মিলন সেতু
অমৃতা লাহিড়ী
‘ধর্ম ‘শব্দটির প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করা সহজ নয়। আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম বলতে বোঝায় দেবদেবীর উদ্দেশ্যে কিছু আচার-অনুষ্ঠান এবং কিছু রীতিনীতি পালন ,তথাপি এটিও ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ নয় ।’ধর্ম ‘ শব্দের প্রকৃত অর্থ যা মানুষকে ধারণ করে থাকে ।যুগে যুগে জাতিতে, আদর্শের কত বিভিন্নতা ঘটে, আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির অনুসরণ যদি ধর্মের একান্ত রূপ হতো তাহলে ধর্মের সার্বজনীন কোন রূপ থাকত না। ‘ধর্ম’ কথাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত ও জাতিগত ব্যাপারই মাত্র বোঝাত। কিন্তু সনাতন ভারতবর্ষ কখনো ধর্ম বলতে এই সংকীর্ণ অর্থ কে বোঝে নি । তার দৃষ্টিতে সকল তুচ্ছতার মধ্যে,সকল আচার-অনুষ্ঠান এর মধ্যে, সকল উত্থান-পতনের মধ্যে যা মানুষকে চিরন্তন সত্যে ধারণ করে থাকে তাই ধর্ম । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “সংসারের একমাত্র যাহা সমস্ত বৈষম্যের ঐক্য, সমস্ত বিরোধীদের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে, সমস্ত বিচ্ছেদের মধ্যে একমাত্র যাহা মিলনের সেতু, তাহাকে ধর্ম বলা যায়।”
সভ্যতার আদি যুগ থেকে ভারত বর্ষ এই ধর্মেরই সাধনা করে এসেছে।কোন বুদ্ধিমান মানুষ ই কখনো একশো শতাংশ নিশ্চিত হন না কিভাবে কাজ করবেন তা নিয়ে, তিনি সবসময় এটা পরখ করেন। একমাত্র কোন ব্যক্তি নিজের বিষয়ে বা বাহ্যিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন না করে একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে যান। আমরা যা কিছুই করি আমাদের অস্তিত্ব,আমাদের খাওয়া-দাওয়া, জীবন-যাপন ও শ্বাস নেওয়া- তা কোন না কোন জীবের প্রতি অবিচার, যদি আপনি বিষয়টি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন আপনি খেলে আপনি হত্যা করেন, আপনি শ্বাস নিলে, আপনি হত্যা করেন। আপনি হাঁটলে আপনি হত্যা করেন। আবার আপনি যদি এসব কিছু না করতে চান তাহলে আপনি নিজেকে হত্যা করেন। বিশ্বের কোন মানুষই বা তাদের কর্ম পুরোপুরি সঠিক বা পুরোপুরি নির্ভুল হতে পারে না। আপনার কর্মের মাধ্যমে যে বৃহত্তর ভালো কাজটি সৃষ্টি হয় সেই কর্ম ই বিবেচ্য বিষয় এবং সেই মতো কর্ম সম্পাদন করতে হবে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে বৈদিক যুগে ধর্ম জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার ছিল না, সেখানে ধর্ম, সাহিত্য,সমাজ সব অঙ্গাঙ্গী ভাবে এক হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য এই জাতির অন্তরের ইতিহাসকে ধারণ করে থাকে। বৈদিক সাহিত্য ও একটা প্রাচীন জাতির আত্মসচেতনতার, আত্মবিকাশের, সর্বোপরি তার অধ্যাত্বসাধনার পরিচয় বহন করেছে। এই বিশাল সাহিত্য তার ক্রমাভিব্যক্তির পরিণতির সঙ্গে যে সমাজের প্রতিচ্ছবি কে ধারণ করে আছে সে সমাজ কিন্তু শুধুই আদিম মানবের গোষ্ঠী জীবন নয়। সংস্কৃতির এমন একটা সুসংহত রূপ আমরা বৈদিক সাহিত্যে লক্ষ্য করি যা কোনমতেই বর্বর জাতির সংস্কৃতি হতে পারে না। প্রাচীন জাতির সহজ সরল জীবন চর্যার সঙ্গে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের মিলন-এই হল বৈদিক সমাজ জীবনের পরিচয় একদিকে যেমন বৈদিক ঋষিরা মধুব্রতা, ঘৃতবতী, পয়স্বতী পৃথিবীতে বলিষ্ঠ জীবন নিয়ে শতায়ু হয়ে বাঁচবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়-“জীবেম শরদঃ শতম্”। অপরদিকে জগতের বন্ধন ও মৃত্যু থেকে মুক্তিলাভের ও সেইসঙ্গে অমৃতের অধিকারী হবার বাসনা ও তাঁদের মন্ত্রের ভিতর প্রকাশিত-“উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ”-“উর্বারক ফলের নেয় যেন আমরা বন্ধন ও মৃত্যু থেকে মুক্ত হই, অমৃত থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই”। পার্থিব জীবনের সহস্রবিধ তুচ্ছতার মধ্যে তারা অপার্থিব অলৌকিক শক্তির স্পর্শ দেখতে চাইতেন। এই জন্যই তাঁরা দৈবশক্তি কে আহ্বান করতেন। বৈদিক সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি তাই প্রতিষ্ঠিত দেববাদের ওপর।
ধর্ম হল কেবল আপনার ভিতরে আপনি কেমন তা নিয়েই। যদি আপনি এক সর্বময় অন্তর্ভুক্তিকরণের অবস্থায় থাকেন, তবে আপনি সর্বদা আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং পরিস্থিতি বিচার করে কাজ করবেন। মানুষ যদি অন্তর্ভুক্তির অবস্থায় না থাকেন, যদি সে তখন বিচারসভায় বসে অর্থাৎ “তুমি বনাম আমি” এই বিচার্য বিষয় হয়, তবে কিন্তু ভুল পথে চলতে শুরু করবে। সঠিক কিছুই সে করে উঠতে পারবে না কারণ তাঁর যে অস্তিত্ব তা সম্পূর্ণ ভুল।
বৈদিক দেব বাদের দুটি দিক আছে। একটি হলো উপাসনা এবং অপরটি যাগ। উপাসনাতে দেবের মাহাত্ম্য কীর্তন, যাগেতে তাঁদের তুষ্টি করণের উদ্দেশ্যে ক্রিয়ার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। যজ্ঞ বেদীতে প্রজ্বলিত অগ্নির যজ্ঞসাধক রূপ, দ্যুলোকে সূর্যের অপার মহিমা অন্তরীক্ষ লোকে মেঘ বিদ্যুৎ,বায়ুর খেলা প্রতিদিন একই নিয়মে রাত্রি ও ঊষার আবির্ভাব, দ্যুলোক ও পৃথিবী লোকের অনন্ত বিস্তৃতি- এই সমস্ত কিছুই বৈদিক ঋষি দের মুগ্ধ করেছে। এই সমস্ত নিসর্গ ঘটনার পিছনে তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন অপার্থিব শক্তির লীলা-সেই শক্তির অলৌকিক মাহাত্ম্য তাঁদের দিব্য ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, ভাষা তখন হয়ে উঠেছে মন্ত্র। অনেকের ধারণা প্রবলতর কোন শক্তির প্রতি ভয় বা তাকে সন্তুষ্ট রাখবার প্রয়োজন থেকেই ধর্মের উদ্ভব। অগ্নি, জল,বায়ু সূর্যের আলোক-এগুলি আমাদের কাছে নিত্য প্রয়োজনীয়, তাই এঁরা দেবতা, এঁদের রুদ্রমূর্তি আমাদের পক্ষে অনিষ্টকর, তাই তাদের তুষ্ট করার জন্য স্তুতি ও যাগানুষ্ঠানের আবশ্যকতা। কিন্তু কেবলমাত্র ভয় বা প্রয়োজনকেই বৈদিক ধর্মের আদি কথা বললে সবটুকু বলা হবে না। নিজের ক্ষুদ্রতর সত্তাকে বৃহত্তর কোনো সত্ত্বার সঙ্গে মঙ্গলের সম্বন্ধে যুক্ত করাই বৈদিক ধর্মের মূল কথা। রবীন্দ্রনাথের উক্তি এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি-” যেকোনো সম্বন্ধের মধ্য হইতে আমরা মঙ্গল লাভ করি সেই সম্বন্ধের মধ্যেই আমরা আদি মঙ্গল শক্তিকে স্বীকার করিতে চাই। সেই সকল উপলক্ষ্য হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া মঙ্গলময় সুদূর স্বর্গে স্থাপনপূর্বক পূজা করা ভারতবর্ষের ধর্ম নহে “…..” ইন্দ্র, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ুকে বেদে দেবতা বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে তাহার ও এই কারণে। শক্তি প্রকাশের মধ্যে ভারতবর্ষে শক্তিমান পুরুষের সত্ত্বা অনুভব না করিয়া কোনদিন তৃপ্ত হয় নাই।” রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন-“এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা যে আমরা দীনতা বশতই প্রবণতার পূজা করিয়া থাকি। সকলেই জানে গাভীকে ভারত বর্ষ পূজা করিয়াছে। গাভী যে পশু তাহা সে জানেনা ইহা নহে। মানুষ প্রবল,গাভীই দুর্বল। কিন্তু ভারতবর্ষীয় সমাজ গাভীর নিকট হইতে নানা প্রকার মঙ্গল লাভ করে। সেই মঙ্গল মানুষ যে গায়ের জোরে পশুর কাছ হইতে আদায় করিয়া লইতেছে, এই ঔদ্ধত্য ভারতবর্ষের সমস্ত মঙ্গলের মূলে সে দেব অনুগ্রহকে প্রণাম করিয়া সকলের সঙ্গে আত্মীয় সম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারিলে বাঁচে”।
তাহলে ধর্ম কি? শুধুই কি স্পর্শকাতর বিষয়? মানুষের প্রাত্যহিকতার একটা অঙ্গ ধর্ম। সাধারণভাবে ইউরোপীয় সমালোচকরা মনে করেন বহু দেবতা থেকে এক দেবতা বাদ অর্থাৎ Monotheism পরিণতি ধর্মবোধের ক্রমিক অভ্যুদয়কেই সূচিত করে। মানুষের অধিকার আছে যেকোন মতবাদ বা ধর্মগ্রন্থের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের। সব ধর্মই সুন্দর এবং পরিপূর্ণ। “ধর্ম” শব্দটি আসে সংস্কৃত ধৃ ধাতু থেকে। এই ধৃ ধাতু এর অর্থ ‘ধারণ’। একজন ব্যক্তি তার জীবনে তার যত প্রকার বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে সব মিলিয়ে হয় তার ধর্ম। আগুনের ধর্ম যেমন ‘দহন’, জলের ধর্ম যেমন ‘শীতলতা’, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনি মানুষের ধর্ম হয় ‘মনুষ্যত্ব’। মনু স্মৃতিতে বলা হয় মানুষের দশটি গুণ তার মনুষ্যত্ব প্রমাণ করে।
“ধৃতিঃ ক্ষমা দম অস্তেয় শৌচং ইন্দ্রনিগৃহ।
ধীঃ বিদ্যা সত্যম্ অক্রোধ দশকম্ ধর্মস্য লক্ষণম্।।”
অর্থাৎ ধৈর্য, ক্ষমা, সংযতভাব, চৌর্য বিদ্যা না দেখানো, স্বচ্ছতা, ইন্দ্রিয় সংযম, বুদ্ধি, বিদ্যা, সততা এবং ক্রোধ নিবারণ-একজন মানুষের ধর্মের লক্ষণ। এই মনুষ্যসুলভ ধর্মই সময়ের স্রোত এর সঙ্গে দর্শন, নিয়ম এবং সঠিক পথের দিশার খোঁজ দিতে পারবে। মহাভারতে কৃষ্ণকে দ্রৌপদী প্রশ্ন করেছিলেন,’ধর্ম কি’? শুধু দ্রৌপদী নয়, আরো অনেকেই কৃষ্ণকেই প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে কৃষ্ণ বলেছিলেন-“ধর্মের মূল অর্থ কি তা আমি জানি না” সুতরাং মানুষ যদি মনুষ্যত্ব হারায় তাহলে ধর্মের কোন সংজ্ঞাই থাকে না। মানুষকে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে উদ্বুদ্ধ করা এবং সংহতি, ভ্রাতৃত্ব,শ্রদ্ধা, ও ক্ষমার বার্তা ছেড়ে দেওয়া ধর্মের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।।
************************************************************
অমৃতা লাহিড়ী পরিচিতি:
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ.। আধ্যাত্মিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। প্রমথনাথ তর্কতীর্থ (ঠাকুরদা)র সঙ্গ সংস্কৃত শিখতে প্রেরণা জাগায়।