স্বাভিমান
চন্দ্রকান্তি দত্ত
“রজতাভ বাড়ি আছো?” উমাপ্রসন্নবাবুর কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল রজতাভর বাড়ির ঠিক বাইরে থেকে। রজতাভ বাড়িতেই ছিল। কিন্তু সাড়া দিল না। উল্টে সুদীপাকে ফিস্ ফিস্ করে বলল, “ওহ্। আবার বোধহয় টাকার দরকার। বলে দাও, আমি বাড়ি নেই। কোন্নগর গেছি। কালকে ফিরব।”
সুদীপার খারাপ লাগল। সামান্য কটা টাকা ধার দেওয়ার ভয়ে কতকগুলো মিথ্যা কথা বলতে হবে। তাও আবার শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইকে। বলল, “কি দরকার বাপু। হাজার দুয়েক টাকা তো। দিয়ে দাও না। উনি তো শোধ করে দেন।”
-“না না। এখন হাতে টাকা নেই। তোমাকে যা বললাম করতো।”
সুদীপা অন্তর থেকে জ্বলে-পুড়ে খাক্ হয়ে যাচ্ছিল। তবু স্বামীর মান রাখতে মিথ্যা কথাগুলো বলতে বাধ্য হল। মাস্টারমশাই দাঁড়িয়েছিলেন বারান্দার নীচে জমিতে। বারান্দায় ওঠেন নি। সামান্য দুটো সিঁড়ি ভাঙ্গতেও সাহস হয় না। শরীরটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। পড়ে যাবার ভয় থাকে।
সুদীপার কথা শুনে বললেন, “ও তাই? আচ্ছা মা।”
মাস্টারমশাই ফিরলেন। সুদীপা দেখল, অতি কষ্টে ধীরে হেঁটে ফিরছেন পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই। শরীরটা ভীষণ ভাবে কাঁপছে। পা দুটোও ঠিকমতো পড়ছে না। সুদীপার আশঙ্কা হল, মাস্টারমশাই বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবেন তো? নিজের প্রতি লজ্জ্বায়, ঘৃণায় মাথা নীচু করে দরজা থেকে সরে এল সুদীপা।
রজতাভ দ্রুত তৈরী হয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আজ ক্লাবে ‘অকসন ব্রিজ’-এর ফাইনাল। ফিরতে দেরী হবে। তুমি সময়মতো খেয়ে নিও।”
সুদীপা তখনও অকারণ অপরাধের মনস্তাপ থেকে নিজেকে সামলাতে পারে নি। বলল, “মাস্টারমশাই-এর সাথে আজকে আমাদের ব্যবহারটা কিন্তু ঠিক হল না।”
“আরে ছাড়ো তো। অত ভাবলে হয় না”-খেতে খেতে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল রজতাভ।
সুদীপা কিন্তু মাস্টারমশাইকে দেখার পর থেকে আর স্থির থাকতে পারছিল না। রজতাভ মাস্টারমশাইকে এড়িয়ে সাবধানে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই শাড়িটা পাল্টে টাকার ব্যাগ আর ব্যাঙ্কের কার্ড নিয়ে সুদীপা মাস্টারমশাই-এর বাড়ি পৌঁছে গেল।
মাস্টারমশাই উমাপ্রসন্নবাবু বিছানায় শুয়ে আছেন। রজতাভর বাড়ি পর্যন্ত হাঁটার পথটা সামান্য হলেও উমাপ্রসন্নবাবুকে প্রচণ্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সুদীপা লক্ষ্য করল, মাস্টারমশাই-এর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সুদীপা মন্টুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, “মন্টু, মাস্টারমশাই-এর শরীর এত খারাপ কি করে হল?”
-“আজ্ঞে বৌদিমনি, মাস্টারমশাই-এর ডাইলোসিস ছিল পরশুকার দিন। কিন্তু বেঙ্কের ধর্মঘটক হইছে। টাকা তুলতে পারেন নাই। তাইতেই শরীরটা খারাপ হই গেইছে।”
সুদীপা প্রমাদ গণল। পরশু থেকে ডায়ালিসিস হয় নি? এই অবস্থায় প্রায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রিয় ছাত্রের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন মাস্টারমশাই। অথচ, ছাত্র অত্যন্ত অবহেলাভরে ফিরিয়ে দিয়েছে এই হতভাগ্য মানুষটাকে।
সুদীপা আর দেরী করল না। মন্টুকে বলল, “মন্টু, এক্ষুনি একটা ট্যাক্সি ধরে নিয়ে এসো। মাস্টারমশাইকে নিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি।”
সুদীপা যখন উমাপ্রসন্নবাবুকে নিয়ে বাড়ি ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যে ছটা। খিদেয়-তেষ্টায় শরীর আর চলতে চাইছে না। কিন্তু কোন উপায়ও ছিল না। উমাপ্রসন্নবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই ওরা বলল, “স্যারের অবস্থা বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। আগে ব্লাড টেস্ট করতে হবে। হিমোগ্লোবিন আর পটাশিয়ামটা চেক করতে হবে। আপনি বিলটা বানিয়ে আনুন। আমরা ব্লাড স্যাম্পেল পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ঘন্টাখানেকের মধ্যে খবর পাওয়া গেল, পটাশিয়ামের মাত্রা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। হিমোগ্লোবিনও বিপদসীমা পেরিয়েছে, তবে সেটা উল্টোদিকে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পাঁচের নীচে নেমেছে। আগে দুটো ইউনিট রক্ত দরকার। তারপরই ডায়ালিসিস করা যাবে। এইসব কারণে ডায়ালিসিস ইউনিটে চার ঘন্টার বদলে প্রায় আট ঘন্টা থাকতে হয়েছে। শেষে মাস্টারমশাইকে আপাততঃ বিপদমুক্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সুদীপা।
তাসের প্রতিযোগিতায় হেরে মন-মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল রজতাভর। ওর মনে হয়েছে, দলের পার্টনার সত্যেনের তিনটে ভুল চালের জন্যই জেতা ম্যাচ হারতে হয়েছে। সত্যেনের সাথে তাই নিয়ে একচোট ঝগড়াও করেছে রজতাভ। এরপর বাড়ি ফিরে দ্যাখে সুদীপা নেই। কোথায় গেছে বা কখন ফিরবে সেটা দাশুর মা-ও জানে না। রজতাভর গরম মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। দাশুর মা খাবার দিলেও ভাল করে খেল না। বিছানায় শুয়ে ঘন ঘন সিগারেট খেতে লাগল। রাগটা ক্রমশঃ বাড়ছে। ‘কোথাও যাবে যখন ঠিক করাই ছিল, তখন বলে গেলে কি খুব অসুবিধা হতো? নাকি কোন গোপন অভিসার? মনে তো হয় তা-ই। দুপুরের খাবার সময়ও পেরিয়ে গেল। তার মানে খাওয়াটাও বাইরে সেরেছে। সুদীপার এই আচরণ সহ্য করা যায় না। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।’ রজতাভর রাগ বাড়তে বাড়তে উন্মত্ত ক্রোধে পরিণত হল।
সন্ধ্যে ছটা নাগাদ সুদীপা ঢুকলে রজতাভ ওর বিধ্বস্ত চেহারার দিকে ফিরেও তাকালো না। প্রচণ্ড ক্রোধে প্রায় ফেটে পড়ল, “সারাদিন কোথায় ছিলে, হ্যাঁ? বাড়ি ফিরে তোমাকে পাওয়া যায় না। খাওয়ার সময়ও তুমি নেই। কি ব্যাপার তোমার? ফোনটাও নিয়ে যাও নি। কার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলে?”
রজতাভর কথাগুলো শুনে সুদীপা স্তম্ভিত হয়ে গেল। রজতাভর এরকম উগ্রমূর্ত্তি ও দুর্ব্যবহার সুদীপা কল্পনাও করতে পারে নি। ভেবেছিল, রজতাভকে সারাদিনের ঘটনাগুলো বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু ঢোকামাত্র রজতাভর এরকম বিশ্রী একতরফা আক্রমণ সুদীপার মধ্যে এক স্বাধীন সত্ত্বার সৃষ্টি করল। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কিছুই বলবে না। রজতাভ যা ভাবার ভেবে নিক।
সুদীপা কোন জবাব না দেওয়ায় রজতাভর ক্রোধ মাত্রা অতিক্রম করল। গলা প্রায় সপ্তমে চড়িয়ে রজতাভ বলল, “আমি কি বলছি কানে যাচ্ছে না? কালা হয়ে গেলে নাকি? জবাব দাও।”
সুদীপা কষ্টে মাথা ঠাণ্ডা রেখে জবাব দিল, “শোন, আমি তোমার বিয়ে করা বৌ। কোন দাসী-বাঁদী নই। তুমি যদি আমার সাথে এভাবে কথা বলো, তাহলে আমি কোন কৈফিয়ত্ দেব না।”
-“ও আচ্ছা, এতদূর? তাহলে শুনে রাখো, আমার সাথে ঘর করতে হলে ভদ্রভাবে থাকতে হবে। কোন বেলেল্লাপনা চলবে না।”
-“কি, কি বললে তুমি? বেলেল্লাপনা? আমি বেলেল্লাপনা করছি? এতবড় খারাপ কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে?”
-“হ্যাঁ পারলাম। কারণ তোমার আচার-আচরণ সেটাই প্রমাণ করছে।”
-“ও কথা যখন বলতে পারলে তখন শুনে নাও, তোমাকে আমি কোন কথাই বলব না। তোমার যা খুশী ভেবে নাও।”
-“তা হলে এটাও শুনে রাখো, এই অবস্থায় আমাদের এক ছাদের তলায় থাকা সম্ভব নয়। আমি চলে যাব।”
-“তুমি যাবে কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে? আমিই চলে যাচ্ছি।”
-“যাচ্ছি মানে? কোথায় যাচ্ছো? কে থাকতে দেবে তোমাকে?”
সুদীপা রজতাভর শেষ কথার জবাব দিল না। যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই বেরিয়ে গেল।
হাতব্যাগে এখনও হাজার দেড়েক টাকা আছে। সুদীপা ট্যাক্সিতে হাওড়া পৌঁছে শ্রীরামপুরের ট্রেন ধরল। শরীর আর চলতে চাইছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। অথচ, কিছু খাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। সুদীপা এক বোতল জল কিনে একসাথে অনেকটা জল খেয়ে নিল। ভাবল, যাওয়ার আগে মাকে একটা ফোন করে দেবে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, ফোনটা সাথে নেই। সকাল থেকেই ঘরে পড়ে আছে। সুদীপা জানালার ধারে বসে ঠাণ্ডা হাওয়ায় নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। মাথার ভেতরে আগুনটা এখনও জ্বলছে। সহজে নিভবে বলে মনে হয় না। কারণ, আগুনটা সে নিজে জ্বালায় নি। জ্বালিয়েছে তার প্রাণাধিক প্রিয় ভালবাসার মানুষটা। রজতাভ কিছুটা রগচটা, সেটা সুদীপা জানে। কিন্তু আজকে যে রজতাভকে সে দেখল, তাকে সে চেনে না, জানেও না। সুদীপা ভাবতেই পারছে না, কি করে শুধুমাত্র অলীক সন্দেহের বশে তার এতকালের বিশ্বস্ত স্ত্রীকে রজতাভ চরিত্রহীনা বলতে পারল!
একটা উদগত অশ্রু সমস্ত বাধা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। প্রাণপণে আটকে রাখল সুদীপা। শক্ত তাকে হতেই হবে।
অনেক রাত হল। সুদীপা এখনও ফিরল না। রজতাভ ভাবল খুঁজতে বেরবে। তারপর কি মনে করে শ্রীরামপুরে ফোন করল। বার বার তিনবার। কেউ ফোন ধরল না। রজতাভর বুঝতে বাকি রইল না সুদীপা কোথায় গেছে।
সুদীপা চলে গেছে পরশু। কাল ও আজ, দুটো দিন পেরিয়ে যেতে বসেছে। কি করা উচিৎ রজতাভ কিছুই ঠিক করতে পারে নি। তবে, এরই মধ্যে রজতাভর মনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সর্বাঙ্গে জ্বলে ওঠা আগুন নিভে গিয়ে সেখান থেকেই একটা অনুশোচনা উঁকি দিচ্ছে। রজতাভ জানে, সুদীপা কোন গর্হিত কাজ করতে পারে না। তবু কেন যে সেদিন রজতাভ নিজেকে অতটা নীচে নামিয়ে ফেলল, সে ব্যাখ্যা তার নিজের কাছেও নেই। সুদীপাই বা কেমন ব্যবহারটা করল। কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কিছুই না বলে রাগ দেখিয়ে চলে গেল। একবার বুঝিয়ে বললেই তো হতো। শুধু শুধু অশান্তি হয়ে গেল। কবে যে ফিরবে তারও কোন ঠিক নেই।’
* * *
রজতাভ সবে অফিস থেকে ফিরেছে। হাত মুখ ধুয়ে সোফায় বসলে দাশুর মা চা দিয়ে গেল। বলল, “দাদা, মাস্টারমশাই-এর বাড়ি থেকে মন্টু এসেছিল। বৌদিকে খুঁজছিল। আমি এখন আসতে বলেছি।”
-“মন্টু? বৌদিকে খুঁজছিল? কেন?”
-“জানি না। আমাকে কিছু বলেনি।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। এলে নিয়ে এসো।”
মিনিট পাঁচেকও পেরোয় নি। সদর দরজায় মন্টু আবির্ভূত হল। দাশুর মা ভেতরে নিয়ে এলে বলল, “দাদাবাবু, বৌদিমণি নাই?”
-“কেন রে মন্টু? বৌদিমণি কি করবে?”
-“আজ্ঞে মাস্টারবাবু শুধালেন, বৌদিমনি কত টাকা পাবেন।”
-“বৌদিমনি টাকা পাবেন? সেটা কি রকম?”
-“আজ্ঞে পরশুকার দিন বৌদিমনিই তো মাস্টারবাবুকে হাসপাতালে লিয়ে গেলেন। ডাইলোসিস করাইছেন। মাস্টারবাবু বইললেন, দুটা রক্তও লাইগেছে। সবই তো বৌদিমণি কইরেছেন। মাস্টারবাবু আজ বেঙ্কে যেয়ে টাকা লিয়ে আইসেছেন। তাই বইললেন, মন্টু, বৌদিমনিকে শুধিয়ে আয় কত টাকা তিনি পাবেন। বৌদিমণি মানুষ লন গো, দ্যাবতা।”
রজতাভর লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। লক্ষ্মী প্রতিমার মত বৌয়ের সাথে কি দুর্ব্যবহারটাই না করেছে। কিন্তু হঠাৎ সুদীপা এর মধ্যে এল কিভাবে? রজতাভ মন্টুকে প্রশ্ন করল, “হ্যাঁ রে মন্টু, মাস্টারমশাইকে নিয়ে তোর বৌদিমণিকে যেতে হল কেন? উনি তো নিজেই ডায়ালিসিস করতে যান।”
-“হঁ দাদাবাবু, তাই তো যান। কিন্তু বেঙ্কের ধর্মঘটক হইছিল না, তাই টাকা তুইলতে পারেন নাই। ইদিকে তিনদিন ডাইলোসিস হয় নাই। মাস্টারবাবু তো মইরেই যেথেন। বৌদিমণি যেয়ে এযাত্রা বাঁচাইলেন।”
-“কিন্তু মন্টু, বৌদিমণি তো এখন নেই। শ্রীরামপুরে গেছে। ফিরলে আমি জিজ্ঞাসা করে বলব, কেমন?”
-“হঁ দাদাবাবু। তবে আমি যেছি।”
রজতাভ আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। কিছুতেই ভাবতে পারছে না, এত নীচে সে নামল কিভাবে।
মন্টু ফিরে গেল। দাশুর মাকে আজকের মতো বিদায় দিয়ে রজতাভ শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। আর দেরী করা চলবে না। সুদীপাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। যে পাপ রজতাভ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। পাল্টে ফেলতে হবে নিজেকে। তাস আর সে খেলবে না। ক্লাবে যাওয়াও ছাড়তে হবে। অফিসের পরে সুদীপাকে সময় দেবে। চুটিয়ে সংসার করবে দুজনে। বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু আর নয়।
রজতাভ যখন শ্রীরামপুরে পৌঁছল, তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। সুনীল দোকানেই ছিল। রজতাভকে দেখে বলল, “আরে রজতদা তুমি? এই অবেলায়? এখানে কেন? বাড়ি যাওনি?”
-“তোমার সাথেই যাব। তাই এখানে চলে এলাম।”
-“কিন্তু আমার তো একটু দেরী হবে দাদা। হিসাব-পত্র কিছুই করা হয় নি। তুমি বরং যাও। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসছি।”
রজতাভ তবু ইতস্ততঃ করছিল। গত তিনদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ একবার ফোনও করে নি। শ্বশুরমশাই, শাশুড়ি, সুদীপা বা সুনীল, কেউ না। ফোন অবশ্য সেদিন রাতের পরে রজতাভও করে নি। এসব কারণেই আজ সরাসরি সুদীপার সামনে দাঁড়াতে বাধা। সুনীল হয়ত কিছু আন্দাজ করল। বলল, “আচ্ছা রজতদা, তুমি একটু বোসো। আমি তাড়াতাড়ি গুটিয়ে নিচ্ছি।”
পথে যেতে যেতে সুনীল বলল, “তোমাদের মধ্যে ঠিক কি হয়েছে, আমি খুব একটা জানি না। কারণ, আমি তো সারাদিন দোকানে থাকি। তবে বাড়ির অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। বাবা, মা, দিদি তিনজনেই তোমার উপর রীতিমত ক্ষুব্ধ। শুনলাম তুমি নাকি দিদির সাথে অকারণে খারাপ ব্যবহার করেছ?”
-“হ্যাঁ রে ভাই। পরপর কয়েকটা ঘটনায় সেদিন কেন যে আমি বুদ্ধি-সুদ্ধি হারিয়ে ফেললাম, আজও বুঝতে পারছি না। আমি স্বীকার করছি, ভুল করেছি। কিন্তু ভাই, ভুল তো মানুষমাত্রেই করে, তাই না।”
-“কিন্তু রজতদা, তুমি কিছু না জেনে দিদির চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করবে?”
রজতাভর কাছে এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না। মাথা নীচু করে সুনীলের সাথে হাঁটতে লাগল।
সুনীল আবার বলল,”তুমি কি জানো, দিদি সেদিন সারাদিন কিছু খায় নি।”
* * *
রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে ন-টা। শ্রীরামপুর লোকাল এইমাত্র হাওড়ার দিকে যাত্রা করল। একটা প্রায় ফাঁকা কামরায় জনা ছয়েক যাত্রীর সাথে রজতাভও রয়েছে। বাড়ি ফিরছে। একা। সুদীপাকে ফেরাতে পারে নি।
ওবাড়িতে কেউ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। শাশুড়ি জোর করে খাইয়েও দিয়েছেন। কিন্তু রজতাভর সাথে ফেরার বিষয়ে সবাই সুদীপার মতকেই সমর্থন করেছেন। সুদীপা রজতাভর সাথে দেখা করে নি। সুনীল কয়েকবার চেষ্টা করেছে দিদিকে বোঝাবার। ব্যর্থ হয়েছে। সুদীপার বক্তব্য কি, রজতাভ সঠিক জানতে পারে নি।
রজতাভ সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, অপেক্ষা করবে কি না। কিন্তু শ্বশুরমশাই-এর একটা মন্তব্য তাকে বাধ্য করেছে সব আশা ত্যাগ করে ফিরে যেতে। শ্বশুরমশাই বলেছেন, “দ্যাখ বাবা , তুমি ঠিকই বলেছ। মানুষমাত্রেই ভুল করে। ভুল আমিও করেছি তোমার সাথে আমার অমন সুন্দর মেয়ের বিয়ে দিয়ে। আগে তোমাকে চিনতে পারলে ওকে এমন দিন দেখতে হতো না। এমন অপমানও সইতে হতো না। এখন দেখি, কি করে ভুল শোধরানো যায়।”
স্তম্ভিত রজতাভ আর দেরী করে নি। বেরিয়ে এসেছে একা-নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বহারা।
* * *
সকালে বারান্দায় বসেছিলেন রজতাভ। দাশুর বৌ চা দিয়ে গেছে। সাথে আজকের খবরের কাগজ। দাশু গাছে জল দিচ্ছে। দাশুর মা গত হয়েছে প্রায় আট-নয় বছর আগে। তারপর থেকে দাশুর বৌ বহাল হয়েছে। বাগানের দেখাশোনা আগে রজতাভ নিজেই করতেন। ইদানিং আর পারেন না । সেখানে এখন দাশুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুদীপার বড় প্রিয় ছিল এই বাগানটা।
চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে দিন-তারিখগুলো ঠিকমত মনে থাকে না। খবরের কাগজে দেখতে হয়। আজও দেখলেন। চোখ গেল বাংলা তারিখটায়। আটকে গেল দৃষ্টি – আজ ২৭শে আষাঢ়। উনত্রিশ বছর আগে এই দিনেই সুদীপা এসেছিল তাঁর ঘর আলো করে।
মাত্র একটা ঘটনা। সেটা ছোট না বড়, সে প্রশ্ন আজ অবান্তর। কিন্তু সেই একটা ঘটনাই তাঁর সংসারজীবনটাকে ছারখার করে দিয়েছে। কিন্তু কেন? এটাই কি ভবিতব্য ছিল? তা-ই হয়ত হবে। রজতাভ ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওপ্রান্ত থেকে কঠিন নীরবতা ছাড়া কিছুই পান নি।
সুনীলের বিয়েতে একটা বাঁধাধরা নিমন্ত্রণ পত্র এসেছিল। শুধু একটা ছাপানো পত্র। কোন ফোন আসেনি, কোন বাহকও নয় – এসেছিল ডাকে। ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রজতাভর। সেই দিন থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এভাবেই পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর।
নিজের শোওয়ার ঘরে প্রবেশ করলেন রজতাভ। সুদীপার ছবিটা আজও বিছানার পাশে টেবিলে সাজানো আছে। রজতাভ অত্যন্ত কোমল স্বরে অস্ফুটে বললেন, “যেখানেই থাকো, ভাল থেকো সুদীপা।।
**************************************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে, তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও, শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন, চাকরী থেকে অবসরের পরে, প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
Natural instinct ,down to the earth free flow beautiful narrative.
গল্পটির বাঁধনশৈলী এবং উপস্থাপনা এত্ত সুন্দর যে মনটা ভরে গেল।
Khub bhalo laglo go sejomama.ato sundar lekha ta hoyeche pore mon ta vore gelo