রায়পুর জমিদারবাড়ি
পরাগ ভূষণ ঘোষ
মনুষ্য ধর্ম বিশেষত আমাদের মতো সাধারণ বাঙালী হঠাৎ কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে যখন দিশাহীন অবস্থায় হাবুডুবু খান, সেই সময়েই ত্রাণকর্তা রূপে গুরুদেব, শান্তিনিকেতন, বোলপুরকে আঁকড়ে ধরে পরিত্রাণ পাওয়ার চিরাচরিত প্রথা আমিও অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম। বন্ধুবর ব্যানার্জীমশাইয়ের অনুরোধকে (যেটাকে আমি আদেশ বলেই মেনে নিয়েছি) উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা আমার নেই।
বীরভূমের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে চলে আসে লালমাটি, মাদল, ধামসা, বিশ্বকবি, শান্তিনিকেতন, দশমহাবিদ্যা, একান্ন পিঠ, সোনাঝুড়ি হাট ইত্যাদি। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর এবং ক্রমবর্ধমান। কিন্তু, না জানা বা স্বল্প জানা ইতিহাসের পাতাও ছড়িয়ে আছে এই জেলায়। সেরকমই একটি গ্রামের নাম রাইপুর বা রায়পুর। ভৌগলিক ভাবে বোলপুর স্টেশন থেকে ইলামবাজার যেতে সাত আট কিমি দূরে এই গ্রাম। অপরপক্ষে ইলামবাজার থেকে চোদ্দ পনেরো কিমি। রায়পুর-সুপুর গ্রাম পঞ্চায়েত, বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লক, বোলপুর সাব ডিভিশন।এখানে একটি জমিদার বাড়ি আছে, যেটা স্থানীয় জনসাধারণের কাছে রাজবাড়ী নামে বহুল পরিচিত। ভগ্নদশা, কঙ্কালসার এই জমিদার বাড়ি ইতিহাসের সাক্ষী রূপে ভূতুড়ে আকার নিয়ে দন্ডায়মান। একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে এই অঞ্চলে কালের বিবর্তনে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে,এই জমিদার বাড়ি বা রাজবাড়ী তার ভরকেন্দ্র। গ্রামের নামকরণ নিয়েও ভিন্ন মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। একটি মত অনুযায়ী অজয় নদের তীরে আদমপুর নামে একটি গ্রাম ছিল এবং যার জমিদার ছিলেন রায়চৌধুরী পরিবার। নদের বন্যা এবং ভাঙনের ফলে গ্রামবাসীরা তুলনামূলক নিরাপদ এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এই জমিদার পরিবার মূলত ছিলেন দত্তচৌধুরী। নতুন এলাকায় এসে জমিদার পরিবার গোপীনাথ ও রাধারাণীর মন্দির স্থাপন করেন যেটি আজও বর্তমান। জিতানাথ দত্ত ছিলেন এই পরিবারের সন্তান। ১৭৪০ সালে মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দী খাঁর দশ হাজার সেনার সেনাপতি পদে ইনি নিযুক্ত হন। সেই সময়ে বাংলায় ভয়ংকর বর্গীর আক্রমণ ঘটে। জিতানাথ তার দশ হাজার সেনা নিয়ে অজয় নদের তীরে সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন। পুরস্কার স্বরূপ আলীবর্দী তার সেনাপতি জিতানাথ দত্তচৌধুরী কে “রায়চৌধুরী” উপাধি দেন। এই উপাধি থেকেই আদমপুর গ্রামটি রায়পুর নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় মত অনুসারে লালচাঁদ সিংহের কোনও এক উত্তরপুরুষ বিশ্বম্ভর সিংহ বর্ধমানের রাজার কাছ থেকে “রায়” উপাধি লাভ করেন। সে কারণেই এটিকে রায়পুর বলা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই লালচাঁদ সিংহ?
এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে সেদিকেই আলোকপাত করা মূল লক্ষ্য।
১৭৬৪ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে সিংহ পরিবারের আদি পুরুষ লালচাঁদ দে (মতান্তরে লালচাঁদ সিংহ) অজয় নদের তীরে আদমপুরে আসেন বাণিজ্যিক কারণে। তিনি এক সহস্র বা এক হাজার তন্তুবায় পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে আসেন মূলতঃ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে পাটের কাপড়ের ব্যবসার উদ্দেশ্য সাধনে। এই তন্তুবায় পরিবারগুলোর দ্বারা বীরভূমের মির্জাপুর, সুরুল, সিয়ান, চন্দনপুর, রাইপুর, সুখবাজার প্রভৃতি এলাকার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতে শুরু করে। সেই সময়ে আদমপুরের চৌধুরী জমিদার বংশ অবনতির পথে। বলা যেতে পারে জমিদার বংশ পড়ন্ত বিকেলের আঙিনায়। কল্পনার জালে ধরা পড়ে তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার জলসাঘরের বিশ্বম্ভর দত্তকে। ইতিমধ্যেই লালচাঁদ বাণিজ্যে বেশ কিছু অর্থ লাভ করেন। সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ তিনি ১৭৭০ সালে চৌধুরীদের জমিদারি ক্রয় করেন এবং স্থানীয় জমিদার রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই সময়েই ১৭৭০ থেকে ১৭৭৪ এর মধ্যে তিনি ৬০ বিঘা জমির উপর প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার মধ্যে ১২০টি ঘর ছিল। লালচাঁদের তিন পুত্র পঞ্চানন, রামকিশোর ও শ্যামকিশোর। পিতা লালচাঁদ তার প্রাসাদ যেরকম তিন মহল্লা বিশিষ্ট করেন তিন পুত্রের জন্য, তেমনই কাজের দায়িত্বও বন্টন করেন। এক পুত্র চাষবাস, একপুত্র জমিদারি ও অবশিষ্ট জন ব্যবসায় নিযুক্ত। কনিষ্ঠ পুত্র শ্যামকিশোর ১৮০০ সালে জন চীপ এর অধীনে মাসিক কুড়ি টাকায় দেওয়ান নিযুক্ত হন। চীপ সাহেবের মোটা থান কাপড়ের ব্যবসা ছিল, যেগুলো প্রধানত নৌকো এবং জাহাজের মাস্তুল রূপে ব্যবহৃত হতো। ইউরোপের বাজারে এই কাপড়ের খুব চাহিদা ছিল সেই আমলে। শ্যামকিশোর খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মেদিনীপুর থেকে আগত সেই তন্তুবায় পরিবারের উৎপাদিত কাপড় চীপ সাহেবকে যোগান দিতে থাকলেন। ফলতঃ অচিরেই প্রচুর অর্থাগম হয়।
ইনি অর্থাৎ শ্যামকিশোর,পরবর্তীকালে রাজনগর রাজার কাছ থেকে বেশ কিছু মৌজা ক্রয় করেন, যেগুলোর নামাকরণের মধ্যে তার বা তার উত্তরসূরীর উপস্থিতি বিদ্যমান। যেমন,বর্তমান শ্যামবাটি, তার নামানুসারে, বর্তমান বোলপুর শহরের পৌষমেলা চত্বরের নাম ভুবনডাঙ্গা যেটি তার তৃতীয় পুত্র ভুবনমোহনের নামানুসারে। শ্যামকিশোরের চার পুত্র –জগমোহন, ব্রজমোহন, ভুবনমোহন ও মনমোহন। জগমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশ্বম্ভর অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, তেজস্বী ও সপ্রতিভ পুরুষ ছিলেন। তিনি বর্ধমানের মহারাজা তিলকরাজের দেওয়ান ছিলেন। মহারাজা তাকে “রায়” উপাধি দেন। কথিত আছে এই রায় উপাধি থেকেই ঐ স্থানের নাম রায়পুর হয়। তবে এই প্রতিবেদকের নিকট প্রথম মতবাদকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। এই সিংহ পরিবার যে সময়ে বিশাল প্রসাদটি নির্মাণ করে মোটামুটিভাবে সেই সময়েই পরিবারটি তিনটি পৃথক ভাগে বিভক্ত হয়ে তিনটি পৃথক জায়গায় জমিদারবাড়ি তৈরী করে যেগুলো মূলতঃ রাজবাড়ি নামে জনশ্রুত ও চিহ্নিত। প্রথম শাখা স্বাভাবিক ভাবেই এই রায়পুর জমিদার বাড়ি। অপর দুটি হলো মুর্শিদাবাদের কান্দি রাজবাড়ী ও পূর্ব বর্ধমানের জাজিগ্রাম রাজবাড়ী। কান্দি রাজবাড়ির কাত্যায়নী নাম্নী এক রানী জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছ থেকে পাইকপাড়া রাজবাড়ী ও বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ী ক্রয় করেছিলেন। সুতরাং বলা বাহুল্য কান্দি রাজবাড়ী ও পাইকপাড়া রাজবাড়ী অভিন্ন। বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে একটি নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্কালঙ্কারের “রত্নাবলী”,মধুসূদনের “শর্মিষ্ঠা” মঞ্চস্থ হয়। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে এই পরিবারের নিবিড় যোগাযোগ ছিল ও বাংলার নবজাগরণে পরিবারের সক্রিয়তা লক্ষণীয়। কান্দি রাজ পরিবারের বিমল চন্দ্র সিংহ ছিলেন বিধান চন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভার ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী। পরিবারের কৃতীদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অতীশ চন্দ্র সিংহ, যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়ও পরবর্তীতে লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব করেন। ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহও এই পরিবার থেকে এসেছেন। ইনি ২০১০ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন।
ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে।
রাজায় রাজায় বা জমিদার জমিদারে যেমন বৈরীতা থাকে তেমনই মিত্রতাও তৈরী হয়, যেমনটি জোড়াসাঁকোর জমিদার বাড়ির সঙ্গে রায়পুর জমিদার বাড়ির বন্ধুত্বর বেড়াজাল ডিঙিয়ে সখ্যতা পেরিয়ে মিত্রতায় পৌঁছতে বেশী সময় লাগে নি। সেই বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে সিনহা পরিবারের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার রায়পুর জমিদার বাড়িতে আসেন। যদিও পরবর্তীতে ১৮৫৫ থেকে ১৮৮৬ মহর্ষির নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঐ প্রাসাদদোপম জমিদার বাড়িতে। দেবেন্দ্রনাথের জন্য চার তলায় একটি আলাদা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল। তিনি মাঝে মাঝে সেখানে আসতেন, বিশ্রাম, উপাসনা ও ব্রাহ্ম সমাজের আলোচনা করতেন। বলা যেতে পারে কলকাতার বাইরে ব্রাহ্ম উপাসনার পীঠস্থান হয়ে উঠে এই প্রাসাদ শুধুমাত্র দেবেন্দ্রনাথের অগ্রণী ভূমিকার মাধ্যমে। প্রথম দিন তিনি যখন পালকি চড়ে রায়পুর আসছিলেন, একটি নির্জন, নিরিবিলি, ছাতিম গাছের ছায়া সম্বলিত জায়গায় বাহকেরা বিশ্রামের নিমিত্ত থামে। উনি নেমে আসেন পালকি থেকে। এই নির্জন, শান্ত পরিবেশটি একনজরে ওনার ভালো লেগে যায়। মনে মনে স্থির করেন উপাসনার আদর্শ স্থান এর থেকে আর ভালো হতে পারে না। এতো শান্তি! মনে সত্যিই প্রশান্তি আনে। এখানে একটি উপাসনালয় ও অতিথিশালা করলে কেমন হয়? সে আমলে রায়পুর জমিদার ছিলেন তার অনুজ বন্ধু ভুবনমোহন সিংহ ওরফে সিনহা। প্রাসাদে পৌঁছে বিশ্রামপর্ব সাঙ্গ করে তার মানবাঞ্ছা জমিদারকে জানান। জমিদার ওনাকে সেই জমির সঙ্গে আরও কিছু অনুর্বর জমিসহ সর্বমোট কুড়ি বিঘা জমি অত্যন্ত খুশি হয়ে দান করে দিতে চাইলেন। কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের শরীরে রাজরক্ত প্রবাহিত। তারা দান করেন, দান গ্রহণ করেন না। পরিশেষে সেই কুড়ি বিঘা জমি পাঁচ টাকায় ক্রয় করেন। অতিথিশালা ও উপসনাস্থল নির্মাণ করা হলো। সকলের জন্য উৎসর্গ করা হলো এই শান্তির নিকেতন বা শান্তিনিকেতন। সেটিই ছিলো আজকের বিশ্বভারতীর মূলমন্ত্র বা বীজমন্ত্র।
রবি তার ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে বার কয়েক এসেছেন। তারও জায়গাটি বেশ ভালো লেগে যায়। যখন রবি ঠাকুর তাদের জমিদারি দেখাশোনা করতেন তখন মাঝেমধ্যে এই স্থলে এসে মানসিক চঞ্চলতা থেকে মুক্তি পেতেন। ততদিনে দুই জমিদার পরিবারের বন্ধুত্ব গভীর, গাঢ় , নিবিড় হয়েছে। অবশ্য শান্তিনিকেতনের বপু বৃদ্ধি পায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সক্রিয়তায়। গুরুদেবের সঙ্গে পরবর্তী জমিদার প্রতাপ নারায়ণ সিনহার সম্পর্ক ছিলো গভীর ও হৃদ্যতাপূর্ণ। জমিদার প্রতাপ নারায়ণ আরও কুড়ি বিঘা জমি, আম্রকুঞ্জ, ইত্যাদি কুড়ি টাকার বিনিময়ে গুরুদেবের হাতে তুলে দেন। কবি তার পিতার পছন্দের স্থানকে লেখাপড়ার চর্চা কেন্দ্র তৈরী করার প্রস্তুতি নেন। শান্ত, নির্মল মুক্ত পরিবেশে ভিন্ন আচারে, এই শিক্ষাকেন্দ্রটি সবার মাঝে যেন দৃষ্টান্ত তৈরী করে। শুরু করলেন মহাবিদ্যালয় বা কলেজ স্থাপনের প্রস্তুতি। যথা সময়ে তার নামকরণ করেন রবি ঠাকুর। বিশ্বের দরবারে ভারতের মিশ্রণ, এই ভাবনাকে ফলপ্রসূ করে নাম রাখেন বিশ্বভারতী। কলেজ উদ্বোধন হয় ১৯০১ সালের ২২ শে ডিসেম্বর বাংলা ক্যালেন্ডার মতে ৭ই পৌষ ১৩০৮, রবিবার। তারপর থেকে বিশ্বভারতীর জন্ম লগ্নকে স্মরণ করে ভুবনডাঙা ময়দানে বিশাল মেলা সংঘটিত হয়, যেটা সকলের কাছে পৌষ মেলা নামে পরিচিত। পাঠককুলের মনের অন্তস্থলে একটি জিজ্ঞাস্য উঁকি মারতে পারে, কেন বিশ্বভারতী ৭ই পৌষ উদ্বোধন হলো? কেন সেটা ৫, ৬, ৮ তারিখ নয়। উত্তরটিও অতি সরল। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ৭ই পৌষ। সেই তারিখকে সম্মান জানাতে পুত্র রবি ঐ তারিখটিকেই বেছে নেন। কালের আবর্তনে এই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।
ফিরে আশা যাক রায়পুর জমিদার বাড়িতে।
আড়াইশো বছরেরও অধিক পুরোনো এই পরিবারের উপর মা সরস্বতীর অসীম কৃপা লক্ষ্য করা যায়। এই জমিদার পরিবারের সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। যে বৎসর মহর্ষি শান্তিনিকেতনের পরিকল্পনায় জমি নেন জমিদার ভুবনমোহনের কাছ থেকে সেই বছরেই বীরভুমের গৌরব সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬৩ সালের ২৪ শে মার্চ জমিদার বাড়ির অন্যতম সদস্য সিতিকণ্ঠ সিনহার এই কৃতী পুত্রের জন্ম রায়পুর জমিদার বাড়িতেই, পরবর্তী জীবনে যিনি লর্ড এস.পি.সিনহা নামে অধিক পরিচিত ও সমাদৃত। তিনি ১৮৭৭ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন ও স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করেন। ১৮৮০-১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনে যান এবং লিঙ্কনস ইন (Lincoln’s Inn) নামক আইন কলেজে আইনের পাঠ শুরু করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সাফল্যের সঙ্গে আইন পাঠ শেষ করেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করে ব্যারিস্টার সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি সিটি কলেজে অধ্যাপনাও শুরু করতে থাকেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে একটি কঠিন মামলা লড়ে, এক ইউরোপীয়র বিরুদ্ধে জয় এনে দেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ভারত সরকারের স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলর নিযুক্ত হন। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ী পদে অ্যাডভোকেট জেনারেল হয়ে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ী হন। সে সময়ে তার আইন ব্যবসার ফি ছিল বছরে দশ হাজার পাউন্ড। স্বাভাবিক কারণেই তিনি তুলনামূলক অল্প আয়ের অ্যাডভোকেট জেনারেল পদটি নেওয়ার আগ্রহ দেখান নি। কিন্ত মহম্মদ আলী জিন্না এবং গোপালকৃষ্ণ গোখলের পরামর্শে ঐ পদ গ্রহণ করতে রাজি হন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বড়লাটের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় সদস্য হন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ১লা জানুয়ারি ইংরেজি বর্ষের প্রারম্ভে তাকে নাইট উপাধি প্রদান করা হয়। সেই বছরেই তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি War Conference এর সদস্য হয়ে বিলেত যান। স্বদেশে ফিরে সরকারের শাসন পরিষদের সদস্য রূপে কাজ শুরু করেন। বিশ্বযুদ্ধের শেষে Peace Conference এ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ যান। ঠিক তার পরে পরেই “লর্ড” উপাধিতে ভূষিত হয়ে সহকারী ভারত সচিব রূপে পার্লামেন্টে আসন গ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালটি তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ হাউস অফ লর্ডসে ভারতীয় হিসেবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রথম “ব্যারন সিনহা অফ রায়পুর” হন। মূলতঃ তার প্রচেষ্টাতেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে হাউস অফ লর্ডসে “গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট” পাশ হয়। দেশে ফিরে ১৯২০ সালে বিহার উড়িষ্যার প্রথম ভারতীয় গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯২৮ সালের ৪ ঠা মার্চ তিনি মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার নাম স্মরণ করে কলকাতার রবীন্দ্র সদন চত্বর, এক্সাইড মোড় অঞ্চলে লর্ড সিনহা রোড। বাণিজ্যিক স্তরেও এই ভগ্নদশা জমিদার বাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম। সৌমিত্র, সুমিত্রা অভিনীত দেবদাস ছবির কিছু অংশ এখানে ফ্রেমবন্দী হয়। মৃণাল সেন তার “খন্ডহর” ছবির দৃশ্যয়নে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত্য নাসিরউদ্দিন শাহ, শাবানা আজমিকে সঙ্গে নিয়ে শুট করেছেন। যদিও ছবিটি তার দশ বছর পর ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায়। রঞ্জিত মল্লিকের নবাব, দেবের চাঁদের পাহাড় (শুধু বক্সিং দৃশ্য), ভূতের ভবিষ্যৎ, যেখানে ভূতের ভয় ইত্যাদি বহু ছবি ক্যামেরাবন্দী হয়েছে। স্থানীয় যুবকদের একটি ক্লাব এই জমিদার বাড়ির ভগ্নাবশেষ রক্ষা করার তাগিদে বিভিন্ন স্তরে তদ্বির করছেন এবং নিজেরাও রক্ষণবেক্ষণের শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারী সহযোগিতা ব্যতিরেকে তার কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সন্দেহ থেকে যায়। আড়াইশ বছরের ইতিহাস আজ ধংসের মুখে। একা কঙ্কালসার অট্টালিকাটি ইতিহাসের সাক্ষী রূপে দাঁড়িয়ে আছে।
****************************************************
পরাগ ভূষণ ঘোষ পরিচিতি
আটান্ন বছর বয়সী পরাগ ভূষণ ঘোষ। পিতা ঈশ্বর নির্মল চন্দ্র ঘোষ। মাতা ঈশ্বর সাথী ঘোষ। জন্ম শহর শিলিগুড়ি, জেলা দার্জিলিং। বর্তমান নিবাস বহরমপুর। পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী। পিতা ছিলেন রাজ্য সরকারি কর্মচারী। ছোটবেলায় লক্ষ্য করতেন স্বর্গীয় পিতৃদেব ও স্বর্গীয়া মাতৃদেবী অবসর সময়ে সর্বদা বই পড়ায় নিজেদের লিপ্ত রাখতেন। যে কারণে কৈশোরবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। পরিবারে টুকটাক লেখালেখির প্রচলন ছিল যেটা আজও আছে।