ভোর পথ
শাশ্বতী হোসেন
শ্যামা যখন হাসান আলির বাগানে ফুল তুলতে যায়
মৌন ভোরবেলা
তখন গেরুয়া আলো মাখা বাগান সবে শিশিরের সাথে
ভোরের শিস একাত্ম হয়েছে।
হাসান আলির খুরপিতে বেজে উঠেছে মাটির একতারা
ফুলে ফুলে লেগে আছে নকশিমুখের বানজারা সুখ।
শ্যামার পুজোর থালায় আমপল্লব, সিঁদুরলেপা ঘট
তার নাকে হাসানের দেওয়া রুপোর পালক ঝোলানো নাকছাবি
চোখের মণিদুটি ভেজানো ভাষায় একা একা।
আঙুলে আঙুলে লেগে আছে ভীরু অধরের মধু।
রোজ ভোরে হাসান আলির বাগানের ফুলে
ভৈরবেশ্বরী মন্দিরে পুজো দেয় শ্যামা।
রোজ ভোরে শ্যামার পথ চেয়ে বাগান সাজায়
হাসান।
শ্যামাকে দেখিয়ে হাসান বলে,অই দ্যাখ,দেইখতে পাচ্ছিস?
লদীর চরে পাখিগুলা রঙচঙা ড্যানায় ভালোবাসার সাধ জ্যাগেছে–
অরা ভরা জলকে নাম্যেছে কেনে জানিস?
জানিস নাই?
দ্যাখ দ্যাখ,পানকৌড়ি জোড়টা এখুনি ডুবতে যাছে
অ শামা, চায়্যে দ্যাখ…
কিন্তু পানকৌড়ি দুটি নিযুত ডুবের আগেই
মন্দিরের পুরোহিত ওদের চুপিচুপি দেখে ফেলে
এমনভাবে মোড়লকে জানায়, যেন পুরোহিত নয়,
সি আই ডি গোয়েন্দা।
ঢোলের কাঠিতে হই হই করে জেগে উঠল
ঘুমন্ত গ্রাম। ভালোবাসারও ভয় থাকে।
লজ্জা থাকে।
সমাহিত অশ্রুধারায় ঘন অরণ্যে বৃষ্টি পড়ে
সালিশী সভা বসল। বিচারকমন্ডলী রক্তচোখে
শ্যামার দিকে চেয়ে রইল।
পুরোহিত শ্যামাকে ফিসফিসিয়ে বলল, এরা মোসলমান কাজী। একপেশে বিচার হয়।
হাসান আলিকে যদি অস্বীকার করিস,
গ্রামছাড়া থেকে তোরা বাঁচবি।
শ্যামা উঠে দাঁড়ায়।
যেভাবে অকাল ঢেউয়ে প্রদীপ ভাসায় গেরস্ত বউ
শেষবারের মতো গোপন আলিঙ্গন ছিন্ন করে
নিঃসঙ্গ তরুণী অপেক্ষা করে,—
সেইভাবে দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে মিছা হতে দিও না ঠাকুর।
ভোরের মৃত্যু নেই।
গ্রাম জুড়ে ছায়াঘর, মিঠে জমিন ধানের বয়ান
ভৈরবেশ্বরীর থালায় তখনো হাসানের দেওয়া
শেষ ফুল থেকে শিশির ঝরছে
সামনে দিগন্ত ছোঁয়া গেরুয়া ভোর
হেঁটে চলেছে অগোচরে।।
****************************************************
শাশ্বতী হোসেন পরিচিতি:
জন্ম-১৯৬৪। হবি-লেখা। বিভিন্ন বাণিজ্যিক, (দেশ তথ্যকেন্দ্র) ওয়েব ম্যাগ, প্রচুর পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত। জঙ্গলমহলের আঞ্চলিক মানুষের জীবনচর্চা ওদের মুখের ভাষা নিয়ে কবিতার চর্চা।