সত্যজিতের জীবনে সৃজনে ভ্রমণ
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়
“ছেলেবেলার কোন্ ঘটনা মনে থাকবে আর কোন্টা যে চিরকালের মতো মন থেকে মুছে যাবে সেটা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। মনে থাকা আর না-থাকা জিনিসটা কোনো নিয়ম মেনে চলে না। স্মৃতির রহস্য এখানেই।”- লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ের মুখবন্ধে। পিতৃস্মৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সত্যজিৎ জানিয়েছেন বাবার স্মৃতি তাঁর কাছে প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি বাবার মৃত্যুদিনের কোনো ঘটনাও তাঁর স্মরণে ছিল না। কেননা তাঁর বাবা প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী সুকুমার রায় যখন মারা যান তাঁর বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। কিন্তু বাবার জীবৎকালের দুটি ঘটনা তাঁর স্মৃতির পটে আজীবন ছবির মতো আঁকা ছিল। তা ভ্রমণের স্মৃতিকেন্দ্রিক। অসুস্থ সুকুমারের স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য তাঁকে একবার সোদপুরে আর একবার গিরিডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে ছিলেন সত্যজিৎ। তখন সত্যজিতের বয়স দুই কিম্বা তারও কম। গঙ্গার ধারে সোদপুরের বাড়িতে ঘরের জানলার ধারে বসে ছবি আঁকতে ব্যস্ত সুকুমার তাঁকে নদীর বুকে ভোঁ বাজিয়ে স্টীমার যাবার দৃশ্য দেখান। গিরিডির ঘটনায় সুকুমার নেই। আছেন তাঁদের বাড়ির বৃদ্ধ চাকর প্রয়াগ। এক সন্ধ্যায় প্রয়াগের কথায় প্রবল উৎসাহে তিনি খেলনার দোকানে কেনা কাঠের খোন্তা দিয়ে উশ্রী নদীর ধারের বালি খুঁড়ে জল বার করেছিলেন। স্মৃতির এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারি বা না-ই পারি, এই দুটি ভ্রমণ সত্যজিতের শিশুমনে ভ্রমণপ্রীতির অঙ্কুরোদ্গম ঘটায় একথা বলতেই পারি। আর এও বলা যায় যে শৈশবে দেখা গিরিডির কথাই ফিরে এসেছে তাঁর লেখা প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পে। গিরিডি শহরের পাকাপাকি বাসিন্দা প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। তবে তার চাকরের নাম প্রয়াগ নয়-প্রহ্লাদ।
কলকাতায় যে বাড়িতে সত্যজিতের জন্ম, একশো নম্বর গড়পার রোডের সেই বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো ছিল তাঁর ঠাকুরদাদা স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আঁকা রঙিন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র ছবি। সাত বছর বয়সে মায়ের সাথে দার্জির্লিং-এ মাসিদের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে সেই ছবির কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে আসল কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মিলিয়ে দেখেন সত্যজিৎ। বুঝতে পারেন ঠাকুরদাদার ক্যানভাসে ধরা পড়েছে সূর্যাস্তের সময়কালীন কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর তাঁর চোখের সামনে মেঘ ও কুয়াশাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা সূর্যোদয়ের আলোর ছোঁয়ায় পরতে পরতে উন্মোচিত করেছে তার অসামান্য রূপ। উপেন্দ্রকিশোরের ছবি এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রথম দর্শন তাঁর অবচেতনকে মুগ্ধতার ঘোরে আবিষ্ট করেছিল। পরবর্তীকালে সেই মুগ্ধতারই বহিঃপ্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন নানাভাবে। ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ লিখেছেন, “এর পরে নিজের দেশে আর বাইরে পৃথিবীর বহু দেশে বহু নামকরা সুন্দর দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো সুন্দর দৃশ্য আর কোথাও দেখিনি।” দার্জিলিং-এর পটভূমিকায় সত্যজিতের নির্মিত এক চলচ্চিত্রে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ তার আপন মহিমায় ভাস্বর। সে নিজেই সেখানে হয়ে গেছে কাহিনীর এক চরিত্র। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা বলেই হয়তো দার্জিলিং শহরটাও ছিল সত্যজিতের অত্যন্ত প্রিয়। বহুবার তিনি দার্জিলিং গিয়েছেন। তাই শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়, এই শহরের প্রেক্ষাপটে তিনি ফেলুদার গল্পও লিখেছেন-‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ ও ‘দার্জিলিং জমজমাট’। প্রসঙ্গত,’ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ তাঁর লেখা ফেলুদার প্রথম গল্প যা ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর সত্যজিৎ তাঁর মা সুপ্রভা রায়ের সাথে গড়পারের বাড়ি ছেড়ে ‘সোনামামা’ প্রশান্ত কুমার দাশের বাড়িতে চলে আসেন। তাঁর বয়স তখন ছয়ের কাছাকাছি। সোনামামার বাড়ি ছিল কলকাতার ভবানীপুরের বকুলবাগানে। বকুলবাগানে যাবার পরেই মা-মাসি-মামাদের সাথে সদলবলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাবার সুযোগ তাঁর হয়। যদিও বাবা মারা যাবার পর গড়পারে থাকার সময়েও তিনি মায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কলকাতার বাইরে বেড়াতে গেছেন। সত্যজিৎ স্কুলে ভর্তি হন ন’বছর বয়সে। সুপ্রভাও বিধবাদের স্কুল বিদ্যাসাগর বাণীভবনে চাকরি নেন। গ্রীষ্মে ও পূজোর ছুটিতে হাওয়া বদলের জন্য তখন মাঝে মাঝেই বাইরে যেতেন সুপ্রভা-সত্যজিৎ।
ছেলেবেলায় লক্ষ্ণৌতে বেশ কয়েকবার গিয়েছেন সত্যজিৎ। পেশায় ব্যারিস্টার তাঁর মেজমামা সুধীন্দ্রচন্দ্র দাশ থাকতেন লক্ষ্ণৌতে। সেখানে সুপ্রভার মাসতুতো ভাই বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও গায়ক অতুলপ্রসাদ সেন ও অতুলপ্রসাদের বোনের বাড়িও ছিল। তিনজনের বাড়িতেই পালা করে থাকতেন তাঁরা। বার বার যেতে যেতে লক্ষ্ণৌ শহরের উপর এক অদ্ভুত টান পড়ে গিয়েছিল তাঁর। সেখানকার সব দ্রষ্টব্য দেখে বিস্ময়বিমুগ্ধ সত্যজিৎ ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ লিখেছেন,”নবাবদের শহরের বড়া ইমামবাড়া, ছোটা ইমামবাড়া, ছত্তর মঞ্জিল, দিলখুশার বাগান – এসব যেন মনটাকে নিয়ে যেত আরব্যোপন্যাসের দেশে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত বড়া ইমামবাড়ার ভিতরের গোলকধাঁধা ভুলভুলাইয়া।…রেসিডেন্সির ভগ্নস্তূপের দেয়ালে কামানের গোলার গর্তে সিপাহী বিদ্রোহের চেহারাটা যেন স্পষ্ট দেখতে পেতাম।” ফেলুদার দুটো গল্প পড়ে লক্ষ্ণৌ ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যায়-‘বাদশাহী আংটি’ ও ‘শকুন্তলার কন্ঠহার’। হিন্দি ও উর্দু ভাষার অন্যতম কালজয়ী সাহিত্যিক মুন্সি প্রেমচাঁদের ছোটো গল্প অনুসারে সত্যজিতের পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র কাহিনীর পটভূমিও লক্ষ্ণৌ।
সত্যজিতের মেজোপিসিমা পুণ্যলতার স্বামী অরুণনাথ চক্রবর্তীর ছিল বদলির চাকরি। তাই হাজারিবাগ, দ্বারভাঙ্গা, মজঃফরপুর, আরা – এইসব বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা বসবাস করেছেন। কৈশোরে পিসিমার বাড়ি বেড়াতে যাবার সুবাদে সবগুলো জায়গাই সত্যজিতের ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। হাজারিবাগ-রাজরাপ্পার গভীর জঙ্গলের পথে ঘোরাঘুরি করেই তাঁর জঙ্গলের প্রতি তীব্র ভালোবাসা জন্মায়। তাই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে পালামৌর জঙ্গল এবং ‘এ যে দৃশ্য দেখি অন্য/এ যে বন্য এ অরণ্য’-‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে গুপির গান গাওয়ার এই দৃশ্যে দেখা জঙ্গলের প্রকৃতি অত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। হাজারিবাগ ভ্রমণের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সত্যজিৎ বলেছেন “ক্যানারি হিলের চূড়োয় ওঠা, রাজরাপ্পায় পিকনিক,বোকারো জলপ্রপাত দেখতে যাওয়া-সব মিলিয়ে যেন সোনায় মোড়া দিনগুলো।” প্রথমবার হাজারিবাগ বেড়াতে গিয়ে পিসেমশাইয়ের সবুজ রঙের ওভারল্যান্ড গাড়িতে চড়ে তাঁরা রাজরাপ্পায় গিয়েছিলেন। ভেড়া (ভৈরবী) নদী পেরিয়ে মাইল খানেক হেঁটে তাঁরা রাজরাপ্পায় পৌঁছান। ছিন্নমস্তার মন্দির দেখে তাঁর গা ছমছম করে ওঠে। দামোদর নদের ওপর জলপ্রপাত, নদীর বালি, দূরের বন ও পাহাড় মিলিয়ে অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য তাঁর মন কেড়ে নেয়। ফেরার পথে ব্রাহ্মণবেড়িয়া পাহাড়ের ধারে তাঁদের গাড়ি বিকল হয়ে যায়। সেই পাহাড়ে নাকি অনেক বাঘ-ভাল্লুকের বাস। গাড়ি সারাতে সারাতে অনেক রাত হয়ে যায়। কিন্তু কোনো বাঘ-ভাল্লুকের দেখা তাঁরা পাননি। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ নামে ফেলুদার যে উপন্যাস সত্যজিৎ লেখেন, তাতে এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই ছাপ ফেলেছে। তবে ব্রাহ্মণবেড়িয়া পাহাড়ের ধারে জন্তু-জানোয়ারের ভয় থাকলেও মনে মনে সেদিন বাঘ দেখার আশা হয়তো সত্যজিৎ করেছিলেন। তাই উপন্যাসটিতে সার্কাসের পালিয়ে যাওয়া বাঘের সাথে লালমোহন বাবু, তোপসে ও তাদের গাড়ির চালক হরিপদবাবুর আকস্মিক মোলাকাত হওয়ার দৃশ্যের অবতারণা করে তিনি তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছার পূরণ ঘটিয়েছেন বলা যেতে পারে। সত্যজিৎ পরিচালিত ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে বাঁশবনে এবং ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে রাজার কোষাগারের সামনে গুপি-বাঘাও বাঘের দেখা পেয়েছিল। এগুলোও সেই ইচ্ছে পূরণের গল্প বলেই মনে হয়।
ডুয়ার্সের মালবাজার ও ওদলাবাড়িতে ‘কাপুরুষ’ ছবির বেশিরভাগ দৃশ্য তুলেছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ উপন্যাসের পটভূমিও ডুয়ার্স। ডুয়ার্সের জঙ্গলে ফেলুদা, তোপসে ও লালমোহনবাবু সহ আরও কয়েকজনের মানুষখেকো বাঘের মুখোমুখি হওয়া এবং বাঘটাকে গুলি করে মারার গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে সত্যজিতের ছোটোবেলার আরও একটি ভ্রমণের স্মৃতি। সেবারে তিনি স্টিম লঞ্চে চেপে সুন্দরবন সফরে যান। বেড়ানোর দলে ছিলেন তাঁর রণজিৎদা বা ‘রণদা’। রণদা শিকারী। বন্দুক ও প্রচুর টোটা তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু সে যাত্রাতেও বাঘের দেখা পাওয়া যায়নি। রণদা শুধু একটা কুমীর মেরেছিলেন।
শৈশবে একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আতিথ্যে মা ও ছোটো মাসি কনক দাশের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়ে সেখানে মাস তিনেক ছিলেন সত্যজিৎ। খোয়াইতে দিগন্তবিস্তারী পূর্ণিমার রাতে মায়ের খোলা গলার গান তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। আর একবার দশ বছর বয়সে পৌষ মেলার সময় সত্যজিৎ মায়ের সাথে শান্তিনিকেতনে যান। এক সকালে উত্তরায়ণে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করেন। সত্যজিতের অনুরোধে তাঁর নতুন অটোগ্রাফের খাতায় সই সহ একটি কবিতা লিখে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সুপ্রভাকে বলেছিলেন, “এটার মানে ও আরেকটু বড় হলে বুঝবে।” কবিতাটি আট লাইনের সেই বিখ্যাত কবিতা –
বহুদিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্ব্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।।
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন। বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ডি জে কিমার অ্যান্ড কোং’-এর আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে প্রথম বিলেত যাবার পর্বে সত্যজিৎ সস্ত্রীক লন্ডন, অস্ট্রিয়া, ভেনিস, সুইজারল্যান্ড ও প্যারিস ভ্রমণ করেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্বর্ধনা নিতে কিম্বা ফিল্মোৎসবে যোগ দিতে সারা জীবন তিনি পৃথিবীর নানা দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। তবু সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গ্রামবাংলাই ছিল তাঁর বেশি প্রিয়। যদিও প্রথম জীবনে নাগরিক যাপনে অভ্যস্ত সত্যজিতের বাংলার গ্রাম সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা জ্ঞান ছিল। পরবর্তীকালে কলকাতায় আগত মার্কিন প্রবাসী ফরাসি দার্শনিক জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে ‘দ্য রিভার’ ছবির লোকেশন খুঁজতে বেরিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে এবং কিছুটা রেনোয়ার প্রাচ্যবাদী ধ্যানধারণার প্রভাবেও সত্যজিৎ গ্রামবাংলার অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি বিলেত রওনা হওয়ার আগে সিগ্নেট প্রেসের কর্ণধার দিলীপ গুপ্ত তাঁকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালি’-র ছোটোদের সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়তে ও তার ইলাস্ট্রেশন করতে দেন। এই কাজটা করতে গিয়ে সত্যজিৎ তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়কে বলেছিলেন, ”বিভূতিভূষণের বইতে গ্রাম-বাংলার যে-বিবরণ আছে, তাতে চোখের সামনে যেন সব দেখতে পাই।” ‘পথের পাঁচালি’ ছবি তৈরি করার পর বাংলার গ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সত্যজিৎ একবার বলেছিলেন, “এখন আমি এর অনেক কিছুই জানি। আমি এর মাটিকে জানি, জানি এর ঋতুগুলিকে। এর গাছপালা, অরণ্য, ফুল এসবও জানি। আমি এখন জানি মাঠে কেমন করে পুরুষেরা কাজ করে, মেয়েরা কীভাবে কুয়োতলায় গল্প করে। জানি, রোদবৃষ্টিতে যে শিশুরা খেলা করে সারা পৃথিবীর যে কোন শিশুর মতই তাদের আচরণ।” ‘পথের পাঁচালি’-র লোকেশন খুঁজতে গিয়ে কলকাতার কাছাকাছি অনেক গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়। ‘পথের পাঁচালি’-র শুটিং প্রায় পুরোটাই হয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বোড়াল গ্রামে। শুধু বর্ধমানের কাছে পালশিটে রেললাইনের ধারে কাশফুল ভরা মাঠে অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার দৃশ্য তোলা হয়েছিল। পরে ‘অপরাজিত’ ছবির কিছু দৃশ্য এবং ‘গুগাবাবা’ ছবিতে গুপি-বাঘার বাঘ দেখার দৃশ্যও তোলা হয় বোড়াল গ্রামেই। তবে ‘অপু ট্রিলজি’-র শেষ ছবি ‘অপুর সংসার’-এর শুটিং স্পট জলঙ্গী নদীর ধারে নদীয়ার মহেশগঞ্জ গ্রাম।
কলেজের পাঠ শেষ করে ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্যকে জানতে ও বুঝতে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে যান। সেখানে প্রথম দিনই কলাভবনে নতুন ছাত্রাবাসের বারান্দার সিলিং-এ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের আঁকা ছবিতে বীরভূমের গ্রামের দৃশ্য দেখে তিনি অভিভূত হন। বিনোদবিহারীকে নিয়ে পরে তিনি তথ্যচিত্র (দ্য ইনার আই) নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন ছবির শুটিং করতে বীরভূমের নানা গ্রামে ঘুরেছেন। সিউড়ি ও রামপুরহাটের কাছাকাছি অনেকগুলো জায়গায় ‘গুগাবাবা’-র শুটিং হয়েছিল। রামপুরহাট থেকে বিশ মাইল দূরে ‘নতুনগ্রাম’ নামে একটা গ্রামকে করা হয়েছিল গুপীর গ্রাম। গুপী বাঘার প্রথম ভোজ, ডুলিতে ওস্তাদ যাবার দৃশ্য, ‘ঝুন্ডি’ বলে প্রথম হাততালি – সবই তোলা হয় নতুনগ্রামের এক নদীর ধারে। ‘অভিযান’-এর শুটিং হয় দুবরাজপুর ও সেখানকার ‘মামা ভাগ্নে পাহাড়’-এ। ‘অশনি সংকেত’ ও ‘আগন্তুক’-এর লোকেশন হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনকে। শান্তিনিকেতনের কাছেই একটা গ্রামে একটা ভাঙা বাড়িকে মেরামত করে ‘অশনি সংকেত’-এর গঙ্গাচরণ ও অনঙ্গর বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, ফেলুদাকে নিয়ে তাঁর শেষ লেখা ‘রবার্টসনের রুবি’-তেও বীরভূমের নানা জায়গাকে তিনি তুলে ধরেছেন। এই গল্পে পূর্ণিমার রাতে ফুলবেড়িয়া গ্রামে সাঁওতালি নাচের কথা পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর পরিচালিত ‘আগন্তুক’ ছবির সাঁওতালি নাচের দৃশ্য। বক্রেশ্বর, কেন্দুলি, তারাপীঠ, বোলপুর, শান্তিনিকেতন, দুবরাজপুর, হেতমপুর – গল্পে উল্লেখিত এই প্রতিটা জায়গাই বীরভূমের জনপ্রিয় সব পর্যটনস্থল। তবে দুবরাজপুরের ‘মামা ভাগ্নে পাহাড়’ আর হেতমপুরের রাজবাড়ি ও টেরাকোটা মন্দির দেখতে আগে খুব কম লোকই যেতেন। সত্যজিতের ছবির ‘শুটিং’ জায়গা দুটোকে বিখ্যাত করেছে। তাঁর চলচ্চিত্রের প্রভাবে আরও অনেক অখ্যাত স্থান কালেদিনে ভ্রমণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যেমন পুরুলিয়ার জয়চন্ডী পাহাড়। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির কিছু অংশ চিত্রায়িত হয় এখানে। এটা উদয়ন পন্ডিতের আত্মগোপনের স্থান। ভ্রমণ-পাগল বাঙালিরা ছুটে যান মুর্শিদাবাদে গঙ্গার ধারে নিমতিতা গ্রামেও। সত্যজিৎ পরিচালিত ‘জলসাঘর’ খ্যাত নিমতিতা রাজপ্রাসাদ দেখতে। নিমতিতায় তাঁর ‘দেবী’ ও ‘তিনকন্যা’ (সমাপ্তি) ছবির শুটিং-ও হয়েছিল। ‘ইউ টিউব’-এ পূর্ব বর্ধমানের চকদীঘি ভ্রমণের অনেকগুলো ভিডিও পাওয়া যায়। চকদীঘিতে সিংহ রায়দের বাগানবাড়ি সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’ ছবির লোকেশন।
বাংলার বাইরে সত্যজিতের ছবির কল্যাণে সারা পৃথিবীর পর্যটক আকর্ষণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে রাজস্থানের মরুশহর জয়সলমীর। ভারতের ভ্রমণ মানচিত্রেও জয়সলমীর একরকম উপেক্ষিতই ছিল। ‘অভিযান’ ছবির শুটিং করতে সত্যজিৎ প্রথম রাজস্থানে যান। সেবার সেখান থেকে ফিরে স্ত্রী–কে বলেছিলেন ‘রাজস্থান অসাধারণ জায়গা।’ ‘গুগাবাবা’ ছবি তৈরির সময় হিমাচলপ্রদেশের সিমলার কাছে বরফে ঢাকা কুফরিতে (যেখানে পরে জমে উঠেছিল ফেলুদা সিরিজের ‘বাক্সরহস্য’ গল্পের ক্লাইম্যাক্স) ‘ঝুন্ডি’-র দৃশ্য তোলার পর তিনি দ্বিতীয়বার পা রাখেন রাজস্থানে। জয়সলমীরের কাছে এক জায়গায় ‘হুন্ডি’ এবং বুঁদির কাছে ‘শুন্ডি’-র দৃশ্য তোলেন। হাল্লা রাজার দুর্গ হয় জয়সলমীরের কেল্লা। হলুদ বেলে পাথরে তৈরি সেই কেল্লাই তাঁর গল্পে ও ছবিতে ‘সোনার কেল্লা’ হয়ে জয়সলমীরকে বিখ্যাত করে দেয়। ‘সোনার কেল্লা’ ছাড়াও ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির শুটিং হয়েছিল রাজস্থানে।
রাজস্থানের মতোই বেনারস-ও ছিল সত্যজিতের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। তাঁর ‘অপরাজিত’ ছবিতে বেনারসের সাদা কালো ছবি আজও সেরা শিল্পকর্মের সম্মান পায়। বেনারসের অলিগলি আর তার দু’ধারের চিত্রিত ‘হাভেলি’ থেকে শুরু করে গঙ্গার ঘাটগুলোর সুন্দর দৃশ্যায়ন তিনি করেছেন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পে ও চলচ্চিত্রে। ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’-র জট ছাড়াতেও ফেলুদাকে তিনি বেনারসে পাঠিয়েছিলেন। সত্যজিতের পুত্র খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক সন্দীপ রায় একবার বলেছিলেন, “বাবা যেখানে যেখানে বেড়াতে গিয়েছেন, সেখানে সেখানেই ফেলুদা রহস্য উন্মোচনে গিয়েছেন। ফলে সেই সব জায়গায় বেড়ানোর একটা আমেজ ফেলুদার গল্পে রয়েছে। কিন্তু বাবা-র যেখানে যেখানে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সেখানে তিনি পাঠিয়েছেন প্রোফেসর শঙ্কুকে।” প্রোফেসর শঙ্কু বিদেশেই বেশিবার গিয়েছেন। একবার তিনি মঙ্গল গ্রহেও যান। কিন্তু ফেলুদা নেপাল, লন্ডন ও হংকং ছাড়া দেশের বাইরে আর কোথাও কখনও যায়নি। সত্যজিৎ-ও দেশের মধ্যেই স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বেশি ঘুরেছেন। তবে তিনি সপরিবারে বহুবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু গিয়েছেন। শুধু প্রকৃতিই নয়, ‘ক্যাসিনো’-র টানেও। ‘হীরক রাজার দেশে’-র একটা দৃশ্য গ্রহণ করতেও তিনি কাঠমান্ডু যান। কাঠমান্ডু থেকে কাক্নি নামের একটা জায়গায় গিয়ে তোলেন ‘এবারে দ্যাখো গর্বিত বীর’ গানটির দৃশ্য। তারপরেই লিখে ফেলেন ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’। সন্দীপ যখন স্কুলে পড়তেন, তখন প্রতি বছর গরমের ও পুজোর ছুটিতে তাঁরা দার্জিলিং না হয় পুরী যেতেন। ‘আমার পাহাড়ও ভাল লাগে, আবার সমুদ্রও ভাল লাগে’ – ‘বাদশাহী আংটি’-তে তোপসের এই কথা আসলে সত্যজিতেরই মনের কথা। শুধু বেড়াতেই নয়, নতুন ছবির চিত্রনাট্য লেখার প্রয়োজনে সমুদ্রের কাছে নির্জন পরিবেশ পেতেও সত্যজিৎ পুরী চলে যেতেন। নষ্টনীড়‘ (চারুলতা)-র চিত্রনাট্য লিখতে তিনি অবশ্য গোপালপুরে যান। এই ছবির কিছু ‘শট‘-ও নেওয়া হয় গোপালপুরে সমুদ্রের ধারে। তবে তাঁর বার বার পুরী যাবার অবশ্যম্ভাবী ফল – ‘হত্যাপুরী’ । সিকিমের উপর একটা তথ্যচিত্র করার পরেই তিনি লেখেন ‘গ্যাংটকে গন্ডোগোল’। বহুবার বোম্বাই যাওয়ার অভিজ্ঞতায় লেখেন ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’। প্রখ্যাত ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী ‘বালাসরস্বতী’-কে নিয়ে তথ্যচিত্র করার সময় তিনি স্ত্রীর সঙ্গে মাদ্রাজ যান। শুটিং-এর ফাঁকে দুজনে মিলে সেখানকার অনেক জায়গা দেখেন। সত্যজিৎ ছিলেন ‘গাইড’-এর ভূমিকায়। মহাবলীপুরমের মন্দিরের ইতিহাস ও তার স্থাপত্য-ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত সহজ ভাষায় তিনি বিজয়া রায়কে বুঝিয়ে দেন। ‘নয়ন রহস্য’ উপন্যাসে পড়েছি মাদ্রাজে গিয়ে ফেলুদা তোপসে ও লালমোহনবাবুর সাথে মহাবলীপুরমের মন্দির দেখতে যান। লক্ষ্য করার বিষয় যে তামিলনাড়ু ছাড়া ফেলুদা দক্ষিণ ভারতের আর কোনো রাজ্যে যায়নি, সত্যজিৎ-ও গিয়েছেন বলে জানা নেই। মধ্যপ্রদেশেও তিনি খুব বেশি গিয়েছেন বলে মনে হয়না। ‘টিনটোরেটোর যীশু’ উপন্যাসের শুরুতে জটায়ুও বলেছেন – ‘এম পি-টা দেখা হয়নি।’ ”অপুর সংসার’-এর শুটিং করতে সত্যজিৎ চিরিমিরি গিয়েছিলেন। ‘সদ্গতি’ ছবির শুটিং হয়েছিল রায়পুরে। চিরিমিরি ও রায়পুর এখন ছত্তিশগড়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও তখন ছিল মধ্যপ্রদেশে। ‘সদ্গতি’-র লোকেশন খুঁজতে মধ্যপ্রদেশের কিছু জায়গায় তাঁর ঘোরার সুযোগ হয়। তাই শেষপর্যন্ত ‘টিনটোরেটোর যীশু’-তে হংকং যাওয়ার আগে ফেলুদা’র সাথে ছিন্দওয়ারা গিয়ে জটায়ুর এম পি-টা দেখা হয়ে যায়। ‘সদ্গতি’ মুক্তি পাওয়ার পরের বছরেই ‘টিনটোরেটোর যীশু’ লেখা হয়। মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র ও খাজুরাহোতে সত্যজিৎ যান কলাভবনে ভর্তি হওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই। সে এক মজার গল্প। ‘স্টুডেন্ট কনসেশন’ নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সঙ্গী তিন বন্ধু – দিনকর কৌশিক, পৃথ্বীশ নিয়োগী ও মুথুস্বামী। যাবার সময় ভুল ট্রেনে ওঠা, টি. টি-র সঙ্গে কথা কাটাকাটি, মারাঠি ও মালয়ালাম ভাষা বলে টি. টি-কে নাস্তানাবুদ করা – সে তো এক পর্ব। তারপর জলগাঁও পৌঁছে অজন্তা ও ইলোরার গুহাগুলো দেখে বোম্বাইয়ের এলিফ্যান্টা গুহা দেখতে যান। শেষে গোয়ালিয়র হয়ে তাঁরা খাজুরাহো পৌঁছান। খাজুরাহোতে সারা দিন ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব মন্দির দেখেন। মন্দিরের শিল্পরীতি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পৃথ্বীশ তাঁদের ‘গাইড’ হন। দিনকর কৌশিক ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রকর এবং কলাভবনের এককালীন অধ্যক্ষ। এই অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘আনন্দলোক’-এ প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি লিখেছেন, “পৃথ্বীশ এমন রসিয়ে কথা বলত যে তা শুনে মনে হত মূর্তিগুলো জ্যান্ত হয়ে মন্দির গাত্রে ক্রীড়া করছে।” তারপরেই তিনি আবার লিখেছেন, ” কিন্তু শিল্প দিয়ে পেট ভরে না – বা দিনের ক্লান্তিও দূর হয় না। কোনোরকম দু মুঠো খেয়ে শোবার জন্য জায়গার তল্লাশি শুরু করলাম। শোব আর কোথায়? কোন হোটেল নেই, ধর্মশালা নেই, কোন ছাদ নেই – যার তলায় চুপ করে পড়ে থেকে রাত কাটাই। শেষে এক গোয়ালঘর পাওয়া গেল। খড়ে ভরতি। এক পাশে গোরু মোষগুলি – হুশ-হাশ-ধুপ ধাপ করে পা নাড়াচ্ছে। লেজে পোকা মাছি তাড়াচ্ছে। ”জয় খাজুরাহো” বলে আমরা শুয়ে পড়লাম।” এই ভ্রমণে ইলোরায় কৈলাস মন্দির দেখার অভিজ্ঞতাতেই সত্যজিৎ ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ লেখেন।
ফেলুদার যাওয়া সব জায়গাতেই সত্যজিৎ কোনো-না-কোনও সময় গেছেন, সন্দীপ রায় বলেছিলেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে একটা জায়গা নিয়ে আমার মনে একটু সংশয় দেখা দিয়েছে। ফেলুদা কেদারনাথে গিয়েছিল। কিন্তু সত্যজিৎ কেদারনাথে গিয়েছিলেন এমন কোনো তথ্য পাইনি। সত্যজিতের কোনো লেখাতে পাইনি। বিজয়া রায়ের লেখা ‘আমাদের কথা’-য় পাইনি। কেদারনাথে বা কেদারনাথের পথে কোনো জায়গায় সত্যজিতের কোনও ছবির শুটিং-ও হয়নি। প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকের পর বেলভিউ নার্সিংহোমে ভর্তি থাকাকালীন একটু সুস্থ হলে সেখানেই ‘এবার কান্ড কেদারনাথে’ লিখে শেষ করেন সত্যজিৎ। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় একথা লিখেছিলেন সন্দীপ। কিন্তু সেখানে তিনিও লেখেননি যে সত্যজিৎ কেদারনাথে গিয়েছিলেন। ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ সত্যজিৎ কাশ্মীর ভ্রমণের কথা লেখেননি। পূর্বোক্ত ‘সন্দেশ’-এর সেই লেখাতেই সন্দীপ জানিয়েছেন ছেলেবেলায় ঘোরা কাশ্মীরের স্মৃতি থেকেই লেখা হয়েছে ফেলুদা কাহিনী ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’। সেক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে সত্যজিৎ নিজে না লিখে থাকলেও ছেলের কাছে তাঁর কাশ্মীর ভ্রমণের গল্প করেছিলেন। তবে এক্ষেত্রেও কি তাই? কখনও কি ছেলের কাছে তাঁর কেদারনাথ ভ্রমণের গল্পও করেছিলেন সত্যজিৎ? আর সে ভ্রমণ তিনি করে থাকলে কবে করেছিলেন তা জানার ইচ্ছেও হচ্ছে। এ ব্যাপারে আলোকপাত এখন একমাত্র সন্দীপ-ই করতে পারেন।
‘ঘরে বাইরে’ ছবি নির্মাণের সময় দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পর চিকিৎসকেরা সত্যজিৎকে নির্দেশ দেন পরবর্তী ছবির শুটিং সব স্টুডিও-তে করতে হবে। ‘গণশত্রু’ ছবির শুটিং পুরোটাই স্টুডিওতে হয়েছিল। শিলিগুড়ির কাছে শুকনা ফরেস্টে ‘শাখা প্রশাখা’ এবং শান্তিনিকেতনে ‘আগন্তুক’ ছবির লোকেশন শুটিং হলেও তা খুবই অল্পদিনের জন্য। অসুস্থতার কারণে ক্রমে কলকাতা-কেন্দ্রিক জীবনেই সত্যজিৎ-কে অভ্যস্ত হতে হয়। যদিও কলকাতা ছিল তাঁর প্রাণের শহর। এই শহরে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অন্যতম সম্পদ তাঁর ‘মহানগর’ ছবি গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কলকাতার পটভূমিতে তৈরি। যে সাবেকি কলকাতা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে থেকে, তাকে আমরা খুঁজে পাই এই চলচ্চিত্রে। ছবিটি বানানোর পর সত্যজিৎ বলেছিলেন, “আমার নিজের শহর কলকাতাকেও আমি এখন আরও ভাল করে জানি। কারণ এখন আমি এর বিষয়ে একটা ছবি করেছি, দেখলেই বোঝা যায় যে পৃথিবীর অন্য কোন শহরের সঙ্গে হুবহু এক নয় এ শহর। তবুও লন্ডন, ন্যুইয়র্ক কিংবা টোকিওর মতই এ শহরেও মানুষ জন্মায়, জীবনযাপন করে, পরস্পরকে ভালবাসে এবং জীবিকা নির্বাহ করে।” ‘অপরাজিত’, ‘পরশপাথর’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’ ও ‘জন অরণ্য’ – সত্যজিৎ পরিচালিত এই ছবিগুলোতেও ‘কলকাতা বেঁচে আছে রূপকথা হয়ে’। কলকাতার পুরোনো রাস্তা, গলিঘুঁজি, বাড়িঘরদোর, ট্রামলাইন, গঙ্গার ঘাট, ময়দান বা গড়ের মাঠ – সত্যজিতের চলচ্চিত্রে এ সবই ‘নস্টালজিয়া’ তৈরি করে। সত্যজিতের গল্প-উপন্যাস-ও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষত তাঁর ‘ফটিকচাঁদ’ গল্পে মাদারির খেলা ও ফেরিওয়ালার হাঁকডাকে সরগরম ময়দান এবং ‘গোরস্থানে সাবধান’- উপন্যাসে কলকাতার প্রাচীনতম গোরস্থানের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য। বহুকাল আগে থেকেই বাঙালিরা হাওয়া খেতে গড়ের মাঠে যায়। কিন্তু পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান যে এখন রীতিমতো বেড়ানোর জায়গা হয়ে গেছে, তা সত্যজিতের লেখার গুণেই। শুধু পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান-ই নয়, ফেলুদা’র চোখ দিয়ে কলকাতার আরও অনেক জায়গাকেই নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। যেহেতু ‘কৈলাস চৌধুরীর পাথর’, ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’, ‘গোলকধাম রহস্য’, অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’, ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’, ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’, ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’,’ ডাঃ মুনসীর ডায়েরি’ – ফেলুদা’র এই গল্পগুলোতে রহস্য দানা বেঁধেছে কলকাতাকে কেন্দ্র করেই।
প্রথমবার লন্ডন ভ্রমণে ভিত্তোরিও দে সিকা’র ‘বাইসাইকেল থিভ্স’ দেখে সত্যজিৎ গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ছবিটা দেখে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বলেছিলেন, “ভাবতে পারো কত সস্তায় ওই ধরনের ছবি করা যায়? পুরোটাই প্রায় লোকেশান, স্টুডিও ভাড়া করার হাঙ্গামা নেই বললেই চলে।” কিন্তু সত্যজিৎ নিজে সারা জীবন শুধুমাত্র খরচ কমানোর জন্যই যে লোকেশন শুটিং বেশি করেছেন তা নয়। ভ্রমণের নেশাতেও করেছেন। লোকেশন শুটিং একরকম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুবই মনোকষ্টে ভুগেছেন তিনি। স্ত্রীকে বলেছেন, “ভাবতে পার, আমাকে লোকেশন শুটিং করতে দেওয়া হবে না! ওই বন্ধ স্টুডিওতে যা করবার করতে হবে, আমি নিজে যা অত্যন্ত অপছন্দ করি।” মনে মনে এই বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছে তাঁর হয়েছে। তাই তো দেখি তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এর মনোমোহন মিত্র ভ্রমণের নেশায় ঘর ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর পথে। বিদায় মুহূর্তে নাতিকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন কূপমন্ডুক না হতে। বুঝতে অসুবিধা হয়না জীবন থেকে চির বিদায় নেওয়ার আগে মনোমোহনের মুখ দিয়ে সত্যজিৎ স্বয়ং ভাবী প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।
তথ্যসূত্রঃ
(১) যখন ছোট ছিলাম – সত্যজিৎ রায়
(২) একেই বলে শুটিং – সত্যজিৎ রায়
(৩) বিষয় চলচ্চিত্র – সত্যজিৎ রায়
(৪) ফেলুদা সমগ্র (১ ও ২) – সত্যজিৎ রায়
(৫) শঙ্কু সমগ্র – সত্যজিৎ রায়
(৬) আনন্দলোক (৯ মে ১৯৯২)
৭) দেশ (২ মে ১৯৯২)
(৮) দেশ (২ মে ২০২১)
(৯) আনন্দবাজার পত্রিকা – উত্তরের কড়চা (১৮ জুন ২০১৪)
(১০) এই সময় (১৩ জানুয়ারি ২০১৯)
(১১) সন্দেশ ‘ফেলুদা ৩০’ বিশেষ সংখ্যা (অগ্রহায়ণ ১৪০২)
(১২) আমাদের কথা – বিজয়া রায়
****************************************************
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন’-এ স্নাতকোত্তর সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত একজন লেখিকা,সংগীতশিল্পী এবং বিজ্ঞান ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। ‘কালান্তর’,‘সুস্বাস্থ্য’ ‘উৎস মানুষ’,‘টপ কোয়ার্ক’,‘যুক্তিবাদী’, ‘এখন বিসংবাদ’,‘মানব জমিন’,‘আবাদভূমি’,‘সাহিত্য সমাজ’,‘সারথি’,‘অভিক্ষেপ’ ইত্যাদি বেশ কিছু পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। একসময় তিনি ছিলেন ‘আজকাল’ পত্রিকার নিয়মিত পত্রলেখিকা। ২০০৩-এ ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’-র উদ্যোগে তাঁর সম্পাদনায় ‘র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন’ প্রকাশন থেকে ড. পবিত্র সরকারের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয়েছে ‘ছোটোদের কুসংস্কার বিরোধী গল্প’-র দুটি খন্ড। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে মরণোত্তর দেহদান–আন্দোলন ও উত্তরণ’ বইটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। দূরদর্শনে ‘মরণোত্তর দেহদান’ নিয়ে সম্প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন। সম্প্রতি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী কানন দেবীর জীবন নিয়ে তাঁর একটি গবেষণামূলক কাজ ‘ফেসবুক’-এ তাঁর টাইমলাইনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে তিনি ‘সংগীত প্রভাকর’ ও ‘সংগীত বিভাকর’। দীর্ঘদিন শাস্ত্রীয় সংগীতেও তালিম নিয়েছেন। শৈশব ও কৈশোরে বেতারে ‘শিশুমহল’,‘গল্পদাদুর আসর’ ও ‘কিশলয়’-এর অনুষ্ঠানে বহুবার গান গেয়েছেন। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলায় ও এই রাজ্যের বাইরেও মঞ্চানুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত,পল্লীগীতি ও গণসংগীত ছাড়াও তাঁর ভাই রাজেশ দত্তর কথায়-সুরে ‘মানবতার গান’ পরিবেশন করেছেন। ২০০৬-এ রাজেশের কথায়-সুরে তাঁর গাওয়া ‘পাল্টা স্রোতের গান’ অডিও ক্যাসেট ও সিডি আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রজীবনে বেশ কয়েকটি নাটক ও শ্রুতিনাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীতে চন্দননগরের ‘কোরক’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাট্যাভিনয় করেছেন। আবৃত্তি,সংগীত ও কয়েকটি ‘রিয়্যালিটি শো’-এ বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কৈশোরে খেলাধূলার জগতেও তিনি বিচরণ করেছেন। স্কুলে ইন্টারক্লাস ‘কবাডি’ খেলায় নিজের ক্লাসের টীমে তিনি ‘ক্যাপ্টেন’-এর দায়িত্ব পালন করেছেন। চন্দননগরের ‘চিত্তরঞ্জন ব্যায়ামাগার’-এ তিনি ‘জিমনাস্টিকস্’,বিশেষত ‘তারের খেলা’-র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ব্রতচারী নাচের প্রশিক্ষণ শেষে শংসাপত্র-ও অর্জন করেছেন। এখন গৃহকর্মের ফাঁকে ও অবসরে লেখালেখি ও গানের চর্চা ছাড়াও আঁকতে ও ছবি তুলতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ’ভ্রমণ’।
সু
অসাধারণ তথ্য। পড়ে খুব ভালো লাগলো।