Shadow

বৃদ্ধাশ্রম : সমস্যা? না সমাধান? – সোনালী গুহ

PC: Anandabazar.com

বৃদ্ধাশ্রম : সমস্যা? না সমাধান?

সোনালী গুহ 

বৈদিক ভারতবর্ষে চতুরাশ্রমের কথা পাওয়া যায় প্রৌঢ়ত্বে বাণপ্রস্থে যাবার রীতি ছিল সংসার থেকে  স্বেচ্ছায় নির্বাসনসংসারের সব  কাজ সেরে নিজের মতো জীবন যাপন করতে বাণপ্রস্থের পথে এগিয়ে যেতেন তখন সকলেসংসার ত্যাগ করে ঈশ্বর চিন্তায় দিন অতিবাহ করার জন্য এই ব্যবস্থাপঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎবাণপ্রস্থে এইরকমই নিয়ম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরকণিকাকাব্যগ্রন্থেরশাস্ত্রকবিতায় কবি যদিও বলেছেন,
পঞ্চাশোর্ধে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে,
আমরা বলি বাণপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে” …..
         কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে আছে,যখন গৃহস্থের নিজ দেহে বলি পলিত  উপস্থিত হবে এবং যখন পৌত্র ভূমিষ্ঠ হবে,তখন বনে গমন করা কর্তব্য “Retirement from household life.”
 সংসারে তখন সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করে,তাদের হাতে সব ছেড়ে বাণপ্রস্থে যাওয়াই শ্রেয়কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই নিয়ম আর মানা হয়নাএকান্নবর্তী পরিবারের ধারা প্রচলিত হতে সেখানে সকলে মিলেমিশে থাকাই হয় প্রচলিতবাড়ির বয়স্কজন সসম্মানে  সংসারের কর্তা হয়ে সকলকে দেখাশোনা করতেনতারপর পুত্র বড় হয়ে হাল ধরতেন সংসারেরসেখানেও পিতামাতার  যত্নের কোনো ত্রুটি হত না নাতি নাতনি সমভিব্যহারে করতেন দিনাতিপাতশিশুদেরও মানসিক বৃদ্ধিতে এক সুন্দর পরিপূর্ণতা পেতোকিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন তো স্বাভাবিকফলে,যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে একান্নবর্তী পরিবারে ঘটে ফাটলনিউক্লিয়ার পরিবারে বড় স্থান সঙ্কুলানস্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকুরীজীবী,ছোট ফ্ল্যাট,স্বাধীন থাকার মনোবৃত্তি,সব মিলিয়ে বৃদ্ধ পিতামাতার দায়িত্ব পালন করা নিয়ে ঘটে অশান্তিঅবশ্যই এই দায়িত্ব পালন করা প্রতিটি সন্তানের কর্তব্যকিন্তু এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাঁধে নানান গোলযোগ উপরে বর্ণিত কারণগুলি ছাড়াও আধুনিকা বধূটির সঙ্গে পুরনো দিনের মানসিকতার শাশুড়ির মনের মিল অবধারিত ভাবেই হয়নাশাশুড়ি বউর ঝগড়া তখন পরিবারের ভাঙন ঘটায়সংসারের এক কোণে নির্বাসিত হন বৃদ্ধ বৃদ্ধারাতার মধ্যে যেদিন তাঁরা একজন হয়ে যান,তখন থেকে একক নিঃসঙ্গ জীবন হয়ে ওঠে বড়ই যন্ত্রণাদায়কঅবশ্য এই ছবি সর্বত্র নয়সুখী গৃহকোণ শোভে বয়স্কজনএই ছবি দেখা যায় প্রচুরনাতি নাতনী নিয়ে সুখের সংসারবিংশ শতাব্দীতে এটাই স্বাভাবিক ছিলকিন্তু একান্নবর্তী পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবার পর থেকেআমি তুমি সন্তানএইরকম পরিবারের কাঠামো যখন প্রচলিত হতে লাগলো তখনবৃদ্ধাশ্রমধারণা টা চলতে শুরু করে
         বয়স্ক পিতা মাতার ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে অবশ্যই তাঁদের অনিচ্ছায়সবাই চান নিজের বাড়িতে ছেলে,বউ,নাতি,নাতনি নিয়ে শেষজীবনটা কাটিয়ে দিতে প্রিয়জনদের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতেকিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয়না,স্থান সঙ্কুলান,বিদেশে থাকতে হয় হয়তো জীবিকার তাগিদে,আবার অনেক সময় মতের অমিল হওয়ায় এইসব নানান কারণেতখন বাধ্য হয়ে তাঁদের ঘর ছাড়তে হয়অনেক সন্তান কষ্ট পেলেও বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেনঅনেকে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ছেড়ে আসেন তাঁদেরএইরকম একটা কাজ করতে তাঁদের বিবেক দংশন হয়কিন্তু পারিবারিক শান্তি রক্ষায় বাধ্য হন হয়তো
         এখন প্রশ্ন হল,বৃদ্ধাশ্রম সমস্যা না সমাধান? শাশুড়ি বৌমার বিবাদ যুগযুগ ধরে চলে আসছেদুই পক্ষেরই দোষ থাকে সবসময়ই এই নিয়ে বিচার করে লাভ নেইকিন্তু বাড়ির বয়স্ক দের স্থান বাড়িতে হবে না,এটা কিন্তু অনেকসময়ই একটা সমস্যা হয়ে ওঠেনিন্দার ঝড় ওঠেআবার এটা নিয়ে ভাবতে বসলে সমাধান কারো পছন্দ নাই হতে পারেকোনো একটা বৃদ্ধাশ্রমে উঁকি দিলে,তাঁদের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করা যায়মায়া অতি বিষমবস্তুতাই ঘর ছাড়া বৃদ্ধবৃদ্ধারা অনেকেই মনে মনে খুবই কষ্টে থাকেনঅসহায় লাগে তাঁদের দেখলেঅনেকেই থাকেন আশায়ভাবেন কবে ছেলে বা মেয়ে আসবে তাঁকে দেখতেকেউ বা নাতি নাতনির জন্য হাহুতাশ করেন মনে মনে মোটের উপর তারা বাধ্য হয়ে এই অবস্থা মেনে নিলেও থাকেন মনোকষ্টেনিজেদের অবহেলিত,অপমানিত,অবাঞ্ছিত মনে করে শেষের দিনের অপেক্ষায় কাটে দিনএটা নিঃসন্দেহে সমস্যাবয়স্ক পিতা মাতার ঠাঁই কেন হবে না পরিবারে? এটা একটা সামাজিক সমস্যাছোট ছোট শিশুরা কেন তাদের শৈশবে ঠাকুরদা,ঠাকুমার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে? রূপকথার ঝুলি নিয়ে কেন তাঁরা গৃহের পরিবেশ করবেন না আমোদিত? নিঃসন্দেহে এটা সমস্যা
         কিন্তু আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় গতির যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই বয়স্ক মানুষ দের অবস্থান কিন্তু অনেকাংশে স্বেচ্ছায় বদলে যাচ্ছেছেলে মেয়ে দের জীবনে প্রতিষ্ঠা করিয়ে পিতা মাতা চাইছেন নিজেদের মত করে বাঁচতেনিজেরাই বেছে নিচ্ছেন আধুনিক ব্যবস্থা সম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রমমনের আনন্দে সেখানে সমবয়স্ক মানুষদের সঙ্গে আনন্দে শেষ জীবনটা কাটানোর মধ্যে কিন্তু কোনো গ্লানি নেইনিজের ইচ্ছামত,স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার সকলেরই আছেআর এইরকম জায়গায় সেটা আজকাল পাওয়া যাচ্ছেনিজেদের মতকরে নানান অনুষ্ঠান পালন,বেড়াতে যাওয়া ,সান্ধ্য বৈঠক,পূজার্চনা প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিব্যি তাঁদের নিঃসঙ্গ জীবনের নিরাপত্তা যেমন পাচ্ছেন,তেমন কাটছে একাকীত্বএটাকে সমস্যা বলা যায় নাএটাই তো বর্তমান নাগরিক জীবনের বাণপ্রস্থ, – সমাধানঅনেকেই আজকাল পঞ্চাশ বছর হতেই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বৃদ্ধাশ্রমে নাম নথিভুক্ত করে রাখছেন কর্মজীবনের অবসরের পর,সাংসারিক দায়িত্ব পালনের পর চলে যাচ্ছেন সেখানে,বাকি জীবনটা সুন্দর ভাবে কাটাতে কারো উপর দোষারোপ নয়,স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই একটা ভালো এবং ইতিবাচক দিকহয়তো বিত্তবান একজন বয়স্ক মানুষ নিজগৃহেই চাকর বাকর রেখে দিন কাটাতে পারতেন,কিন্তু একাকীত্ব তাতে কাটতো নাছেলে মেয়েদের ব্যস্ত জীবনে সময় সত্যি নেইদূর দেশে থাকার কারণেই অনেকসময় সম্ভব হয়না সেক্ষেত্রে বাড়িতে বৃদ্ধ পিতামাতার নিরাপত্তাও একটা সমস্যা হয়বাড়ির কর্ম সহায়করাই অনেক সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁদের খুন করে সব কিছু ডাকাতি করেপ্রায়ই খবরে জানা যায় একাকী বৃদ্ধের মৃত্যু,হয়তো বেশ কয়েকদিন পরে দরজা ভেঙে মৃতদেহ উদ্ধারএটা আরো বেদনাদায়কএই পরিণতি কারো কাম্য নয়তার থেকে তিনি যদি বৃদ্ধাশ্রমে থাকতেন,তবে অন্তত তাঁর দেখাশোনা হতো,সময় মতো ডাক্তার,সেবা পেতেনউপরন্তু,সমবয়সী মানুষের সঙ্গ তাঁকে করত সমৃদ্ধবৃদ্ধ বয়সে এটাই প্রাপ্য সকলেরযেটা এইধরনের আশ্রমে মিলতে পারেআমরা একবিংশ শতাব্দীর মানুষ তাই নিজেই সচেতন হয়ে নিজেদের শেষ জীবনের ব্যবস্থা করে রাখিযাতে ছেলে মেয়েদের বিড়ম্বিত হতে না হয়,তারা যাতে অপরাধ বোধে না ভোগেতারা তো আমাদেরই সন্তান,তাদের সাফল্য,জীবনের প্রতিষ্ঠাই তো প্রত্যেক মানুষের একমাত্র কাম্যযোগাযোগ থাকবে,তারা আসবে সময় পেলেই,ওনারাও যেতে পারেন ঘুরতে কোনো সময়,সম্পর্কও ভালো থাকবে,আবার নিজেদের স্বাধীন সত্তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটলো নাতাই বৃদ্ধাশ্রম কোনো সমস্যা নয়,বরং সমাধানই
         বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানটা শুনলে চোখে জল আসতে বাধ্য আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য সন্তানরাতাদের সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে যেমন পুরনো আসবাব বেমানান,তেমনি মা বাবাওছোট ছোট ফ্ল্যাটে একটা ঘর মা বাবাকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়না অতএব,মা বাবার জন্য বৃদ্ধাশ্রমচারিদিকে নিন্দার ঝড়,আত্মীয় স্বজনের কানাকানি,মা বাবার দীর্ঘশ্বাস,চোখের জল নগরসভ্যতায় এটা সত্যি একটা সমস্যাতাই মানিয়ে চলতে গিয়েই সংসারে শুরু হয় অশান্তিএটা তো সামাজিক সমস্যাই বটেআগেকার দিনে বড় বাড়িতে,স্থান সঙ্কুলান হত নাএকান্নবর্তী পরিবারের পরিকাঠামোয় এই সমস্যা ছিল নাতখন বৃদ্ধাশ্রমের কল্পনাও ছিল নাকিন্তু নগরসভ্যতায় মানুষ যত অভ্যস্ত হয়েছে,ততই সংসার ছোট হয়েছেনিউক্লিয়ার পরিবারের জন্য বাসস্থানও হয়েছে ছোট,সামর্থের কথাও আছে অবশ্যইপ্র্যাকটিক্যাল মানুষ তখন কর্মদায়ীনি ব্যবস্থায় এইরকম শিশুদের জন্য ক্রেশ,বৃদ্ধদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি করেছেউপায় বা কী! সমস্যার সমাধান এইভাবেই এসেছে যান্ত্রিক জীবনে
         তাই কাউকে দোষারোপ না করে,পিতামাতারা আজকাল অনেকেই নিজেরাই তাঁদের বুড়ো বয়েসের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে নিচ্ছেনঅত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সর্বত্র,তাই ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে বুকিং করে রাখছেন কর্মজীবনের অবসরের বয়সসীমা আসার আগেইঅন্যের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার কষ্ট আছে,কিন্তু স্বইচ্ছায় এই ব্যবস্থা মেনে নিতে আনন্দই আছে,বেশ রোমাঞ্চকরও বটেএটাই তো স্বাভাবিক সমাধানএই কারণেই আগের দিনের মত, বৃদ্ধাশ্রমগুলোর নামেও বেহাগের সুর শোনা যায় না,বরং আনন্দ উচ্ছ্বল অর্কেস্ট্রার সিম্ফোনিই হয় ধ্বনিত
         আধুনিক মানুষ মনে করেন,ষাটের পরই আসল জীবন শুরুজীবনের দায়িত্ব কর্তব্য শেষে নিজের মত করে বাঁচতে পারেন তখনবন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা,গান,আবৃত্তি,নাটক নানাবিধ জৈবনিক উপকরণ একসঙ্গে রঙিন এক স্বপ্নের যাপন সম্ভব তখন বৃদ্ধাশ্রমেআধুনিক এই আবাসগুলোতে এই সব ব্যবস্থাই মজুদ যার যেমন সামর্থ্য সেই অনুযায়ী বিলাসবহুল ঘরই তিনি পেতে পারেননিজের পছন্দমতো থাকার মধ্যে আছে অপার শান্তি এখানেও বলা যায়,”এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়,/একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু!” এখানেও কোনো নিঃসঙ্গ জীবনে খুশিয়াল মুহূর্ত আসতে পারে,বদলে যেতে পারে যাপন চিত্রকোনো একক জীবনের পথচলা দ্বৈত জীবনের হাতছানিতে হয়ে উঠতে পারে সঙ্গীতমুখরমোদের পাকবে না চুল,পাকবে না চুল গো “… এই সবুজ মন নিয়েই এখানে জীবনের বাকী সময়কাল সুন্দরভাবে কাটানো যায়
         তাই বৃদ্ধাশ্রম আজকের যুগে কোনো সমস্যা নয়,বরং সুন্দর সমাধান
**********************************************************
সোনালী গুহ পরিচিতি:
পেশায় শিক্ষিকা। মাতৃভাষায় কিছুটা মনের আনন্দে লেখালিখি করেন। অত্যন্ত অমায়িক, সবার সাথে মিলেমিশে, সবাইকে নিয়ে চলতে স্বস্তি অনুভব করেন।

 

 

                                

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!