কালাপানির প্রেম
শুভজিৎ বসু
হঠাৎ করে ঘোষণা–আপনারা নিজেদের সিটবেল্ট ভালো করে বেঁধে নিন। বাইরের আবহাওয়া ভালো নেই। ওয়াশরুমে আপাতত যাবেন না। প্লেনটা ডানে বাঁয়ে করছে। বছর চল্লিশের সুজয়ের মুখ শুকিয়ে কিসমিস। সবে তো আধ ঘণ্টা, এখনো কম সে কম দু ঘণ্টা, তবেই না পোর্ট ব্লেয়ার। থাকার বলতে মা একাই। আপাতত গোবরডাঙায় থাকবেন। মফস্বলের ছেলে। বিদ্যা বুদ্ধি সবই ঠিক আছে, তবে লোকজনের মধ্যে এখনো সেভাবে সপ্রতিভ নয়। ষোলো বছর ব্যাঙ্কে করণিকের কাজ করছে। অফিসারের দায়িত্বের বোঝা নেবে না বলে পদোন্নতির পরীক্ষায় বসে নি। বর্তমানে ব্যাঙ্কের যা অবস্থা কেরাণীকুল থাকলেও তা টিম টিম করে জ্বলছে। আর বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা অফিসার হয়ে এসে তার উপর মুরুব্বিয়ানা করছে। এটা মানতে অসুবিধা হবে ভেবেই হয়ত পরীক্ষায় বসল ও উতরেও গেল। বদলি আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে। ঘরকুনো হলেও খুশি। ইতিহাস, ভূগোলের জ্ঞান যথেষ্ট আছে। তাই ওখানকার ভূগোল, নৃতত্ত্ব, কখনো ডেনমার্ক, কখনো অস্ট্রিয়া তারপর ব্রিটিশ মাঝে জাপান ও নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীর কর্তৃত্ব ইত্যাদির আন্দামান কেন্দ্রিক ইতিহাস ওর মনকে টানে। ঘোষণা হল যে আর পনেরো মিনিটের মধ্যে বিমান অবতরণ করবে। জানলা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখে অসংখ্য দ্বীপের সারি সারি অবস্থান। সামনেই এক বড় দ্বীপ। সমুদ্রের ঢেউগুলো কালের নিয়মে পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। কালাপানির দেশ। ব্রিটিশদের ভাষায় রাজনৈতিক আসামীদের থাকার জায়গা। পালানোর নেই কোন অবকাশ। পালাতে হলে কালাপানির নোনা জল পান করে পৌঁছতে হবে সমুদ্রের অতলান্তে। কষ্ট থেকে বাঁচতে, মুক্তির স্বাদ পেতে হ্যারিয়ট পয়েণ্ট থেকে নিচে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে মুক্তির মন্দির সোপানতলে অসংখ্য বিপ্লবী প্রাণের বলিদান দিয়েছিল। সেই অশ্রুজল কালাপানির পানিতে মিশে আছে।
কয়েকটা লজ দেখে সুজয় এবারডিন মার্কেটের কাছে এক বাঙালি লজে ওঠে। এক বয়স্ক ভদ্রলোক, মালিক বা ম্যানেজার রিসেপসনে বসে আছেন। এবারডিন বহু পুরোনো জায়গা ও পোর্টব্লেয়ারের মধ্যভাগে অবস্থানের জন্য কাছাকাছি সব কিছুর সুযোগ সুবিধা আছে। অফিসে জয়েনিং রিপোর্ট করে কয়েকদিন এদিক ওদিক সব ঘুরে জায়গা সম্বন্ধে একটা ধারণা করে সুজয়। এক সন্ধেতে অফিস থেকে ফিরে দেখে রিসেপসনে এক সুন্দরী মহিলা বসে। চাবি চাইতে উনি দিলেন। ব্যাপারটা অতি সাধারণ। সময়ের প্যাঁচে কখন এই তুচ্ছ ব্যাপারও অসাধারণ পর্যায়ে বাঁক নেয়। কোন কারণ না থাকলেও সুজয় অহেতুক বা সুন্দরী মহিলার রূপচ্ছটায় আকৃষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করে,”বয়স্ক ভদ্রলোক আজ আসেন নি?”
“উনি আমার বাবা, বয়স হয়েছে। মাঝেমধ্যে আসেন বটে তবে আমাকেই পুরোটা সামলাতে হয়। আমাকে মালিক বা ম্যানেজার সবকিছুই ভাবতে পারেন। মনে হচ্ছে আপনি বদলি হয়ে এসেছেন। কোন ব্যাঙ্কে? আর কতদিন থাকবেন?” পরিষ্কার করে বললেন। সুজন যথার্থ উত্তর দিল।
“ঠিক আছে এখন রুমে যান, ফ্রেশ হয় নিন, চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ডিনারের সময় কথা বলা যাবে।” বলে মিষ্টি হাসলেন।
সুজয় এখন চাকরির সূত্রে সবরকম লোকের সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা রপ্ত হয়েছে। মূলত ও একেবারে মুখচোরা। আর মহিলাদের চোখের পর চোখ রেখে কথা বলায় বেশ অনভ্যস্ত। ফ্রেশ হয়ে চা খেয়ে বিছানায় গা এলায় । টিভি চলছে। মাঝে মাঝে চোখ ফেলছে। মহিলার মিষ্টি হাসিটা ওর কানে লেগেছিল, এখন তা যেন মরমে পশিয়া গো আকুল করিছে তার প্রাণ। ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ডিনার বেল বেজে উঠে।
ডিনার সেরে রিসেপসনের সামনে দিয়ে আসতেই ভদ্রমহিলা সাহেবি কেতায় জিজ্ঞেস করে,”স্যার, হাউ ইজ ইয়োর ডিনার, ওকে? আসলে মিষ্টি জলের মাছ ভালো পাওয়া যায় না। তবে সী–ফিস এ্যাবাণ্ডাটলি পাওয়া যায়। আজকের ফিসটা একেবারে তাজা ধরে এনেছে আর খেতে রুই–এর মতো। সী ফিস বলে একটু শক্ত।” উনিই কথা বলে যাচ্ছেন, সুজয় মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়ে। মনে হচ্ছে সুজয় বেশ উপভোগ করছে। ওনার প্রফেশনাল কথাবার্তার মধ্যেও একটু অন্যরকম পরশ থাকায় সুজয় মোহিত হয়ে শুনছে। আসলে, কথা বলাটা একটা আর্ট। যে কাজ রণে বা বাহুবলে হয় না, তা বাকচাতুর্যে সময়ে সময়ে অনায়াসে হয়ে যায়। শুধু অপরপক্ষের মনস্তত্ত্বটা বুঝে নিতে হয়।
“আপনি কী ফ্যামিলি নিয়ে আসবেন?”
“আমি তো একা, তবে মা আছেন, দেখি কী করি। হয়ত আনতে হবে“-সুজয় বলে।
“তবে একটা কাজ করতে পারেন। এই লজে আমরা রুম দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ভাড়া দিই। এতে ভাড়া আপনার অনেক কম পড়ে যাবে। রান্নার বা অন্য ঝামেলা নেই। পোর্টব্লেয়ারে বাড়ি ভাড়া অনেক। যেভাবে ট্যুরিস্টের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তার সাথে বিভিন্ন নিত্য নতুন অফিস । তবে কি এখানে কোন ভিখিরি নেই। ক্রাইম নেই বললেই চলে। ক্রাইম করে পালাবে টা কোথায়? যেখানেই পালাবে সেখানেই সমুদ্র। আর এখানে স্থানীয় বাসিন্দারা মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। বাড়ির কাজের লোক পাওয়া মুশকিল। দূর দূরান্ত থেকে আনতে হয়। বেশিরভাগই বাঙালি। আন্দামানে বাঙালির সংখ্যা অনেক বেশি হলেও পোর্টব্লেয়ারে দক্ষিণ ভারতীয়দের বিশেষ করে তামিলদের দাপট বেশি। আগে সব ব্যাপারে এখানকার লোকেরা কলকাতা কেন্দ্রিক ছিল বটে, এখন আর নেই। এখন মানুষ বহুলাংশে চেন্নাই কেন্দ্রিক, সে শিক্ষায় হোক, চিকিৎসায় হোক বা অন্য অনেক ব্যাপারে। গণতন্ত্রে গুণের থেকে সংখ্যার দাপট বেশি থাকায় আমরা বাঙালি সাংসদ পাই প্রায় সবসময়। তবে এটাও কতদিন থাকবে জানি না। একটা বিষয়ে এখনো কলকাতার দাপট আছে, তা হলো কলকাতা হাইকোর্টের এক পোর্টব্লেয়ার বেঞ্চ আছে। গ্রাম দেশের তবে সবাই প্রায় বাঙালি। আসলে ওই জায়গাগুলো মানুষের বাসোপযোগী ছিল না। বন জঙ্গলে ভরা জায়গা। দেশ ভাগের পর বা তার পরেও হাজার হাজার উদ্বাস্তু কে জোর করে এখানে পাঠানো হয়। তাদের রক্ত, ঘাম এবং মৃত্যু দিয়ে তৈরি এই গ্রামগুলো। এখন অনেক জমি আবাদি হয়েছে, ট্যুরিজমের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তাই এখন গ্রামের জমির দাম বিশাল। নামেই কালাপানি, এখন সব রমরমিয়ে চলে। একসময় বাংলাদেশীরা ভারতীয় বাঙালি সেজে এখানে পালিয়ে চলে আসত। এখন খুব কড়াকড়ি। আমাদেরও বাড়ি দুর্গম হ্যাভলকে। বাবা, ঠাকুরদার মত বয়স্করা যে কী কষ্ট করেছিল তা ভাবনার অতীত। শিক্ষা কী জিনিস গ্রামের লোকেরা জানত না। অনেক কষ্টে আমাদেরকে পোর্টব্লেয়ারে পাঠিয়ে স্কুলিং করিয়েছে। আমাকে চেন্নাই পাঠিয়ে বি এস সি পাশ করিয়েছে। যাক অনেক কথা বলে ফেললাম। হ্যাঁ, আমার নাম মিতালি। আই এ্যাম ফাইন উইথ মিতালি টু ইউ। গুড নাইট। নেক্সট অন আদার ডে।”
সুজয় হতবাক। আজকেই আলাপ হল। এখনো অবধি সেভাবে চেনাজানা হয় নি। আর এত সব গুরুত্বপূর্ণ কথা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল। এটা কী ওনার বিজনেস বাড়ানোর ইউ এস পি ? তবে সুজয় সুন্দরীর গুরুত্ব পেয়ে খুশি। কিছু বলার অভিপ্রায় হয়েছিল কিন্তু বড় মেঘের কাছে ছোট হালকা মেঘগুলো যেমন ধর্তব্যের মধ্যে আসে না, বা সূর্যালোকের বিশাল আলোয় মোমের আলো যেমন ভাস্বরহীন সুজয়কে মিতালির বাগ্–বিস্তারে তেমনি অতি সাদামাটা মনে হলো।
রাতে শুয়ে নানান চিন্তার মধ্যেও মিতালিকে নিয়ে কেন যে কেমন কেমন লাগছিল, তা ঠিক বলে বোঝানো যায় না। দখিনা মলয় বাতায়নে মৃদু ধাক্কায় ঘরে ঢুকে মধুর আবহ তৈরি করে, তেমনি সুজয়ের কোমল হৃদয়ে মিতালি দেয় অনির্বচনীয় টোকা, আর তাতেই কেমন ভালো লাগার ছোঁয়া অনুভবে এল। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় একবার দেখতে পেলেই খুশি। মনটা কেমন হালকা হালকা হয় আর সবকিছুই ভালো লাগে, নিজেকে উদার ও বিশ্বজনীন মনে হয়। আর না পেলে খিটখিটে ভাব বেড়ে যায়, সবকিছুতেই বিরক্তি। ভাড়ার ব্যাপারে যা হবার তাই হল। লজের এক রুমের সাথে এগার মাসের ব্যাঙ্কের লিজ এগ্রিমেণ্ট হয়ে গেল।
লজ ছেড়ে সোজা গিয়ে বাঁয়ে বেঁকলেই নেতাজী স্টেডিয়াম, ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স, চিলড্রেনস পার্ক, ফিসারি মিউজিয়াম, সাই কমপ্লেক্স, নেতাজীর বিরাট মূর্তি নেতাজী স্টেডিয়ামে । সমুদ্রের উপর কংক্রিটের ঘোরানো, প্যাঁচানো আবার সোজা ব্রীজ। ব্রীজে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে স্বচ্ছ নীল জলের মধ্যে দিয়ে সমুদ্র তলা অবধি দেখা যায়। আর হাজার হাজার ছোট ছোট মাছেরা দল বেঁধে এদিক ওদিক যাতায়াত করে। কোন বেঞ্চে বসে বা দাঁড়িয়ে সামনে তাকালেই পোর্টব্লেয়ারের মধ্যমণি সবুজ গোলাকার রস আইল্যান্ড। ইংরেজদের সময়ের প্রথম দিকটায় ওটি ছিল রাজধানী। পরে পরিত্যক্ত হয় এবং অবহেলায় তার মহিমা একেবারে ক্ষীয়মাণ। অবস্থার জরাজীর্ণতাতেও তার লুকোনো স্থাপত্য মনে করিয়ে দেয় তার আভিজাত্যকে। কয়েকটা লঞ্চ যায় আর দুপুরের পরে ফিরে আসে। পুরোনো ভাঙাচোরা দালান, ঘরবাড়ি, পার্ক, কিছু সৌধ, হরিণের ছুটোছুটি খেলা, কিছু নতুন অফিস, পুরোনো ঘর বাড়ি ফাটিয়ে বট অশ্বত্থের মস্তক উত্তোলন–এ সবই দেখা যায়। ইতিহাস আগ্রহী সুজয়ের ভালো লাগারই কথা। এসব দেখলে ভাবুকতা আরো বাড়ে কেননা মনটা পিছিয়ে আসে অদেখা শত বছর আগের দিনগুলোতে। কল্পনায় সব হয় জারিত। আর পিছনে সমুদ্রে নামার সিঁড়ি। অনন্ত, অসীম নীল জলের আস্তরণ অতিদূরের আকাশের সাথে মিশে যায়। বড় বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকে মালপত্র খালাস করবার জন্য। আবার এপারে এসে রাস্তা বরাবর যেয়ে বাঁয়ে বেঁকলেই সেলুলার জেল স্মৃতিসৌধ। ১৮৯৬ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে স্থাপিত হলেও ১৮৫৭ সাল থেকে রাজনৈতিক অপরাধীদের মূল ভূখণ্ড থেকে এখানে স্থানান্তরিত করা শুরু হয়। বেশিরভাগই এখানেই মারা যায়। সন্ধ্যায় লাইট এণ্ড সাউণ্ডে ১৮৫৭ থকে ১৯৬০ অবধি জেল কেন্দ্রিক ঘটনাবলী পূর্বাপর দেখানো হয়। সেলুলার জেলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সভারকরের কক্ষ এবং ওনার নামে পার্ক এবং তৎসহ বিশাল স্ট্যাচু। সারা দেশের রাজনৈতিক অপরাধীদের এই রকম হাজার কক্ষে রাখা হত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অকথ্য নির্যাতনের মধ্য দিয়ে এখানে রাখা হত। কতজন অত্যাচারের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে মারা যান। তাঁদের কষ্টে, চোখের জলে আজো সৌধের মধ্যে তাঁদের মৃতাত্মা গুমরে গুমরে কাঁদে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আক্রমণে সেলুলার জেলের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু তাই নয় ব্রিটিশদের হাত থেকে দ্বীপকে ছিনিয়ে নেয়। সেই সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী কর্তৃত্ব নেয়। মিতালির কথামতো এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় করাত কল ছাতাম স–মিল সুজয় দেখে নেয়। ৫৭২ টা ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে আন্দামান। তার মধ্যে আটত্রিশটিতে মানুষের বসবাস আছে। সেই দ্বীপগুলির মধ্যে আর দেশ বিদেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয় পোর্টব্লেয়ারের কাছে হাড্ডো থেকে। এটাই সংযোগ রক্ষাকারী জলবন্দর। এ ভাবেই সুজয় সময় করে বেরিয়ে পড়ে। কোনদিন করবিন কোভ, কোনদিন ওয়াণ্ডার বিচ বা কোনদিন নর্থ বে আইল্যান্ড, ভাইপার আইল্যান্ড ঘুরে আসে এবং প্রতিটি জায়গা তার অনুসন্ধিৎসু চোখ ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। তবে যেখানেই যাক না সমুদ্র ওকে ছাড়ে না। অক্টোপাসের বাহুর মতো সমুদ্র ওকে আটকে রাখে।
একদিন চলে যায় জলি বয় আইল্যান্ডে। তবে সেদিন সুজয় বড়ো একাকীত্ব বোধ করছিল। পাশে কাছের কেউ থাকলে মন্দ হত না। সব সময়ের জন্য একজন হৃদয়–বন্ধুর দরকার হয়। মিতালি কী এখনো বোঝে না যে সুজয়ের মনেপ্রাণের এক বড় অংশ জুড়ে মিতালি। হয়ত জানে, আর মিতালিও সুজয়কে ভালোবেসে থাকতে পারে। তাতে তো সব শেষ হয় না। কার কী বাধা আছে কে জানে। জীবনটা বানানে যত সহজ, প্রকৃতপক্ষে তার মধ্যে নিহিত জটিল সব গূঢ় রহস্য বা ব্যথা দানা বেঁধেই থাকে। সেগুলি থেকে মুক্তি সহজ কাজ নয়। তবে মিতালি এটুকু ভালোমতো বুঝতে পেরেছে যে সুজয় একজন সজ্জন ব্যক্তি এবং তার প্রতি গভীর ভালবাসা মন খুলে মিতালিকে বলতে দ্বিধাগ্রস্ত। মিতালি হয়ত একদিন সব খুলে বলবে। জলি বয় সাঁইত্রিশ কিলোমিটার দূর। রাস্তার দুপাশে সারি সারি সুপারি, নারকেল গাছ আর টিনের বাড়ি। পুরোটা পূর্ব বঙ্গীয় বাঙালিদের বাস। কবি জীবনানন্দ দেখে যেতে পারেন নি। দেখতে পারলে আর একটা বাংলা ও বনলতা সেনকে দেখতে পেতেন। নিউ ওয়াণ্ডারের মহাত্মা গান্ধী পার্ক, তারপর গারছামারা তারপর ওখান থেকে পারমিট নিয়ে লঞ্চের উপর। দুপাশে ঘন জঙ্গল,লোকবসতি নেই। মাঝেমধ্যে ছোটখাট দ্বীপ হাজির হয়। গরান গাছের অবিন্যস্ত শিকড়, তার ডালপালা সব পাড়ে সমাচ্ছন্ন করে রেখেছে যার ফলে ডানে বাঁয়ে দৃষ্টি থমকে যায়। কথায় কথায় মাথার উপর ঘন কৃষ্ণবর্ণের একদলা মেঘ আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারী বারিপাত যা কি না এখানকার নিয়ম। আবার চলেও গেল। এবার সমুদ্রের মধ্যে চলছি। দূরে জলি বয়কে দেখা যাচ্ছে। অনেকটা প্লে বয় ইমেজে ওকে লাগছে। প্লে বয়দের তাৎক্ষনিক ইমেজে আকৃষ্ট হয়ে অনেক ললনা এগোয়, শেষে বুঝতে পেরে অষ্টরম্ভা। তবে জলি বয়কে ওরকম ভাবা ঠিক নয়। সে অপার সৌন্দর্যের চিরন্তন আধার। এক বিরাট উৎসবের আকারে চলছে ধুম। মোটর বোট এক এক করে এসে যাত্রীদের নিয়ে যায়। অনেকেই বোটে নামতে ভয় পায়। এক গুজরাটি মহিলার এরকম ভীতি হয় যে সুজয় তার দু বাহু ধরে আস্তে করে বোটে নামায়। কাঁচ বোটের নিচে লাগানো থাকে যার মধ্যে দিয়ে সমুদ্রের নিচের বিভিন্ন ধরনের মাছ, উদ্ভিদ আর বিশেষ করে প্রবাল দেখা যায়। সুজয় মজা লুটতে স্কুবা ডাইভিং করে। একাকী, তাই মিতালি হঠাৎ হঠাৎ করে চোখের সামনে এসে পড়ে আর মনটা আনমনা হয়ে যায়।
পরের রবিবার বারাটং। মিতালির কথামতো খুব ভোরে এবারডিনের গান্ধী স্কোয়ারের মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির নিচ থেকে বাস ধরে। তবে সিট বুক করা ছিল। ফেরারগঞ্জ হয়ে আদিম জাতি জারোয়া অধ্যুষিত জেরাটন। চারধারে জঙ্গল। গা ছমছম করে। একটা লোককেও রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয় না। জারোয়ারা নিজেদের আত্মরক্ষার্থে মেরে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, তাদের এটা একটা সরকার নির্দেশিত মুক্তাঞ্চল। আধুনিক মানুষের ভয় ভীতি থেকে দূরে রাখার অভিপ্রায়ে সরকারের এটা প্রয়াস। দু তিন জন জারোয়াকে রাস্তা দিয়ে মাথায় কাঠ নিয়ে খালি গায়ে ও হাফ প্যান্ট পরে এগিয়ে আসতে দেখে। কিছু অত্যুৎসাহী যাত্রীর সোরগোলে তারা জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যায়। জারোয়ার সংখ্যা প্রতিবছর এত কমে যাচ্ছে যে তাদের অস্তিত্বের সংকট দেখা যেতে পারে। প্রচুর সরকারি সাহায্য তারা পায়। বারাটং পৌঁছলে এক জাহাজ সবাইকে জেটিতে নিয়ে যায়। ওখান থেকে স্পীড বোট পিছু চারজনকে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে নদীর উপর দিয়ে দুরন্ত গতিতে বোট চলে। একটা জায়গা আসে যেখানে বড়,মাঝারি গাছগুলো জলের মধ্যে বিরাট শাখা প্রশাখা বিস্তার করে জলের উপর মাথা নত করে আছে। তাদের কে সরিয়ে বোট পাড়ে আসে। লাফ দিয়ে নেমে গাছগাছালি ধরে মাটিতে পা রাখতে হয়। তারপর সরু রাস্তা দিয়ে দেড় কিলোমিটার গেলেই লাইমস্টোন কেভ। হাজার হাজার বছর ধরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন উপাদান স্তরীভূত হয়ে লাইমস্টোন কেভে নানান মজাদার আকার নিয়েছে। তারপর সুজয় ফিরে আসে। ফেরার পথে মাড–ভলকানোটাও দেখে নেয়।
“আপনার ঘোরা কেমন হচ্ছে? দেখাই পাওয়া ভার।“-মিতালি হেসে বলে। মনে মনে ঠিক করেছে সুজয়কে এক বড় বাস্তব সত্য জানানো দরকার। “আপনার কথায় ঘুরছি, ভালো না হয়ে উপায় আছে“-বেশ আত্মপ্রত্যয়ে সুজয় উত্তর দেয়। মিতালি বলে,”বাবা,কথার ভারটা তাহলে বেড়েছে দেখছি। কাল তো আপনার ছুটি। কাল আমি স্কুটারে চিড়িয়াটাপু–তে যাব, ইচ্ছে করলে আমি সওয়ার হয়ে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি–কোন আপত্তি?” বলেই মিতালির লাস্য জড়ানো হাসি যা সুজয়ের হৃদয়ের তন্তুকে অবশ করাতে যথেষ্ট। হাতে চাঁদ পেল। সুজয় বলে,”এর চেয়ে ভালো আর কী আছে? তবে আমিও স্কুটার চালাতে পারি।” সুজয়ের মেল শভিনিজম, মনে হলো, প্রকাশ পেল। মিতালির বাস্তব জ্ঞান প্রখর। তাই মুহূর্তে বলে ওঠে,”না চালালে আপনাকে আমি ছাড়ব নাকি।” সাঁইত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা। সমুদ্রের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ওরা নির্জন, প্রায় জনমানবহীন ও দুপাশের বড় বড় গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছে। সমুদ্র কখন বাঁয়ে, আবার কখন ডানে, হারিয়ে যায় না। পাখির মিষ্ট আওয়াজ কানে ভেসে আসে। এছাড়া সবসময় একটা মৌমাছির ডাকের মত হামিং সাউন্ড বেজে চলেছে। কী অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সম্পূর্ণ কোলাহল রহিত জায়গায় এই ধরণের মিষ্টি আওয়াজ মাদকতা এনে দেয়। মনে হয়, ধরায় থেকেও ধরার বাইরে। প্রকৃতি প্রেমিকদের আদর্শ গন্তব্যস্থল। থাকতে চাইলে মানব মানবীর উৎকৃষ্ট রোমান্সের জায়গা। তাই না বিদেশীদের এত ভিড়। সমুদ্র এখানে সেভাবে নড়াচড়া করে না, বড় বড় শুকনো গাছ তটে পড়ে আছে। ওর উপর বসে মজা করে সময় কাটানো যায়। মিতালি ডাকে,”আসুন, একটু বসি।” বসলে মিতালি শুরু করে “আচ্ছা, কয়েক মাস হল আমাদের হৃদ্যতা স্থাপিত হয়েছে। আমার সম্বন্ধে আপনার কী কোন কৌতূহল হয় না? কখন কোন কিছু তো জিজ্ঞেস করেন না? আমার তো হয় এবং আপনার থেকে ট্যাক্টফুলি আমি জেনেও নিই। কিন্তু আপনি তো কিছুই জানতে চান নি। ইচ্ছে হয় না?” সুজয় চোখ বড় বড় করে বলে,”হয় আবার না! সুযোগ করে উঠতে পারছি না, তাই।” মিতালির এই অযাচিত কিছু জানানোর ইচ্ছে সুজয়কে আনন্দ ও বিস্ময়ের চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে এল। প্রাণে জল ও বল দুইই ভরে গেল। ভোরের সূর্যের আলোয় পাহাড় যেমন খুশিতে রাঙা হয়, তীব্র তপনতাপের পর বৃষ্টির ফোটায় যেমন ময়ূর ময়ূরী পেখম তুলে নাচতে থাকে, সমুদ্রতটে অর্ধদগ্ধ জেলিফিস বা অক্টোপাসকে বিশাল ঢেউ এসে তট থেকে গভীর জলে নিয়ে গেলে যেমন নির্বাক আনন্দে মত্ত হয়,তেমনি সুজয় ভাবে,” হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে।” গভীর আনন্দে হল লীন।
মিতালি জানায়,”আমি পরশু চেন্নাই যাব।”
“কেন?” শুধায় সুজয়।
“ও মা আপনি জানেন না আমার ন–বছরের ছেলে আন্না দুরাই স্ট্রিটের এক নামী বোর্ডিং স্কুলে পড়ে।”
সুজয়ের হৃৎপিন্ড বিকল হয়ত হল না, তবে তার কম্পনের তাল অনেকটাই কেটে গেল। সামলে নিয়ে বলে,”আপনার স্বামী তাহলে চেন্নাই থাকেন?”
“না মারা গেছেন।” বলে কিছুক্ষণ চুপ রইল।
“দুঃখিত, আমি না বুঝে আঘাত দেওয়াতে।“–আমতা আমতা করে সুজয় বলে।
মিতালি বলে,“না দুঃখিত হই নি। আপনি তো জানেন না। তবে আমি মনে করি আপনাকে এই ঘটনা জানানোর দরকার। আমি মহিলার ইন্সটিন্কট থেকে বুঝতে পারি আপনি আমাকে আপনার মতো করে কাছে টানতে চান। আর আমি কী চাই তা নিশ্চয় আপনি বোঝেন নি। কিছু জিনিস নিজে থেকে বুঝতে বা শিখতে হয়। কেউ শিখিয়ে দেয় না। আপনার বয়সের অভিজ্ঞতায় বোঝা উচিত। বুঝতে কী পেরেছেন এখন? যা হোক আমার দিকটা জানিয়ে রাখলাম। ২০০৪ সালের সুনামীতে বাথু বস্তিতে তেত্রিশ ফুটের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আর তারপর ভূমিকম্প প্রায় সবকিছু শেষ করে দেয়। স্বামী ওখানে বড় ব্যবসা করত। আমি ছেলেকে নিয়ে বাবার কাছে কয়েকদিনের জন্য তখন ছিলাম। আন্দামানে সরকারি হিসাবে দু হাজার লোক মারা যায়, তার মধ্যে আমার স্বামী একজন। পোর্টব্লেয়ার থেকে ছ কিলোমিটার দূর হল বাথু বস্তি। আমার বাচ্চার বয়স তখন এক বছর। বাধ্য হয়ে বাচ্চা সমেত বাবা আমায় নিয়ে যায় হ্যাভলকে। পরে জমি বিক্রি করে এই লজ বা হোটেলটা কেনা হয়। বাবা ও আমি এখানেই থাকি। মা আর এক ভাইকে নিয়ে হ্যাভলকে থাকেন। ওখানকার হোটেল ওরা সামলায়। এখানে লোক কলকাতার চাইতে সমস্ত ব্যাপারে চেন্নাই কে প্রেফার করে। একমাত্র আত্মীয় স্বজন থাকায় কলকাতার কথা বাঙালিদের ভাবতে হয়। আমি ভেবেছিলাম চাকরি করি। কিন্তু এত বড় ব্যবসা ছাড়তে মন সায় দেয় নি। পোর্টব্লেয়ারে সব ধরণের মানুষকে পাবেন। মিনি ভারত। তাই ইংরাজী, হিন্দি জানা থাকলে সুবিধা হয়। আমি মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারি। এটা ঠিক হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলাম,জীবনের ছন্দ কেটে গেছিল। ছেলে তো উপলক্ষ্য,জীবনে তো আমায় ফিরতেই হবে। আমি ফিরে এসেছি। হাসতে হাসতে বলে । চলুন, পোর্টব্লেয়ারেও তো ফিরতে হবে।”
“তা তো বটেই।” অন্য এক জগৎ থেকে ধপাস করে সুজয় পড়ল। বেশ অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে। মিতালি বুঝতে পেরে অন্য নানান কথা বলে ওকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। বলে,”এবারও কিন্তু আমি স্কুটার চালাব।” পুরুষাকারে হয়ত লাগলো । তাই, বলে ওঠে,”তা কখনো হবে না, এবার আমি স্কুটার চালাব।“
“দেখবেন আমার দুঃখের অংশীদার হয়ে স্কুটার যেন গাছে ধাক্কা না মারে। “বলেই খিল খিল করে হেসে ওঠে।“এবার আরো কিছু জায়গা একা একা ঘুরুন। শুনুন আমি তিনদিনের জন্যে হ্যাভলকে যাব। আপনিও যাবেন,বুঝলেন বাবুমশাই।”
রাতে শুয়ে সুজয় সব ঘটনা পূর্বাপর চিন্তা করে আর মিতালির জীবনে বাঁচার অদম্য তাগিদকে সেলাম জানায়। মিতালির এত কথা বলার দরকারই ছিল না কেননা সুজয় ওকে ভালবেসে ফেলেছে। এখন বুঝল যে উনি বিধবা। একটু বাধা তো এলোই। “ধুর্ ওসব প্রাচীন চিন্তা কে করে? ভালো লেগেছে,ব্যস।” সত্যিই প্রেম মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। অনেক রাতে ঘুম এল। মিতালি কীভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন যে উনি যেহেতু হ্যাভলকে যাবেন তাই সুজয়ের ও যেতে হবে। তবে উনি কী ধরেই নিয়েছেন যে ওনার কথাতে তার যেতে হবে। তার কি কোন নিজস্বতা নেই ? না, এ ক্ষেত্রে থাকল না। এ তো প্রেম। ব্যাখ্যাতীত বস্তু। এর কোন সংজ্ঞা হয় না। নিয়ম –অনিয়ম এতে খাটে না। দুটি প্রাণ কী চায় তা ভগবানই শুধু জানেন। দেখা যাক ও কী রে।
যা করার তাই করলো। নির্দিষ্ট দিনে জাহাজে দুজনেই উঠল। উত্তাল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে বাঁপাশে হ্যারিয়ট পয়েন্ট ও মধুবনকে রেখে জাহাজ ছুটছে। সুজয় বাইরে বেরিয়ে ডেকের পর এসে সমুদ্র ও দুপাশের গ্রামগুলোকে দেখে। অসংখ্য স্পীড বোটের গমনাগমন লেগেই আছে। বহুদূর যায়, মন আরো দূরে ধায়। ডানে এলিফ্যাণ্ট বিচ এল। নীল স্বচ্ছ জলে ভ্রমণকারীরা স্নান করছে। কয়েকটা শুকনো গাছ পাড়ে পড়ে আছে। এই আইল্যান্ড একেবারে নির্জনতায় ঢাকা। জাহাজ ডানে ঘুরে কিছুদূর যাবার পর হ্যাভলক জেটিতে ভিড়ল। জেটির হোর্ডিং–এ লেখা আমাদের স্বাগত জানালো। জেটি থেকে বাইরে আসতেই অজস্র দোকান আর হোটেল। প্রায় সব বাঙালিদের। মিতালির ভাই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। মিতালি সুজয়কে ব্যাঙ্কের অফিসার বলেই পরিচয় করিয়ে দেয়। বাড়িটি ভিতরে অনেকখানি জমি নিয়ে। ওর মার সাথে পরিচয় করাতে সুজয় প্রণাম করে। পরের দিন পূবদিকের কালাপাথর বিচে সময় কাটায়। গাছপালা, জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। পাড় দিয়ে সরু রাস্তা। চলতে ডালপালা গায়ে লাগে। লোকজন নেই বললেই চলে। মিতালি আর সুজয় বিচে নেমে কথাবার্তা বলে। সামনের পূব দিকটা মিয়ানমার। দুদিন আগে জাহাজডুবি হওয়ায় তার কিছু ভাঙা যন্ত্রাংশ ভাসতে ভাসতে এদিকে এসে তটে পড়ে রয়েছে। পুলিশ ওগুলোকে ওদের জিম্মায় নিতে এসেছে। বনের মধ্যে কয়েকটা অতিথি নিবাস দেখা গেল। পরেরদিন রাধানগর সী বিচ। এশিয়ার সবথেকে সুন্দর নীল জলের সী বিচ। ঢেউ ছোট ছোট। প্রশস্ত বেলাভূমি। বহু বিদেশীর সমাগম। ভারতে একমাত্র কেরালার কোভালম বা গোয়ার আঞ্জুনা সী বিচের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করা যায়। বিচের পিছনে লম্বা লম্বা গাছের জঙ্গল। মিতালি ওখানকার মেয়ে। জড়তা নেই। এসেই সমুদ্রে নেমে পড়ে। দেখাদেখি সুজয়ও নামে। প্রথমে সুজয়ের সংকোচ এলেও তা কাটিয়ে একেবারে কাছাকাছি এসেই দুজনে স্নান করে বাড়ি ফেরে। আবার পরের দিন আসে। তবে স্নান করে নি। বিচের পিছনে বসার কংক্রিটের বেঞ্চ আছে। একটু নিরিবিলিতে দুজন পাশাপাশি বসে। সূর্য ঢলতে চলেছে। তার লালাভ রশ্মি জলের ফেনার সঙ্গে,গাছের সঙ্গে মিশে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। মিতালি আরো সুজয়ের কাছে আসে। সুজয়ও ধরা দেয়। প্রথমে দুটি হাত একসাথে মেশে। মিতালি তার মাথা আলতো করে সুজয়ের বাঁ কাঁধে রাখে। সুজয় দু‘হাত দিয়ে জড়িয়ে তাকে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একাকার হয়ে যায়। সুরক্ষিত আজ একে অপরের কাছে। এভাবেই প্রেম নীরবে আসে, অনেকে ধরতে পারে, আবার কেউ পারে না। সুজয় ও মিতালি ধরতে পারল। তাদের মঙ্গল হোক।
******************************************************
লেখকের পরিচিতিঃ
শুভজিৎ বসু এম এস সি (এজি ) পাশ করে ব্যাঙ্কের অফিসার পদে চাকরি জীবন ১৯৮৩ সালে শুরু করেন। গত ২০১৯ সালে ব্যাঙ্কের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে অবসর নেন। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর চাকরিতে থাকাকালীন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। অবসর গ্রহণের পর থেকেই তিনি বস্তুত লেখালেখিতে মন দেন। চাকরি জীবনের পূর্বে তিনি প্রধানত কবিতা লিখতেন। বর্তমানে উনি নিম্নোক্ত ঠিকানায় বাস করেন।