কাপুরুষ
ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ
আমার মেডিকেল কলেজ পাশ করার দু বছর পরে বাংলা দেশের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হবার এক বছর আগে থেকেই আর্মি মেডিকেল কোর, নানান মেডিকেল কলেজে ডাক্তারদের রিক্রুটমেন্ট শুরু করে দিয়েছিল। আমি মেডিকেল কলেজে চার বছর এন.সি.সি করে তারপরে ফাইনাল ইয়ারে, আর্মি এটাচমেন্ট ক্যাম্প করায়, আর্মি লাইফের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম। এবারে মেডিকেল কলেজে থেকেই আর্মিতে ডাক্তার হিসাবে যোগ দেবার ও যুদ্ধ দেখার সুযোগ পেয়ে, আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। লাইনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।
রাঁচির পাশেই নামকুম মিলিটারি হাসপাতালে প্রথম পোস্টিং। দিনের বেলায় মিলিটারী হাসপাতালে রুগী দেখে আর রাতের বেলায় যুদ্ধের বিষয়ে ফার্স্ট হ্যান্ড কিছু জ্ঞান অর্জন করে নিয়ে, দুমাসের মাথায়, হাতে কাগজ পেলাম যে পোস্টেড টু কমান্ড হসপিটাল, ক্যালকাটা। সেখান আরো কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে একদিন রাত্রিবেলা, তিরিশটা থ্রী টন, কুড়িটা ওয়ান টন আর পনেরটা জোঙ্গা গাড়ির এক কনভয়ে বসে, ভোর হবার আগে সীমানার ওপারে। ডিসেম্বর মাসে শুরু হল যুদ্ধ। এরপর রমনা মাঠে পাকিস্তান আর্মির সারেন্ডার দেখে, টু মাউন্টেন ডিভিজনের সঙ্গে ফিরলাম দিনজান,আসামে। যুদ্ধ চলাকালীন মুখ বুজে সব কষ্ট সইবার পুরস্কারস্বরূপ লম্বা একমাসের ছুটিতে,বাড়ি। ছুটি থেকে ফিরে,অপেক্ষাকৃত আরামের চাকরি, দিনজান মিলিটারী হসপিটালে। তবে আর্মিতে বেশি দিন আরাম সয় না।
এবার পোস্টিং,অরুণাচল প্রদেশের ১৮২ ফিল্ড হসপিটাল। জানতে পারলাম তিন ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র নদী পার করে ওপারে পৌঁছাতে হবে। শহরের নাম পাশিঘাট। এই ফিল্ড হাসপাতালে জয়েনিং দেবার পর বিকেলে ফিল্ড হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল সুভাষ দেব নিজের রুমে ডেকে বললেন,“ক্যাপ্টেন সরখেল,আই ওয়েলকাম ইউ,দি ইয়ঙ্গেস্ট মেম্বার টু মাই ১৮২ ফিল্ড হসপিটাল। আমি তোমার সার্ভিস রেকর্ড থেকে যতটুকু খবর যোগাড় করতে পেরেছি সে অনুসারে তুমি দু বছর আগে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে, ইন্টার্নশিপ শেষ করেই, ওয়ারফিল্ডএ ছিলে। তিন মাস পরে, ইস্টার্ন বর্ডার থেকে দিনজান মিলিটারী হসপিটাল। এক বছর পোস্ট-ওয়ার আরামের ডিউটি করে, এবারে কষ্টের ফিল্ড ডিউটি করতে পোস্টিং হযেছে এই ১৮২ ফিল্ড হসপিটালে। তুমি এখন আর্মি সার্ভিসে প্রায় নতুন তাই তোমাকে এই ফিল্ড এরিয়ার বিষয়ে বেসিক কিছু জানাই।
এটা অরুণাচল প্রদেশ অর্থাৎ এর ওপারে চায়না। ভীষণ সেন্সিটিভ এরিয়া। ১৮২ ফিল্ড হসপিটালকে কেন্দ্র করে করে নানান ফরওয়ার্ড এরিয়াতে পোস্টেড আর্মি পার্সনেলদের শরীর খারাপ হলে বা আহত হলে, তাদের চিকিৎসার প্রথম কেন্দ্র হল এ.ডি.এস. অর্থাৎ অ্যাডভান্সড ড্রেসিং স্টেশন। এখানে দু তিন দিন থেকে তারা ফিরে যায় নিজের ডিউটিতে অথবা বিশেষ চিকিৎসার জন্যে পাঠান হয় ১৮২ ফিল্ড হসপিটালে তারপর মিলিটারী হসপিটাল দিনজানে। এই কাজ ছাড়া চায়না বর্ডারের কাছাকাছি স্থানীয় অধিবাসীদের যে জনপদ আছে, যেমন লাল্দুং, ডুগি, আলোআ, জিরও ইত্যাদি জায়গায় অধিবাসীদের, চিকিৎসার সুবিধা দেওয়া হয়। অধিবাসীদের মধ্যে কে চায়নার বন্ধু আর কে ভারতের বন্ধু উপর থেকে তুমি বুঝতে পারবেনা, সবাই একরকম দেখতে। মনে রেখ, তুমি ডাক্তার, তাই তোমার কাছে যে চিকিৎসার জন্যে আসবে, সে তোমার বন্ধু আর যে চিকিৎসা ছাড়া অন্য কারণে তোমার কাছে আসবে সে তোমার বন্ধু নাও হতে পারে। আমার এই কথাগুলো মনে রাখবে। আমার খবর অনুসারে তুমি এখনো মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর। আমি তোমার ‘টেম্পরারি ডিউটি’ র জন্যে ফিল্ড স্টেশন ঠিক করে রেখেছি। তুমি এনজয় করবে। তুমি কালকে আপাতানি ট্রাইবাল বেল্টের এ.ডি.এস. জিরোতে জয়েন করছ। ইউ শুড স্টার্ট এট ফাইভ এ এম শার্প। একটা ওয়ান টন রেডি থাকবে। ইউ উইল রিচ ‘জিরও’ বাই ফোর পিএম। আই উইশ, লেট দিস বি মোস্ট মেমোরেবল পোস্টিং অফ ইওর লাইফ। গুড লাক। জয়েন অল অফ আস ইন অফিসার্স মেস টু এনজয় ইওর ড্রিংক এন্ড ডিনার।
ভোর চারটায় আমার ব্যাটম্যান এসে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলল, গুড মর্নিং স্যার, ইউনিফর্ম প্রেস করে আনা হয়ে গেছে, আপনার ট্রাঙ্ক গোছান হয়ে গেছে , রাস্তার জন্যে খাবার প্যাক হয়ে গেছে আর বেড টি রেডি । আমি উঠে, মুখ ধুয়ে, শেভিং করে, চান করে, ইউনিফর্ম পরে নিলেই ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দেবে। ততক্ষনে মিল্কত সিং ওয়ান টন নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। আর আমি ঠিক ‘পাঁচ বজে’ স্টার্ট করে যাব পাশিঘাট থেকে জিরও পর্যন্ত সব চেক পোস্ট কো আপকা মুভমেন্ট ডিটেল দিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা আপনার কোন দরকার পড়লে হেল্প করতে পারে। আমি মশারি থেকে বার হয়ে বললাম, গুড মর্নিং। থ্যাঙ্ক ইউ ফর অল ইওর কেয়ার। আমি আধ ঘন্টায় তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
ঠিক ‘পাঁচ বজে’ আমাকে বসিয়ে মিল্কত সিং তার ওয়ান টনের যাত্রা শুরু করল আমার জন্যে এক অজানা দেশে। অল ওয়েদার রোডে,পাহাড়, পর্বত, নদী, নালা, সব কিছুই ছিল আর অফুরন্ত ছিল। এখুনি দেখা যাচ্ছিল, দুরে বরফ ঢাকা বিশাল পর্বত শ্রেণী আর একটু এগোতে রাস্তার ধরে বিরাট খাদ। নিচে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। কখনো মেঘ এসে চারদিকে ঘিরে ফেলছে, কখনো শরীর গরম করা রোদ। প্রায় সাত ঘন্টা প্রকৃতির খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছালাম উত্তর লখিমপুর। এখান থেকে জিরও প্রায় চার ঘন্টা। লখিমপুরে দুপুরের খাওয়া। মিল্কত সিং বার করল একটা থালা, তাতে সাজিয়ে আনল চপাতি, আলু ভুজিয়া, আমলেট আর সালাদ। সব কিছু ওই ফিল্ড হসপিটালের মেস থেকে আনা। তারপর ফ্লাস্ক থেকে গরম গরম চা। লাঞ্চটা দারুণ হল। আবার গাড়ি চলল। কিছুদুর যাবার পর, শুরু হল পরপর লম্বা লম্বা পাইন গাছের সারি। কোথাও কোথাও চাষ করা ক্ষেত আর তারি মাঝে মাঝে পাইন গাছের কান্ড দিয়ে তৈরি পিলারের উপর মাটি থেকে প্রায় দশ থেকে বার ফুট উঁচুতে, একটা বড় হল ঘরের মত এক কামরার বাড়ি। বাঁশের মেঝে আর বাঁশের দেয়াল। জংলি জন্তুদের থেকে বাঁচতে মাটি থেকে অত উঁচুতে ঘর বানান হযেছে। বাড়িতে ঢোকার জন্যে ঘরের মাঝখানে খোলা জায়গা আছে,সেখান থেকে মাটি পর্যন্ত সিড়ি নেমে আসছে।
ঠিক সন্ধ্যে চারটায় মিল্কত সিং এর সৌজন্যে এ.ডি.এস. জিরও তে পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম একজন নায়েব সুবেদার এ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই এসে আমায় সেল্যুট করে জানাল, “নায়েব সুবেদার কৃষ্ণণ ওয়েলকামস ইউ এট এ.ডি.এস. জিরও।” উত্তরে সেল্যুট গ্রহণ করে হাত বাড়িয়ে দিলুম। বললুম “থ্যাঙ্ক ইউ। ইট ইজ মাই প্লেজার”। এ.ডি.এস. এর ভিতরে বারান্দায় দাঁড়ান অন্য স্টাফদের সঙ্গে পরিচয় হল। হাবিলদার কামথ, লান্স নায়েক সারেজ ধরপ, সিপাই লায়েক সিং, অরিন্দম প্রাসাদ, প্রভাত শীল, জামুল সালাম, আর সবার শেষে দাঁড়ান “গ্রেড ফোর” এর সিপয় জীবন লামা আর সিপয় নাজের হায়তু। মেডিকাল অফিসারের চেম্বারে বসে জয়েনিং রিপোর্ট ভরছিলুম, টেবিলের অপর দিকে এসে বসলেন নায়েব সুবেদার কৃষ্ণণ। সঙ্গে এল গরম গরম পাকোড়া আর এক মগ গরম গরম চা। আঃ কি আরাম।
কৃষ্ণণ সাহেব জানাল, এগার ঘন্টা জার্নি করে এসেছেন। আপনি টায়ার্ড হবেন। আজ রেস্ট করে নিন কাল সকালে আমরা জিরও র এম.আই.রুমে যাব। জিরওর কথা বলার ভাষা হল আপাতানি। আপাতানি ভাষায় চিকিৎসার জায়গাকে দিইরোহোহো বলে। এই দিইরোহোহোতে ওখানে সিভিলিয়ানদের অর্থাৎ অধিবাসীদেরও চিকিৎসা করা হয়। আগে এরা ‘লেম্বাদিইরো’ মানে ‘গ্রামের ঝাড়ফুঁক ওয়ালাদের’ বেশি বিশ্বাস করত। কিন্তু গত দশ বছর ধরে আর্মি নিজের এম.আই. রুম খুলে ফ্রিতে ওষুধ দেয়ার জন্যে এখন লেম্বাদিইরোদের প্রতিপত্তি আগের চেয়ে কমলেও, গ্রামের লোকেরা এদের মান্য করে। এরা এখনো বিশ্বাস করে যে সব রোগ কষ্ট কিছু দুষ্ট আত্মাদের জন্যে হয়। আত্মাদের এরা ‘উয়ীগাজে’ বলে এবং ভীষণ ভয় করে। লেম্বাদিইরোরা সব সময় বোঝায় যে বিদেশী ওষুধ খেলে কিছুদিনের জন্যে কষ্ট কম হলেও পরে আরও কষ্ট হবে আর উয়ীগাজের দেওয়া শাস্তিস্বরূপ ফসলের ক্ষতি হবে। কিন্তু মন্ত্র পড়ে উয়ীগাজের পুজো দিলে আর মুরগির বলি চড়ালে সবসময়ের জন্যে ভাল হয়ে যাবে। তাই দিইরোদের আর আর্মির ডাক্তারদের একটা অলিখিত যুদ্ধ চলতে থাকে। অনেক দিন এইখানে কোন আর.এম.ও. পোস্টেড্ ছিল না তাই গ্রামের লোকেরা ‘লেম্বাদিইরো’দের কথা বেশি শুনত। কিন্তু এবারে আপনি এসেছেন, আমরা নিশ্চয় গ্রামবাসীদের বোঝাতে পারব যে কোন বলি না চড়িয়েই, আর কোন পয়সা খরচ না করেও শারীরিক কষ্ট থেকে তারা মুক্তি পেতে পারে। এবার আমরাই এই যুদ্ধে জিতব। কৃষ্ণণ সাহেব যুদ্ধের কথা বলাতে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা কৃষ্ণণ সাহেব আপনার চাকরি কত দিনের হল? হেসে বললেন প্রায় ২২ বছর। ভাবলাম আমি যদি মেডিকেল কলেজে মাত্র তিন বছর এন.সি.সি. আর এক বছর আর্মি অ্যাটাচমেন্ট ক্যাম্প করে, আর্মি বলতে অজ্ঞান হই তাহলে যে লোকটা বাইশ বছর আর্মিতে কাটিয়েছে সে জীবনের প্রতি কাজে যুদ্ধ দেখবেনা কেন?
নায়েব সুবেদার কৃষ্ণণ সাহেবের তথাকথিত সকাল নটার সময়ে তৈরি হয়ে দেখলাম যে তিনি আমার আগেই তৈরি হয়ে, অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে স্যালুট করে জানালেন যে জিরোর আর.এম.ও. র চেম্বারে আমার সঙ্গে গাঁওবুড়া আর দুভাষিয়া দেখা করতে আসবেন। ওরা কে আর কেন আসবে বুঝতে না পারলেও আমি আমার সিরিয়াসনেসটা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেন ওদের কোন কাজ আছে’? কৃষ্ণন সাহেব জানালেন ‘না কোন কাজ নেই। আসছেন কার্টসি ভিজিট করতে। ওনারা গভর্নমেন্টের লোক। গাঁওবুড়া খানিকটা ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের মত। গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। গ্রামের প্রায় প্রত্যেক মানুষকে নাম ধরে চেনেন,গ্রামের প্রতিটি ডেভেলপমেন্টের কাজ তাঁর দেখাশোনাতে হয় আর দুভাষিয়া হলেন যিনি কিছু কিছু হিন্দি জানেন, কিছু কিছু ইংরেজী জানেন আর আপাতানি ভাষা জানেন । তাই তিনিও সরকারী লোক। তিনি আপাতানি ভাষা বলা অধিবাসীদের কথা দরকার মত ইংরেজী বা হিন্দী ভাষায় সরকারী অফিসারকে আর সাহেবদের ইংরেজী বা হিন্দী ভাষায় বলা কথা অধিবাসীদের আপাতানিতে শুনিয়ে দেন। সরকারী প্রতিটি মিটিঙে তাঁদের থাকা দরকার। আপনাকে ওনারা খুশি রাখতে চাইবেন। কারণ আপনারা ডাক্তাররা হলেন সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। সরকার আপনাদের কথা অনেক সম্মানের সঙ্গে শোনে; চলুন দেরী হয়ে যাচ্ছে। এই বলেই তিনি আমায় সাল্যুট করে ওয়ান টনের সামনের গেট খুলে ধরলেন। আমি সামনের সিটে বসলাম আর তিনি পেছনে বসলেন। আধ ঘন্টায় জিরো শহরে পৌঁছালাম তার পর আধ ঘন্টায় পৌছালাম জিরোওর অধিবাসীদের জন্যে আর্মির চিকিৎসা কেন্দ্রে বা আর্মির ভাষায় এম. আই. রুমে।
দেখলাম জনা দশেক আপাতানি অধিবাসীরা বসে আছে। পুরুষরা লাল রঙের স্ট্রিপ দেওয়া জ্যাকেট আর হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা ছোট লুঙ্গি পরে আছে আর মেয়েরা ঐরকম কাপড়ের ব্লাউসের মত জামা, একটা বড় গামছার মত ওড়না, কোমর থেকে পা পর্যন্ত জড়ানো লাল রঙের স্ট্রিপ দেওয়া লুঙ্গির মত কাপড়। অনেক মহিলাদের নাকে বড় বড় ফুটো আর তাতে কাঠের প্লাগ লাগান আছে। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, তাঁর মাথায় বেশ কয়েকটা পাখির পালক লাগান একটা হ্যাট, গলায় অঙ্গবস্ত্র, হাতে একটা হাতল লাগান মোটা ছড়ি। নায়েব সুবেদার কৃষ্ণণ এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে জানালেন যে ইনিই হলেন গাঁওবুড়া আর পরের জন দুভাষিয়া। দেখলাম ইনিও মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, মাথায় ছোট পাগড়ির মত কিছু বাঁধা আর গলায় অঙ্গবস্ত্র। এই অঙ্গবস্ত্র, সরকার থেকে দেয়া। কৃষ্ণন সাহেব আমায় প্রোটোকল জানালেন যে এঁরা দুজনেই নিজের গলায় পরা লাল আর সাদা সুতোর মালা আপনাকে পরাবেন। আপনি এঁদের পরান মালা আবার ওদের পরিয়ে দেবেন। এর মানে হল যে ওনারা নিজের সম্মান আপনাকে দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন আর আপনি সসম্মানে তাঁদের সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে নিজের করে নিলেন। প্রোটোকল পুরো হতে লক্ষ্য করলাম তাঁদের সঙ্গে কুড়ি বাইশ বছরের একটি মেয়ে বসে আছে, জিন্সের সঙ্গে শার্ট পরা, আর মাথায় ফুল গোঁজা। কৃষ্ণণ সাহেব এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘জেনতিলা নার্নো’, গাঁওবুড়ার মেয়ে। পাসিঘাটের কনভেন্ট স্কুল থেকে পাশ করেছে, ইংরেজী বলতে পারে, হিন্দি বলতে পারে, তাই বাবাকে কাজ করতে হেল্প করে। নার্নো দাঁড়িয়ে সপ্রতিভ ভাবে হাত বাড়িয়ে বলল ‘ওয়েলকাম ইউ স্যার অ্যাট জিরো’। অতএব আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম ‘থ্যাঙ্ক ইউ, আই ফীল অনার্ড’। গাঁওবুড়া আর দুভাষিয়া, আর্মিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আর সিভিলিয়ান এম. আই. রুম তৈরী হওয়াতে আপাতানিদের কি কি সুবিধে হযেছে, তার বিষয়ে কিছু হিন্দি কিছু ইংরাজীতে আর কিছু আপাতানিতে বললেন। এর পর আমায় কিছু বলতে বলাতে, আমি হিন্দিতে বললাম,“আর্মি মেডিকাল কোর গত দশ বছর ধরে আপনাদের চিকিৎসা করে আসছে। আমরা আপনাদের এই বিশ্বাসের জন্যে ধন্যবাদ জানাই। আমি নতুন জয়েন করেছি। তবে কথা দিচ্ছি আপনাদের বিশ্বাসের অনুরূপ আমরা আমাদের চিকিৎসা সেবা দিতে পারব। জিরোতে বসবাসকারী প্রত্যেক অধিবাসীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি”। সেদিনকার মত তথাকথিত কার্টসি ভিজিট শেষ হল। এরপর আমি আমার কাজ শুরু করলাম অর্থাৎ রুগী দেখা। প্রায় পনের জন রুগী ছিল, বেশি ভাগ রুগীরা আপাতানি ভাষায় নিজের কষ্ট বলছিল বলে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। হটাৎ জেনতিলা সেখানে হাজির হল। সব্বাইকে এক লাইনে বসিয়ে, তাদের এক এক করে ডেকে, আপাতানি ভাষায় কথা বলে সব কষ্ট বুঝে নিল, তারপর আমার রুগী দেখার টেবিলের কাছে এসে রুগীদের কষ্ট ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বুঝিয়ে দিল। মেডিকেল স্টোরে গিয়ে ওষুধ এনে কি করে খাবে সবাইকে বুঝিয়ে দিল। কাজ শেষ হতে এ.ডি.এস. এ ফেরার আগে জেনতিলা নার্নোকে এত এফিসিয়েন্টলি আমার পেসেন্ট দেখার কাজটা ম্যানেজ করে দেবার জন্যে, ধন্যবাদ জানাতে তার কাছে গিয়ে বললাম ‘আই রিয়ালি থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর হেল্প’। নার্নো একটু হেসে বলল,‘ ইউ হ্যাড নো ওয়ে, ইউ ডোন্ট নো আপাতানি, এন্ড দে ডোন্ট নো হিন্দি। সো আই ফেল্ট টু স্টে ব্যাক। উইল ইউ মাইন্ড ইফ আই কাম হিয়ার টু হেল্প ইওর পেশেন্টস, হোয়েনেভার আই হ্যাভ টাইম টু স্পেয়ার’। আমার কি বলা উচিত বুঝতে না পেরে শুধু বললাম ‘ইফ ইউ এনজয় হেল্পিং মি, আই ওয়েলকাম ইউ’।
জেনতিলা নার্নো প্রায়ই আসতো, দুভাষিয়ার কাজ করে আমার কাজের অনেক সুবিধে করে দিয়েছিল । বেশ বুদ্ধিমান, খুব তাড়াতাড়ি নানান কষ্টে কী ওষুধ দিতে হবে তার নাম জেনে নিয়েছিল। রুগীদের ভাল ভাবে বসাত। যাদের বেশি কষ্ট থাকত তাদের ধরে ধরে সঙ্গে নিয়ে আসত, তাদের কষ্ট আমায় বোঝাত আর তাদের যে ওষুধ দিতাম আর যে কষ্টে দিতাম তা একটা ছোট ডায়রিতে লিখে নিত। পাশের রুমে আমাদের মেডিকেল স্টোরে গিয়ে ডিসপেনসর সিপাই গনেশ কুমারকে ওষুধ বার করে দিতে সাহায্য করত। ওখানকার গ্রেড ফোর মানে সুইপার হরি মোহনের সঙ্গে কথা বলে পুরো মেডিকেল ক্যাম্পাসকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে রাখত। কিছুদিনের মধ্যে সে আমাদের এম. আই. রুমের সব থেকে জরুরী মানুষ হয়ে দাঁড়াল। কোন দিন না এলে, সেদিন মনে হত, কোন কাজই ঠিক ভাবে হচ্ছে না। কিছুদিন পর থেকে দেখলাম আমার রাইটিং টেবিলে রোজ কিছু তাজা লাল ফুল সাজিয়ে রাখা আছে। একদিন নার্নো আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপকো য়ে লাল ফুল আচ্ছা লগতা হ্যায়? আমি মাথা নাড়াতে বলল,‘লাঞ্চন কিনা লেন নিপ্পা’। আমি অবুঝের মত তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারল যে তার আপাতানি আমি বুঝতে পারিনি। ও দু হাত জড়ো করে বলল ‘য়হ লাল ফুল আপকে লিয়ে হ্যায়’। কী উত্তর দেব? শুধু হাত দুটো জুড়ে বললাম, ধন্যবাদ। আর এক দিন কাজ করতে করতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল যে ‘আপকা কোই নিয়মুন হ্যায়? বললাম ‘নিয়মুন ক্যা হ্যায়’। – ‘গার্ল ফ্রেন্ড কো আপাতানি ভাষা মে নিয়মুন বোলতে হ্যাঁয়’| কী উত্তর দিই? যদি বলি নিয়মুন আছে, তাহলে হয়ত কাল থেকে আসবেনা আর যদি বলি নিয়মুন নেই তাহলে বিপদটা বাড়বেনা ত? তার প্রশ্নটাকে এড়াতে হো হো করে হেসে, তাকেই জিজ্ঞেস করলাম যে তার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা। ঘাড় নেড়ে বলল, দো মিহা আছে, কিন্তু একজন লেখাপড়া করেনা। অন্যজন দিনভর ‘অপং’ মানে দারু নিয়ে থাকে। সত্যি ব্যাড লাক।
রুগীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছিল। আরও ওষুধের জন্যে ডিমান্ড পাঠান হল। উত্তর এল যে গত পাঁচ বছরে তো এত ওষুধের ডিমান্ড হয় নি এখন এত ওষুধ কেন দরকার পড়ল তা এক্সপ্লেন করে জানান হোক। ভাবলাম লিখে পাঠাই যে এটা হল নার্নো ইফেক্ট | নায়েব সুবেদার কৃষ্ণণ সাহেবকে বললাম পেশেন্ট এটেনডেন্স রেজিস্টার আর মেডিসিন ডিস্পেন্সিং রেজিস্টার নিয়ে ১৮২ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স অফিস গিয়ে দেখাতে।
সব ঠিক ঠাক ভাবে চলছিল। সবাই খুশি ছিল। একজন লোক কিন্তু খুবই অখুশি ছিল। সে হল এই জিরোর লেম্বাদিইরো মানে ‘গ্রামের ঝাড়ফুঁকওয়ালা, গ্রাম দেবতার পুজারী, কারণ তার রুগী কমে গিয়েছিল। কয়েকবার দেখেছি তাকে এখানে আসতে ও জেনতিলা নার্নোর সঙ্গে বা রুগীদের সঙ্গে রাগারাগি করতে। কৃষ্ণণ সাহেব সাবধান করে দিয়েছিলেন এদের না ঘাঁটাতে, কারণ অনেক অধিবাসীরা এখনো লেম্বাদিইরোদের অনেক সম্মান করে, তারা বিশ্বাস করে যে লেম্বাদিইরো অনেক ‘যুবংয়ালো’ অর্থাৎ অতৃপ্ত আত্মাদের বশ করে রেখেছে। এই আত্মারা নানান রোগ সৃষ্টি করে। লেম্বাদিইরো গ্রামের বাইরে,গাছপালার ডাল আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে রুগীদের রাখার জন্যে ঘর তৈরি করেছিল যাকে গ্রামের লোকেরা হোহো বলত। এখানে লেম্বা দিইরো জড়িবুটি খাইয়ে, চিৎকার করে করে মন্ত্র পড়ে আর মুরগি জবাই করে চিকিৎসা করত। সবাইকে বলত যে রোগের চিকিৎসা ডাক্তাররা করতে পারেনা তা লেম্বাদিইরো পারে। চেষ্টা করতাম লেম্বা দিইরোর সঙ্গে কথা না বলতে। তবে সে আমায় পছন্দ করেনা বুঝতে পারতাম। নার্নোকেও পছন্দ করত না। প্রায় তারা চিৎকার করে নিজেদের ভাষায় ঝগড়া করত। মাঝে মাঝে দিরু (ডাক্তার) শব্দটা শুনতে পেতাম, তাই বুঝতাম ঝগড়ার কারণটা আমি, আর নার্নোর বার বার এম.আই রুমে আসা।
আর্মিতে সাধারণত বলা হয় যে যদি খারাপ দিন আসে তাহলে মাথা নিচু করে কান খোলা রাখ খারাপ দিন কেটে যাবে আর যদি ভাল সময় চলছে তাহলে সাবধানে খোঁজ,‘খারাপ সময়টি’ আনাচে কানাচে কোথাও ঘোরা ফেরা করছে। এম. আই. রুমের এই রমরমা অবস্থা বেশিদিন চলবে না তা জানতাম কিন্তু বিপদ কোন দিক থেকে আসবে বুঝতে পারছিলাম না।
হটাৎ দেখা গেল এম.আই.রুমে অদ্ভুত কষ্ট নিয়ে গ্রামবাসীরা রিপোর্ট করছে। খুব জ্বর, জলের মত পায়খানা, আর হাতে পায়ে ভীষণ ব্যথা। লেম্বাদিইরো জানাল এটা অতৃপ্ত আত্মারা করছে। অনেকদিন এদের পুজো হয়নি তাই এরা রেগে আছে। এর জন্যে আলাদা পুজো করতে হবে। তাই রুগীদের হোহোতে রেখে জড়িবুটি খাওয়াচ্ছিল আর মুরগি জবাই করে পুজো করছিল। যারা আমাদের কাছে আসছিল তারা প্রায় শেষ সময়ে আসছিল। যা ওষুধ ছিল তাই দিয়ে চিকিৎসা শুরু হল। কিন্তু বাঁচান যাচ্ছিল না। আমরা ১৮৪ ফিল্ড হসপিটালের মাধ্যমে রুগীর পায়খানা বমি দিন্জান মিলিটারী হাসপাতালে পাঠালাম, স্পেশাল কালচার করার জন্যে আর কালচার করে ওষুধ খুঁজে পেতে। দিন্জান হসপিটাল স্যাম্পল পাঠাল কমান্ড হাসপাতাল দিল্লিতে। জিরোওর অবস্থা খারাপ। প্রায় পনের জন মারা গ্যেছে। কিন্তু নার্নো বেশি সময় রুগীদের সঙ্গে কাটাচ্ছে,তাদের দেখা শোনা করছে, তাদের শারীরিক কষ্টগুলো হিন্দি ইংরিজি মিলিয়ে আমাকে জানাচ্ছে। অনেক বারণ করেছিলাম রুগীর কাছে যেতে। কিন্তু শোনেনি। শেষ পর্যন্ত যা ভয় করেছিলাম তাই হল। নার্নো কে সেই অজানা রোগ ধরল। তবে গাঁওবুড়া তাকে লেম্বা দিইরোর হোহোতে নিয়ে গেল। অনেক জড়ি বুটি খাওয়াল, অনেক মন্ত্র পড়ল, অনেক মুরগির জবাই হল কিন্তু কিছু লাভ হল না। বিকেল হতে হতে বলল ‘যুবংয়ালো’ আত্মা খুশি হচ্ছেনা। লেম্বাদিইরো বলল একে আর বাঁচানো যাবে না, একে গ্রাম দেবতার পায়ের কাছে রেখে দেওয়া হোক। গাঁওবুড়া শেষ চেষ্টার মত আর্মির এম.আই. রুমে নিয়ে এল। ফিল্ড হসপিটালে আমার কাছে খবর গেল। তখুনি ট্রিটমেন্ট রুমে পৌঁছালাম। ভাল ভাবে দেখলাম ডিহাইড্রেশন শুরু হয়ে গেছে। দু হাতে ফ্লুইড শুরু করা হল। আমিকাসিন আর ওফ্লোকসাসিন ড্রিপ যোগ করা হল। অক্সিজেন, স্টেরইড যোগ হল। নাকে টিউব দিয়ে দুধ দেওয়া হল। ব্লাডপ্রেসার কমতে লাগল। ওষুধ পড়ল। কিছু লাভ হল না। ব্লাড টেস্ট হল। দেখা গেল রক্ত অনেক কম। ও নেগেটিভ ব্লাড চাই। রেয়ার ব্লাড গ্রুপ। কোথাও ব্লাড পাওয়া গেল না। হঠাৎ মনে পড়ল আমার ব্লাড গ্রুপও তো ‘ও নেগেটিভ’। ক্রস ম্যাচিং হল। দেখা গেল মিলে গেছে। রাত আটটার মধ্যে ব্লাড দিয়ে দেওয়া হল। রাত দশটা থেকে ব্লাডপ্রেসার বাড়তে লাগল। পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরে এল। বিকেল হতে হতে উঠে বসল। গাঁওবুড়া এসে আমার কাছে হাত জোড় করে দাঁড়াল। আমি ওর হাত ধরে বললাম তোমার ন্যিমিই (মেয়ে) ভাল আছে। জিজ্ঞেস করল বাড়ি ফিরতে পারবে তো? বললাম নিশ্চয়ই, তবে আজ নয়,কাল বিকালে। পরদিন সকালে আর্মির এম.আই. রুমে পৌঁছে দেখলাম লেম্বাদিইরো, গাঁওবুড়া, দুভাষিয়া সবাই আছে, সঙ্গে প্রায় কুড়ি পচিশ জন লোক। লেম্বাদিইরো চিৎকার করে করে কিছু বোঝাচ্ছে। আর গ্রামের লোকেরা হাও হাও বলে ওকে সমর্থন করছে। আমাকে দেখে ওর চিৎকার করা আরও বেড়ে গেল। আমার চেম্বারে দুভাষিয়া এল | জানাল, লেম্বাদিইরো বলছে যে ডাক্তারের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করার জন্যে গ্রাম দেবতা জেনতিলা নার্নোর উপর কুপিত ছিলেন । তিনিই অপদেবতাকে পাঠিয়েছিলেন জেনতিলাকে শাস্তি দিতে। তাই লেম্বাদিইরোর ঝাড়ফুঁক কোন কাজে এলনা । এটা বুঝতে পেরে লেম্বাদিইরো বলেছিল জেনতিলা নার্নোকে গ্রাম দেবতার পায়ের কাছে রেখে আসতে। কিন্তু গাঁওবুড়া অমান্য করে মেয়েকে নিয়ে এলেন ডাক্তারের কাছে। এখানেও ওষুধ দিয়ে কোন কাজ হলনা। তখন ডাক্তার নিজের রক্তের মাধ্যমে নিজের আত্মার অংশ দিয়ে জেনতিলাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তাই জেনতিলার শরীরে এখন ডাক্তারের আত্মা আছে। জেনতিলা গ্রামে ফিরে গেলে গ্রাম দেবতা আরও কুপিত হবেন। গ্রামের আরও লোক মরবে এবং ফসলের ক্ষতি হবে। গ্রামের লোকদের বাঁচাতে জেনতিলাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন ডাক্তারের দায়িত্ব জেনতিলাকে রাখার। আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম রক্ত দিলে নিজের আত্মা দেওয়া হয় না,রক্ত দেওয়া চিকিৎসার এক অংশ। মেডিকেল কলেজে যাও,দেখবে অনেক লোককে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধ লাগলে পুরো দেশের লোকেরা রক্ত দান করে আহতদের দেবার জন্যে।
কিন্তু কোন লাভ হল না। ঘোঁট বড় হতে লাগল। সিভিলিয়ান অফিসাররাও নড়ে চড়ে বসল। কারণ এতে আর্মি ইনভল্ভড ছিল,এখুনি ইন্টারফেয়ার করতে চাইছিল না। শেষে গাঁওবুড়া লেম্বাদিইরোকে জিজ্ঞেস করল আর কী উপায় আছে যাতে উনি বেঁচে ওঠা মেয়েকে বাড়িও নিয়ে যেতে পারবেন আর গ্রামেরও ক্ষতি হবে না।
লেম্বাদিইরো অনেক ভেবে চিন্তে জানাল যে যদি ডাক্তার জেনতিলাকে বিয়ে করে আর তারপরে ডাইভোর্স করে তাহলে ডাক্তারের আত্মা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে আর জেনতিলা বাড়ি যেতে পারবে। এ ছাড়া কোন উপায় নেই। গাঁওবুড়া হাত জোড় করে সব কথা আমায় জানাল। কৃষ্ণণ সাহেব পাশেই বসেছিল। সেই গাঁওবুড়াকে জবাব দিল যে সাহেব আর্মিতে আছে,তাই আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে বিয়ের পারমিশান নিতে হবে। কিছু সময় চাই। গাঁওবুড়া কিছু আশ্বাস পেয়ে চলে গেল।
আমি বললাম কৃষ্ণণ সাহেব এবার কি হবে? কৃষ্ণন সাহেব একটু ভেবে বলল,দেখুন আপাতানি ট্রাইব নারী প্রধান। এদের প্রথা মত ডাইভোর্স মেয়েরা চাইতে পারে,ছেলেরা চাইতে পারেনা। তাই জেনতিলা নিজে থেকে ডাইভোর্স না দিলে আপনার কাছে কোন উপায় থাকবে না। তাই এই পথে যাবেন না। অবশ্য জেনতিলাকে আপনার পছন্দ হলে আমার কিছু বলার নেই। আমি জানালাম যে এ হতে পারে না,কারণ আমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করছে। তাছাড়া আমি কোনদিন জেনতিলাকে এই চোখে দেখিনি। কৃষ্ণন সাহেব বলল,‘তাহলে রাস্তা সোজা,আপনি কোন কারণ দেখিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যান। আমি ১৮২ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স অফিসে সুবেদার মেজর আলুবালিয়া সাহেবের সাথে কথা বলছি, সি.ও সাহেব কর্ণেল সুভাষ দেবকে সব বুঝিয়ে, আপনাকে টেম্পোরারী ডিউটিতে ডেকে পাঠাতে। অন্য কোন ডাক্তার আসবে আপনাকে রিলিভ করতে। আপনি ফিরে যাবেন মিল্কত সিং এর ওয়ান টনে। কিন্তু আমার প্লানটা ঠিক পছন্দ হল না। এই ভাবে চুপচাপ পালাতে ভাল লাগছিলনা। ভাবলাম এখানকার এসডিও সাহেব, থানা ইনচার্জকে বলে, লেম্বাদিইরোর প্লানটাকে ভেস্তে দেওয়া যায় না? যদি ভেস্তে দিতে পারি তাহলে জেনতিলা নার্নোর এই কলঙ্ক যে সে আমার আত্মার অংশে বেঁচে আছে,শেষ হয়ে যাবে আর রক্ত দিয়ে আমার আত্মার ভাগ দিয়েছি লেম্বাদিইরোর এই বুজরুকিটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া ‘আর.এম.ও. ট্রিটমেন্ট রুম’ মানুষকে বাঁচাতে পারে এটা প্রমাণ হবে।
কৃষ্ণণ সাহেব বলল,কপ্তান সাহেব আমরা ফৌজি আদমিরা বিনাযুদ্ধে জমি ছাড়িনা কিন্তু সে তো দুশমনের বিরুদ্ধে। এখানে লড়াই তো ঘরকে বিভীষণ কে সাথ। এখানে মাঝে মাঝে টেকটিকেলি পিছে হটনা ফায়দেকা হোতা হায়। চলিয়ে, জিরোও সে চলে জানেকে পহলে লড়কি সে মিল লিজিয়ে। নহি তো নহি মিলনে কা আফসোস রহ জায়েগা। আমরা দুজনে আর.এম.ও. ট্রিটমেন্ট রুমে জেনতিলা নার্নোর বেডের পাশে দাঁড়াতে ও উঠে বসল। টেবিলে রাখা কিছু তাজা লাল ফুল আমার হাতে দিয়ে বলল ‘লাঞ্চন কিনা লেন নিপ্পা’। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নার্নো ভাবলো আমি তার আপাতিনি বুঝতে পারিনি। আমি দু হাত জড়ো করে বললাম ‘য়হ লাল ফুল কে লিয়ে আপকো ধন্যবাদ’। হঠাৎ নার্নো আমার হাত ধরে বলল, ‘ডাক্তার সাহব, জিতনা জলদ হো জিরোও সে চলে যাইয়ে। লেম্বাদিইরো আপকো আউর পরেশান করনে কো তৈয়ারী কর রহা হ্যায়, উনকে সাথ আউর কুছ লোগ হ্যায়, আওর ওয়ে লোগ অচ্ছে নহী হ্যাঁয় । মেরে বারে মে মত সোচেঁ, ম্যাঁয় পঢ়ী লিখি লড়কি হুঁ, সব কুছ সম্ভাল লুঙ্গি । দেখলাম ওর চোখে জল ভরে এসেছে।’
কৃষ্ণণ সাহেব, কী কল কাঠি নেড়ে ছিল জানিনা তবে পরদিন সকালে মিল্কত সিং এর ওয়ান টনে বসে আমি ১৮২ মোবাইল ফিল্ড হাসপাতাল, পাশিঘাট যাচ্ছিলাম। জেনতিলা নার্নোর কথা বার বার মনে পড়ছিল আর জানিনা কেন, জেনতিলাকে ওই অনিশ্চয়তার মধ্যে ছেড়ে পালিয়ে আসার জন্যে বার বার নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছিল।
************************************************
ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ পরিচিতিঃ
বর্ষীয়ান অস্থি শল্য চিকিৎসক। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সাক্ষী ভারতীয় স্থল সেনার আধিকারিক পদে থাকাকালিন। বর্তমানে পটনা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রফেসর। বিহার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন এর বর্তমান সভাপতি। বিহার রাজ্য বাংলা একাডেমির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। সর্বভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চ, কলকাতার সভাপতি পদে অধিষ্ঠাধিন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়,পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা বিদ্যাসাগর সম্মানে ভূষিত। অবসর সময়ে ছোট গল্প লিখতে পছন্দ করেন।