আগন্তুক
নাজির হোসেন বিশ্বাস
“কে বাবা তুমি, চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে খুব কষ্টে রয়েছো?” কোন কথা না বলে শুধু একবার চেয়ে দেখলো আগন্তুককে। বাপের বয়সী’ই হবে। তিনি খেয়াল করলেন, ছেলেটির চোখ ছলছল করছে, এক টোকাতেই যেন বৃষ্টির ফোঁটা ঝরঝর করে ঝরে পড়বে। আগন্তুক পাশে বসে, পিঠে হাত রাখতেই গ্রীষ্মের শুকিয়ে যাওয়া লতায় বৃষ্টির ছোঁয়া পাওয়ার মতো যেন স্নেহের পরশ লাগলো, সেই স্নেহের ছোঁয়ায় হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো চব্বিশ পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক। আগন্তুক ভদ্রলোক পিঠে থাবা দিয়ে বলতে থাকেন, কাঁদিস না বাবা, কি হয়েছে বল আমাকে। জানিস না,“বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়।“ আগন্তুকের কথায় যেন ছেলেটি কোন আপনজনের সান্নিধ্য পেল। নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে,”আব্বু এই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন দু’সপ্তাহ থেকে। “ভদ্রলোক মুখে দুঃখসূচক শব্দ করে বলে উঠলেন,”তোমার নাম কি বাবা? বাড়ি কোথায়?”
কাঁদোকাঁদো স্বরে,”ইসলাম, বাংলাদেশ।”
বাংলাদেশ নাম শুনেই আগন্তুকের বুকটা চিনচিন করে উঠলো কি? কোথাও কি শেকড়ের টান অনুভব করলেন? মুখে বললেন,”বাংলাদেশ? আহারে, কি হয়েছে তোমার আব্বুর?”
“বুকের সমস্যা। হয়তো আব্বুকে আর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবো না।”
“কেন? ঈশ্বরের ‘পরে ভরসা রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। “আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে,”উনি সব দেখছেন।”
“জানি না কাকাবাবু, ভাগ্যে কি রয়েছে। মাকে রোজ মিথ্যে সান্ত্বনা দেওয়া কত যে কষ্টের, তখন বুকটা নদীর পাড়ের মতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে। ভীষণ অসহায় মনে হয় নিজেকে।”
“কেমন আছেন? ডক্টর কি বলছেন?”
“পরীক্ষা করতে দিচ্ছেন, ওষুধ পাল্টে দিচ্ছেন কিন্তু ক্রমশ অবনতির দিকেই যাচ্ছে।”
“যাই তোমার আব্বুকে একবার দেখে আসি। হাজার হলেও শেকড়ের টান তো!”
“যাবেন কাকাবাবু? চলুন।”
লম্বা করিডোর ধরে যেতে যেতে মইদুল বললো,”শেকড়ের টান বললেন কেন?”
আগন্তুক মুচকি হেসে বলে উঠলেন,”তোমার মতো আমারও জন্মভিটে যে বাংলাদেশ।”
পরম উৎসাহে,”জানেন কাকাবাবু? আব্বু কিন্তু আপনার সমবয়সী হবেন। আব্বু খুব ভালো ফুটবল খেলতেন ছোট বেলায়। শরীর খুব ফিট ছিলো কিন্তু কিসে থেকে যে কি হয়ে গেল…!”
ঔষধের ঝাঁঝালো গন্ধ আর রোগীর আত্মীয় স্বজনের ছোঁয়া বাঁচিয়ে ওরা পৌঁছে গেল ১০২ নং বেডে।
মইদুল তাঁর আব্বুর গায়ে হাত দিতেই জেগে উঠে,”তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিবি মইদুল, খুব ইচ্ছে করছে। আর যদি কথা বলার সুযোগ না পাই?”
“তোমাকে একজন দেখতে এসেছেন।”
“দেখতে? কে এসেছেন?” বলেই পাশ ফিরলেন।
“আমি এসেছি, কেমন আছেন? কষ্ট কিসের?”
আগন্তুকের হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে, কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন, তারপরেই ম্লান হেসে,”ভদা না তুই?”
রোগীর মুখে ভদা নামটা শুনেই আগন্তুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠলো। এই নামে তো একজনই ডাকতো, সইদুল। আমি যাকে সদা ডাকতাম। মুখে বললেন,”আপনি আমাকে চেনেন?”
“আমি তোর সদা। একসঙ্গে ফুটবল খেলতাম। মনে পড়ছে?” ঠোঁটের কোণায় চিকচিক করে উঠলো এক ঝলক হাসি।
উৎফুল্ল হয়ে,”সদা? তুই গোল কিপার, আমি স্ট্রাইকার? উড়োখই ক্লাব?”
দুজনের হাত দুজনের মুঠোই তখন একটু উষ্ণতার সন্ধানে আঙ্গুলে আঙ্গুলে জড়াজড়ি করছে। কত স্মৃতি, সব যেন ছায়াছবির মতো শৈবাল মানে ভদার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
এসো এসো। সইদুল মাকে বলো, শৈবালকে নাস্তা দিতে, বলো শৈবাল পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“আমি আপনার কাছে পড়তে চাই। গণিতটা মাথায় ঢুকছে না।”
“ভাবছো কেন? সইদুলকে তো পড়াই, তুমিও আসবে। দু’ভাই এক সঙ্গে পড়বে।”
কথার মাঝেই থালা সাজানো নাস্তা দেখে,”এত খাবার এই অবেলায়?” কাকিমা আমি কিচ্ছু খাবো না,”বলেই একটা মতিচুরের লাড্ডু হাতে তুলে নিল শৈবাল। সেই শুরু দুটি পরিবারের একসঙ্গে চলাফেরা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান,পালা পার্বণে একে অপরের বাড়িতে খাওয়া থাকা যেন নিয়ম হয়ে উঠলো। দুই বন্ধু মিলে পুকুরে সাঁতার কাঁটা, ঘুড়ি ওড়ানো থেকে ফুটবল খেলা। উড়োখই ক্লাবের নির্ভরযোগ্য দুই খেলোয়াড়। ওদের দুজনকে ছাড়া ফুটবল টিম যে অকল্পনীয়।
দুই বন্ধুর কৈশোর যেন রঙিন প্রজাপতির মতো ফিনফিনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগলো। কে যে কখন কার বাড়িতে খায়, কার বাড়িতে ঘুমায়। যেন দুই সহদোর ভাই, যাকে বলে নাড়ির টান। তেমন করেই দিন মাস বছর কাটতে থাকে। সেবার ফুলমনি হাইস্কুল পাশ করে সবে কলেজে ভর্তি হলো দুই বন্ধু। শুরু হলো কলেজ জীবন। নদীর মতো মসৃণ ভাবে এগিয়ে চলেছে জীবন, চোখে কত স্বপ্ন, কত আশা বাসা বুনছে। কিন্তু ঐ যে “কাহারো দিন সমান নাহি যায়।“ কিসে থেকে কি যে হয়ে গেল। সবার চোখে মুখে একটা আতঙ্ক। পরস্পরকে অবিশ্বাস, আর শত্রুতার নাগপাশে চেপে ধরলো। চারিদিকে দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠলো। সব মানুষ ছিন্নমূল হয়ে গেলো। পিঁপড়ের মতো লাইন দিয়ে চলেছে মানুষ, যাঁর নতুন নাম মানুষ নয়, উদ্বাস্তু।
“সুরেশ দিনকাল ভালো নয়, বাইরে খুব একটা যাবি না। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবি। তুই আমার আর একটি ভাইয়ের মতো। বুক দিয়ে তোকে আগলে রাখবো। এই রহমত থাকতে তোর কোন ভয় নেই সুরেশ। “সূর্যকে সাক্ষী রেখে, পিঠ চাপড়ে সাহস দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন।
সবে সূর্য উঠছে ভোরের আকাশ রাঙিয়ে। ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। সইদুল ফুটবল হাতে করে গুটিগুটি পায়ে চলেছে শৈবালকে ডাকতে। গিয়েই দেখে ঘরের দাওয়ায় পোটলা পুটলি বাঁধার কাজ চলছে জোর কদমে। বিদেশ বিভুঁইয়ে কোনটা কখন কাজে লাগে…!
সইদুল ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এসে,”আব্বু আব্বু, কাকাবাবুরাও দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, আমার ভাই ভদা চলে যাচ্ছে আব্বু। আমি কি করে থাকবো?” বলেই কাঁদতে লাগলো।
“যাচ্ছে মানে? ওদের তো আমি যেতে দেব না,”সইদুলের আব্বু আম্মু ছুটে গিয়ে,”কি ব্যাপার সুরেশ তোমরা কোথায় যাচ্ছো? আমি কাকে নিয়ে থাকবো? সইদুল শৈবালরা একে অপরকে ছেড়ে যে থাকেনি কোনদিন? তুমি একবার ওদের কথা ভাবছো না?”
“মাস্টারদা, আমরা চলেই যাই।” কথাটা বলতেই সুরেশ বাবুর চোখ ফেটে জল ঝরতে লাগলো। ফ্যালফ্যাল করে দেখতে লাগলেন, হাতে গড়া বাড়ি, বাগান, পুকুর সব। গোয়ালে বাঁধা দুধের গরুটা দেখিয়ে,”মাস্টারদা গরুটা নিয়ে যাও তোমার বাড়িতে। সইদুলরা দুধ খাবে। “জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন দুজনেই। সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে যাচ্ছে শৈবালরা।
সইদুল আর শৈবাল জড়াজড়ি করতে থাকে, তোকে যেতে দেব না আমি। এই মাটিতে তুই জন্মেছিস, জন্মভূমি যে মায়ের মতো, তাঁকে ফেলে কোথায় যাবি ভদা। চিৎকার করে দুই ভাইয়ে কান্না জুড়ে দেয়। সেই কান্না ঘূর্ণিপাক খেয়ে খেয়ে আকাশ বাতাস দ্রবীভূত করে তুললো।
সুরেশ বাবু বলে উঠলেন, আজ দেশের মাটি ছেড়ে জন্মভূমির আঁচল ছেড়ে ছিন্নমূল হয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে মাস্টারদা। বলেই নীচু হয়ে এক মুঠো মাটি তুলে চুম্বন করে, সেই মাটি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন দুই বন্ধু রহমত আর সুরেশ। অন্যদিকে সইদুল আর শৈবাল গলা ধরে কেঁদে উঠলো আকাশ কাঁপিয়ে।
ডুমুর গাছের নীচ দিয়ে, বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে, শালী ধানের জমির গা ছুঁয়ে শৈবালরা শেষ বারের মতো পেছন ফিরে দেখে নিল স্বজনদের, শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট বুকের মধ্যে গোপন করে রেল লাইনকে পেছনে ফেলে এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল।
শৈবাল বন্ধুর জন্য কেঁদে কেঁদে কত রাত যে ঘুমায়নি। তারপর কেটে গেছে কত বছর। পদ্মা গঙ্গার বুক দিয়ে বয়ে গেছে কত বিরহ বেদনা। স্মৃতির আয়নায় ধুলো জমে হয়েছে বিবর্ণ। হারিয়ে গেছে জড়াজড়ি করে থাকার সেই সুখস্মৃতি।
সেই বন্ধুর সঙ্গে আজ ১০২ নং বেডে দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর দেখা হয়ে গেল। এটাও কি ঈশ্বরের মহিমা? হিন্দু মুসলিম,জাতপাত সরিয়ে বিনিসুতোয় মালা গাঁথার গোপন ইঙ্গিত?
তখনও সইদুলের হাতে ধরা শৈবালের হাত। একটু ঝাঁকানি দিতেই শৈবালের চোখের জল ঝরঝর করে ঝরে পড়লো।
“কিরে শৈবাল কাঁদছিস কেন? দেখ না আমার চোখে একটুও জল নেই। “দুই বন্ধু ডুকরে কেঁদে উঠলো। শৈবাল কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো, খুব মনে পড়ছে রে দেশের কথা। তুই আমি তো একাত্মা ছিলাম। যেন একই মায়ের দুই সন্তান। নজরুলের কবিতাটার কথা মনে পড়ছে,“একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।“ না হলে এতগুলো বছর পরে আবার আমাদের সাক্ষাৎ ঘটলো কেন?”
“মনে রেখেছিস শৈবাল, দুজনে মিলে কত কেঁদেছিলাম বল? কত রাত ঘুমাতে পারিনি। সেই সোনাঝরা দিনের কথা কেউ কি ভুলতে পারে? কিন্তু তুই এখানে কিভাবে এলি? কি করে খুঁজে পেলি?”
“বলিস কেন? শেকড়ের টান কেউ কখনও অস্বীকার করতে পারে? নইলে তোর ছেলের সঙ্গে দেখা হবে কেন? আর তোর কাছেই বা আসবো কেন? সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছা।”
আজ আমি পরম সুখী রে শৈবাল। শুয়ে শুয়ে খুব তোর কথা মনে পড়ছিলো, ভাবছিলাম একবার যদি তোর সঙ্গে দেখা হতো। আর দেখ কি কপাল ওপরওয়ালা বোধ হয় মনের কথাটা শুনতে পেয়ে তোকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবার মরেও আমার শান্তিরে।”
“একদম মরণের কথা বলবি না, আমি আছি তো? তোকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে, ফুটবল খেলবি না, সাইড লাইনের ধারে হাজার হাজার দর্শক যে আজও চিৎকার করছে, গোওওওওল…!”
“দেখি একটু সরে দাঁড়ান, রুগী দেখতে দিন। ডক্টরকে দেখে সবাই জায়গা করে দিলেন।” দু’মিনিট ডক্টর দেখেই চোখের ভ্রূ নাচিয়ে বলে উঠলেন,”একেই বলে মিরাকল। সিস্টার রুগীতো একদম ফিট। ইনার ছুটি করে দিন। “রোগীর উদ্দেশ্যে বললেন,”আবার ফুটবল খেলবেন, কোন ভয় নেই। বাড়ি ফিরে যান।” ডক্টর চলে যেতেই, মইদুল বলে উঠলো ,”আপনার স্পর্শ পেয়েই আব্বু সেরে উঠলেন। আপনি নিশ্চয়ই দেবদূত আছেন কাকাবাবু।”
গাছের ডালে পাখিগুলো আজ যেন একটু বেশিই ডাকাডাকি করছে। সইদুলের মনটাও ভীষণ্ ফুরফুরে। আজ দেশে ফিরে যাবেন, আপন মানুষদের আবার কাছে পাবেন। “মইদুল তোর কাকাবাবু কখন আসবে?”
“এই তো আমি চলে এসেছি, সইদুল চল বেরিয়ে পড়ি। নাহলে রোদ হয়ে যাবে। তোকে স্টীমারে তুলে দিয়ে আসি…!”
সইদুল ছেলের হাত ধরে স্টীমারে উঠতে যায়, এমন সময় শৈবাল বলে উঠলো, সদা এই প্যাকেটে ভারতের মাটি রয়েছে, এই মাটিতে বাংলাদেশের মাটি মিশিয়ে একটা গাছ লাগাস। দুই দেশের মাটিতে বেড়ে উঠবে সূর্যের দিকে মাথা উঁচু করে। সেই গাছই হোক তোর আমার ভালোবাসার প্রতীক, রচিত হোক মহামিলনের ঐকতান।
সইদুলের স্টীমার পদ্মার বুকে ঢেউ তুলে তুলে দূরে বহুদূরে চোখের বাইরে চলে গেল….!
আর শৈবাল অশ্রুসিক্ত নয়নে বন্ধুর চলে যাওয়া পথের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন।
আবার কি ওদের দেখা হবে !!
*******************************************************
নাজির হোসেন বিশ্বাস পরিচিতিঃ
নাজির হোসেন বিশ্বাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। পেশায় রাজ্য সরকারের স্কীম, স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পের, প্রকল্প সহায়ক। লেখালেখি সেই স্কুল জীবন থেকে। পত্রপত্রিকায় কিছু কবিতা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ভালো গল্প কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক।