পপামাসীর তৃতীয় অভিযানঃ জা লে র জা লে
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত
ড্যাস রে সাহেব মুচকি হেসে বললেন,এতদিন ধরে সাউথ ক্যালকাটা ক্লাবে আসছি,এমনটা হয়নি কখনো। রথ দেখা আর কলাবেচা,এদেশে এই চান্স খুব কম, প্রাডোট্ সেন মাথানেড়ে বললেন,সে আর বলতে?
ভবানীপুরের এই শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবের সান্ধ্য আড্ডা যেন তারকা সম্মেলন। রথ্ অ্যান্ড কোলম্যানের জিএম মার্কেটিং হ্যার্ডন ড্যাস্ রে ওরফে এইচ ডি রে আজ বেশ মুডে। গতকাল রাতে ইউএআইয়ের প্রায় এক কোটি ডলারের কন্ট্রাক্ট টা ফাইনাল হয়েছে। এর ফর্টি পারসেন্ট অর্থ চুক্তি মত কোম্পানির অ্যাকাউন্টে আগাম জমাও পড়ে গেছে।
দূর থেকে মিসেস দেশমুখ রাণাড়ে সাহেব কে দেখে হাত নাড়লেন। লোটাস ইন্ডিয়ার জেনারেল ম্যানেজার মাধুরি দেশমুখের সঙ্গে সুমিত এগ্রোর ডিরেক্টর কাম মালিক অজেয় রাণাড়ের একটু বেশী ইন্টিমেসী এখন আর কারও অজানা নেই। এই ব্যাপারটা এখন বেশ চর্চার বিষয়!টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন ইন্টু থ্রিসিক্সটিফাইভ দিন এই সব এলিটরা ব্যস্ত। আজ দুবাই তো কাল কোপেনহেগেন,পর্শু নাইরোবি তো পরদিন লন্ডন,প্যারিস, নিউইয়র্ক। ব্যবসা,ব্যবসা আর ব্যবসা। এর মধ্যে এই ক্লাবের পার্টি যেন ওয়েসিস। সকলেই চেষ্টা করেন থার্ড স্যাটারডে অব এভেরি মান্থ এই সান্ধ্য পার্টিতে আসতে,যদিও সময় পেলেই এখানে এঁরা একবার ঢুঁ মারবেন। সকালে টার্ফ ক্লাবের গল্ফের মাঠে আর সন্ধ্যায় এখানে, এই সাদার্ন ক্যালকাটা ক্লাবে আড্ডা আর কোটি কোটির ব্যবসা দুটোই চলে। আজ আবার বিশেষ মিটিং। যতটা কাজের তারচেয়ে বেশী মজার,কৌতুহলের। সকলেই আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে আজ এসেছেন। বিশেষ আমন্ত্রণ। সোহ্ রাব আলির গজল আর সংগে নিজের পছন্দের ড্রিংকস,অঢেল খানাপিনা। আলি সাহেবের গজলের টিকিট পাওয়া খুব কষ্টের। এখানে নাকি শেষে গজল সম্রাটের সংগে ফোটো সেশন।
ঘোষণা মত হেল্প ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের পক্ষ থেকে নিখুঁত ব্যবস্থা।
দুই।।
একদম প্রথম সারির মাঝামাঝি আমাদের সীট। প্রথমে সুকান্ত আচার্যের গান। সুকান্ত-জয়িতা এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। আর আছে সুমিতা। এরপর শঙ্কর হালদারের নাটক। একদম ঠাসা প্রোগ্রাম। সুকান্ত স্টেজে উঠতেই হাততালি। পপামাসী বলে,সুকান্ত নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত কে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে যে এখন নাকি ওর কোনই প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
এখানে আমাদের পরিচয়টা জানিয়ে রাখি। আমার মায়েরা দুই বোন। বড় বোন, মানে আমার মা হলেন রুমঝুম, ডাক নাম শম্পা, বাবার নাম সুভদ্র রায়চৌধুরী। মা গৃহবধূ আর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি গ্রুপ এ অফিসার।
পপামাসীর ভালো নাম পমপম বিশ্বাস, জুলজি তে পিএইচডি, আইপিএস করে গোয়েন্দা বিভাগে বেশ উঁচু পোস্টে। ডাক নাম পম্পা। ছোট বেলায় আমি পম্পা উচ্চারণ করতে পারতাম না।মাসীকে পপা বলতাম। আজও তা পাল্টায় নি!পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মাসী পড়াশোনা,খেলাধুলো,নাচে,গানে তুখোড়। বিশ্বভারতী থেকে সঙ্গীত নিয়ে এমএ। আকাশবাণীতে নিয়মিত গান গাইতো। এখন সময় পায়না। দারুণ পিয়ানো বাজায়। বেজায় ডানপিটে। বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে একটুর জন্য বেঁচে যায়। তাই ওর ডান চোখের কোনের কাটা দাগটা আজও আছে। বাঁ গালের ঠিক মাঝখানে খুব ছোট্ট একটা জড়ুল কে তিল বলে ভুল হয়। ওটা মাসীর আইডেন্টিটি! আমার নাম মুনমুন রায় চৌধুরী। স্ট্যাটিসটিক্স-ইকনোমিক্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করছি। ডাক নাম মুন। ছুটি টুটি পেলেই সোজা মাসীর কাছে চলে আসি। যেমন এসেছি। কোভিডের জন্য এখন কলেজ বন্ধ।
-বুঝলি রে?আমার কিন্তু সবকিছুই কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে!
-কেন?
-হেল্প ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের অল্প দিনেই এত রমরমা অবস্থা!
-কিন্তু ওরা তো বলছে এটা ৩৬ বছরের একটা পুরনো এন জি ও?
-সেখানেই তো গোলমাল! নেট সার্চ করে দেখলাম,ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নামে একটা সংস্থা ছিলো। ৩৬ বছর আগের। দিল্লির হাউজখাস এলাকায় অফিস। জনা পাঁচেক এক্স আর্মির স্ত্রী রা এটা তৈরি করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বব্যপী প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কোনও কারণেই হোক সংস্থা টি একরকম বন্ধ হয়ে যায়!
আমি বললাম ভালোইতো। একঢিলে দুই পাখি মারা হবে। গান শোনা আর তদন্ত,দুটোই একসঙ্গে হোক না। মাসী বললে,ঠিকই বলেছিস। আমার মাথায় যখন একটা সন্দেহের ভুত ঢুকেছে তখন শেষ দেখতে ক্ষতি কোথায়?
-আরেকটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে, এই সংস্থার ডিরেক্টর একজন আই এ এস। তিনি আবার সরকারের একটা বড়সড়ো পদে আছেন।
-তা হলে শুধু শুধু এ নিয়ে ভেবে লাভ কি?
-সেট একরকম ঠিকই বলেছিস। কিন্তু ডিরেক্টর সাহেবের দপ্তরেরই তো ঠিক ঠাক খোঁজ পাচ্ছিনা। যদিও মাত্র দেড় দিন সময় পেয়েছি।
-তোমার এই সন্দেহের কথা উপর ওয়ালাকে জানিয়েছ?
-আমার ডিআইজি সাহেব কে বলেছিলাম রে। উনি খুব একটা পাত্তা দিলেন না। বললেন,অন্য কাজে চোখ দিতে।তাইই হয়তো করতাম। কিন্তু..
-কিন্তু কেন?আমি প্রশ্ন করি।
-তোকে সেই বিরক্তিকর প্রাক্তন ডিআইজি,পাগলাটে বুড়োটার কথা বলেছিলাম,মনে আছে? আমার গানের পাগল? আমাকে আধুনিক গানও গাইতে বলেন? কীভাবে যে এই মাথা মোটাটাকে কাটাবো ভেবে পাচ্ছিনা রে। মোস্ট বোরিং সেই বুর্বাক বুড়োটা আবার একথা শুনে বললেন “যেখানে দেখিবে ছাই..!” তিনি যে আবার গোপনে তদন্ত চালিয়ে যেতে বললেন।
-ওঁর কথাকে এত পাত্তা দিচ্ছ কেন?
-আসলে ওই বুড়োটা বিরক্তিকর, একঘেয়ে, বাচাল হলেও ভেবে দেখলাম আমাকে তো উনি কখনো অসম্মান করেন নি। বরং একটু স্নেহই করেন। আমি বহুবার ওঁকে অপমান করেছি,যা নয় তাই বলেছি,আঘাত দিয়ে কথা বলেছি কিন্তু গায়ে মাখেন নি। উল্টে যা বলেছি তাইই করেছেন। তৎক্ষনাৎ। অনেক রহস্যভেদে সাহায্য করেছেন।সে কারনেই..
ডিআইজি সাহেব নিজেই আসতেন। কিন্তু বিশেষ কাজে উনি দিল্লিতে। যাবার আগে তাই পপামাসীকে বলে গেছেন এই অনুষ্ঠানে আসনে। পপামাসীও তো গানের লোক!
পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের জোরালো আওয়াজে পপামাসীর মৃদু কন্ঠ ঢাকা পড়ে যায়। অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে।
ঘোষণার মাঝে সংস্থার পক্ষ থেকে আমাদের দেওয়া হলো একটিকরে সুন্দর চাদর,একটা বই,ঢাউস প্যাকেটে সম্ভবত শুকনো খাবার,ফুলের বোকে,কলম আর লেখার প্যাড। সুকান্ত আচার্য ধরলেন “আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে….”। ওর ভরাট আর উদাত্ত কণ্ঠে গমগম করে উঠলো চারদিক। আমাদের প্রাণে যেন ছুঁয়ে যেতে লাগলো আগুনের পরশমণির স্নিগ্ধ উষ্ণতা…।
তিন।।
কাল বিকেলে অফিস থেকে ফিরে পপামাসী খবরটা দিলো। এমনিতে পপামাসী নিজের অফিসের ব্যাপার নিয়ে খুব একটা মুখ খোলে না। গতবছর ওঁর প্রমোশনের ব্যাপারটাও জানতাম না। কাল বিকেলেও প্রথমে মুখ খোলেনি। ঢাউস ঢাউস দুই ব্যাগ ভর্তি খাবার নামাতে দেখে ভাবলাম সন্ধ্যেটা গান বাজনা খাবার দাবারে ভালো কাটবে! বলতে ভুলে গেসলাম,মাসী ইদানিং সময় পেলে নিয়মিত রেওয়াজ করছে,গাইছে। রবীন্দ্র সঙ্গীত,নজরুল,ডি এল রায়,অতুল প্রসাদ,সব যেন ওর গলায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ইদানিং আবার মাসীর সিনিয়র, রিটায়ার্ড, দূরবাসী কলিগ এক আধপাগল(মাসীই বলে),গান পাগল বুড়োর চাপাচাপিতে আধুনিক গানও গাইতে হচ্ছে! এই বুড়োটা নাকি মাসীকে কখনো কখনো দরকারে তদন্ত নিয়ে সাহায্য করে থাকে। যদিও মাসী বুড়োটাকে একদমই পছন্দ করেনা,অ্যাভয়েড করে! রেগে যায়,একটুতেই কথা শোনায়, কিন্ত ভদ্রতার খাতিরে আবার ফেলতেও পারেনা,এটাই হয়েছে মুস্কিল। কী ভাবে যে এর থেকে বাঁচবো,জানিনা! একথা মাসীই বলেছে হাসতে হাসতে!
ওর সুরোকার স্কেল চেঞ্জ হারমোনিয়মটা টিউনিং করে এনেছে। কখনো ওটাতে আবার কখনো পিয়ানো নিয়ে গায়। কী অসাধারণ যে লাগে। পাশের ফ্ল্যাটের ব্যাঙ্ক ম্যানেজার প্রসেনজিৎ কাকু দুরন্ত তবলা বাজান,কাকু এসে সঙ্গত করেন। উপরতলার সুব্রম্মনিয়ম জেঠু কখনো আসেন বেহালা নিয়ে। মন্দিরা কাকীমা তানপুরায় সুর ধরেন। আসেন কৃশানু জেঠু। কৃশানু মিত্র।একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত ভি সি। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ গবেষক। এনিয়ে ওঁর প্রচুর পড়াশোনা আর বই আছে। দার্শনিকের মতন মানুষটি প্রায় ত্রিশ চল্লিশ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে এই গানের মিলন সভায় মাঝে মাঝে চলে আসেন। চুপচাপ গানবাজনা শোনেন। চলে যান। আর আসেন ইন্দ্রজিৎ কাকু। ইন্দ্রজিৎ সরকার। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। এক আধা সরকারি সংস্থার জিএম। দারুন ফোটো তোলেন। গাড়ি পাগল শান্তশিষ্ট মানুষ। গ্যারোজে একাধিক গাড়ি। কখনো এলে মুভি তোলেন। গোটা অনুষ্ঠানের ছবি তুলে এডিটিং করে নেম কাস্টিং করে পাঠান। ইন্দ্রজিৎ কাকু এলে বাড়ির পরিবেশটাই যেন পাল্টে যায়। পপামাসীর গান যেন নতুন চেহারা নিয়ে আসে!
আমার আাবার পেটুক হিসেবে খ্যাতি৷ আছে যে। পরে জানাগেলো এক ব্যাগে রয়েছে প্যাক করা চিকেন রোস্ট,তন্দুরি,জিরা রাইস,মাটন মাঞ্চুরিয়ান,সসেজ,বার্গার,ল্যাম্বের একটা আইটেম -স্টেক,স্প্যাঘেট্রি,মাসীর প্রিয় পিৎজা, আরও কত কি। যার যেমন রুচি। আমার সিজ্ লার খুব পছন্দ। কিন্তু ওটা গরম গরম খেতে হয়!রেস্তোরাঁয় ওটা জ্বলন্ত অবস্থায় সার্ভ করে,তাই। মাসী বললো,ওটা যে কোনও দিন হবে। আর এক ব্যাগে রয়েছে মায়ের জন্য একটা ময়ুর কন্ঠী রঙের অপূর্ব কারুকাজ করা সিল্কের কাঁথাস্টিচ!দুটো স্প্যানিশ পারফিউম। একটা আমার একটা নিজের! কিন্তু এসবের কারণ টা কি?
চার।।
সারা বিশ্বের এখন জ্বলন্ত সমস্যা হলো প্লাস্টিক। এর কখনো শেষ নেই। মাটিতে মেশেনা। কৃষি জমি নষ্ট করে।নর্দমার মুখ আটকে দেয়। দূষণ সৃষ্টিতে এর জুড়ি নেই। তৃণভোজী গৃহপালিত পশু মাঠে ঘাসের সঙ্গে প্লাস্টিক খেয়ে মারা গেছে,দেশের বিভিন্ন গ্রামে এমন ঘটনা আকছার ঘটছে। পরিবেশ আর কৃষি,এই দুই ক্ষেত্রেই দেশ আজ প্লাস্টিক নিয়ে মারাত্মক সঙ্কটে। অনেক জায়গায় এর ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্ত আইনকরে এসব বন্ধ করা যায়না। দেশের মানুষ সচেতন না হলে কিছু হওয়ারও নয়।মাসী বলেছে,ও যখন লন্ডনে ছিলো, তখন দেখেছে ওখানকার মানুষ খুবই সচেতন। দেশকে ভালোবাসে।পরিচ্ছন্ন রাখে।এমন কি বাচ্চারাও যেখানে সেখানে এমন কি চকোলেটের কাগজটাও রাস্তায় ফেলেনা।পকেটে পুরে বাড়িতে নিয়ে আসে।সেখানে বিন ব্যাগে পুরে অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে আসা হয়।তবুও কেউ যদি একবার কোনও ময়লা,সেটা একটুকরো সিগারেট, দেশলাই কাঠি হলেও তা খোলা যায়গা,রাস্তা,পার্ক ইত্যাদিতে ফেলে তবে পুলিশ এমন মোটা অঙ্কের ফাইন করে যাতে জীবনে দ্বিতীয় বার কেউ আর ওই ভুল করার আগে দশবার ভাবে!পপা মাসী জীববিজ্ঞানের পি এইচ ডি।চাকরিতেও তাই এনিয়ে অনেক কেস সলভ করেছে। একবার মাছি আরেকবার পিঁপড়ে দিয়ে দোষী পাকড়েছে। সম্প্রতি প্লাস্টিকের ক্ষয় নিয়ে বিদেশের এক জার্নালে লিখেছিলো এমন এক ব্যাকটিরিয়ার কথা,যা প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে! মাসী বললে,২০১৬ সালে জাপানী বিজ্ঞানীদের একটি দল ও দেশের এক ডাম্পিং গ্রাউন্ডে প্লাস্টিক খেকো একধরণের ব্যাকটিরিয়ার খোঁজ পান।গবেষণায় বছর দুয়েক পরে তা থেকে একরকম এনজাইম মেলে,যার নাম দেওয়া হয় পেটসি।পরে অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী রা দেখলেন এধরনের ব্যাকটিরিয়া প্লাস্টিকের অনুকে ভেঙে তরল করে দিতে পারে।এমন কি দুর্ভেদ্য এবং বিপদজনক প্লাস্টিক’পলিইথিলীন টেরিপ্যাথালেট’বা পেট কেও খতম করা যেতে পারে! ভিয়েনার ইউনিভার্সিটি অব ন্যাচারাল রিসোর্স অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সের গবেষক ডঃ ডোরিস রিবিটস বলেছেন, এই ব্যাকটিরিয়াকে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। এই ইউনিভার্সিটি থেকেই মাসীকে তাঁর প্রবন্ধ পাঠ ও বিভিন্ন লেকচার দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দশ দিনের প্রোগ্রাম। থাকা,খাওয়া ও যাতায়াতের যাবতীয় খরচ দেবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়। মাসী ওর দপ্তর কে জানিয়ে ছিলো। নো অবজেকশন সহ ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। উল্টে ডিপার্টমেন্ট এর জন্য মাসীকে একটা একস্ট্রা ইনক্রিমেন্ট দেবার সুপারিশ করেছে। আর তিন মাস পর মাসী যাবে!
পাঁচ।।
প্রায় মাস দুয়েকের মত কেটেছে।মাসী একটা কেস নিয়ে খুব ব্যস্ত।সেই ভোর বেলা অফিস যায় আর ফেরে রাতে। তাই মাসীর সঙ্গে খুব একটা কথা হয়না। আজ ঘুম ভেঙে ব্রাশ করছি,এমন সময় মাসীর ফোন!
-আজ সকালের কাগজ গুলো দেখেছিস? না দেখলে দেরি করিস না। এক্ষুনি দেখ?দৌড়ে পেপার গুলো খুললাম।টিভি খুললাম। সবক’টাতেই একই খবর। কলকাতার বড় বড় কিছু ব্যবসায়ীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টস হ্যাক হয়েছে। প্রায় চারশো কোটি টাকা এঁদের খাতা থেকে যেন উবে গেছে! এঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী,ঠিকাদার,ডেভেলপার ইত্যাদি রয়েছেন। যাঁদের সংখ্যা পঁয়ষট্টির মতন!যাঁরা পঞ্চাশ কোটির বেশী খুইয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রথ অ্যানড কোলম্যানের এম ডি হারাধন দাশ রায়,সিরাম ইন্ডিয়ার এম ডি প্রদ্যাৎ সেন,ব্লু ডায়মন্ড হাউসিংয়ের প্রীতম সান্যাল,ইন্ডিয়ানা হোটেল চেইনের মধ্য এশিয়ায় ডেপুটি চীফ একজিকিইউটিভ অতুল খুরানা ইত্যাদি।আবার টিভিতে দেখি একই খবর। কোনও এক ড্যাস রে (দাশ রায়) সাহেবের ইন্টারভিউ নিচ্ছে সাংবাদিক। আরেকটাতে জনৈক ডাঃ রফিক আহমেদ!দেশের অন্যতম হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জানালেন ওঁর যৌথ মালিকানার নারসিংহোমের কারেন্টএকাউন্ট থেকে দশ কোটির মত টাকা গায়েব হয়ে গেছে।আরেকটি চ্যানেলে একটি ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ বলছেন কিভাবে হ্যাক হলো তাঁরা বুঝতেই পারছেন না। সার্ভারে কোনও গন্ডগোল নেই।নিয়ম করে ভাইরাস চেকিং ও ক্লিনিং হয়।বিশ্বের অন্যতম অ্যান্টি ম্যালঅয়ার ইন্সটল করাআছে… তা সত্বেও! এসব ক্ষেত্রে যেমন টা হয়ে থাকে,কোনও দিকের কেউই বুঝতে পারছেন না তাঁদের কী করণীয়।তবে নিউজে দেখলাম যে চারটি ব্যাঙ্ক থেকে এই জালিয়াতি হয়েছে,তাঁরা আপাততঃ সব ধরণের ট্র্যানজাকশন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এর মধ্যে সবাই বলছে পুলিশ কি করছে।পুলিশের পক্ষথেকে কোনও বাইট নেই বলে এক রাজনৈতিক নেতা আবার অভিযোগ করলেন।এর মধ্যে একটি নামী চ্যানেলের রিপোর্টার পুলিশ প্রধানকে ক্যামেরায় ধরলেন।পুলিশ প্রধান যান্ত্রিক ভাবে বললেন তদন্ত হচ্ছে।শীগগিরই অপরাধীদের ধরা হবে!এর বেশী ওঁর কাছ থেকে জানা গেলনা।আমি ভাবতে থাকলাম,পপামাসীর মানসিক অবস্থা।পুলিশ কর্তা হিসেবে ওকেও কথা শুনতে হবে বিষয়টা ওর এক্তিয়ারের না হলেও। মাসীকে একটা ফোন করলে হয় না? রিং হলো,মাসী তুললো না। এমনটা হয়না। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। মাসীর ভিয়েনার ট্রিপ এগিয়ে আসছে!এবার ফোনটা বেজে উঠতে দেখি পপামাসী রিং ব্যাক করেছে। বেশ হাসি খুসি মুডে জানতে চাইলো খবরের কাগজ আর টিভি দেখেছি কি না। আমি বললাম,সে তো সব মুখস্ত হয়ে গেলো। তুমি কখন আসবে?
-আমার একটু বেলা হবে রে।খেয়ে নিস। আর ঠিক বেলা এগারোটায় টিভি খুলিস। খুলিস কিন্ত। এতটা বলে পপামাসী ফোন কেটে দিলো। এগারোটায় টিভি খুলতেই,
আরে? পপামাসী ওখানে কি করছে?
ব্রেকিং নিউজে বলছে মূল অপরাধী সহ মোট পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে দুজন কে দিল্লি,একজন ভুবনেশ্বর আর বাকী দের কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেল থেকে।মধ্যরাতেই দের পাকড়াও করা হয়। প্রায় একশো কোটি নগদ টাকাও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। প্রচুর নথি উদ্ধার হয়েছে।
এবারে দেখছি পপামাসী এইঘটনা নিয়ে বাইট দিচ্ছে….
ছয়।।
বেলা প্রায় শেষ করে মাসী ফিরলো।খুব তাড়াতাড়ি স্নানটান সেরে একটা হলুদ সাদা ম্যাক্সি পরে মাসী এসে বসলো। বলতে ভুলে গেছি এর মধ্যেই অজস্রবার মাসীর ফোন এসেছে। বেশীরভাগই মাসী ধরেনি। গরম এক কাপ চায়ে আরামে চুমুক দিয়ে মাসী গা এলিয়ে দিলো সোফায়।
-তুমি কী ভাবে এদেরকে এত তাড়াতাড়ি ধরলে? কাল রাতে হ্যাক হলো আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই? আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না।
-শোন,সেদিন হেল্প ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রোগ্রামে গিয়েই আমার মনে খটকা লেগেছিল। ডিরেক্টর রতিকান্ত দাশগুপ্তকে কেমন যেন মানতে পারছিলাম না। যে সরকারি অফিসের সঙ্গে উনি যুক্ত,সে অফিস টার অস্তিত্বই নেই। দিল্লির হাউজখাসে ওই এন জি ওর যেটা অফিস,তাতে বড়জোর একটা বেঞ্চ ঢুকবে! ওখানে শুধু ডাক রিসিভ হতো। ফান্ডিং নেওয়া হতো।
-তুমি কি ওর ওপর নজর রাখছিলে?
-অবশ্যই। তবে খুব গোপনে। এনিয়ে একটা বিশেষ টিম গঠন করা হয় আমাকে মাথায় বসিয়ে। এর নাম শিট্(স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম)।
-এত গোপনীয়তা কেন?
-না হলে পাখি উড়ে যেত। একটা ব্যাপার কি জানিস? সেদিন হেল্প ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রোগ্রামে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের বেশীর ভাগেরই অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। আমি প্রতিটি মানুষের উপরই নজর রাখছিলাম।
তার মানে হলো মাসী এতদিন এই কেসটা নিয়েই মেতে ছিল। ওদের দিল্লি আর ভুবনেশ্বরের অফিসেও নজরদারি ছিলো। আরেকটা ব্যাপারের পর মাসীর সন্দেহ দৃঢ় হয়।তা হলো,ওই লোকটা,মানে জাল আইএস দু’তিনটে ক্যাম্প করে ওদের কোভিড নিরোধক টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো। এজন্য ওদের আধার কার্ডগুলোর কপি লেগেছিল। কোভিড টিকা নিতে গেলে আধারকার্ড বাধ্যতামূলক। এই কার্ডের সাহায্যেই ওদের ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ও যাবতীয় টাকাপয়সার হাল হকিকত হ্যাক করে।আগে থেকে ফাঁদ পেতে হ্যাকড হওয়া টাকা যে সব অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার হয়েছে সেই অ্যাকাউন্টগুলোতেও নজর ছিলো শিটের! আর বি আইয়ের সহায়তায় ওগুলোকে ব্লক করা হয়েছে এদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্ত এর মধ্যেই ভুবনেশ্বরের একটি ব্যাঙ্ক থেকে একশো কোটির মতন এনক্যাশমেন্ট হয় আর এখানেই ওরা ভুল করে।দেশের সমস্ত ব্যাঙ্কেই হিউজ অ্যামাউন্ট লেনদেনের উপর নজর রাখা হয়েছিল। পট্টনায়ককে দুপুর এগারোটা নাগাদ অর্থ সমেত ভুবনেশ্বরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের শাখা থেকে পাকড়াও করা হয়।কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওকে কলকাতায় উড়িয়ে এনে কোর্টে প্রডিউস করা হয়।জাল আইএএস রতিকান্তকে ধরাহয় দক্ষিণ কলকাতার বেলতলার ফ্ল্যাট থেকে। ওদের বিরুদ্ধে আই পি সির 464,182,465,470,471,477A,ইত্যাদি ধারায়, সরকারি পদ জাল,জাল নথি,ষড়যন্ত্র,প্রতারনা,সাইবার ক্রাইম সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। টিভিতে বলা হয়েছে,পপামাসীর নাম রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদকের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।মাসী এদিকে একটার পর একটা ফোনে ব্যস্ত ছিলো মাসী তো এখন স্টার। সব টিভিতে মাসীর ছবি। বাইট। কাল দেশের খবরের কাগজেও মাসীর ছবিতে ছয়লাপ হবে।
শেষ ফোনটায় মাসী ওঃহো বলে ছেড়ে দিলো।
– কী হলো মাসী?
-আর বলিস না। ওই পাগলাটে বুড়োটাকে আমার এই কেসের সাফল্য জানাতে ফোন করেছিলাম। ওর স্ত্রী ধরলেন।জানালেন গত রাতে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই উনি মারা গেছেন! আমি পপামাসীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর চোখে কি ওই বুড়োটার জন্য কোনও দুঃখ ফুটে উঠেছে? বা স্বস্তি? বুঝতে পারলাম না।।
।।শেষ।।
(এটি একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী। কোনও চরিত্র বা ঘটনার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল পাওয়া গেলে তা নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার বলে ধরে নিতে হবে।)
***********************************************************
প্রত্যুষ সেনগুপ্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।