Shadow

সত্যজিৎ রায় – বর্তমান সময়ে তাঁর চলচ্চিত্রের প্রাসঙ্গিকতা – ব্রতী ঘোষ

সত্যজিৎ রায় – বর্তমান সময়ে তাঁর চলচ্চিত্রের প্রাসঙ্গিকতা

ব্রতী ঘোষ

সত্যজিৎ রায় কে নিয়েকিছু লেখার মত ক্ষমতা বা ধৃষ্টতা কোনটাই আমার নেই ৷ ২মে  তাঁর জন্মশতবর্ষের  এই ক্ষণটা বড়ই উথাল পাথাল | একদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মারণব্যাধির ভ্রুকুটি। তার সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে চরম দুর্দশায় মানব সমাজ।  আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়।   চতুর্দিকে মৃত্যুর ভ্রুকুটি। তবে তার মধ্যেও জন্মশতবর্ষের পাদপ্রদীপের আলোয় যখন আসেন সত্যজিৎ রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব তখন শত সংকটকে সরিয়ে রেখেও ভাবতে হয় তাঁর কথা ৷
রবীন্দ্রনাথের পর আন্তর্জাতিক বাঙালি বলতে সম্ভবত এক কথাতেই তাঁর নাম সর্বাগ্রে স্থান পাবে ৷   শুধু চলচ্চিত্রে নয় সাহিত্য-সঙ্গীত চিত্রকলা এ সমস্ত ধারা গুলিকেই তিনি আত্মস্থ করেছিলেন এক অসামান্য দক্ষতায় ৷ তাঁর সম্পর্কে কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয় ৷ তাঁর জীবনদর্শন ছিল মানবতাবাদের  উপর প্রতিষ্ঠিত।৷
গত শতাব্দীতে যে কজন বাঙালির নাম আমরা উল্লেখ করতে পারি যাঁরা  বিশ্ব নাগরিক হয়েও প্রকৃত অর্থে ছিলেন বাঙালি,তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ৷ তারপরেই যাঁর কথা উল্লেখ করতে হয় তিনি  সত্যজিৎ রায় ৷ তার মূল কারণ বাংলার সংস্কৃতির গভীর চর্চা ও অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব সংস্কৃতির সম্পূর্ণ ভাবনা ও সৃষ্টিকে নিজস্ব আঙ্গিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরেই একমাত্র অগ্রগণ্য বাঙালি ৷
চলচ্চিত্র মাধ্যমে তিনি ছিলেন চিত্রনাট্যকার,চিত্রনির্মাতা,সংগীত রচয়িতা,সুরকার,চিত্রগ্রাহক শিল্পনির্দেশক,সম্পাদক এমনকি শিল্পী কলাকুশলী দের নামের তালিকা ও তিনি স্বহস্তে প্রস্তুত করতেন (টাইপোগ্রাফি) অর্থাৎ একটি চলচ্চিত্র রূপায়িত করতে গেলে যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুতেই তিনি ছিলেন শেষ কথা ৷ আর চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে গল্প লেখক,-প্রকাশক, চিত্রকর,গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।
সত্যজিৎ তাঁর ৭১বছরের জীবনে ভারতীয় চলচ্চিত্র কে উপহার দিয়েছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য ও তথ্য চিত্র সহ ৩৭ টি সিনেমা ৷ যাঁরা বিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছেন ও জীবিত থেকে এখনও  বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনের সাক্ষী তাঁরা জানেন যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রূপায়িত চলচ্চিত্র কিভাবে এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ৷
১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী দিয়ে পথচলার শুরু। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্র বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পথের পাঁচালী,অপরাজিত,অপুর সংসার অর্থাৎ অপু ট্রিলজি,জলসাঘর দেশের   সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে যথার্থভাবে প্রকাশ করেছে ৷
“দেবী” তে আমরা দেখতে পাই ধর্মীয় কুসংস্কার এবং তার প্রতিবাদ। ‘সদ্গতি’ থেকে ‘আগন্তুক’ ক্রমশ:  সমাজের অবক্ষয়ের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে৷ সমাজের একশ্রেণীর মানুষের আভিজাত্য ও অহংকারের কুৎসিত রূপ দেখা যায় ‘শাখা প্রশাখা’ তে ৷
সত্যজিতের অন্যতম সৃষ্টি তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা গল্প “গুপিগাইন বাঘাবাইন”এর চলচ্চিত্রায়ণ। এটি মূলতঃ ছোটদের জন্য তৈরি ছবি হলেও এর অন্দরে নিহিত যুদ্ধবিরোধী চিন্তা স্পষ্ট। গুগাবাবার পরের ছবি হীরক রাজার দেশে কিন্তু প্রাপ্ত মনস্কদের ছবি। তাঁর রচিত চরিত্র “ফেলুদা” বাঙালির হৃদয়ে মিশে গেছে। ফেলুদা নিয়ে তাঁর সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ বাঙলা জয় করে বিশ্বজয় করেছে।
তাঁর রূপায়িত চলচ্চিত্রে আমরা প্রত্যক্ষ রাজনীতি নয় অতি নাটকীয়তা নয়,আমরা পাই পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি গভীর সমবেদনা ৷  ধর্ম সবসময় হতে পারে রাজনৈতিক হাতিয়ার’,যা তাকে গভীর ভাবে চিন্তিত করত ৷ তাই বোধহয় তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তক’এ  বাঙালিকে কূপমণ্ডূকতার আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসার ইতিবাচক পথ দেখিয়েছেন ৷ একজন মানুষ তখনই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজনীন হয়ে ওঠেন যখন তাঁর শিল্পসৃষ্টি কালের সীমা অতিক্রম করে সর্বকালীন হয়ে ওঠে। তাই বোধহয় জাপানি চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন,”রায়ের ছবি না দেখা আর চাঁদ সূর্য না দেখে বেঁচে থাকা একই ব্যাপার ৷” সত্যজিতের চিন্তাভাবনা যে কতটা তাঁর সময় থেকে এগিয়ে তার প্রমাণ হলো তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ৷ তাঁর বিরাট কর্মযজ্ঞের শুধু এই দিকটি এই রচনায় তুলে ধরতে চেষ্টা করা হয়েছে ৷ বিশ্ব বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ত্বের শততম জন্মদিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম ৷
************************************************
ব্রতী ঘোষ পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা | সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷ এই পত্রিকাতেই তার লেখার পথ চলার শুরু |
শ্রীমতী ব্রতী ঘোষ

2 Comments

  • Madhumita Mitra

    সুন্দর প্রতিবেদন, চমৎকার শ্রদ্ধার্ঘ্য বিশ্ববন্দিত এই কিংবদন্তী কে নিয়ে।হ্যাঁ অতি যথার্থ এই বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথের পর তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় বাঙালী তিনি বাঙালী র সংস্কৃতিকে বাংলার মোড়কে পৌঁছে ছিলেন বিশ্বসভায় এবং দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মান,শুধু তাই নয় নান্দনিকতম আন্তর্জাতিক মান।জানাই জন্মশতবর্ষে তাঁকে প্রণাম🙏

  • অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য

    চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎকে অল্প পরিসরে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই! শিল্পী,সঙ্গীতকার, লেখক সত্যজিৎবাবুকে এইভাবেই ক্রমশঃ পাঠকের কাছে তুলে ধরবার দাবী রইল লেখিকার কাছে।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!