বাংলার পুতুল : ঐতিহ্যময় জীবনশৈলীর অঙ্গ
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী
পৃথিবীর সর্বত্রই পুতুলের ইতিহাস অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ। আদিম প্রপিতামহদের যাদুবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কর্মধারা থেকেই এক সময় পুতুলের উদ্ভব হয়। মানুষের জীবন তখন ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। কেবলমাত্র জীবনধারণের তাগিদ থেকেই বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশীভূত করার জন্য পুতুলের সাহায্য নেওয়া হত। মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার হাত ধরে আদিম কৌমসমাজের বিবর্তন হতে শুরু করে। স্থায়ী বসতি বিস্তারের সঙ্গে মানুষের মনে নান্দনিক চিন্তা আসতে শুরু করে। তার এই সৃষ্টিশীল মনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গাছ, ফুল, লতা-পাতা, পশু-পাখি প্রভৃতি প্রকৃতির নানা সম্পদ। এভাবেই নান্দনিক উৎকর্ষপূর্ণ দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের পাশাপাশি শিশুর বিনোদনের নানা খেলনাও তৈরি হয়। বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্বিক উৎখনন ও হঠাৎ আবিষ্কারের ফলে উর্বরতা-কেন্দ্রিক ধর্মধারায় ব্যবহৃত পোড়ামাটির হাতে টেপা মাতৃকামূর্তির সঙ্গে শিশুর উপযোগী নানা খেলনা পুতুলও পাওয়া গিয়েছে। মেহেরগড় থেকে সিন্ধুসভ্যতার এরকম কয়েকটি নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, কালাতীত টেরাকোটার নিদর্শনরূপে যা আজও প্রচলিত। এর পর যত নতুন নতুন প্রযুক্তিগত কৃৎকৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে,এই শিল্পমাধ্যমটিও ততই পরিণত হয়েছে। মানুষ ক্রমে কাঠ, পাথর ও ধাতুর ব্যবহার শিখেছে। এই মাধ্যমগুলো যুগের পর যুগ পেরিয়ে মার্গরীতির সঙ্গে লোকায়ত শিল্পকলার ক্ষেত্রেও সমানভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ধাত্রী দেশ হিসেবে ভারতবর্ষ তথা বাংলার পুতুল আজও তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
প্রাচীন কাল থেকেই লোকসমাজে পুতুলের ব্যবহার হয়ে আসছে দুভাবে-ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে এবং শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য। লোকায়ত বাংলার বিস্ময়কর ঐতিহ্য হল পুতুল। আদিম জনজাতি অধ্যুষিত বাংলা দীর্ঘ দিন আর্য সংস্কৃতির বলয়ের বাইরে অবস্থিত ছিল। পাকাপাকিভাবে এ দেশে আর্য সংস্কৃতি প্রবেশ করতে বহু দিন সময় লেগেছিল। কিন্তু তা কখনই নিখাদ ছিল না,এ দেশের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রমে তা উভয় সংস্কৃতির সাঙ্গীকরণ রূপে লোকসমাজে পরিচিত হয়েছিল। এই কারণেই আর্য সংস্কৃতির মানুষেরা বাংলার সংস্কৃতিকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে অকারণে একে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল। এ দেশের মানুষের পালনীয় ব্রতকেন্দ্রিক ধর্মধারা উপলব্ধি করতে না পেরে তারা এদের নাম দিয়েছিল ব্রাত্য বা অন্যব্রত। বাংলার উর্বরতাকেন্দ্রিক এই ধর্মধারার মূলে ছিল মাতৃকা উপাসনা। প্রকটিত স্ত্রী-অঙ্গ সহ হাতে টেপা পোড়ামাটির পুতুল ছিল এই মাতৃকার প্রতীক। আবার বিভিন্ন ব্রতেও শস্য ও সন্তানের কামনায় পুতুলের ছবি আঁকা হত। বর্তমানে পূর্ব বাংলার কয়েকটি অঞ্চলে এবং পশ্চিম বাংলায় কালীপুজোর সন্ধ্যায় গোবরের অলক্ষী পুতুল আর চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি লক্ষ্মী,নারায়ণ ও কুবেরের পুতুলের পুজো সেই ধারাকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। ক্রমবর্ধমান ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রসারের ফলে ধীরে ধীরে সমাজে নানা ধরনের দেবতার প্রতিকৃতি দেখা দিল। বিশুদ্ধ পৌরাণিক দেবতামণ্ডলীর পাশাপাশি অঞ্চলভেদে টুসু,ভাদু,বড়ামের মতো লৌকিক দেবদেবীরাও আবির্ভূত হলেন। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেব-দেবীদের পুতুল নানা রূপে আবির্ভূত হল। সাঙ্গীকরণের এই সংস্কৃতিতে গ্রামবাংলার মানুষ শুধু মনুষ্যরূপেই নয়,পোড়ামাটির হাতি,ঘোড়া,বাঘ,সাপ ইত্যাদি পশুমূর্তিও দেবতার থানে উৎসর্গ করেন। এ ছাড়া শিশুদের মন ভোলানোর জন্য নানারকম পুতুল আজও পাওয়া যায়। বাংলার লোকশিল্পের নিদর্শন এই পুতুলগুলো বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। এগুলির বেশির ভাগই কাঁচা মাটি ও পোড়ামাটির। স্থানীয় কুমোরেরা ছাড়াও পটুয়া বা চিত্রকরেরা এগুলো নির্মাণ করেন।
এক সময় কাদামাটির তাল দিয়ে মানুষের পুতুল তৈরির সূচনা হয়েছিল। হাতে টেপা এই সব পুতুল যেমন পুজোর কাজে ব্যবহৃত হত, তেমনই শিশুর মনভোলানো খেলনা হিসেবেও কাজে লাগত। তবে এই সব পুতুলের মধ্যে মানুষ বা পশু-পাখির বাস্তবসম্মত রূপের পরিবর্তে তার অবয়ব ধরা পড়ত। আদিম ধারার লক্ষণযুক্ত এই পুতুলগুলির বেশিরভাগই সন্তানসহ মায়ের প্রতিরূপ। সাধারণত কাঁচামাটির বা পোড়ামাটির তৈরি এই পুতুলগুলোর চলই বেশি। এ ছাড়াও পটুয়ারা হাতি,ঘোড়া,পাখি,মাছ আর পয়সা জমানোর ভাঁড় তৈরি করেন। পটুয়ারা পোড়ানোর পর এর গায়ে রং বার্ণিশ করে দেন,ফলে পুতুলগুলো দেখতে বেশ চকচকে হয়।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে যখন পুতুলের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন হল,তখন শিল্পীরাও নতুন কৃৎকৌশলের আবিষ্কার করলেন। হাতে টেপা পুতুলের জায়গায় এল ছাঁচের ব্যবহার, কারণ এর দ্বারা কম সময়ে বেশি সংখ্যক পুতুল তৈরি করা যায়। প্রথমে এসেছিল একখোল ছাঁচ। তার পর এল দু’খোল ছাঁচ,অর্থাৎ পুতুলের দেহের দুটি অংশ আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি করে জুড়ে দেওয়া। এ ছাড়া চাকের সাহায্যেও বিভিন্ন ধরনের পুতুল তৈরি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া,স্যান্দ্রা,বিবড়দা, রাজগ্রাম, উলিয়াড়া, বিষ্ণুপুর ইত্যাদি অঞ্চলের পোড়ামাটির হাতি,ঘোড়া ও মনসাচালি। বস্তুত এই জায়গাগুলি হাতি-ঘোড়া নির্মাণের কেন্দ্র বলে পরিচিত ছিল। এই সব অঞ্চলের নির্মাণশৈলীর একটা নিজস্বতা ছিল,যার মধ্যে আদিম শিল্পধারার লক্ষণ অনেক স্পষ্ট। এক সময় হাতি,ঘোড়া প্রভৃতির মূর্তি দেবতার থানে উৎসর্গ করা হত। পাঁচমুড়োর যে আলংকারিক হাতি-ঘোড়ার কাজ জগৎ-বিখ্যাত,তা কিন্তু আসলে ছলন বা উৎসর্গীকৃত বস্তু। স্যান্দ্রা গ্রামের খ্যাতি মূলত বোঙা হাতির জন্য। গোলাকার ধরনের বিশেষ আকৃতির এই হাতির মূর্তিটি এক সময় সাঁওতালদের দেবতা সিংবোঙাকে উৎসর্গ করার জন্যই তৈরি হয়েছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার কাঁঠালিয়ার কুমোরেরা তৈরি করেন গ্রাম জীবনের অন্দরমহলের নানা দৃশ্য,যেমন-জাঁতা পেশাইরত মহিলা,গয়লানি,খোঁপা বাঁধা ইত্যাদি। এই সব পুতুলের দেহটা নির্মিত হয় চাকে,মুখটা তৈরি হয় ছাঁচে,হাত-পা ও অন্যান্য অংশ তৈরি হয় হাতে। মেদিনীপুরের মির্জাবাজার কুমোরপাড়ায় তৈরি হয় বাহারি দেওয়ালি পুতুল বা দীপলক্ষ্মী পুতুল। এই পুতুলের ঘাগরার মতো নীচের অংশটি হয় চাকে,মুখটি ছাঁচে,দেহের বাকি অংশ তৈরি হয় হাতে।
অনেক সময় পুতুলের উপর স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রভাব পড়ে। যেমন উত্তর দিনাজপুর জেলার কুনুরে যে মা ও ছেলে পুতুল তৈরি হয় তাতে চা বাগানে কর্মরত মহিলার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পুতুলে মায়ের পিঠে সন্তান বাঁধা থাকে। আবার বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে দুর্গাপট নির্মাতা ফৌজদার পরিবারের মহিলারা যে হিঙ্গুল পুতুল তৈরি করেন তার পোশাক-পরিচ্ছদ অনেকটা বিদেশীদের মতো। দুর্গাপুজো,জিতাষ্টমী বা সন্তান হবার পর মানত পূরণের জন্য এগুলো ষষ্ঠী পুতুল হিসাবে বিক্রি হয়। হাওড়ার তাঁতিবেড়ে,উত্তর ২৪ পরগণার নজরনগর ইত্যাদি অঞ্চলে চাকা লাগানো নৌকা বা পাল্কি-গাড়ির সঙ্গে ঘোড়ায় চড়া মানুষের পুতুল তৈরি হয়। অর্থাৎ শিশুমনের চাহিদা মেটাতে স্থির পুতুলের পরিবর্তে চলমান পুতুল-খেলনার আবির্ভাব হয়। অনেকটা এই কারণেই বিভিন্ন মেলায় কাঁচামাটি বা পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি হুঁকো নিয়ে বসে থাকা ঘাড় নাড়া বুড়ো পুতুল দেখা যায়। এই পুতুলের মাথা স্প্রিং দিয়ে দেহের সঙ্গে লাগানো থাকে।
পুতুলের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার প্রভাবের একটি উদাহরণ হল বরিশালের মনসা ঘট। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার বরিশালের শিল্পীরা উত্তর ২৪ পরগণা, নদিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে চলে আসেন। শ্রাবণ-সংক্রান্তিতে মনসাপুজো উপলক্ষ্যে এই বিশেষ ঘটটি বিক্রি হয়। পাশাপাশি নদিয়া জেলার নবদ্বীপের শিবের মুণ্ডমূর্তি হল আঞ্চলিকতার প্রভাবের আরও একটি উদাহরণ। নবদ্বীপে বাসন্তী পুজোর দশমীতে শিব-দুর্গার বিয়ে হয়। এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় কুমোরেরা শিবের এক বিশেষ মুণ্ডমূর্তি তৈরি করেন যা শিবের মুখোশ নামে পরিচিত। এই মুখোশটি চতুর্দোলায় বসিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে তা দিয়ে শিব-দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। মূলত ছোট ছেলে-মেয়েরাই এই প্রথাটি উৎসাহের সঙ্গে পালন করে।
বাংলার পুতুলকে নিঃসন্দেহে কুটির শিল্প বলা যায়। কুমোর বা পটুয়া পরিবারের মহিলারা তাদের কাজের অবসরে এই সব পুতুল তৈরি করে সেগুলো সরা বা মালসায় ঘুঁটের আগুনে পুড়িয়ে নিতেন। বর্তমানে শান্তিনিকেতনের কিছু মৃৎশিল্পী পরিবার এই পদ্ধতিতে পুতুল তৈরি করেন। কিন্তু যেখানে যোগানের ব্যাপারটি বেশি মাত্রায় থাকে সেখানে বাটি বা পোনের ব্যবহার হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগরের কিছু শিল্পী পরিবার এই পদ্ধতিতে ছাঁচে পুতুল তৈরি করে পোড়ান। তাঁদের তৈরি আহ্লাদ-আহ্লাদী পুতুল,বারা মূর্তি,বনবিবি,ষষ্ঠী ঠাকুর প্রভৃতি পুতুল এখনও তার নিজস্ব ঘরানাকে বজায় রেখে চলেছে। একই পদ্ধতিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের নির্জা বাজারের দেওয়ালি পুতুলও নির্মাণ করা হয়।
মাটির পুতুলের ক্ষেত্রে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের কথা উল্লেখ করতেই হয়। এখানকার ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীরা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবধর্মী পুতুল নির্মাণ করতে শুরু করেন। ছাঁচে তৈরি এই পুতুলের আকৃতি হুবহু মানুষ বা পশুর মতো। এই পুতুলের ক্ষেত্রে আদিমতার কোনও লক্ষণই দেখতে পাওয়া যায় না। মাটির পাশাপাশি কাঠ,গালা,ধাতু,পাট,শোলা,তালপাতা,কাপড় ইত্যাদিও পুতুল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। নদিয়ার নবদ্বীপের কাঁসারি সম্প্রদায় শুধুমাত্র পিতল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের দেব-দেবীর নানা আকারের মূর্তি তৈরি করেন। এর মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ,নাড়ুগোপাল প্রভৃতি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বহুবর্ণ-শোভিত গালার পুতুল লোকশিল্পের ক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমসাঁই, প্রতাপদিঘি, পাঁচরোল এবং বীরভূম জেলার ইলাম বাজার ছিল গালার পুতুলের জন্য উল্লেখযোগ্য। প্রথমে উইঢিবির মাটি দিয়ে গালার পুতুলের অবয়বটি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে পোড়ানো হয়। তার পর গালাতে রং মিশিয়ে দণ্ড তৈরি করে তা দিয়ে অলংকরণ করা হয়। এই পদ্ধতিটি কিন্তু বেশ জটিল। গালার দণ্ডটি উত্তপ্ত করে প্রথমে সরু সরু গালার সুতো তৈরি করা হয়। এর পর কাঠকয়লার আগুনে পোড়ামাটির পুতুলগুলো কিছুটা গরম করে নিয়ে গালার দণ্ড থেকে গালা লাগানো হয়। সব শেষে গালার সুতো দিয়ে পুতুলটির অলংকরণ করা হয়।
বহু দিন থেকেই বাংলায় আদিম পদ্ধতির পিতল ঢালাই শিল্প বা ডোকরা শিল্পের প্রচলন ছিল। এক সময় যাযাবর ডোকরা শিল্পীরা গ্রামের শেষ প্রান্তে অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করে গৃহস্থের প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী (যেমন চাল মাপার কুনকে) তৈরি করতেন এবং বাসনপত্রের ফুটো-ফাটা ঝালাইয়ের কাজও করে দিতেন। এর সঙ্গে তাঁরা নানা ছোট-ছোট দেব-দেবীর মূর্তিও বানাতেন-যেমন লক্ষ্মী,গণেশ বা গোপাল ঠাকুরের মূর্তি। বর্তমানে বাঁকুড়ার বিকনা ও বর্ধমানের দরিয়াপুরে সরকার থেকে এদের বসবাসের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অঞ্চলে এঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ডোকরা শিল্পীরা দেব-দেবীর মূর্তি ছাড়াও পশু,পাখি,আদিবাসী ও নানা ধরনের যুগোপযোগী মূর্তি তৈরি করেন। এ ছাড়া লক্ষ্মীর ঝাঁপি,গয়নার বাক্স,মুখোশ ইত্যাদিও বানান।
বর্ধমান জেলার নতুনগ্রাম চিত্র-বিচিত্র কাঠের পুতুলের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলের সূত্রধর সম্প্রদায়ের জীবিকা হল লক্ষ্মীপুজোয় ব্যবহৃত কাঠের প্যাঁচা, রাজা-রানি, বউ, গৌর-নিতাই ইত্যাদি নানা ধরনের পুতুল বানানো। কলকাতার কালীঘাট বা নদিয়ার নবদ্বীপেও এই পুতুল বিক্রি হয়। মাথা, হাত বা দেহের কিছুটা অংশ ছাড়া এই ধরনের পুতুলের অধিকাংশ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাঁকা থাকে। সাধারণত গামার গাছের কাঠ খোদাই করে এই পুতুল তৈরি করা হয়, তবে গামারের পরিবর্তি শিমূল বা মেহগনি কাঠও ব্যবহার করা হয়। আগে কাঠের গায়ে ভেষজ রং লাগানো হত, বর্তমানে বাজারি রংই ব্যবহৃত হয়। হাওড়া জেলার থলে রসুলপুর নামক স্থানেও একদা একই ধরনের পুতুল তৈরি হত। বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে ধর্মরাজ পুজোর জন্য এখনও কাঠের নন্দরানি পুতুল তৈরি হয়। তবে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ছাড়া এই পুতুল পাওয়া যায় না। উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়া ও হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে কিছু শৌখিন কাঠের পুতুল তৈরি হয়। এদের মুখটা হয় কাঠের যা একটি দণ্ডের গায়ে লাগানো থাকে। এর ওপর বাহারি পোশাক পরানো হয়। এভাবে রাধা-কৃষ্ণ, বর-বউ, বাউল-বাউলানি প্রভৃতি নানা রকম পুতুল তৈরি হয়।
তালপাতার হাত-পা নাড়া পুতুল, যা তালপাতার সেপাই নামে পরিচিত, এখনও গ্রামবাংলার মেলার অন্যকম আকর্ষণ। তালপাতাকে শুকিয়ে কেটে তাকে সুতো দিয়ে জুড়ে মানুষের মতো অবয়ব তৈরি করা হয়। এর ভেতর বাঁশের কঞ্চি এমনভাবে লাগানো থাকে যে তা ঘোরালেই পুতুলটি ঘুরতে থাকে। বর্তমানে এই পুতুলের এক দিকে ছেলে, অন্য দিকে মেয়ের প্রতিরূপ তৈরি করা হয়, শিল্পীর ভাষায় যাকে বলা হয় সাহেব ও মেম। তবে শিল্পীরা নানা পশুর প্রতিরূপও তৈরি করেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগর ও মথুরাপুর এবং কলকাতার নতুন বাজারে রাস উৎসব উপলক্ষে শোলার ফুল ও পশু-পাখির সুদৃশ্য পুতুল তৈরি করা হয়। শোলার সাদা অংশটি পাতলা ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে শিল্পীরা এমন পুতুল তৈরি করেন। এর গায়ে পাখির ঠোঁট,বাঁদরের হাত-পা ইত্যাদি গুঁজে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে লাগানো হয় বাজারি রং আর রঙিন কাগজ। রাস পূর্ণিমার পর এই পুতুল আর দেখতে পাওয়া যায় না। এক সময় পরিবারের মহিলারা পুরনো কাপড় তুলো আর সুতো দিয়ে বেঁধে বাচ্চাদের খেলার জন্য পুতুল তৈরি করতেন। এভাবে তৈরি বর-বউ, বাউল-বাউলানি,পূজারিনি ইত্যাদি নানা ধরনের কাপড়ের পুতুল এখন মহিলাদের জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায়। পাট দিয়ে অনেক দিন আগে থেকেই ছোট-ছোট পুতুল তৈরি হত। এখন মূলত মুর্শিদাবাদ জেলার ইসলামপুর,বহরমপুর প্রভৃতি অঞ্চলের গ্রামের মহিলারা পাটের রঙিন পুতুল তৈরি করছেন।
উত্তর ২৪ পরগণার হাড়োয়ার নজরনগর গ্রামের কুমোরপাড়ার মহিলারা পুতুলের সঙ্গে তৈরি করেন চাকা লাগানো গরুর গাড়ি ও মোটর গাড়ি। চাকা লাগানো এই সব খেলনা পুতুল শিশুদের খুশি করে। বেড়াচাঁপা-চন্দ্রকেতুগড়ে এমন চাকা লাগানো গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই নজরনগর গ্রামটিকে ঐতিহ্যবাহী পুতুলের গ্রাম বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হয় না। হাওড়া জেলার বেশ কিছু অঞ্চলের প্রসিদ্ধি চাকা লাগানো পালকি,শালতি নৌকা প্রভৃতির জন্য। পাতিয়াল, বাঁটুল, নরেন্দ্রপুর, যাদবপাটি প্রভৃতি অঞ্চলে এই মেলাকেন্দ্রিক খেলনা-পুতুল পাওয়া যায়। হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানার পানসিলা,ঘুঘুবেশে ইত্যাদি অঞ্চলের কুমোরপাড়ায় পুতুলের পাশাপাশি তৈরি হয় লক্ষ্মী-গণেশ ঘট। পৌষ সংক্রান্তির দিন এতে ধান ভর্তি করে লক্ষ্মীপুজো হয়। পূর্ব মেদিনীপুর ঝেলার কোলাঘাট থানার মাড়োবেরিয়া,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মির্জাবাজার ও বেলিয়া ইত্যাদি জায়াগাতেও লক্ষ্মী-গণেশ ঘট পাওয়া যায়। আচারকেন্দ্রিক এই ঘটগুলোর গ্রামীণ সমাজে যথেষ্ঠ চাহিদা রয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের পদ্মতামালি গ্রামটির খ্যাতি হাত-নাচনা পতুল বা বেণী পুতুলের জন্য। এক সময় তালের আঁটি আর বাঁশ দিয়ে তৈরি এই পুতুল নাচিয়ে শিল্পীরা গ্রাম থেকে গ্রামে সওদা করে বেড়াতেন। এখন এই পুতুলের মুখটা মাটি দিয়ে তৈরি হয়,আর হাতটা হয় কাঠের। দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হাতে লাগানো হয় ঘুঙুর। পুতুলের মাথা ও হাত একটা বাঁশের দণ্ডে সুতো দিয়ে জুড়ে তাতে পোশাক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। বাঁশের দণ্ডটির নীচে থাকে কয়েকটি ছিদ্র। এই ছিদ্রের মধ্যে আঙুল গলিয়ে, সুতোয় টান দিয়ে, হাতের কৌশলে পুতুল নাচান। তার সঙ্গেই চলে গান। যেহেতু শিল্পীর হাতের আঙুল পুতুলের পোশাকের তলায় থাকে,তাই দর্শকের মনে হয় পুতুল যেন নিজেই নড়াচড়া করছে। লোকপ্রযুক্তির এক সার্থক উদাহরণ হল এই বেণী পুতুল।
পুতুল বঙ্গ-সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। হাতে তৈরি পুতুল বাংলার মানুষের ঐতিহ্যময় জীবনশৈলীর অঙ্গ। বর্তমানে প্লাস্টিক, পলিথিন, সেরামিক্স প্রভৃতি উপাদান দিয়ে নির্মিত বাহারি পুতুল হয়ত বাজার দখল করেছে। কিন্তু লোকশিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এগুলি কখনই হাতে তৈরি পুতুলের স্থান নিতে পারেনি। বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত বিভিন্ন ঘরানার পুতুলগুলো লোকসংস্কৃতির অঙ্গ। তাই লোকশিল্পের এই ধারাটিকে কিছুতেই অবলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না।
তথ্যসূত্র :
১. পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ-তারাপদ সাঁতরা।
২. বাংলার পুতুল ও বিশ্ব বাংলা:আর্থ-সামাজিক উজ্জীবন-সোমা মুখোপাধ্যায়,পশ্চিমবঙ্গ,বিশেষ সংখ্যা,অক্টোবর–ডিসেম্বর,২০১৫।
*******************************************************
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী পরিচিতি :
রঞ্জন চক্রবর্ত্তীর জন্ম ১৬ মে ১৯৭৪, কলকাতায়। ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরীরবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে রাজ্য প্রশাসনে আধিকারিক হিসেবে কর্মরত। ছাত্রাবস্থা থেকেই নিয়মিত লেখালিখির শুরু। এ যাবৎ বহু পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরে যাব একদিন নৈঃশব্দ্য হয়ে’ এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নের মুখ ঢেকে রাখি দর্পণে’ পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয়েছে। প্রবন্ধ সংকলন ‘বেদ থেকে পুরাণ’ পাঠক ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। ইতিমধ্যে সারস্বত সাহিত্য সম্মান, বিবৃতি সাহিত্য সম্মান, শীতলগড় সাহিত্য সম্মান ইত্যাদি বিবিধ সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।