ঠাকুরবাড়ি ও বাঈজি সংগীত
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার সেই ইতিহাস লগ্ন৷ সাংস্কৃতিক নানা বিভাগেই সেই শতাব্দীর শেষার্ধে বিপুল প্রেরণা যুগিয়েছিল৷ কলকাতার তথা বাংলার সংগীত ক্ষেত্রেও তখন নব নব কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টিতে বিভোর৷ ভারতীয় সংগীতের মূল ধারা রাগ সঙ্গীতের চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে বাঙালি প্রতিভা৷ কলকাতায় খেয়াল ঠুংরির সত্যিকারের চর্চা ও খানদান শুরু হয় ১৮৫৬ সালে যখন লক্ষ্মৌ থেকে নবাব ওয়াজেদ আলী শা মেটিয়াবুরুজে বন্দীজীবন কাটান সঙ্গে আনা ওস্তাদ কলাবন্তদের সাহচর্যে৷ ঠুংরি গানের যোগসূত্র যেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ দরবারের তওয়ায়েফ বা বাঈজিদের সঙ্গে৷ নবাবের মৃত্যুকাল পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর ধরে সেই দরবারে নিয়মিত বসতো নাচ-গানের মেহফিল৷ ভারতবর্ষের নানা স্থান থেকে ওস্তাদ বাঈজিরা আসতো এই দরবারে৷ কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মায়া এড়াতে পারত না তাঁরা৷ উত্তর ভারতের অনেক বাইজি কলকাতাতে বসবাস শুরু করে দিলেন৷ এঁরা কলকাতার বিভিন্ন ধনী গৃহে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করতেন৷ যেমন বড়ী মালকাজান, গওহরজান, মালকাজান, আস্রাওয়ালী, জানকীবাঈ, মালকাজান চুলবুলওয়ালী প্রভৃতি অবাঙালি বাঈজি। বাঙ্গালীদের মধ্যে যাঁরা বিখ্যাত ছিলেন তাঁরা হলেন হরিমতি, যাদুমণি, মানদা সুন্দরী, পান্নাময়ী, আশ্চর্যময়ী, কৃষ্ণভামিনী ইত্যাদি৷
সেই সময়ে যাঁরা এই বাঈজিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাঁরা হলেন রাধারমণ রায়, নীলমণি মল্লিক, রূপচাঁদ রায়, গোপীমোহন দেব, রাজা রামমোহন রায়, রাজা রাজকৃষ্ণ, রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রমুখ৷ তখনকার বিখ্যাত বাঈজিরা যাঁরা উল্লিখিত ব্যক্তিদের বাড়ি গান ও নৃত্য প্রদর্শন করতেন তাঁরা হলেন নিকিবাঈ, হিঙ্গুনবাঈ, বেগম জান, সুনন বাঈ, হুসনা বাঈ, আশরুন বাঈ, হীরা বুলবুল প্রমুখ৷ পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়িতে ও কলকাতার অন্যান্য বনেদি বাবুদের বাড়ির মতোই বাঈ নাচের আসর বসতো৷ দুর্গাপূজোয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তখনও গড়ে ওঠেনি৷ বাবু দর্পনারায়ণ ঠাকুর দুর্গাপূজায় খরচ করতেন দরাজ হাতে৷ পুজোর সময় সাহেব সুবোদের পাশাপাশি দেয়ান, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দিরাও নিমন্ত্রণ পেতেন৷ তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য বসতো পানভোজন আর বাঈ নাচের মজলিস।
PC : Wikipedia
দর্পনারায়ণের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুরের আমল থেকেই ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত জমজমাট মজলিস বসতে শুরু করে৷ জোড়াসাঁকো বাড়িতে বাঈ নাচের আসর বসানো শুরু করেন নীলমণি ঠাকুরের পুত্র রামলোচন ঠাকুর৷ বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আমোদপ্রমোদ এর আয়োজন করার কথা ভেবেই রামলোচনের পালিতপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর বাড়ির পাশেই বানিয়েছিলেন বৈঠকখানা বাড়ি৷ অতিথিদের আপ্যায়ন ও ভোজসভার আয়োজন এর জন্যই দ্বারকানাথ বেলগাছিয়া ভিলা বানিয়ে ছিলেন৷ সেখানে ভোজসভার পাশাপাশি বাঈনাচ ও নানান আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করতেন৷ ১৮৪০ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারির ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা সূত্রে জানা যায়-‘গত বুধবারে শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর বেলগাছিয়ার স্বীয়োদ্যান বাটীতে এতদ্দেশস্থ অনেক ইউরোপীয় সাহেবদিগকে মহাভোজ করাইলেন …..এবং গত রবিবারে শ্রীযুত বাবু ঐ উদ্যানে স্বদেশীয় স্বজনগণকে লইয়া মহাভোজ আমোদ প্রমোদাদি করিলেন এবং তদুপলক্ষে বাঈয়ের নাচ হইয়াছিল তাহাতে কলিকাতার মধ্যে প্রাপ্য সর্বাপেক্ষা যে প্রধান নর্তকী ও প্রধান বাদ্যকর তাহাদের নৃত্য গীত বাদ্যাদির দ্বারা আমোদ জন্মাইলেন এতদ্ভিন্ন উৎকৃষ্ট আতসবাজির রোশনাই ও হয়েছিল৷’
পাথুরিয়াঘাটা বাড়ির গোপীমোহন ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র ছিলেন হরকুমার ঠাকুর৷ হরকুমার হিন্দুস্থানী রাগ সংগীত ও সেতার বাদন এ পারদর্শী ছিলেন৷ তাঁর দুই পুত্র যতীন্দ্রমোহন ও সৌরীন্দ্রমোহন ছিলেন সংগীতের সমঝদার এবং সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী৷ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথ ঠাকুর সুগায়ক না হলেও ছিলেন সমঝদার৷ ওঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ কালোয়াতি গান ও পিয়ানো শিখেছিলেন৷ ভক্ত ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের৷ তাঁর উৎসাহে বাড়িতে শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞদের মজলিস বসতো৷ দেবেন্দ্রনাথের ভাই গিরীন্দ্রনাথের ছিল অনেক রকম শখ৷ যাত্রা দেখা, নাটক লেখা, কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, গান শোনা এবং গান লেখা৷ মাঝে মাঝে বেলগাছিয়া ভিলাতে মজলিশ বসাতেন আর দুর্গাপূজার সময় বাঈ নাচের আসর ও বসাতেন৷ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার পর দেবেন্দ্রনাথ নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেন৷ কীর্তন, বাঈ নাচ সব বন্ধ করে দেন দেবেন্দ্রনাথ৷ বৈঠকখানা বাড়িতে গিরীন্দ্রনাথের পুত্র গুণেন্দ্রনাথ কিন্তু সাবেক রীতিতে নাচ ঘরে গান ও বাঈজি নাচের আসরের আয়োজন করতেন৷
রামলোচন বা দ্বারকানাথের আমলে যেরকম গানের আসর বসতো যুগের পরিবর্তনে সে আসরের রূপ পাল্টাতে শুরু করে দিলো গুণেন্দ্রনাথ এর আমল থেকেই৷ তৎকালীন যুগের অবক্ষয়ের হাত থেকে বাড়ির ছেলেদের বাঁচাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বাড়ির অভিভাবকেরা। এঁদের মধ্যে প্রধানা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের মা সৌদামিনী দেবী৷ পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ গান ও বাঈজি নাচের আসর বসিয়েছেন তবে তা শুধুই শিল্প রসের জন্য৷ কয়েকজন বাঈজির গান শোনার গল্প লিখে গেছেন অবনীন্দ্রনাথ ৷ এক জায়গায় বলছেন,” শ্রী জান ও আসে৷ সেও বুড়ো হয়ে গেছে৷ চমৎকার গাইতে পারে৷ মাকে (সৌদামিনী দেবী) বললুম,”মা একদিন ওর গান শুনবো৷” মা বললেন শ্রীজান কে?” ….শ্রীজান রাজি হলো৷ একদিন সারারাত ব্যাপী শ্রীজানের জলসায় বন্ধু-বান্ধবদের ডাক দেওয়া গেল৷ নাটোর (জগদিন্দ্রনাথ রায়) ছিলেন তার মধ্যে৷ বড় নাচঘরে গানের জলসা বসল৷ শ্রীজান গাইবে চার প্রহরের চারটে গান। শ্রীজান আরম্ভ করল গান।| …. কি গলা কোকিল কন্ঠ যাকে বলে৷ এক একটা গান শুনি আর বিস্ময়ে কথা বন্ধ হয়ে যায়৷” আরেক জায়গায় বলছেন,”তখন আমি দস্তুরমতো গানের চর্চা করি৷ কোথায় কে গাইয়ে বাজিয়ে এলো সব খবর আসে আমার কাছে৷ কাশী থেকে এক বাঈজি এসেছে৷ নাম সরস্বতী৷ চমৎকার গায়৷ ….. তোড়জোড় সব ঠিক৷ দশটা বাজল গান আরম্ভ হলো। একটি গানে রাত এগারোটা, নাটোর মৃদঙ্গ কোলে নিয়ে স্থির৷ সরস্বতীর চমৎকার গলার স্বরে অত বড় নাচ ঘরটা রমরম করতে থাকল৷” গগনেন্দ্রনাথ এর পুত্র গেহেন্দ্রনাথের বিয়ে উপলক্ষে ঠাকুরবাড়িতে গওহরজান এর গান হয়েছিল বলে জানিয়েছেন গগনেন্দ্রনাথের মেয়ে পূর্ণিমা ঠাকুর৷ তিনি বলছেন,”তার পরদিন ফুলশয্যার আসর৷ মেয়েমহলে খেমটা নাচ গান সন্ধ্যে থেকেই শুরু হলো৷ পুরুষ মহলের আগেই খাওয়া হয়ে গেলে রাত আটটা থেকে বাঈ নাচ শুরু হয়৷ দুজন বাঈজি আসে,শ্রীজান ও গহরজান,কলকাতার নামকরা বাঈজি৷ …… গহরজান বৈঠকখানার গান হয়ে গেলে দিদিমাকে গান শোনাতে যায়৷ …..গহরজান তাঁকে ‘হরিনাম মহামন্ন হৃদয়ে জপ রসনা’ গানটা গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন৷”
সে যুগের আরেক বিখ্যাত বাঈজি ছিলেন এলাহাবাদের মুস্তুরিবাঈ। সেই মুস্তুরিবাঈকে একবার কলকাতা এনেছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল মহাশয়৷ ওঁর সেই মেহফিল ই কলকাতায় আকাশবাণীর প্রথম ওবি বা আউটসাইড ব্রডকাস্টিং প্রোগ্রাম। হাজির ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর বাড়িতে বসে রেডিও মারফত মুস্তুরির বেহাগ শুনে রবীন্দ্রনাথ রাইচাঁদ কে ফোন করে বলেছিলেন,”এ তুমি কী স্বর্গীয় গান শোনার সুযোগ করে দিলে রাই? আমি কবে এই কিন্নরিকে সামনাসামনি দেখতে পাবো? “জোড়াসাঁকোতে বসে মুস্তুরির গান শুনে চোখে জল এসেছিল রবীন্দ্রনাথের৷ রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন,”হোসনা বিবির মুখে শাস্ত্রীয় সংগীত শুনে বুঝলাম এঁদের মত সঙ্গীতজ্ঞা ও কণ্ঠস্বর ধারিণীদেরই আছে শাস্ত্রীয় সংগীত গাওয়ার অধিকার৷ দুটি ঘন্টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল বোঝা গেল না-যেন সকলকে আনন্দ রসে ডুবিয়ে দিলো৷ “গুরুদেব সে সংগীত সুধায় মুগ্ধ হয়ে অনেক প্রশংসা করে বলেন,”এ কণ্ঠস্বর এমন সংগীত দুর্লভ৷” বাঈজি বলেন,”আজ আমার সমস্ত শিক্ষা ও জীবন সার্থক৷’
কালের নিয়মেই বৈভবের যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছিল,তাই মজলিশি গান-বাজনাও আসছিল কমে৷ ধীরে ধীরে ঠাকুর পরিবারে ও সাংস্কৃতিক হাওয়া বইতে শুরু করেছিল অন্যদিকে৷ জমিদারির আয়ত্ত গিয়েছিল অনেক কমে৷ মেহফিলের যুগ ঠাকুরবাড়ি থেকে বিদায় নিলেও সঙ্গীতচর্চা,নাট্যচর্চা,সাহিত্য চর্চা এবং শিল্প চর্চার ধারাটা আরো অনেকদিন ধরে চলেছিল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন কে কেন্দ্র করে৷।
****************************************************
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচিতিঃ
বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গ কন্ঠ সংগীত শিল্পী আরাধনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, (জন্ম ১৯৫৮) , সরোদবাদনে তালিম পেয়েছেন ধ্যানেশ খান, আশীষ খান, বাহাদুর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলি আকবর খাঁ এর কাছে। আলি আকবর খাঁ এর কাছে তিনি শিক্ষা পেয়েছেন ওস্তাদজির মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব পর্য্যন্ত। ইউরোপ, ব্রিটেন, কানাডা, আমেরিকার বহু শহরে উনি সংগীত পরিবেশন করেছেন। তাঁর সরোদ বাদনে তিনি যেমন রবাব, সুরশৃঙ্গার ও বীনার গুনলক্ষন অঙ্গীভুত করেছেন, তেমনই আবার অপ্রচলিত সুরশৃঙ্গার বাদনেও তাঁর দক্ষতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কলকাতার স্টেটসম্যান ও টেলিগ্রাফ দৈনিকে দীর্ঘকাল সংগীত সমালোচকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একাধিক সংগীত বিষয়ক তথ্য চিত্রে তাঁর সংগীতজ্ঞ্যানের পরিচয় আছে। দেশে বিদেশে সংগীত শিক্ষাদানেও তাঁর ক্ষ্যাতি প্রতিষ্ঠীত।