শিউলি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
আকাশপ্রদীপ আকশের বুকে ছোট্টো, তীব্র, মিষ্টি হয়ে ফুটে আছে। কেমন গন্ধ। আলোরও বিশেষ গন্ধ হয়। হেমন্তের গন্ধ! জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশে কুচোকুচো সাজানো ডায়মণ্ড তারা। একদৃষ্টে দেখার মতো ঝলক নেই। বড্ড মায়া-মায়া। চোখ বুজলেও ছুঁয়ে থাকে।
কুঁচকির দুপাশ থেকে আড়ষ্ট অচেনা ব্যথা নেমে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে তোলপাড়। অস্থির লাগছে শরীর। বাবার ঘর থেকে গান আসছে – ‘শুধু এই পথ চেয়ে থাকা ভালো কি লাগে’?
তানিশক থেকে ওরকম হীরের নেকলেস কিনে দিয়েছিল না অরণ্য? বিয়ের জন্মদিনে? “ডাস্কি স্কিনে ডায়মণ্ড গ্ল্যাম দেখাচ্ছে” বলেছিল।
তনু বেঢপ পেটে কাত হয়ে কুঁকড়ে আছে, ফোঁপানির মতো শ্বাস। কান্না আটকে ছাতিতে ব্যথা হচ্ছে। উঠে বসে দম ফেলার চেষ্টায় হাঁকপাক করে। খড়খড়িওয়ালা জানালা হাট করে খুলে ফেলে। পারলে ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে দিত। হাঁ করে হাওয়া নিতে গিয়ে চেঁচায়,
-মা, ও-মা… মা।
হেমন্তের নিঝুম সন্ধ্যেতে জটপাকানো বাড়ির মাথা, ক-খানা ঝিমনো গাছ, তিনমাথা ল্যাম্পপোস্ট, তার আলো, মিলে-টিলে বিমূর্ত শিল্প। ওসব বোঝেনি অরণ্য। চান্স পেতেই ওয়াশিংটনে চলে গেছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
-হোয়াট শ্যালাই ডু রণ? অফিসে নোটিস দিয়ে দেব?
-এতো অস্থির হয়ে পড়ছ কেন? গিয়ে ব্যবস্থা করে জানাচ্ছি।
আটমাস কেটে গেছে, অরণ্য জানাচ্ছে না। হয়ত ব্যবস্থা করতে পারছেনা। এ-মাসের শেষে তনুর ডেলিভারি ডেট। অফিসে ছুটি স্যাংশন হয়েছে। কিন্তু ব্যথাটা কমছেনা। বিন্দুবিন্দু ঘাম হচ্ছে,
-মা–ওমা–মা।
শান্ত পুরনো পাড়ায় শিউলিগাছ দুখানা। ছাতিমও আছে। ছাতিমের ধরা গন্ধ আর শিউলির টাটকা গন্ধ মেলানো। বাবা রোজ কুড়িয়ে তার ঘরে ছোট ডিশে রাখে। তনু হাতের চেটো দিয়ে গাল ঘষে। ঘাম মোছার মতো চোখের জল মোছে। মুখের খসখসে চামড়ায় গন্ধ ফেস-পাউডার হয়ে সেঁটে যাচ্ছে। একটানা পাখির ডাকের মতো বিরক্তিকর সময়। সে বিছানার চাদরে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে থাকে। এই বিছানায়, চাদরে শুয়ে দেড়মাস আগে মা চলে গেছে। তনু চাদরটা আঁকড়ে ধরেছিল, নিতে দেয়নি।
আকাশপ্রদীপ ছোট্ট আগুনফুল। সারা বাড়িতে মা। আলনায় মা’র শাড়ি। হাল্কা সবুজে লাল ডট্স্। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মতো খসখস শব্দ উড়ছে। কেউ এল নাকি? ছোটোবেলায় পপিন্স নামের পুঁচকে কুকুর ছিল তনুর, ভুকভুক ডাকত। দৌঁড়ে বেরিয়ে আচমকা গাড়ির ধাক্কায় গড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েক ফোঁটা রক্ত আর চোখের জল নিয়ে চিরস্থির। কী সর্বনেশে ওই সন্ধ্যেটা। মা-র কোলের মধ্যে ঢুকেছিল তনু। আবার হা-হা কান্না আসছে। জল নামছে প্রপাত হয়ে।
-মা–ওমা–মা!
-তোর ছেলে হবে মামন।
-যাহোক হলেই হল। রণ কিছু জানাচ্ছে না কেন বলো তো?
-থাকনা, ক’টা মাস আছিস মোটে।
-আ-হা, যাবনা নাকি?
টুপটুপ বৃষ্টি! টপটপ করতে করতে মুষলধার। সটান ছুটে এসে গেঁথে যাচ্ছে মাটিতে। ছাঁট আসছে ঘরের মধ্যে। কাঠের ফ্রেমের জানালা ঠাসঠাস করে পড়ছে। ফ্যান দুলছে। তিরের ফলার মতো ব্যথা একবার করে জাগছে, নিভছে। কেঁপে উঠছে তনু। বাবাকে এবারে না ডাকলেই নয়।
মায়ের কাপড়খানা উড়ে এসেছে। তনুকে ঢেকে নিচ্ছে। কোত্থেকে গন্ধ ছুঁচ্ছে টিপ-টিপ-টিপ। মাথায় মুখে কাপড়টা পেঁচিয়ে সে গোঙাচ্ছে,
-মা–ওমা–তুউমিই এসোও…।
**************************************************