Shadow

বন্ধু – ডঃ গৌতম সরকার

PC: iStock

বন্ধু

ডঃ গৌতম সরকার

এদিকটায় নন্দ আগে কখনও আসেনি। কয়েকটা বাড়িঘর, একটা বড় মাঠ আর পুকুর পেরিয়ে জঙ্গল শুরু হয়েছে। নন্দর আজ এতটাই মনখারাপ যে বেখেয়ালে জঙ্গুলে পথ পেরিয়ে অনেকটা ভিতরে চলে এসেছে৷ যত এগোচ্ছে জঙ্গল আরও ঘন হচ্ছে, বড় বড় গাছগুলো মাথার ওপর যেন চাঁদোয়া খাটিয়ে রেখেছে। রোদ প্রায় ঢুকতেই পারছেনা। ভরা দুপুরেও জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পরিষ্কার জায়গা দেখে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। স্কুলের ব্যাগটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলো।
কিছুদিন আগে নন্দ কৃষ্ণনগরে মাসির বাড়ি গিয়েছিল। সেখানেই প্রথম স্মার্টফোন দেখে। এত তাক লেগে গিয়েছিল, বাড়ি ফিরে বহুদিন ঘ্যানঘ্যান করেছে ওরকম একটা মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার জন্যে। মোবাইল তো জোটেইনি, উল্টে বাবার হাতে বেদম পেটানি জুটেছে। আজ ক্লাসে বিপিনের হাতে স্মার্টফোন দেখে পুরোনো দুঃখটাই চাগিয়ে উঠেছিল। তাতাইদার কাছে সে ফোনের অনেক ফাংশন শিখেছিল। আজ বিপনে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতেই সারা ক্লাস হৈ হৈ করে উঠল। নন্দ খুব ভালোভাবেই জানে ক্লাসের কোনো ব্যাটা কিচ্ছু জানেনা। কিছুটা মাতব্বরি দেখাতেই সবাইকে ঠেলে সরিয়ে বিপিনের হাত থেকে মোবাইলটা নিতে গিয়েছিল। কিন্তু বিপিন ওকে দেখে ওরকম ছিটকে সরে যাবে সে বুঝতে পারেনি৷ ধাক্কাধাক্কিতে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। মোবাইলের কিছু না হওয়া সত্ত্বেও বিপনে চিৎকার করে মরাকান্না শুরু করে দেয়। ঠিক সেইসময় পন্ডিতমশাই ক্লাসে ঢোকে, সব শুনে নন্দকে শুধু ক্লাস থেকে নয়, দারোয়ান ডেকে স্কুল থেকেই বের করে দিয়েছে।
এখন বাড়ি ফেরার কোনো প্রশ্ন নেই। অগত্যা ঘুরতে ঘুরতে এই জঙ্গলে এসে পৌঁছেছে। জঙ্গলটা নন্দর বেশ পছন্দ হয়ে গেল। চারদিক শুনশান, আরামদায়ক একটা হাওয়া দিচ্ছে৷ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কিরকম একটা ঘোর লেগে গেল।
 ছেলেটাকে প্রথমে খেয়াল করেনি, একটা খস্ খস্ আওয়াজে চমকে পিছনে ফিরে দেখে, হাত দশেক দূরে একটা ছেলে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কালো গায়ের রং, দোহারা চেহারা। উর্দ্ধাঙ্গ খোলা, কোমরে একটা কাপড় মালকোচা মেরে পরা। নন্দ একটু অবাক হল, এ গাঁয়ে কোনো ছেলেকে এরকম ধুতি পরতে দেখেনি। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। এবার ছেলেটা নিজে থেকেই এগিয়ে এলো।
“তোমার নাম কি?” নন্দ নিজের নাম বলে ছেলেটাকে একই প্রশ্ন করলো।
“হারু”৷
নন্দ জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কোথায় থাকো?”
ছেলেটা হাত বাড়িয়ে পিছনের দিকে ইশারা করলো।
নন্দ বললো, “এই জঙ্গলে কোনো গ্রাম আছে বলে তো জানতাম না!”
ছেলেটা উত্তর না দিয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগলো। হাসলে ছেলেটার দুপাটি দুধসাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ে। ছেলেটা নন্দর পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলো,
“তোমাকে তো এ জঙ্গলে আগে কখনও দেখিনি !”
নন্দ আসল কারণটা বলতে গিয়েও চেপে গেল। কি জানি! সব শুনে এও যদি দাঁত বের করে হেসে ওঠে। নন্দ উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো,
“তুমি বুঝি এই জঙ্গলে রোজ আসো?” ছেলেটি একইরকম হাসি দিয়ে বললো,
“আসবো কেন? আমরা তো এখানেই থাকি। এখান থেকে আমাদের গ্রাম একদম দূরে নয়”৷
নন্দর বিস্ময় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে৷ গ্রাম! এখানে বসতি আছে তাই তো সে জানেনা।
“তুমি স্কুলে যাও না?” ছেলেটি ঘাড় নাড়ে।
“তাহলে কি বাড়িতে পড়াশোনা করো?” এবারও ছেলেটা ঘাড় নাড়ে। নন্দর মধ্যে একটা হিংসে চিনচিন করে উঠলো।
নন্দ বলে, “এই জঙ্গলে থাকতে তোমার ভয় করেনা?”
ছেলেটি বলে, “ভয় কেন করবে! এখানে আমরা সবাই খুব মজা করে থাকি। তুমি যাবে আমাদের গ্রামে?” নন্দ সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলতে পারলোনা। সে ছেলেটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। তাছাড়া গ্রাম কতদূর কে জানে! স্কুলের ছুটির সাথে ঘন্টা মিলিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। দেরি হলে কপালে ডাবল শাস্তি জুটবে। ছেলেটা ওর ইতস্ততঃ ভাবটা বুঝতে পেরে বললো,
“চলোনা, তোমার দেরি হয়ে যাবেনা। গ্রাম ঘুরিয়ে আমি তোমাকে সময়মতো জঙ্গলের বাইরে পৌঁছে দেব”৷
নন্দ রাজি হয়ে গেল, ছেলেটার হাত ধরে ঘাস পাতা মাড়িয়ে কয়েকটা বড় বড় গাছ ছেড়ে এগোতেই ভোজবাজির চমকে চোখের সামনে একটা গ্রাম উঠে এল৷ এত সুন্দর একটা গ্রাম এখানে থাকতে পারে সেটা নন্দর কল্পনায় ছিলোনা৷ মাটির বাড়িঘর, খাপরার চাল, ফসলভরা জমি, পুকুর-দীঘি নিয়ে গ্রামটি দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষেরা জমিতে কাজ করছে, মহিলারা ঘরকন্না সামলাচ্ছে, বাচ্চারা হুটোপাটি করছে। হারু ওর হাত ধরে প্রথমে যেখানে নিয়ে গেল সেখানে একটা চালার নিচে কয়েকজন বৃদ্ধমানুষ বসে হুঁকো খাচ্ছে৷ নন্দ কখনও কাউকে হুঁকো খেতে দেখেনি। ওদের মধ্যে একজনের কাছে এগিয়ে হারু বললো, “গাঁওবুড়ো, এ আমার বন্ধু, ওর নাম নন্দ। আমাদের গ্রাম ঘুরতে এসেছে”। বৃদ্ধ একমুখ হাসি মেখে বললেন, “বাঃ বাঃ ! খুব ভালো কথা। কিন্তু বাবা, আমাদের গ্রাম কি তোমার ভালো লাগবে ! আমাদের গ্রামে তো কিছুই নেই। ইলেকট্রিক আলো, পাখা, টেলিভিশন, কলের গান, মোবাইল এসব কিছুই নেই”। নন্দ তখন চোখের সামনে যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হচ্ছে। হারু ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল। হারুর মা তাকে ফলের রস খেতে দিল, এরকম উপাদেয় পানীয় নন্দ জীবনে কখনো খেয়েছে বলে মনে পড়লোনা। এরপর ওরা চললো গ্রাম ঘুরতে।  ইতিমধ্যে হারুর বন্ধুরা এসে জুটেছে৷ সবাই মিলে চললো বিন্তি নদীর ধারে। জঙ্গলের মধ্যে একটা নদী আছে নন্দকে কেউ বলেনি। পারে ছোট ছোট শালতি সাজানো, তাতে রাখা ছোট্ট ছোট্ট দাঁড়। ছেলের দল হুড়মুড়িয়ে শালতিতে উঠে একটা একটা দাঁড় নিয়ে বসে গেল। নন্দ সাঁতার জানে, কিন্তু সে কখনো নৌকা বায়নি। তার ইতস্ততঃ ভাব লক্ষ্য করে হারু ওর হাত ধরে একটা নৌকায় উঠে পড়লো। ছোট্ট নৌকাগুলো হাওয়ার টানে তিরতির করে ভেসে চলল৷ এখানকার বাচ্চারা সারাদিন খেলা করে, ময়না বিলের খাঁড়ি থেকে চুনো মাছ ধরে, যখন খুশি গাছে উঠে পাকা ফল পেড়ে খায়, কেউ তাড়া করেনা, কেউ বকেনা। দাঁড় বাইতে বাইতে ওরা মাঝনদীতে চলে এল, হঠাৎ নন্দকে অবাক করে দিয়ে আশপাশের নৌকা থেকে বাচ্চাগুলো ঝুপ ঝুপ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর চলল ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতারের কেরামতি৷ হারু ঝাঁপ দিলে নন্দ আর নিজেকে রুখতে পারলোনা, জামাটা খুলে সেও লাফিয়ে পড়ল৷
সময় রূপকথার পাখির হলুদ ডানায় ভর করে কেটে যেতে লাগলো। নদী থেকে ফিরে সবাই মিলে গেল কুসুমকানন। এই বাগান বাচ্চাগুলো নিজেদের হাতে বানিয়েছে। কত রকমের যে ফুল, তাদের কত রঙের বাহার। ফুলের চারপাশে প্রজাপতি, ভ্রমর উড়ে বেড়াচ্ছে। এরা কেউ  প্রজাপতি ধরেনা, তাদের পাখনা ছিঁড়ে দেয়না। সকালে সবাই নিয়ম করে গাছের পরিচর্যা করে। বিকেলে যায় হাতের কাজ শিখতে, দরকারি সব জিনিস এরা নিজেরাই বানিয়ে নেয়। ছোটোরা বড়দের  থেকে কাজ শেখে, সেটাই তাদের পাঠশালা। কোনও জোরাজুরি নেই, যার যেটা ভালো লাগে শেখে। কেউ মাটির জিনিস তৈরি করে, কেউ কাপড়-জামা বানাতে শেখে, কেউ পট আঁকে, কেউ মূর্তি বানায় আবার কেউ চাষের কাজ শেখে। আর ছেলেবুড়ো সবাই সন্ধ্যেবেলা গাঁওবুড়োর কাছে গল্প শোনে। গাঁওবুড়ো যে কতরকমের গল্প জানে তার ইয়ত্তা নেই। আশপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে নন্দর বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে, হারুর হাত ধরে বলল, “ভাই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি আমাকে জঙ্গলের বাইরে রেখে আসবে চল”৷ তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে দৌড় লাগালো৷ ঠিক সেই সময় ঈশান কোণে লুকিয়ে থাকা একটা দুষ্টু কালো মেঘ ওদের মাথায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল। ওরা বৃষ্টির মধ্যে দৌড়তে লাগলো। একসময় হোঁচট লেগে নন্দ হারুর হাত ছাড়িয়ে ছিটকে পড়লো।
ঘোর কাটতে নন্দ দেখলো সে গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে, পায়ের কাছে স্কুল ব্যাগটা পড়ে। আশপাশ আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেছে, কিন্তু বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই। নন্দ অবাক হয়ে ভাবলো, তবে কি সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল! কিন্তু ভীষণ অবাক হল যখন দেখল তার পরনের জামাকাপড় ভিজে জবজব করছে।
রাত্রিবেলা নন্দর ভীষণ জ্বর এলো, ভোরবেলায় জ্বর একশো দুই ছুঁল। নন্দর মা মাথায় বালতি বালতি জল ঢালতে লাগলো। জ্বর না কমায় বেলায় হারান ডাক্তারকে কল দিতে হল। হারান ডাক্তার নিদান দিলেন, ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়েছে, বুকে কফ জমে গেছে, সারতে কিছুদিন সময় লাগবে। নন্দ সারাটা দিন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে রইলো৷
লালমাটির পথ ধরে হেঁটে চলেছে নন্দ, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। তার হলুদ জলে খেলে বেড়াচ্ছে নানা রঙের মাছ। আর কি আশ্চর্য ! মাছগুলো মানুষের গলায় কথা বলছে, হাসছে, গান গাইছে। নন্দ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকে দাঁড়াতে দেখে একটা গোলাপী রঙা মাছ, নীল চোখ তুলে প্রশ্ন করলো, “তোমার কি হয়েছে গো ছেলে? মুখটা ওরকম শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
নন্দ উত্তর দেয়, “আমার জ্বর হয়েছে”৷
“কেন? জ্বর হল কেন?”
“আমি আমার বন্ধু হারুর সাথে নদীতে সাঁতার কেটেছি, তারপর বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়েছে”৷ একথা শুনে গোলাপি মাছ খিল খিল করে হেসে ওঠে,
“মাগো মা! এমন কথা জীবনেও শুনিনি। সাঁতার কাটলে, জলে ভিজলে কখনও কারোর জ্বর হয়! এই তো আমরা চব্বিশ ঘন্টা জলে থাকি, কই আমাদের তো জ্বর জ্বালা নেই!”
নন্দ চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর বলল, “কবিরাজমশাই তো তাই বলল”৷
“তা তোমার সেই বন্ধু কোথায়! হারু?”
নন্দ হাত ওল্টায়।
“সে কেমন বন্ধু তোমার? শরীর খারাপ…তবু সে তোমাকে দেখতে আসেনি?”
“কেমন করে আসবে, সে কি জানে আমার শরীর খারাপ?”
“কেন জানবে না? সত্যিকারের বন্ধু হলে নিশ্চয়ই জানবে। বিপদের কথা টের না পেলে সে কিসের বন্ধু। শোনো ছেলে, তোমার সেই বন্ধু না এলে তোমার জ্বর কিন্তু সারবেনা৷” এই বলে গোলাপি মাছ টুপ করে জলে ডুবে গেল, আর নন্দর ঘুমও ভেঙে গেল।
সত্যিই নন্দর খুব অভিমান হচ্ছে। এই যে কদিন নন্দ যেতে পারেনি, হারুর কি একবার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলোনা। হ্যাঁ বাড়ির ঠিকানা সে জানেনা সত্যি, কিন্তু নাম তো জানে, কতটুকুই আর দূরত্ব, নাম ধরে খুঁজতে খুঁজতে এলে ঠিক নন্দর বাড়ি পৌঁছে যেত৷ নন্দর চোখে জল এসে গেল। সেদিন কি মজা আর আনন্দে সময়টা কেটেছিল। আচ্ছা যে দোপাটি গাছটায় ছোট ছোট কুঁড়ি দেখে এসেছিল, সেটায় কি ফুল ফুটে গেছে! কি রঙের ফুল হয়েছে! নন্দ বলেছিল, বেগুনির ওপর লালের ছিটে ছিটে হবে…আর ওই লালু কুকুরটা পাঁচিল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল, হারু তার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। সে কি এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটছে? না আর ভাববে না, ভেবে কি করবে! হারু ওকে মোটেই বন্ধু মনে করে না। করলে কি আর….! আবার মাথার যন্ত্রণা . শুরু হয়েছে, জ্বর বাড়ছে। ঘুমিয়ে যেতে যেতে কিংবা চেতনা হারাতে হারাতে নন্দ প্রতিজ্ঞা করলো সুস্থ হওয়ার পর আর কখনও হারুর গাঁয়ে যাবেনা।
অনেকক্ষণ ধরে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার হতে চেষ্টা করছে৷ সুড়ঙ্গের শেষ কোথায় সে জানেনা। কিন্তু মনে হচ্ছে সুড়ঙ্গটা পেরোতে পারলেই সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। হাতড়ে হাতড়ে ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে চলল। খুব কষ্ট হচ্ছে, অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, তবুও সে থামছে না। এই অন্ধকারের শেষ তাকে দেখতেই হবে। একসময় সে না পেরে বসে পড়লো, হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগলো। হাঁটু ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে চলা থামাচ্ছেনা। অনেক পর দূরে আলোর হালকা আভাস চোখে পড়লো। প্রাণপণ চেষ্টায় গুহামুখে পৌঁছলো। সুড়ঙ্গের বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখে… আরে এ তো তার পরিচিত জায়গা! এটাই তো হারুদের গ্রাম!  সুড়ঙ্গের বাইরে বেরোতেই হই হই করে হারুসমেত বাচ্চাগুলো তাকে ঘিরে ধরলো। প্রচন্ড অভিমানে নন্দর চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো। হারু পায়ে পায়ে এগিয়ে নন্দর হাত ধরলো, “তুমি রাগ করেছ ভাই?”
নন্দ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, “রাগ করবোনা! আমার এত জ্বর, এত কষ্ট, কই তুমি তো একদিনও আমাকে দেখতে এলেনা !”
হারু চুপ করে রইল, ফোঁপানি কমলে ম্লান স্বরে বললো,
“কিন্তু আমাদের যে তোমাদের জগতে যাওয়া মানা”৷
“কেন?” ভিজে চোখ তুলে নন্দ প্রশ্ন করে।
“তা জানিনা, গাঁওবুড়ো বলেছে আমরা যেন কখনও জঙ্গলের বাইরে না যাই”৷ নন্দ হাঁ করে হারুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হারু বলল, “তাতে কি হয়েছে, তুমি তো এসেছো। চল তোমাকে গাঁওবুড়োর কাছে নিয়ে যাচ্ছি, তোমার কপালে হাত বুলিয়ে দিলে ফুসমন্তরে জ্বর ভ্যানিশ হয়ে যাবে”। নন্দ সত্যিই টের পেল, গাঁওবুড়ো তার ঠান্ডা হাতটা কপালে বুলিয়ে দিতে সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। হারু ওর হাত ধরে টানতে টানতে অন্য বন্ধুদের ডাক দিল, “এই চল আমরা নন্দকে নিয়ে কুঠিবাড়ির জঙ্গলে যাই। আজ ওখানে দোয়েল পাখিদের ডিম ভেঙে বাচ্চা দেওয়ার কথা, গাঁওবুড়ো সকালে বলছিল”৷ সবাই মিলে কুঠিবাড়ির দিকে দৌড়োলো, নন্দও তাদের পায়ে পা মেলালো।
মায়ের গলার আওয়াজে ঘোর কাটলো। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানাতে জানাতে মা বলছে, “ঠাকুর তুমিই আমার বাছাকে ভালো করে দিলে, ওর শরীরে আর এতটুকু জ্বর নেই”। মার কথা শুনতে পেয়ে পাশের ঘর থেকে ঠাকুরদা বললেন, “তাহলে বৌমা ছেলেটাকে আজ একটু ঝোল ভাত দিও। চারদিন বেচারি কিছুই তো খায়নি”৷ নন্দ ভাবতে লাগলো, স্বপ্ন কি কখনও এত স্পষ্ট হতে পারে, এখনও যে তার কব্জিতে হারুর হাতের ওম লেগে আছে।
******************************************************
গৌতম সরকার পরিচিতি :
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার পিয়াসাড়া গ্রামে ৷ উচ্চশিক্ষা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ অর্থনীতি বিষয় হিসাবে বেছে নিলেও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা শৈশব থেকে ৷ যেকোনো মননশীল রচনার একনিষ্ঠ পাঠক ৷ তবে লেখার ব্যাপারে চুড়ান্ত আলস্য বোধ করেন ৷ ফেসবুকের বাইরে লেখা শুরু করোনাকালীন ঘরবদ্ধ সময়ে ৷ পছন্দের বিষয়: ভ্রমণ কাহিনী, বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ক  প্রবন্ধ, রম্য রচনা, গল্প, এবং দৈবাৎ কবিতা, যা বিভিন্ন পত্রিকা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে ৷ দেশ-বিদেশ ভ্রমণ এবং সাহিত্যচর্চা প্রধান বিনোদন ৷

 

                       

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!