গন্ধমালতী
ডাক্তার (ক্যাপ্টেন) দিলীপ কুমার সিংহ
রাধিকা দেবী পাশ ফিরে শুলেন। কিছুক্ষণ আগে নার্স এসে চান করিয়ে,কাপড় পরিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়ে গেছে। যাবার আগে রাধিকা দেবীর পছন্দ মত স্প্রে ছড়িয়ে দিয়েছে। রাধিকা দেবী একটু বেশি সেনসিটিভ গন্ধ নিয়ে | সব গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। হয় তিনি নিজের পছন্দ মত পারফিউম ব্যবহার করবেন নাহলে গন্ধহীন থাকবেন। ‘গন্ধহীন’ শব্দটা মনে আসতেই ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ছোঁয়া দেখা গেল।
পুজোর সময়ে মা নতুন কাপড়ে অগুরু লাগিয়ে দিতেন। পুজোর কদিন সেই মিষ্টি গন্ধ লেগে থাকত | এছাড়া বিয়ের আগে গন্ধের বিষয়ে কোন জ্ঞান ছিলনা । তবে বিয়ের দিন কনে সাজবার পরে চন্দনের সুগন্ধে সারা মন ভরে গিয়েছিল। সেই প্রথম তাঁর মন একটা গন্ধকে আলাদা করে চিনে ছিল । ফুলশয্যার দিন তাঁর স্বামী অলক বাবু কিছুক্ষণ নিজের কথা বলার পর হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন,’একি তুমি গন্ধহীন কেন?’ তারপর নিজেই বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর মতে প্রত্যেক বিশেষ ঘটনার সঙ্গে একটা বিশেষ গন্ধ জড়িয়ে থাকলে মানুষ সহজে সে ঘটনাকে ভুলতে পারে না। জীবনে সেই ‘গন্ধটা’ বার বার কোনো না কোনো ভাবে ফিরে আসে আর সেই বিশেষ সময়টাকে মনে পড়িয়ে দেয়। একটা কান্তা সেন্ট এর শিশি দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখ তো গন্ধটা কেমন?’ তাঁর ভালই লেগেছিল তবে চন্দনের চেয়ে একটু তীব্র। অলক বাবু বলেছিলেন যে,’আপাতত এর চেয়ে বেশি দামি গিফট দেবার সামর্থ্য আমার নেই । আর তাই এটাই গ্রহণ কর।’ তিনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। অলক বাবু তাঁর সারা শরীরে এই সেন্ট লাগিয়ে দিয়েছিলেন |
বিবাহিত জীবনের প্রথম রাত কান্তা সেন্টের গন্ধের মাঝে কাটল আর সময়ের অনুভূতি টা সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে রইল। যখন অলক বাবু কিছু দিনের জন্য বাইরে যেতেন আর মনটা ভাল লাগত না, উনি কান্তা সেন্ট কিছুটা লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন, আর সত্যি সত্যিই মনটা ভাল হয়ে যেত ।
সময়ের সাথে সাথে জীবনও এগিয়ে চলল। কোলে প্রথম সন্তান রাজীব এল। সঙ্গে সঙ্গে জনসনের মাসাজ অয়েল আর জনসনের পাউডারের গন্ধও এল | অত প্রিয় কান্তা সেন্টের গন্ধটাও আর মনটা আনচান করতে পারত না বরং জনসনের গন্ধটাই তাঁকে ঘিরে থাকত |
অলক বাবুর ব্যবসাও ফেঁপে ফুলে উঠল | প্রায়ই বিদেশ যেতেন আর রাধিকা দেবীর জন্যে বিদেশী সেন্ট নিয়ে আসতেন, কিন্তু চোলে পারফিউম তাঁর ভীষণ পছন্দ ছিল,তিনি বারবার চোলেই আনতে বলতেন আর অলক বাবুকেও ওই একই পারফিউম লাগাতে বলতেন | অলক বাবু হাসতেন আর বলতেন,’তোমায় আমি সস্তা কান্তা সেন্টের নেশা ধরিয়ে ছিলাম আর তুমি আমায় চোলে পারফিউমের অভ্যাস ধরাচ্ছো ! জানো এর কত দাম ?’ তারপর বলতেন,’যদি কোনো দিন আমার ব্যবসা না চলে আর আমি এই দামী পারফিউম কিনতে না পারি তখন তুমি আমায় চিনতে পারবে তো ? রাধিকা দেবীর কাছে যেন উত্তর তৈরিই ছিল, বললেন,’ভয় নেই আমার কাছে এখনও কান্তা সেন্টের কয়েক শিশি যত্ন করে বাক্সে রাখা আছে | তোমায় চিনে নিতে আমার কোনদিনও অসুবিধে হবে না |’
রাজীবও স্কুল যেতে শুরু করেছিল | রাধিকা দেবী রোজ ছেলের জামার কলারের নিচে,ছোট আঙ্গুল দিয়ে পারফিউম ল়াগিয়ে দিতেন | ওরও চোলে পারফিউমের নেশা ধরলো | স্কুলে গিয়েও মনে হত ওর মা কাছাকাছিই কোথাও আছে |
চোলে পারফিউম,স্বামী,সন্তান নিয়ে জীবন ভালো ভাবেই কাটছিল কিন্তু হঠাৎ অলক বাবু একদিনের জ্বরে মারা গেলেন | রাধিকা দেবী প্রথমে ভেঙে পড়লেও একটু একটু করে ব্যবসা সামলে নিলেন | ছেলেকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরলেন আর প্রিয় পারফিউমের গন্ধ তাঁর জন্য শ্বাস প্রশ্বাসের মত নিত্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল ৷ রাজীবের বন্ধুদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো । প্রথমে স্কুলের,পরে কলেজের বন্ধু সব নিয়ে সারাটা দিন ব্যস্তই থাকত, কিন্তু সকালবেলা একঘন্টা আর বিকেলবেলা একঘন্টা মায়ের সঙ্গে গল্প করা চাই-ই চাই। আগে তো গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকতো এখন অবশ্য কোলে মাথা রেখে গল্প করে । কলেজে গিয়ে দাড়ি কামানো শুরু করেছিল । প্রতিমা দেবী ওয়ার্ডলের আফটার সেভ লোশন কিনে দিয়ে বলেছিলেন,’ যা তা গন্ধ কখনো লাগাবি না। পছন্দ মত গন্ধ হলে ভাল লাগাটা অনেকক্ষণ থাকে, মন এদিক ওদিক হয় না। পরীক্ষা থাকলে মাকে বলত একটু চোলে পারফিউম লাগিয়ে দিতে । ‘জানো মা, তোমার গন্ধটা আমায় ঘিরে থাকে আর আমার মনে হয় যে তুমি কাছেই আছো আর আমার বিশ্বাস থাকে,যে যাই জিজ্ঞেস করুক আমি ঠিকই উত্তর দিয়ে দেব।’ রাধিকাদেবী স্নেহভরে হাতটা মাথায় ঠেকিয়ে বলতেন,’তোর বাবার আশীর্বাদ রয়েছে। তুই ভালো করবি ।’
কিন্তু সময় এক ভাবে কাটেনা। রোজকার মত সেদিন সকালে চান করে মায়ের হাত ধরে বসে কথা বলছিল হঠাৎ প্রতিমা দেবীর মনে হল রাজীবের গা থেকে অন্য গন্ধ বার হচ্ছে । বুকটা ধক করে উঠল। গলাটা যতটা সম্ভব একই রকম রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁরে, কি আফটার সেভ লাগিয়েছিস গন্ধটা বেশ মিস্টিক।’ রাজীব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একটু হড়বড়িয়ে মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,’তোমার ভাল লেগেছে? রুনা বলেছিল, তোমার ভাল লাগবে।’ প্রতিমা দেবী হাসলেন | কখনো কখনো জীবনের পাতাটা এত সহজ ভাবে লেখা থাকে যে প্রথম লাইনটা পড়লেই বোঝা যায় যে শেষ লাইনটা কি হবে। সস্নেহে রাজীবের হাত ধরে বললেন, ‘রুনাকে যত তাড়াতাড়ি পারিস বাড়িতে নিয়ে আসার উপায় কর আমি আর একলা থাকতে পারছিনা।’ তারপর সবকিছু একের পর এক সাজানো গল্পের মত ঘটে যেতে লাগল। আজ রাজীবের বিয়ের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। কাল থেকেই প্রতিমা দেবীর শরীর খারাপ। ডাক্তার বলেছিল হাসপাতালে ভর্তি হতে | কিন্তু দ্বিতীয় আ্যনিভার্সারী সেলিব্রেট বন্ধ না হয় তার জন্যে ঘরে রইলেন।
পার্টিতে যাবার জন্যে দুজনেই সেজেগুজে মাকে প্রণাম করার জন্যে প্রতিমা দেবীর ঘরে এসে দেখল মা শুয়ে আছে। শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে রুনা জাগাতে চেষ্টা করল। দু তিনবার নাড়াবার পর প্রতিমাদেবী চোখ খুলে তাকালেন। রুনার দিকে হাত এগিয়ে দিলেন, টেনে তুলতে। রুনার সাহায্যে উঠে বসলেন। পরা কাপড়টা ঠিক করলেন। ‘আমার শরীর ভালো আছে তাই চোখ লেগে গেছিল। তোমরা চিন্তা করো না, বালিশের তলায়, রুনা, তোমার জন্যে হীরের হার আছে,আজকের পার্টিতে পরে যাও। প্রবীর তোমার জন্যে চেলো পারফিউমের নতুন প্যাক আনিয়ে রেখেছি। তুমি পার্টিতে লাগাতে পারো । তোমার বাবার খুব পছন্দ ছিল।’
আরো কিছু বলার আগে রুনা বলল,’মা,আমি আজকের জন্যে প্রবীরকে নতুন ‘ব্ল্যাক অর্কিড’ এর পারফিউমের প্যাক প্রেজেন্ট করেছিলাম, ও তাই লাগিয়েছে। একেবারে সিগনেচার পারফিউম। চেলোর চেয়ে আরো বেশি কনটেম্পরারী। আপনিও ইচ্ছে হলে কখনো লাগিয়ে দেখবেন,বেশ ভাল লাগবে। ছাড়তে ইচ্ছে করবেনা ৷’ প্রতিমা দেবী চুপ করে রুনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপরে হেসে বললেন,‘রুনা,এতদিন আমার দেওয়া পারফিউম রাজীবের খুব ভালো লাগতো,আমি তার কাছে আছি সে অনুভব করত তাই আমি তার জন্যে পারফিউম আনিয়েছিলাম | তবে তুমি তাকে তোমার পছন্দ মত পারফিউম আনিয়ে দিয়েছ | ভালই | আমি জানি তোমার দেওয়া পারফিউম নিশ্চই খুব ভালো হবে, রাজীবেরও খুব ভালো লাগবে | ও তাই লাগাক। আমার কোন আপত্তি নেই | ভয় নেই, আমি তোমার গন্ধের জগতে কোনদিনও ভাগ বসাবো না। তবে আমার গন্ধের জগৎ আমার কাছে থাকতে দাও, ওতে নতুন কোন গন্ধ মিক্স করতে বোলো না | আমি এবার শোব | যাবার আগে দরজাটা ভেজিয়ে দিও আর আয়াকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও | ‘
শকুন্তলা এসে তাঁকে গা ধুইয়ে কাপড় পরিয়ে রোজকার মত চোলে স্প্রে লাগাতে গেলে ইশারায় বারণ করলেন আর বললেন,’আমার আর গন্ধের দরকার নাই, তোরা ওগুলো ভাগ করে নিতে পারিস |’
চোখ বন্ধ করার আগে মনে মনে বললেন গন্ধগুলোকে বইবার তার দায়িত্ব শেষ | এবার তিনি মুক্ত।।
*************************************************
ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ পরিচিতিঃ
বর্ষীয়ান অস্থি শল্য চিকিৎসক। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সাক্ষী ভারতীয় স্থল সেনার আধিকারিক পদে থাকাকালিন। বর্তমানে পটনা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রফেসর। বিহার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন এর বর্তমান সভাপতি। বিহার রাজ্য বাংলা একাডেমির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। সর্বভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চ, কলকাতার সভাপতি পদে অধিষ্ঠাধিন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়,পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা বিদ্যাসাগর সম্মানে ভূষিত। অবসর সময়ে ছোট গল্প লিখতে পছন্দ করেন।