উদয়ন পণ্ডিতের অনুসন্ধানে
অনুপ মুখার্জী
বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ দেশ-কাল-পাত্র ভেদে এক অমর সৃষ্টি। ছবিটিতে উদয়ন পণ্ডিতের যে চরিত্র সৃজন তা ছকে বাঁধা তাত্ত্বিক সমাজ বিপ্লবের ধারার থেকে ভিন্ন হয়েও একদিকে প্রাসঙ্গিক অপরদিকে গুপী বাঘার ইপ্সিত শান্তি (গুপী গায়েন বাঘা বায়েন ছবিতে)যে সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ব্যতীত সম্ভবপর নয় তাও পরিস্ফুট। সেই লক্ষ্যেই উদয়নকে পরিচালক এই ছবিতে নায়কের আসনে বসিয়েছেন।এমন একটি মৌলিক আদর্শ চরিত্র এদেশের মাটির রূপ রস ভাষ্যে গড়ে উঠলেও এরকম কোনো ইতিহাস মানুষের সন্ধান কি লেখক পরিচালক পেয়েছিলেন?তারই অনুসন্ধানে এই আলোচনা।
সিকিমের ছায়াতালঃ
চলুন শিলিগুড়ি থেকে জোরথাং পেরিয়ে নয়াবাজার,জুম,চেখুং, সোরেং, কালুক,বার্মিক,হি-পাতাল, ছায়াতাল।দূরত্ব-১৪৫ কিমি,/মোটের উপর সারে পাঁচ ঘন্টার পথ।এর একপাশে রয়েছে ভার্সে সংরক্ষিত বনাঞ্চল পরিদর্শনের আরেকটি প্রবেশপথ।আর সম্মুখ জুড়ে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা।
২১-২৩ শে জুন,২০১৯ আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব স্রেফ ভ্রমণের নেশায় সেখানে গেছিলাম। গ্রামের প্রবেশ পথের বেশ কিছুটা আগে থেকেই গাছপালা, পাহাড় চূড়া ছাপিয়ে চোখে পড়ে একটি মূর্তি।আপনি যদি পেলিং এর দিক থেকে প্রবেশ করেন,তাও মূর্তিটি চোখে পড়বে।শেষদিন প্রাতরাশ সেরে একাকী গ্রাম পরিদর্শনে বের হই ।দুই কি,মি,এলাকা জুড়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় একশটি পরিবারের বসবাস।প্রত্যেকেই কঠোর পরিশ্রমী। সাধারণ মানের ঘর-বাড়িগুলি ফুলে ফুলময়।লাজুক সৌজন্যবোধ,নরম বাক’ভঙ্গী।এরা প্রায় সকলেই লিম্বু জনজাতির।তারাই দেখিয়ে দিলেন মূর্তি মন্দির গমনের পথটি। ‘ছায়াতাল’ গমনের নিম্নগামী মিনিট পনেরর টালি বাঁধানো চার -পাঁচ ফুটের চওড়া আঁকাবাঁকা নিম্নগামী ধাপযুক্ত পথটি গিয়ে শেষ হয়েছে মহাত্মা তিয়ংসি সিরিজুঙ্গা র মূর্তির পাদদেশে।এপথে সঙ্গী সদা ঝংকৃত ঝোড়া আর দু পাশে বিহঙ্গ সংকুল ঘন জঙ্গল।
মহাত্মা সিরিজুঙ্গাঃ
মূর্তিটি বৌদ্ধস্তুপের ন্যায় উচ্চ একটি গোলাকৃতি হলঘর-স্থানীয়দের ভাষায় সিরিজুঙ্গা মন্দিরেরউপর প্রতিষ্ঠিত ।দেওয়াল জুড়ে সিরিজুঙ্গার বাণী ও ছবি।বিছানা।তাকে নিত্য উৎসর্গকৃত সামান্য উপাচার।ধূপের মিষ্টি গন্ধ।সর্বত্র পরিচ্ছন্ন শান্ত,স্নিগ্ধ, নিঝুম পরিবেশ। প্রবেশমুখ থেকে ডানদিকে পেঁচানো একটি পথ উপরে উঠে বাঁদিকে ছায়াতালের সম্মুখবর্তী হয়ে প্রবেশমুখে মিলেছে।একে ঘিরে দূরপ্রসারী মনোরম প্রকৃতি পরিবেশ।দাঁড়ালাম ফ্রেম বন্দী বাণীগুলির সামনে। চমকে উঠলাম!নাঃ,জানতেই হবে।মনে হচ্ছে অনেক বলা অথবা না বলা কথার উৎস উনি।স্থানীয় লিম্বু সম্প্রদায়ের স্নাতক তরুণ দীবেশের কাছে তার সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত ধর্ম ও সংস্কার বিষয়ের পাশাপাশি মহান ‘লেখক'(ওনার সম্পর্কে ওখানে এই শব্দটি সকলে ব্যবহার করেন) ‘তিয়ংসি সিরিজুঙ্গা’র বিষয়ে কিছুটা অবগত হলাম। তাতে মানিকবাবুর ‘হীরক রাজার দেশে’ র উদয়ন পণ্ডিতের সঙ্গে কোথাও যেন এই মহান মানুষটির জীবনের কাঠামোগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করছি।
লিম্বুরা পূর্ব হিমালয়ের বৃহৎ কিরাত জনজাতি গোষ্ঠীর অংশ।কয়েক’শ বছর পূর্বে তারা দার্জিলিং ও সিকিমের পাহাড়াঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ‘যুমা'(yuma)ধর্মানুসারী। ইনি দেবী।এনার নির্দেশে জঙ্গলের দেবতা ‘ঝাকরি’ এই দুর্গম শ্বাপদ সংকুল পার্বত্যভূমিতে লিম্বুদের সকল আপদ- বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছেন।উভয়েই নিরাকার।নিষ্ঠাবান ধর্মীয় পালনকর্তারা আজও স্বগৃহে সপাক নিরামিষ ভোজন করেন।এহেন শান্ত বন্যপ্রাণ এই মানুষগুলি কেনই বা তৎকালীন সিকিমের রাবডেন্সীর শাসক ও রাজধর্ম রক্ষকদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল!এলাকা বিস্তার?না,ধর্মের বেশ কিছুটা কড়া অনুশাসন মুক্ত কৌম স্বাধীন জীবনাচার? না,প্রকৃতি পূজকদের সঙ্গে তান্ত্রিক তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের দ্বন্দ্ব?
একদা লিম্বুরা দক্ষিণ সিকিম থেকে শুরু করে নয়াবাজার, সোরেং,বার্মিওক, হি-পাতাল হয়ে ডেন্টাম পেরিয়ে প্রায় পেলিং এর দোড় গোড়ায় পৌঁছে যায়। এবং পশ্চিম সিকিমের বিরাট এলাকা জুড়ে তারা বাসা বাঁধে।লোককথা অনুসারে লিম্বুদের আগমনের দুয়েকশ বছর পূর্বে তিনজন লামা তিনদিক থেকে এসে ইয়কসামে মিলিত হন। সেখানে মূলত স্থানীয় লেপচা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও বিস্তার করে একসময় লামাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।সপ্তদশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এই লামারা ফুন্টসগ নামগিয়ালকে দীক্ষিত করে ‘চোগিয়াল’ উপাধিতে ভূষিত করেন।যার অর্থ এখন থেকে তিনি এবং তাঁর উত্তরসূরীরা হবেন ধর্মীয় শাসক। অতঃপর নতুন ধর্ম মানুষের মধ্যে বিস্তার যেখানে লক্ষ্য, সেখানে কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভাষা ও ধর্মাদর্শের মানুষজনের উপস্থিতি লামাতন্ত্র শাসিত শাসকদের কাছে যে ভালো ঠেকেনি তা বলা বাহুল্য। সন্ত্রস্ত শাসক লিম্বুদের স্বাধিকার হরণে তৎপর হয়।
সে সময় পশ্চিম সিকিমের রাবডেন্সী ছিল মূল শাসনকেন্দ্র বা রাজধানী।এমন একটি আদিম জনগোষ্ঠী, যারা রাজ প্রতিষ্ঠিত ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির বাইরের জীবনাচারণে অভ্যস্ত, তাদের সম্প্রসারণ রোধের উপায় স্বরূপ শাসকশ্রেণী ভাষার উপর প্রথম আঘাত হানেন।ভাষা সন্ত্রাসীদের ধারণা, ভিন্নতর সাংস্কৃতিক চেতনার অধিকারী শাসিত জনগণের ভাষা ভুলিয়ে দিতে পারলে, তার সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়গত চেতনা ও ক্রমে বিলুপ্ত হবে এবং শাসন, শোষণ, নিষ্পেষণ মজবুত হবে।সেই বাতাবরনে দাঁড়িয়ে প্রাথমিক সারসত্যটুকু উপলব্ধি করে,সিরিজুঙ্গা ঘোষণা করেন, “লিম্বু ভাষা একটি বিশেষ বিষয়, এটাই জীবন। আমরা এটা নিয়েই বাঁচি, এই ভাষাই আমাদের বিখ্যাত করে তোলে । যদি লিম্বু ভাষা হারিয়ে যায়,তাহলে লিম্বু জাতিও অন্তর্হিত হবে।” ভাবা যায় তিনশ বছর আগের এক মানুষের কী গভীর উপলব্ধি!
মহাত্মা সিরিজুঙ্গা কিশোর বয়সে রাবডেন্সীর শাসকের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে জড়ান।১৭৩২ সালে উনি লিম্বু সম্প্রদায় কে শিক্ষিত করতে, তাদের মাতৃভাষা মুন্ধুম ভাষার অধিকার দানের জন্য বেশ কয়েকটি পাঠ প্রতিষ্ঠান খুলে পড়ানো শুরু করেন।তাঁর এই উদ্যোগের কথা এলাকাজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।লিম্বুরা সোৎসাহে সেগুলিতে অংশ নেয়।মানুষের আগ্রহ তাকে কলম ধরতে প্রেরণা যোগায়। অতঃপর তিনি সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়ে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ ও উজ্জীবিত করতে থাকেন।তার বাণী, ” যদি তুমি কথা না বলো, তাহলে তোমায় বোবা বলে ডাকা হবে। বোবার জীবন মৃত।” কী অমোঘ সত্য!কী মহা উজ্জীবনমূলক আলোক দর্শন!আমজনতাকে তাদের কথ্য ভাষার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া। পারস্পরিক যোগসূত্র রচনার এই সূত্র ধরে,জ্ঞানের আলোকধারায় স্নাত হবার আকাঙ্খায় কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে লিম্বুদের মধ্যে যেন এক নবচেতনার বিপুল উন্মেষ ঘটে।তৎকালীন রাজা এতে ভীত হয়ে লিম্বুদের নিজস্ব ভাষাশিক্ষা বন্ধের আদেশ দেন।লিম্বুরাও ততদিনে নিজেদের চিনতে শুরু করেছেন।
ভীত রাজা সিরিজুঙ্গা র বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন।সিরিজুঙ্গা কখনো পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে,কখনো বুনো জন্তুদের আবাসিক গুহায় লুকিয়ে জনসংযোগ রক্ষা করে চলেন।এইভাবে কিছুদিন কাটানোর পর অবশেষে ডেন্টামের নিকটবর্তী মার্তমে নদীর পাশে একটি গুহায় তাঁর আত্মগোপনের সংবাদ গুপ্তচর মারফত রাজার কাছে পৌঁছায়।সেদিন রাজ রক্ষীরা এই মহান মানুষটিকে টেনে হিচঁড়ে ধরে নিয়ে গিয়ে একটি গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মধ্যযুগীয় বর্বরতার চূড়ান্ত সাক্ষ্য রেখে নির্মমভাবে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করেন।মৃত্যুকালে তাঁর নির্ভীক উচ্চারণ “বোবার জীবনের চেয়ে নায়কোচিত মৃত্যু শ্রেষ্ঠ। লিম্বুদের লিম্বু সাহিত্য এবং মুন্ধুম ভাষা শিক্ষাদানের অপরাধে আজ আমায় হত্যা করা হচ্ছে। যেভাবেই হোক, আমি পুনরায় ফিরে আসব।”
শ্রদ্ধেয় পাঠক আসুন এবার আমরা দৃকপাত করি মহান চলচ্চিত্র স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ‘হীরক রাজার দেশে’র মুখ্য চরিত্র উদয়ন পণ্ডিতের প্রতি।
হীরকের উদয়ন পণ্ডিতঃ
যেহেতু ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ এর উত্তর উপাখ্যান, তাই একে শিশু চলচ্চিত্র রূপে দেখা হয়।কিন্তু পূর্বেরটির ন্যায় গুপী বাঘা এখানে মুখ্য নয়,অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ দুটি পার্শ্ব চরিত্র। এবং কাহিনীর স্বার্থে ভূতের রাজার বলে জাদুশক্তিতে বলীয়ান ঠিকই তবে এটিতে প্রধান দুই প্রতিস্পর্ধী চরিত্র হীরকের রাজা ও সেই রাজ্যের পাঠশালার দরিদ্র মধ্যবিত্ত পন্ডিত উদয়ন।বুঝতে অসুবিধা হয়না এই চরিত্রদ্বয় পরস্পর বিপরীত দুই শক্তি শাসক ও শোষিতের প্রতিনিধি।এদের মধ্যে শ্রেণী দ্বন্দ্ব ও সংঘাত যতই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে পার্শ্ববর্তী শুন্ডি রাজ্যের রাজার দুই জামাই -গুপী-বাঘা নিজেদের আপাত উচ্চ কোটির অবস্থান ভুলে আপন শ্রেণী চরিত্র নিয়ে পণ্ডিতের পাশে, বলা ভালো আপন জনগণের সঙ্গে আপন ধারায় যুক্ত হয়ে রাজতন্ত্র ধ্বংসে অতীব গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।এখানেই প্রথম ছবিটি থেকে দ্বিতীয় ছবিটির গুণগত পার্থক্য নিহিত।সমাজ অভ্যন্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বস্তরের মানুষের নিদারুণ শোষণ,পীড়ন,জ্বালা, যন্ত্রণা ও তার প্রকাশ প্রতিবেশ যদি কুসুমবৎ হয়, সেক্ষেত্রে তাতে সময়োপযোগী তাপদানকারী বহিস্থ আদর্শ উপাদান দরকার।তবেই আমূল পরিবর্তনে সাফল্য আসে।প্রসব করে নতুন দিন। স্থিতধী পরিচালক সেই বিশ্বাস থেকেই গুপী-বাঘাকে এই ছবিতে ব্যবহার করেছেন।
একনায়করা চিরকালই শোষকের মদতদাতা স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকতে ভালোবাসেন।তাদের নিয়ে গড়ে তোলেন কু বলয়।হীরক রাজের মোসাহেববৃন্দ-যথা,শিক্ষামন্ত্রী, সভাকবি,জ্যোতিষী তার যাবতীয় কুকর্মের সমর্থক ও সংঘটক।আর অবশ্যই আছেন জাদুকর বা বিজ্ঞানী যিনি তার গবেষণাগার ‘যন্তর -মন্তরে’ অবস্থান করে রাজাজ্ঞা অপালনকারীদের মগজ ধোলাই করেন।সবটাই চলে নিখুঁত যান্ত্রিক পদ্ধতিতে।
প্রতিটি স্বৈরশাসক তিনি যেভাবেই ক্ষমতাসীন হোন না কেন তার আদেশ নির্দেশ যেন ঐশী বাণী -‘যায় যদি যাক প্রাণ,হীরকের রাজা ভগবান’! প্রাথমিকভাবে মগজ ধোলাইয়ের পর প্রজারা সেই নির্দেশ শুনে পুতুলের ন্যায় আচরণ করে।এর প্রথম প্রতিবাদী উদয়ন। মন্ত্রীর সামনে সে রাজনির্দেশক শিক্ষা স্তোত্র ছাত্র স্বার্থে উচ্চারণ করলেও কন্ঠস্বরে প্রতিবাদী জেদ এবং দৃষ্টিতে প্রতিরোধী চাউনি আমাদের চোখে পড়ে।
স্বৈরাচারী একনায়করা কবে আর শিক্ষার মতো চিন্তা-চেতনার বিকাশ মাধ্যমকে মান্যতা দিয়েছে?’লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে’-হীরকের রাজাও সেই তরুটি উন্মুলে তৎপর হয়।উদয়ন প্রাণ বাঁচাতে আত্মগোপন করে পাহাড়ী গুহায়। সেই অবস্থাতেই গুণী শিল্পীদ্বয় গুপী-বাঘার সঙ্গে দেখা।তারা এসেছে শুন্ডিরাজের প্রতিনিধি হয়ে হীরক রাজের বিশাল মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে।উদয়নের মুখে রাজ্যের হালহকিকত শুনে তার পক্ষ নেয়।তাদের জাদু সঙ্গীতের সঙ্গী হন লোকগায়ক তারাচরণ।এই তারাচরণদের মৃত্যু নেই! আর উদয়নের শিক্ষা ও হিতোপদেশের বিপ্লবী বাণী মেহনতি মানুষ থেকে ছাত্রসমাজ সকলকেই নব উদ্দীপনায় একসূত্রে গাঁথে।
মধ্যযুগীয় সংস্কার বলা ভালো ধর্মীয় সংস্কারের সঙ্গে ভোগবাদকে মিশিয়ে একনায়ক মোসাহেবদের মাধ্যমে মানুষের সামনে এমন একটি কাল্ট শক্তি তুলে ধরে যাতে জনগণ সাময়িকভাবে তাকেই সেই শক্তির আধার ও ধারক বাহক ভাবে।এর বিরোধীতা মানেই দেশদ্রোহী বা রাজদ্রোহী,যেমন-উদয়ন।মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা যে কেবল সেইকালের মানুষের অবস্থানের একটি স্তরমাত্র তা ভুলিয়ে দেয়।
সেই লক্ষ্যেই একনায়করা চায় দেশজুড়ে তার মুখ যেন সদা সর্বত্র জনমানসে ভাসে।তিনিই জনগণের মসীহা।এ মুখ, মুখ নয় -ভালোমানুষীর মুখোশ,যার ভিতরে লুকিয়ে শয়তানি।সেই শয়তানির আধার মূর্তি যখন সবার একজোটে ভেঙে পড়ে তখন তাকে হঠাৎ বা তাৎক্ষণিক ভাবা ভুল, তা বহুকালাগত মানুষের ক্ষোভ দুঃখের ফল।
মন্তব্যঃ
অতঃপর সিরিজুঙ্গা ও উদয়ন পণ্ডিতের মধ্যে কাঠামোগত সাদৃশ্যের উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করব।১৯৬৯ সালে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শুটিংএ সত্যজিৎ রায় দার্জিলিং হাজির হলে সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অতিথি হয়ে আসা সিকিমের তৎকালীন রাজা এবং রাণীর।তাঁরা এহেন গুণী মানুষটিকে কাছে পেয়ে অনুরোধ করেন সিকিমের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণে। যাতে মানিক বাবুর হাত যশে বিশ্বজুড়ে সিকিমের সৌন্দর্য আরও বেশি করে পৌঁছে যায়। এতে তখনো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিকিমের মান ও পর্যটন দুইই বাড়বে।
১৯৭০ সালে মুক্তি পায় ‘সিকিম’ তথ্যচিত্র। সিকিমের প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি সবকিছুকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ছবিটির কোনো প্রদর্শনই হল না। সিকিমে বা ভারত কোথাও না! কারণ? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে সিকিমের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে, যা আমাদের আলোচ্য নয়। সিকিমের রাজা চেয়েছিলেন, দেশের পরিবেশ, ভুপ্রকৃতিই, নদ-নদী, ঝরনাই কেবল দেখানো হোক তথ্যচিত্রে। যাতে পর্যটন ক্ষেত্র আরও বেশি মজবুত হয় এবং লক্ষ্মী লাভ হয়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় কাজ করেছিলেন তাঁর মেধা ও দর্শন দিয়ে। সিকিম ও তার জনসত্ত্বার সঙ্গে সেখানকার অধিবাসীদের কথা বিশেষত নেপালিদের কথা বলেন।আর আমরা আগেই জেনেছি লিম্বু উপজাতির জনগোষ্ঠী আদিতে নেপালি। যাইহোক তথ্যচিত্রটি রাজার মনমতো হয়নি।আবার উল্টো স্বার্থগত হিসাব ছিল ভারতের। যা ভিন্নতর বিষয়।তাই রাজনীতির জটিলতায় আটকে গেল সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর ‘সিকিম’। দীর্ঘ ৩৯ বছর পর ২০১১ সালে প্রথমবার সিকিমে ছবিটি দেখানো হয়। ততদিনে( ১/৫/১৯৭৫) স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমা হারিয়ে সিকিম ভারতের ২২ তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
আমার অনুমান সিকিম তথ্যচিত্র নির্মাণ ও তথ্য সংগ্রহ সূত্রেই সত্যজিৎবাবু সম্ভবত সিরিজুঙ্গার কাহিনী শ্রুত হয়েছিলেন।শুধু তাই নয়,সিকিমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সে সময় জারি ছিল তার আঁচ তিনি শুধু অনুভবই করেন নি এর সফল পরিনতিও দেখেন।কালজয়ী পরিচালকের গভীর মনীষায় প্রায় তিনশ বছর আগের লিম্বু উপজাতি শিক্ষক ও তাঁর করুণ পরিণতি এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সার্থক রূপকধর্মী সম্মিলন ঘটিয়ে আমাদের উপহার দেন এই স্বৈরতন্ত্র বিরোধী গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ চলচ্চিত্রটি। সিরিজুঙ্গার মতো উদয়নও শাসকের অত্যাচারে গিরিকন্দরে আত্মগোপন করে নিজের কার্য পরিচালনা করতেন।বিচিত্র পথে সংকেত পাঠাতেন।দুজনেই শিক্ষার সঙ্গে জড়িত।হীরক রাজের শিক্ষা বাণীর প্রতিস্পর্ধী যেন সিরিজুঙ্গার বাণী!সিরিজুঙ্গা যাদের শিক্ষা দান করতেন তারা নিশ্চয় বালক ছিলেন, একথা বলার অপেক্ষা থাকে না।মধ্যযুগীয় বাতাবরণে দাঁড়িয়ে অপর ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি অসূয়া নয়, নিজেদের ন্যায্য দাবি নিয়ে শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই,এখানেও মিল।শুধু এটুকুই নয়,কালগত প্রভেদ ছাপিয়ে উভয় চরিত্রের বিচরণ ক্ষেত্র তথা দেশগত ভূগোলের মিলটি চোখে পড়ে।আর বাদবাকি যা তফাত তা অবশ্যই একালের দৃষ্টিতে পরিচালকের শিল্পীত মুন্সিয়ানা।।
**************************************************
অনুপ মুখার্জি পরিচিতিঃ
শিক্ষক পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র, সাতান্ন বর্ষীয় চিরতরুণ অনুপ বাবুর বিদ্যালয় শিক্ষা দক্ষিণখন্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্নাতক স্তরের পঠন পাঠন বহরমপুর শহরে কৃষ্ণনাথ কলেজে। লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস এবং গ্রামবাংলার বিভিন্ন জনজাতির আচার, সংস্কার, জীবনযাত্রার ওপর বিস্তর পড়াশোনা রয়েছে অনুপ বাবুর। সম্পূর্ণ শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার সীমানায় দত্তবরুটিয়া গ্রামে। লেখালেখির পাশাপাশি ভ্রমণ ও ফটোগ্রাফি তাঁর নেশা।