নেমে আমরা পৌঁছলাম খালসারে। সিয়াচেন হিমবাহের বরফগলা জল তিরতির করে নুব্রা নাম নিয়ে কাছেই শিয়কে এসে মিশেছে। এই দুই নদী সৃষ্টি করেছে এক সবুজ উপত্যকার,যা নুব্রা ভ্যালি নামে খ্যাত। ‘নুব্রা’-র অর্থ ফুলের বাগান, ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস লাদাখের মরুদ্যান। এর গড় উচ্চতা ১০ হাজার ফুট। এখানে বহিরাগতদের পারমিট ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই লে-তে তৈরি পারমিটের এক কপি চেকপোস্টে জমা দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম নুব্রা উপত্যকায়,যা পৃথক করেছে লাদাখ ও কারাকোরাম পর্বতমালাকে । এখানে গম, বার্লি, সর্ষে ছাড়াও শীতের ফল আপেল, খুবানি ও আখরোটের চাষ হয়। স্থানীয় লোকেরা লাদাখি ভাষায় কথা বলে। বেশির ভাগ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও কিছু সংখ্যক শিয়া ও সুন্নি মুসলিমেরও বাস রয়েছে। খালসার থেকে দু’টি রাস্তার উপত্যকার দুই প্রান্তে চলে গিয়েছে । বাঁদিকের রাস্তা ধরে প্রায় ১৯ কিলোমিটার পূর্বে আমরা পৌঁছলাম উপত্যকার সব থেকে বড় গ্রাম দেসকিটে হোটেলে। এখানে দোকান-বাজারের সাথে পৌঁছে গিয়েছে ব্যাংক পরিষেবাও । প্রধান দ্রষ্টব্য ৬০০ বছরের প্রাচীন দেসকিট-মনাস্ট্রি। মাথার ওপর পতপত করে উড়ছে বৌদ্ধদের রঙিন ধর্মীয় পতাকার সারি। এখান থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কে-২ দেখা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আরো সাত কিলোমিটার পথ চলার পর এক সরু নদীর ধারে আমাদের গাড়িটা থামাল। গাড়ি থেকে নেমে আমরা এক আশ্চর্য দৃশ্যের সম্মুখীন । এতক্ষণ দূর থেকে দেখা ধূসর ন্যাড়া পাহাড়গুলো এখন খুব কাছে আমাদের চার দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাথায় বরফের আস্তরণে পড়ন্ত বিকেলের আলো পড়ে স্ফটিকের আকার নিয়েছে। রোদের তাপ বেশ চড়া হলেও কলকল শব্দে বয়ে চলা শিয়কনদীর জল যেমন স্বচ্ছ, ততটাই ঠাণ্ডা । নদীর ওপর এক ছোট বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে আমরা ওপারে পা রাখলাম। সামনে পাহাড়ঘেরা ঢেউ খেলানো সাদা বালিয়াড়ির সমুদ্র । ইতস্তত ছড়িয়ে আছে কাঁটাগাছের ঝোপ । এটাই বিখ্যাত হুন্ডার । ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় ভারতের উচ্চতম মরুভূমি। এই শীতল মরুভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে দুই কুঁজবিশিষ্ট লোমশ উট ৷ এরা মধ্য এশিয়ার তাকলামাকান ও গোবি মরুভূমির ব্যাকট্রিয়ান উটের প্রজাতিভুক্ত।
উটে চড়ে মরুভূমি-বিহার এই সফরে এক অন্য সাধের অনুভূতি । উট সওয়ারির খরচ প্রতি ১৫ মিনিটে ১৫০ টাকা। লাদাখে দিনের আলো থাকে রাত আটটা পর্যন্ত। নৈশভোজ সেরে হোটেলের জানালা দিয়ে রাতের মায়াবী আলোয় কালচে পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। খালসার থেকে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে পানামিক পৌঁছতে ঘণ্টাদুয়েকের বেশি সময় লাগল। এখানে ভূগর্ভ ফুঁড়ে বিরামহীন ধারায় উঠে আসা উষ্ণপ্রস্রবণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পাথরের গায়ে বিচিত্র রঙের সৃষ্টি করেছে। পানামিকই লাদাখের শেষ গ্রাম,যে পর্যন্ত ভ্রমণার্থীদের যাওয়ার অনুমতি মেলে। এরপর এই রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে সিয়াচেন বেসক্যাম্পে। দূরত্ব ৯৪ কিলোমিটার। এবার ফিরতি রাস্তায় লে-তে ফেরা দুপুরে লাঞ্চ করে। সদ্য দেখা চোখজুড়ানো সব ছবিগুলো মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। রুক্ষ দেখে সবুজের মরুদ্যান, ন্যাড়া পাহাড়ের কোলে শীতল মরুভূমি, তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী, উষ্ণপ্রস্রবণ একই সাথে প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ শুধু ভারতবর্ষেই নয় হয়তো-বা সমগ্র পৃথিবীতেই দুর্লভ। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। পথে আবার পড়লো সেই দুর্গম খারদুংলা । আবারও নামা হলো । তবে ভিড়ের দাপটে বেশিক্ষন নয়। এছাড়া লোকেরা গ্লেসিয়ারের গায়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারা শুরু করেছে । তাই মানে মানে বাসে ফিরে এলাম। সন্ধ্যায় পৌঁছলাম লেহ। লেহর হোটেল থেকে আমরা সকাল ৪.৩০ মিনিটে বেরোই পাংগং এর রাস্তাতে । সকাল সকাল সব কর্ম সেরে ওই ঠাণ্ডাতে বেরোনো সারা দিনের জন্য সে এক বিড়ম্বনা। তবে শুনলাম রাস্তাতে নাকি কোথায় বিকালের দিকে বরফ গলে জল আসা শুরু হয় তাই সেই সময়ের আগে ফেরা। না হলে অন্য দুর্গম মিলিটারির রাস্তা দিয়ে ফিরতে রাত কাবার হয়ে যাবে । ২০১১ সালে আমার বড়ো ভাইদের সাথে সেই রকম ঘটে ছিল। (শুনেছি এখন ব্রিজ বা কালভার্ট করে দেওয়ার জন্য এই প্রবলেম নেই) | নিয়মমতো দুই ফোঁটা কোকা ৩০ জিভে দেওয়া হলো। রাস্তা লেহ পার হয়ে শে, থিকসে গুম্ফার পাশ দিয়ে কারু বলে একটা আর্মি বেস পেরোয়। তারপর রাস্তা বেশ খারাপ (অন্ততঃ তখন ছিল )। ঝাঁকানিতে অবস্থা খারাপ। যাই হোক রাস্তাতেই রুটি কলা ডিমসিদ্ধ মিষ্টি দিয়ে ব্রেকফাস্ট। রাস্তাতে পড়লো চাঙলা গিরিবর্ত্ম,বোধহয় ১৭৩০০ ফুট উঁচু। তৃতীয় উচ্চতম গাড়ি যাওয়ার মতো গিরিবর্ত্ম। রাস্তার পাশেই গ্লেসিয়ার। এই পাস থেকে নামার রাস্তার দুই পাশের দৃশ্যাবলী অপূর্ব । দেখা যায় ছোট ছোট নোমাড দের ক্যাম্প। দেখা যায় ইয়াক আর ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে । শুনলাম এই অঞ্চলেই নাকি সব থেকে বেশি বিশ্ব প্রসিদ্ধ পশমিনা উল পাওয়া যায় । এর পর এলো দারবুক যেখানে ১৯৬২ সালের চীন যুদ্ধের ওয়ার মেমোরিয়াল আছে । এখানেই নাকি মারমোট বলে একটি জন্তু দেখা যায় । এরপর টাংস্টে আর মুগলেব পেরোলাম যেখানে রাতে থাকার ক্যাম্প আছে । সকাল ১০টা নাগাদ আমাদের ম্যানেজার দেখালো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাংগং লেক পাহাড়ের কোলে। রাস্তাতে একটা বরফজমা লেকও দেখলাম। এরপর পৌঁছলাম হ্রদের ধারে যেখানের নাম লুকুং। ওখানে রয়েছে বাস দাঁড়ানোর জায়গা আর সারি সারি খাবার দোকান । এছাড়া হ্রদের ধারে রয়েছে রাত্রিবাসের জন্য বিলাস বহুল তাঁবু। ওখানে পৌঁছে বাস থামতেই সবাই দৌড় লেকের দিকে। প্রথম দর্শনেই মন কেড়ে নেয় ওই বিশাল নীল জলের হ্রদ। ওই অপরূপ লেকের বর্ণনা আমার ভাষার অতীত। যত দিন এগোয় সূর্যের এঙ্গেলের সাথে সাথে জলের রং পাল্টিয়ে যায়। চতুর্দিকে নানা রঙের পাহাড়ের সারিতে ঘেরা। শুনলাম লেকের বেশির ভাগ অংশ চীনের ভেতরে। ওই খানেই একটি অংশ চলে গিয়েছে জলের ভিতরে খানিকটা আঙ্গুলের মতো যেখানে থ্রি ইডিয়ট সিনেমার শেষ অংশ শুটিং হয়েছিল।
এই প্যাংগং লেক ১৩০ কিমি লম্বা আর সবথেকে চওড়া জায়গাটি ৭ কিমি চওড়া। যদিও ঠাণ্ডাতে হ্রদটি জমে যায় কিন্তু গরমের সময় প্রচুর পরিযায়ী পাখির আড্ডা। এখানে কমলা খয়েরি মেশানো ব্রাহ্মণী হাঁস ও দেখা যায় । জলের স্বাদ কিন্তু একদম নোনতা আর কষায়। বহু ছবি তোলা, জলের ভেতর পাথরে দাঁড়িয়ে পোজ মারা, ব্রাহ্মণী হাঁস দেখার চেষ্টা করা শেষ করে ম্যানেজার প্রায় ধরে বেঁধে নিয়ে গেল লাঞ্চ খাওয়াতে ওদের টেন্টে। ভাত ডাল তরকারি ডিমের ঝোলের লাঞ্চ। তারপর অল্প বিশ্রাম, এক কাপ চা খেয়ে আবার ফেরা ছয় ঘন্টার রাস্তা । শরীর সব ক্লান্ত কিন্তু মন খুশিতে ভরপুর আর মুখে খই ফুটছে । একে অন্যকে ছবি দেখানোর পালা চললো। রাত প্রায় ৮টা নাগাদ পৌঁছালাম হোটেলে । হাত মুখ ধুয়ে নীচে গরম গরম হাতরুটি আর মুরগির ঝোলের ডিনার সেরে সোজা কম্বলের নীচে । কারণ কাল আবার বেরোনো হবে সোমরিরি লেকের দিকে খুব ভোরে।
সোমরিরি- ৩০০৬১৬
—————————-
আবার সেই ভোর চারটার সময়ে উঠে বেড টি। স্নান ইত্যাদি সেরে ভোর পাঁচটাতে বেরোনো হলো সোমরিরি এর দিকে যাতায়াত প্রায় ৫৫০ কিমি সময় লাগে ৭ ঘন্টা এক দিকে। এই জার্ণিটিকে সব থেকে কষ্টকর বলা হয় । টেম্পো ট্রাভেলারের জার্নি এই লম্বা রাস্তাতে খুবই ঝাঁকানির । আজকাল শুনেছি প্যাংগং এ রাতে থেকে একটা রাস্তা হয়েছে সোমরিরি যাওয়ার। প্রথমে মানালি হাইওয়ে ধরে ৫০ কিমি দূরে উপসী যেখানে পারমিট চেক হয়। তারপর ইনদাসের পার ধরে ১০৯ কিমি দূরে কিয়ারী যেখানে আবার পারমিট চেক হয়। এখানে পাহাড়ের রং গাঢ় চকোলেটের আর সবুজ স্লোপ। কিয়ারীর পর স্লোপ গুলি পার্পল রঙের। অবাক লাগে এত রঙের পাহাড় দেখে পুরো এই রাস্তা জুড়ে। এরপর আমরা পৌঁছলাম চুমথ্যাং ১২৯৬০ ফুট উঁচু। এখানে নাকি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। তারপর ৪০কিমি দূরে মাহে ১৩৬৮০ ফুট। তারপর আসবে ন্যামা যেটি প্রায় চায়নার বর্ডার। এরপর আমরা এলাম রূপশু অঞ্চলে। প্রচন্ড উঁচুনীচু রাস্তা। ধীরে ধীরে উঠলাম নাম সাংলা ১৬২৭০ ফুট। এখান থেকে খুব সুন্দর লেক দেখা যায়। ধীরে ধীরে নেমে সোমরিরি লেকের পাড়ে করজুক বলে স্থানে বাস থামে। এই লেকের সৌন্দর্য প্যাংগং এর মতো না হলেও খুবই সুন্দর বিশেষ করে প্রচুর পরিযায়ী পাখিতে ভর্তি । লেকটি লম্বাতে ২৭ কিমি আর চওড়া ৮ কিমি ।ওখানেই একটি হোটেলে লাঞ্চ সেরে আবার ২টার সময় ফেরার জন্য রওনা হলাম । হোটেলে পৌঁছলাম রাত্রি ৮.৩০,মিনিটে । সবাই একেবারে টায়ার্ড জার্ণিতে । জানা গেলো সেইদিন আবার গ্র্যান্ড ফিস্ট ।প্রচুর খাবারের আয়োজন ডিমের ডেভিল, বিরিয়ানী,মাংসের কাবাব,মাছের কালিয়া সব রকম । কিন্তু খাবার উৎসাহ কারো নেই। এছাড়া যাতায়াতের ধকলে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লেন । তাদের নিয়ে গেল হাসপাতালে । আমরা কোনো রকমে ডিনার সেরে ঘরে ফেরৎ। অবশ্য কাল পুরোপুরি বিশ্রামের দিন। তারপর পরশু মানালীর দিকে রওনা। রাতে সারচু তে টেন্টে থাকা।
এডভেঞ্চার ক্যাম্প ০২০৭১৬
—————————————
আগের দিন ছিল পুরো বিশ্রাম, জিনিস পত্র গুছিয়ে নেওয়া আর লেহর তিবেতিয়ান মার্কেটে টুকিটাকি মেমেন্টো কেনা,কিছু তিবেটিয়ান খাবার চাখা।
সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল ৯টাতে বেরোনো হলো মানালির উদ্দেশ্যে ৪৭৭ কিমি । পথে সারচু বলে একটি জায়গাতে অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পে টেন্টে রাত্রিবাস। মালপত্র সেই ভাবেই নেওয়া হলো। আমার মনে হয় এই পুরো জার্নি টা ভিডিও ফিল্মিং করে রাখলে বেশি ভালো লাগবে কারণ এত নানারকম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর বোধহয় কোথাও পাওয়া যায় না। অবশ্য আমার গিন্নীর মতে চোখের ক্যামেরাতে ছবি তুলে মনে রাখার চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। এই রাস্তার একটা রুট ম্যাপ দিলাম আন্দাজ করার জন্য। প্রথমে উপসী ৪৫ কিমি অবধি সোমরিরির রাস্তা ।তারপর ডান দিকে ইনদাস নদী পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তাতে ২৪ কিমি গিয়ে গিয়া বলে একটি স্থান যেখানে পাহাড়ের রং হয়ে গেল ভায়োলেট। এরপর ৩৬ কিমি খাড়াই রাস্তা দিয়ে আমরা একটি গিরিবর্ত্মে এলাম নাম টাগলাংলা ১৭৫৮২ ফুট উঁচুতে । এটি দ্বিতীয় সর্বাধিক উঁচু গাড়ি যাওয়ার রাস্তা । দিনের বেলা বলে খুব ঠান্ডা ছিলো না । এখানে কিছুক্ষণ থেমে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ । এরপর নামার পালা মোড়ে মালভূমিতে। দুপুর বারোটার সময়ে পৌঁছলাম প্যাঙ যেটি লেহ থেকে ১৭৫ কিমি দূরে । সেখানে রাস্তার ধারে টেন্ট রেস্টুরেন্টে বসে মধ্যাহ্নভোজন। এরপর আবার পাহাড়ি রাস্তাতে ওপরে ওঠা দূরত্ব ৫০ কিমি দূরে এলাম লাচুংলা ১৬৭৩০ ফুট উঁচু গিরিবর্ত্মে। এরপর গাট্টা লুপস দিয়ে ২১টি হেয়ারপিন বেন্ড পেরিয়ে নেমে প্রায় ৭৫ কিমি দূরে পৌঁছলাম সারচু অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প সাইটে ১৪১১০ ফুট উঁচুতে। এই জায়গাটি হিমাচল প্রদেশে। তাই বিদায় লাদাখ। এই ক্যাম্পের কাছাকাছি আরো অনেকগুলি এই জাতীয় ক্যাম্প ছিলো। কয়েকটি তো দূর থেকে প্রচুর সাজানো মনে হচ্ছিল। যাই হোক আমাদের ক্যাম্পে প্রায় ৩০-৪০টি আলাদা টেন্ট ছিল । দরজা জানালা সবই জিপার দিয়ে আটকানো যায়। ১৫×১৫ ফুট টেন্টে দুটি খাট একটি বড় টেবিল আর দুটি ছোট টেবিল ও চেয়ার । সাথে লাগানো বাথরুম যেখানে জলের বেসিন,কমোড ও শাওয়ার আছে। সাধারণ ব্যবস্থা। খাটে দুইটি করে মোটা কম্বল। সন্ধ্যাবেলা আলোর ব্যবস্থা ৭টা থেকে ১০টা জেনারেটর চালিয়ে। কোনো ফোন মোবাইল বা ইন্টারনেট ব্যবস্থা নেই। শুধু স্যাটেলাইট ফোন আছে মিনিটে ১০০ টাকা। টেন্টগুলির মাঝখানে একটি বড় টেন্ট যেটি ডাইনিং হল। আমরা যদিও যথেষ্ট ইনার থার্মাল ও সোয়েটার পড়ে ছিলাম কিন্তু সূর্যাস্ত হতেই প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু হলো ও ঠান্ডা অনেক বেড়ে গেলো। যদিও খাবার ব্যবস্থা ভালোই ছিল কিন্তু ঠান্ডার চোটে গরম নুডুলস সুপ আর মোমো ছাড়া কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হল না। কিছুক্ষন ডাইনিং টেন্টে আড্ডা মেরে তারপর আমাদের নিজস্ব টেন্টে। প্রচন্ড ঠাণ্ডাতে সব জামা সোয়েটার পরে ডবল কম্বলের নীচে। তাও বাইরের হাওয়ার আওয়াজে রাত্রে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল । আর তখন আলোর ব্যবস্থা নেই । মোবাইলেও চার্জ শেষ । ভোরবেলা ৪/৪.৩০ থেকেই বাইরে গলার আওয়াজ । বেরিয়ে দেখি তখন হাওয়া কম। সবাই এর এক অবস্থা। ঘুম না হওয়াতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এই এক অদ্ভুত রাত্রি কাটলো সকলের প্রকৃতির মাঝে। সকাল ৬.৩০ নাগাদ এক বালতি গরম জল পাওয়া গেলো মুখ হাত ধোয়ার জন্য। অন্য কর্ম ইত্যাদি বরফগলা জলের ভয়ে আর দরকার পড়েনি। স্নান তো ভয়ঙ্কর চিন্তা। ব্রেকফাস্টে গরম আলু পরোটা খেয়ে সকাল ৯টার সময় রওনা হলাম মানালির দিকে। প্রায় ৩০ কিমি গিয়ে এলাম আরেকটি গিরিবর্ত্মে বারালাচালা ১৬০৪৬ ফুট। মনে রাখবেন সারা ভারতবর্ষে একই প্রদেশে এতগুলি দুর্গম পাস আর কোথাও নেই। সে এক ভয়ংকর অথচ সুন্দর অভিজ্ঞতা। আরও ৪০ কিমি গিয়ে এলো দারচা । এইখান থেকে যে রাস্তা গিয়েছে সেটি ছোটো ছোটো বিভিন্ন রঙের পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এই রকম বিভিন্ন বর্ণের পাহাড় বোধহয় সারা ভারতে কোথাও নেই । এর পর ৩০ কিমি গিয়ে পড়লো কেইলং যেটি লাহুল স্পিতি অঞ্চলের হেড কোয়ার্টার। এর কিছু দূরেই পড়লো ট্যান্ডি বলে একটি জায়গা যেখানে চন্দ্রা আর ভাগা নদী মিলে শুরু হয়েছে চন্দ্রভাগা বা চেনাব নদী। এরপর খোশকার পেরিয়ে ঢুকলাম পীরপাঞ্জাল পর্বতমালার মধ্যে। কিছুটা দূর গিয়ে পড়লো বিখ্যাত রোহতাঙ্গ পাস ১৩০৫৪ ফুট। শুরু হলো বৃষ্টি আর রাস্তা হয়ে গেল অদৃশ্য। কয়েক হাজার গাড়ির ভিড়ে রোটাং পাস না থাকার মতো। বরফ ও প্রায় নেই। একটা নোংরা কাদার জায়গা। অথচ ১৯৯০ সালে এখানে বরফ সাদা গ্লেসিয়ার ছিল। প্রায় ঘন্টা খানেকের চেষ্টাতে পাস পেরিয়ে মরহি তে বাস থামল মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য। আমার মোবাইলে চার্জ না থাকায় কোনো ছবি তুলতে পারিনি। এখানে কিছুক্ষন থেমে লাঞ্চ করে মানালি পৌঁছলাম বিকালে । উঠলাম জারিম রিসর্টে। সারা বিকাল সন্ধ্যা কাটলো আড্ডা মেরে কফি পকোড়ার সাথে। রাতে আরামে ঘুম কারণ আগামী কাল মানালিতে কাছে পিঠে ঘোরাঘুরি। অবশ্য শুনলাম কেউ কেউ প্ল্যান করছেন কাল সকালে গাড়ি ভাড়া করে সারাদিনে মনিকরণ ঘুরে আসার । আমাদের একবার দেখা আর টায়ার্ড তাই কোনো প্ল্যান নেই। সকালে ধীরে সুস্থে আরাম করে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করে আমরা দুই জন বেরোলাম হেঁটে ঘুরে আসতে। হোটেলের পাশের রাস্তাই কিছুটা উঠলে হিড়িম্বা বা হাড়িম্বা মন্দির। মহাভারত এর ভীমের স্ত্রী ও ঘটোৎকোচের মা। সুন্দর একটি বাগানের মধ্যে দুইজনের দুইটি মন্দির। ওখান থেকে একটি অটো ধরে গেলাম বশিষ্ঠ মুনির মন্দিরে যেটি মানালির একটি প্রান্তে অবস্থিত । এখানে উষ্ণ প্রস্রবণ ও আছে । এই রাস্তাতে যত বিদেশী টুরিস্টদের ভিড় । ভালো বেকারী ও রেস্টুরেন্ট ও আছে এই রাস্তাতে। ফেরার পথে ম্যালে কিছুক্ষন কাটিয়ে স্ট্রবেরী জ্যাম জেলি কিনে হোটেলে ফিরে লাঞ্চ। তারপর বিশ্রাম আড্ডা ইত্যাদি করে টাইম পাস। রাতে ডিনার। পরের দিন সকাল নয়টাতে একটি বড় লাক্সারি বাসে রওনা হলাম বাক্স প্যাটরা নিয়ে। মণ্ডি বিলাসপুর পিঞ্জর হয়ে রাত্রি ৭টার সময় কালকা স্টেশন। সেখানে ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা। ক্যান্টিনে ডিনার। রাত্রি ১০.১৫ নাগাদ ট্রেন লাগলো। দুইটি নীচের বার্থ এসি ২টি তে। গুছিয়ে শোয়া হলো দুই রাত্রিবাস এর জন্য। ১১.৫০ নাগাদ ট্রেন ছাড়ল।
আমাদের ভ্রমণের এইখানেই প্রায় শেষ। বাকী রইলো দিল্লী হয়ে কলকাতা ফেরত।
*********************************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।