ভুলো
দেবাশিস চক্রবর্তী
আমরা তখন অনেক ছোট। ক্লাস সিক্স/সেভেন এ পড়ছি। থাকতাম কলকাতার সি.আই.টি বিল্ডিং পদ্মপুকুরে ৷ ১৯৬৯ -৭০ এর কথা।
স্কুল থেকে ফিরেই একটু খেয়ে দেয়ে ছুটতাম সামনের মাঠে খেলতে। ফুটবল আমাদের নেশার মতন ছিল। রেল লাইন সংলগ্ন একটা বক্রাকার মাঠে আমাদের ফুটবল খেলা চলতো। শীত/ গ্রীষ্ম/ বর্ষা কিছুই আমাদের দমিয়ে রাখতে পারতো না।
দেশভাগের পর বহু রিফিউজি যারা নির্মীয়মান কিছু সি.আই.টি. এর দখল নিয়েছিল, তারাও ছিল আমাদের খেলার সঙ্গী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিকাশ, সুনীল, সদা, ব্যাঙ্গা, কুটি, এবং আরও অনেকে। আমরা যারা সি.আই.টির বোনাফাইড বাসিন্দা, মধ্যবিত্ত হলেও আর্থিক ভাবে ওদের তুলনাতে একটু স্বচ্ছল ছিলাম। যদিও আধখানা ডিম আমরাও খেয়েছি, চাঁদা মাছ, তেলাপিয়া তেই খুশি ছিলাম। ইস্ট বেঙ্গল – মোহন বাগান লীগ এর ফাইনাল খেলার টিকিট পাওয়াটা লটারি টিকিট পাবার মতন ছিল সে সময়ে। কিন্তু সবার ওপরে ছিল আমাদের ফুটবল। ২০/২৫ জন মিলে ফুটবল কিনতে যেতাম রহিম চাচার দোকানে। অনেক ফুটবল দেখেশুনে একটা কেনা হতো চাঁদা তুলে। ইতিমধ্যে ব্যাঙ্গা, বা কালা বাপি, বা কুটির নিপুণ হাতসাফাই এ আরও একটি ফুটবল এসে যেতো আমাদের হাতে। রহিম চাচা বুঝতে পারত কি পারতো না জানা নেই, বুঝলে গালি দিত হয়তো — কিন্তু ফুটবল এর সাথে আমাদের প্রেম/ ভালোবাসা ছিল নির্ভেজাল, অকৃত্রিম।
এই খেলাধুলোর মধ্যেই আমাদের আরও একজন সঙ্গী ছিল ”ভুলো”। রাস্তায় ছোট থেকে বড় হওয়া একটা খয়েরি রং এর কুকুর। সে ও আমাদের সাথে খেলত, দৌড়তো। আমরা যে যখন যা পারি তাই খাওয়াতাম। মাঠে বসে আমাদের খেলা দেখত। আমাদের খেলায় জেতার আনন্দের শিকার ছিল ভুলো। আবার নানান দুঃখের সঙ্গীও ছিল ভুলো। বেশির ভাগ সময়ই এইচ্ ব্লকের কোনো না কোনো একটা গেট এর নীচেই দিন কাটাত ভুলো। মা বাবাদের বকুনি সত্ত্বেও আমরা ভুলোর সাথে বিনা দ্বিধায় খেলা করতাম, আদর করতাম-ও আমাদের সব কথা বুঝত, কখনো কামড়ায় নি কাউকেই। এইচ্ ব্লকের দশটা গেটেই ছিল ভুলোর অবাধ বিচরণ। এই ব্লক টা সি. আই.টির সব থেকে বড় ব্লক ছিল। ৮০ টা ফ্ল্যাট ছিল ৭০০-৯০০ বর্গফুট এর। আর সেজন্যই এই ব্লক এর ছাদটা ছিল বিশাল বড় — ১০ টা গেট এর থেকেই এই ছাদে যাওয়া যেতো। বন্ধুদের কারো জন্মদিন থাকলে ভুলোর স্পেশাল খাওয়া পাওনা ছিল। অনেকে মা বাবাকে না জানিয়েই কিছু না কিছু দিত ভুলো কে। ভুলো আস্তে আস্তে আমাদের সাথেই বড় হয়ে উঠছিল। এইচ্ ব্লকের সিকিউরিটি অফিসার হয়ে উঠেছিল সে। রাতে এগারটার পরে সবাই যখন ঘুমতো — ভুলো পাহারা দিত এইচ্ ব্লক ৷ রাতে ওর চিৎকার শুনলেই বুঝতে হতো যে কোন লোক কোন গেট দিয়ে ঢুকবার চেষ্টা করছে।
এইভাবেই দিন কাটছিল — ভাল মন্দতে। ক্রমশ আমরা বুঝতে পারছিলাম — আমাদের ফুটবল খেলাধুলোর সঙ্গে সঙ্গে ‘ভুলো’ ও হয়ে উঠেছে আমাদেরই একজন — ভালবাসার জন।
আস্তে আস্তে দিন পরিবর্তন হচ্ছিল। কিছু কিছু মারামারি, অশান্তি শুরু হয়েছিল আমাদের পাড়াতে। ওয়াগন ব্রেকিং অবাধে চলছিল মালগাড়ি থামিয়ে। কিছু গুন্ডা গোছের লোকজন এদের নেতৃত্বে ছিল। পাড়ার কেউই কোন প্রতিবাদ করতে সাহস করেনি কখনো। বেশি গোলমাল হলে বাড়ি থেকে বেরোতে দিত না। আমরা গেট এর সিঁড়িতেই হই হুল্লোড় করতাম। কিছু বাড়ি ছিল যেখানে আমাদের বয়সী যারা থাকতো—তারা খুবই প্রোটেক্টেড ছিল। তারা গাড়ি করে খেলতে যেতো, সাঁতার কাটতে যেতো দূরে কোথাও। বাবা মার সাথে। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে। অবশ্যই আমাদের তুলনাতে অনেক বেশি স্বচ্ছল ছিল তারা। একদিন ওই বাড়ির মাসীমা আমার মা কে বলেছিলেন, — আপনার ছেলেপুলেদের রিফিউজি ব্যারাক এর ছেলেদের সাথে মিশতে দিচ্ছেন কেন? ওরা রিফিউজি, সিগারেট, বিড়ি, মদ সব খায়, ছেলেরা তো গোল্লায় যাবে! মা বাবা অফিস যেতেন। তাই আমরা বিন্দাস ছিলাম— আমরা চার ভাই মিশে যেতাম সব রকম বন্ধুদের সাথে। আর ছিল ফুটবল, — সঙ্গে ছিল আমাদের ভুলো — যাকে একবার আদর না করতে পারলে মনে হতো দিনটা ঠিক কাটল না। রিফিউজি কথাটার মানে তখনো ঠিক বুঝতাম না। বাড়িতে কেউ বোঝাবার চেষ্টাও করেনি। ক্রমে ক্রমে ভুলোর রাতের চিৎকার বাড়ছিল। আমরা বুঝেছিলাম যে ওয়াগন ব্রেকার দের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তারা আমাদের এইচ্ ব্লকের ছাদটা ব্যবহার করছে রাতের বেলায় ভাগ বাঁটওয়ারা করবার জন্য। বড়দের মধ্যে কয়েকজন যে প্রতিবাদ করেনি তা নয়—কিন্তু যে কারণেই হোক তারা বিরত থেকেছেন — দু একবার ঝগড়াঝাঁটি হবার পর। পুলিশ মাঝে মাঝে পাড়াতে এসেছে আবার চলেও গেছে। আমাদেরও ছাদে যাওয়া বারণ হয়ে গিয়েছিল।
একদিন পাড়াতে পুলিশ আসে। একটা ভ্যান এ করে কিছু ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। বারান্দা থেকে দেখলাম আমাদের সাথে ফুটবল খেলত যে ছেলেটা— ব্যাঙ্গা, তাকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ও তো একটা পুঁচকে ছেলে—ওকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে? মা বলেছিলেন নিশ্চয়ই কিছু করেছে তাই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙ্গাদের অভাবের সংসার। পরে জেনেছিলাম যে কিছু পয়সার বিনিময়ে ওই ওয়াগন ব্রেকাররা ব্যাঙ্গা কে কাজে লাগাত ভুলো কে সরিয়ে রাখার জন্য। ভুলো ব্যাঙ্গা কে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তো আদর খাবার জন্য। আদরের কাঙ্গাল ছিল ভুলো।
পাড়াটা তারপর কিছুদিন শান্ত ছিল — আবার শুরু হোল তাণ্ডব। আমাদের ছাদটা একটা সেফ হেভেন হয়ে উঠলো ওয়াগন ব্রেকার দের। কেউ কিছু বলতে গেলেই ধমক খেতে হচ্ছে। ছাদ এর দরজায় তালা দিলেও -তা ভেঙ্গে দিচ্ছে। ছাদটা খুবই স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন ছিল। অনেকগুলো এন্ট্রি আর এক্সিট ৷
যাই হোক, সেদিন আমাদের ফুটবল ম্যাচ ছিল। বিকাশ এর টিম ভার্সেস ৯ নম্বর বাবুর টিম। সুবীরদা রেফারি। অনেক দর্শক। বক্রাকার মাঠে দুটো গোল পোস্ট একসঙ্গে দেখা যায় না। কিন্তু তাও কি উত্তেজনা। দাদারা কেরালা কাফের কিমা পরোটা অফার করছে গোল দেবার জন্য। তনুশ্রীদি ঘর থেকে খেলা দেখছে বলে সবার উত্তেজনা আর স্কিল দেখবার মতন। কে বেশি ইম্প্রেস করতে পারে। খেলা জমে উঠেছে। নো স্কোর ইন ফার্স্ট হাফ,সেকেন্ড হাফে দুটো গোল হোল। ১-১। পেনাল্টি শুট আউটে ৯ নম্বর বাবুর টিম জিতে গেল। গোল কিপার পৃথ্বীশ একটা দারুণ গোল বাঁচিয়েছে। হই চই ব্যাপার। ডাঙ্কুদা সবাইকে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাইয়েছিল মনে আছে। সবার জামা ভিজে গেছে। খালি গা। সবাই ভুলোর সাথে খেলছে। ভুলোও মহানন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। বাবা মা ডাকাডাকি করছে—সন্ধে হয়ে গেছে বাড়িতে এসো—পড়াশুনো কিছু নেই নাকি? পরের দিন ছুটি। তাই বাড়িতে যাবার তাগিদ বিশেষ নেই। সুবীরদার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে সবাই মিলে ভুলো কে বিস্কুট খাওয়ানো হোল। আস্তে আস্তে আমরা বাড়ি ফিরলাম। একটু আধটু বকুনির পর পড়াশুনার ভান করলাম। যাতে বাবা এলে দেখে আমরা পড়ছি। এত ক্লান্ত ছিলাম যে তাড়াতাড়ি শুয়েও পড়েছিলাম সেদিন।
পরের দিন রবিবার। বাড়িতে আজ অনেকদিন পরে পাঁঠার মাংস হবে শুনেছি। বায়না ধরেছিলাম আজ পড়াশুনো করব না। মা বলেছিলেন “কবে করছ পড়াশুনো? সব তো ডকে উঠেছে।”
হঠাৎ কালা বাপি দৌড়তে দৌড়তে এসে অঙ্গভঙ্গি করে বলল—ভুলো কে পাওয়া যাচ্ছে না। শোরগোল পরে গেল—সব বন্ধুরা একে একে জানতে পেরে নিচে জড়ো হোল। অনেক খোঁজ খবর নেওয়া হোল—কোথাও নেই। অনেক অভিভাবকরা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল ‘আপদ গেছে। আদিখ্যেতা! সারাক্ষণ ওই রাস্তার কুকুরটার গায়ে হাত দিচ্ছে। কি না কি রোগ আছে কে জানে? ইত্যাদি।’ হঠাৎ বিকাশ এর চিৎকার “ভুলো এখানে, ভুলো এখানে—রেল লাইন এর ধারে।” আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম রেল লাইন এ যাবার বারণ উপেক্ষা করে। ভুলো কে দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। একি? ভুলোর চারটে হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। রেল এ কাটা পড়েছে। চোখ দুটো খোলা। যেন করুণ ভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কালা বাপি ভুলো কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে মাঠে এনে রাখলো। আমাদের সবার তখন একটাই প্রশ্ন—কারা করল এটা? জানতে দেরি হোল না, যে ওয়াগন ব্রেকারদের অসুবিধা হচ্ছিল—তাই ওকে চার পা বেঁধে রেল লাইন এ ফেলে দিয়ে গেছে।
সেদিন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা সি. আই. টি বিল্ডিং | আমরা সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছিলাম ওর সৎকার আমরাই করবো। তারপর ওর হাত পার বাঁধন খুলে দিয়ে, একটা বাঁশের ছোট্ট শয্যা বানিয়ে, ফুল টুল দিয়ে মিছিল করে নিয়ে গেছিলাম একটু দূরে—যেখানে মাটি খুঁড়ে আমরা শুইয়ে দিয়েছিলাম আমাদের ভালবাসার ভুলো কে। সেদিন আমরা কোন মা বাবার ভ্রুকুটি ডাকাডাকি শুনিনি। সব বাড়ির বারান্দা থেকে বড়রা দেখেছিল সেই মিছিল—“ভুলো”র অন্তিম যাত্রা।
এই ঘটনার পরবর্তী পর্যায়ে পাড়ার দুর্গাপূজার ম্যাগাজিনে “ভুলোর কলাম” এ অনেক ছবি, লেখা, ড্রইং ইত্যাদিতে ভরে গেছিল। ছোট বড় সবার লেখা ছিল তাতে। সব থেকে যা তাৎপর্যপূর্ণ —যে আমাদের পাড়ার কিছু দাদারা এবং পরিবর্তন ক্লাব এর কিছু সদস্যরা মিলে একটা নাইট ভিজিলেন্স স্কোয়াড তৈরি করে—এই সব ওয়াগন ব্রেকারদের থেকে বাঁচবে বলে।
আমরা দেখেছিলাম সেই আমাদের পুঁচকে বন্ধু ব্যাঙ্গা — যাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল কিছুদিন আগেই… সেও আছে এই স্কোয়াড এ। ও এত ছোট হলে কি হবে,— ও যে অনেক বড়দের চেয়েও বড় তা ও প্রমাণ করে দিয়েছিল এই মর্মান্তিক ঘটনার পর। ভুলো কে যে ও খুউব ভালবাসতো…
আজও ‘ভুলো’ কে ভুলতে পারিনি আমরা…
****************************************************
দেবাশিস চক্রবর্তী পরিচিতি:
জন্ম কলকাতায় ১৯৫৭ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর। বাবা মনীন্দ্র চক্রবর্তী,আর মা কমলা চক্রবর্তী। হিন্দু স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও B.E. College (এখন IIEST) শিবপুর থেকে মেকানিকাল ইনজিনিয়ারিং এ ডিগ্রি। প্রথমে বিভিন্ন সংস্থায় চাকরী করার পর ১৯৮৫ সালে DRDO তে বৈজ্ঞানিক পদে যোগদান করেন এবং কর্মস্থল হয় NSTL (Naval Science & Technological Laboratory, DRDO), Vizag. NSTL এ থাকাকালীন ওনার সৌভাগ্য হয়েছিল Dr. APJ Abdul Kalam এর leadership এ কাজ করার। এটা ওনার জীবনের একটা বিরাট প্রাপ্তি। দেবাশিস বাবু DRDO কর্ম জীবনের শেষ তিন বছর আগ্রা তে ADRDE, DRDO তে Director পদে ছিলেন। DRDO থেকে অবসর গ্রহণের পর Aerospace Department, IIT Kanpur এ Adjunct Professor ছিলেন। নিম্নলিখিত জাতীয় পুরস্কার গুলি অর্জন করবার সৌভাগ্য হয়েছে …
DRDO Technology award from Dr APJ Abdul Kalam, Chairman & Secretary DRDO in 1986
Agni Award for Self Reliance on technologies for light weight torpedoes as member from Prime Minister 2003, Govt Of India
DRDO Scientist Of The Year 2011 from Raksha Mantri, Govt of India
বিশেষ আগ্রহ এবং অনুরাগ – খেলাধুলা ,গান বাজনা, আবৃত্তি ও সাহিত্য চর্চা।