নাস্তিক
নাজির হোসেন বিশ্বাস
রাতের নিকষ কালো শামিয়ানা ফুঁড়ে ভোরের রবি সবে আলোর আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে কুসুমপুর গ্রামের নরম বুকে। ঘাড়ে কোদাল ফেলে নবীন,মনসুররা খোশ মেজাজে চলেছে ফসলের জমিতে। তাঁদের সঙ্গে দুলু বাগদীও। একই ঘুঁটের আগুনে বিড়ি ধরিয়ে ফুঁকতে ফুঁকতে চলেছে ওরা,এখন যে বীজ ফেলার মরসুম। ঘরে বসে আয়েস করার কিংবা শোক তাপ করার সময় কোথায়?
ওদের যেতে দেখে সজল বাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নীলকণ্ঠ পাখি যেন নিমেষে বসন্ত হাওয়ায় ছড়িয়ে দিল অমরাবতীর সুখ। চোখেমুখে একরাশ প্রসন্নতা,মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এই তো ক’দিন আগেও গ্রামে মানুষে মানুষে কত বিদ্বেষ,কত রেষারেষি। অথচ কুসুমপুরের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য মিলনের ঐক্যতান পাখির ঠোঁটে করে বট ফলের মতোই ছড়িয়ে রয়েছে বহু ক্রোশ ব্যাপ্ত হয়ে, গ্রাম ছাড়িয়ে শহর অবধি।
একটা মানুষের অবর্তমানে কত অঘটন ঘটে যেতে পারে,সেটাও চাক্ষুষ করলো কুসুমপুর গ্রামের মানুষ। অনিমেষ বাবু শিমুল বৃক্ষের ন্যায় বলিষ্ঠ বাহু চারিদিকে প্রসারিত করে গ্রামটিকে আগলে রেখেছিলেন। যেন গ্রামের অতন্দ্রপ্রহরী ছিলেন স্কুল শিক্ষক অনিমেষ চ্যাটার্জী। সজল বাবুর নাস্তিক বাবা। সবাই অনিমেষ চ্যাটার্জীকে নাস্তিক ভাবলেও আসলে তিনি ছিলেন মানবপ্রেমী।
শহর থেকে দূরের একটি অখ্যাত গ্রাম কুসুমপুর। চাষাবাদ করে সকলের সম্বৎসরের খাবার ওঠে,রাতে অনিমেষ বাবুর প্রশস্ত উঠোনে খেজুর পাতার পাটি পেতে চলতো গম্ভীরা, জারিগান। চলতো মনসা মঙ্গলের কাহিনী। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ গায়ে গায়ে ঠেস দিয়ে,রাত জেগে শুনতো সে সব। চ্যাটার্জী গিন্নি ধামা ধামা চিঁড়ে মুড়ি যোগান দিয়ে যেতেন,একই ধামা থেকে মুঠো ভরে সবাই মুচমুচিয়ে খেতেন,সঙ্গে গেলাস ভর্তি চা। আহা দিনগুলো যেন আজও জ্বলজ্বল করছে!
অনিমেষ বাবুর উদ্যোগে কুসুমপুরে লেগেই থাকতো নানা উৎসব অনুষ্ঠান। আজ ফুটবল,তো কাল ঘরের বৌ–মেয়েদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কেউ গাইতো নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত তো কেউ ধরতো রবীন্দ্র সঙ্গীত। ছোটরাও আবৃত্তি করে বড়দের তাক লাগিয়ে দিত। এভাবেই গড়ে উঠেছিল হিন্দু মুসলিমের তীর্থভূমি কুসুমপুর।
সজল বাবুর সময়ের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। গালে হাত রেখে বসে আছেন ঘরের দাওয়ায়,কাঁচাপাকা দাঁড়ি,মাথায় চিরুনী না পড়া উস্কখুস্ক চুল। চারিদিকে এত শূন্যতা,এত হাহাকার! তাঁর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন,বুক চিতিয়ে দিয়েছেন গ্রামের জন্য। সময়ে অসময়ে ডেকে উঠতেন,“সিরাজ আয় তো বিভাসের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে একটু বসতে হবে আমাদের। বেচারা মোটর গাড়ী উল্টে অক্ষম হলো,সাথে সাথে ওর মেয়েটাও স্বর্ণলতার মতো লকলক করে বেড়ে উঠলো। একটা কিছু না করলে যে হয় না সিরাজ?”
মেয়ের গলার হার,জামাইয়ের জন্য সোনার আংটি,হাতের ঘড়ি সব সব ব্যবস্থা হয়েছে নিমেষে। উৎসব পার্বনে মিলেমিশে কাজ করেছেন। অনিমেষ বাবু আর সিরাজ যেন হরিহর আত্মা। দুর্গা পুজোর ক’দিন তিষ্ঠোবার সময় পেতেন না,সিরাজ। কলকাতার বিখ্যাত কবিগানের দল বায়না করা থেকে ঠাকুরের প্রসাদ সব যে সিরাজ ছাড়া যোগাড় হতো না। সিরাজকে দায়িত্ব দিয়ে অনিমেষ বাবুও নিশ্চিন্ত।
সেই দু’টো মানুষ গত হতে না হতেই সব যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না? তাহলে? আজ মানুষ এত অশান্ত কেন? কেন অন্তরে এত বিষ?
“নাজ সুন্দর কবিতা লিখছিস,ডায়েরীতে বন্দি না রেখে,বই ছাপিয়ে প্রকাশ করতে পারিস তো?”
“তন্ময়দা তুমি কি যে বলো,আমার কবিতা কেউ ছাপবেও না,
পড়বেও না। শুধু তোমার জন্য আমার কবিতা লেখা।“
“তা কেন? আমার সঙ্গে আরও কত লোক পড়বে,তোর কবিতা। তাতে তুই আরও কবিতা লেখার উৎসাহ পাবি। চল একদিন কলকাতা যাই, প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে।“
নাজ অবাক হয়ে বলেছিল,“তুমি আমাকে কলকাতা নিয়ে যেতে চাও তন্ময়দা?”
“নিয়ে যেতে পারি না,বলছিস?”
নাজ কোন কথা না বলে নিমেষ হারা হয়ে তন্ময়ের মুখের দিকে চেয়েছিল শুধু। অপার এক ভালোলাগায় হয়তো মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো,নাকি ভাসতে? সেটা জানার আগেই যে…!
পাশাপাশি দু’জনে ঝাউ গাছের ছায়ায় বসে কবিতা নিয়ে কথা বলছিল। সেই কলকাতা শব্দটা ছয় কে নয় করে দিল! তারপর পাঁচ কান হয়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে,তন্ময়,নাজকে নিয়ে পালিয়েছে।
কোথা থেকে উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো কুমুদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে উঠলো, “কাকাবাবু একটা খবর আছে।“
“কি খবর বল,অত ভয় পাচ্ছিস কেন?”
“খারাপ খবর কাকাবাবু।“
“খারাপ? কেন কার কি হয়েছে? চুপ থাকিস না বল তাড়াতাড়ি।“
তারপর পাশে বসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো,কথা শেষ করতে না দিয়েই সজল চিৎকার করে উঠলো,“এ অবিশ্বাস্য! আমার ছেলে তেমন নয় যে…! তাছাড়া ওরা দুজন ভালো বন্ধু। কোথাও ভুল হচ্ছে তোদের?”
“কাকাবাবু শান্ত হয়ে আগে সবটা শুনুন,তারপর ব্যবস্থা নিন। আমরা কিন্তু কোন মতেই মেনে নেব না,তাতে প্রয়োজনে রক্ত গঙ্গা বয়ে যায় তো যাক।“
‘রক্ত” শব্দটা শুনেই সজলের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো,কি বলছে কুমুদ! এর মধ্যে রক্ত কেন? যে কুসুমপুর বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে হিন্দু মুসলিমের মিলন ভূমি, যেখানে ঐক্যের সুর শোনা যায়। ভোরের আজান শুনে ঘরের মহিলাদের রাতের ঘুম ভাঙে,সন্ধ্যায় তুলসী মঞ্চের শঙ্খ ধ্বনি লক্ষ্মীর আবাহন করে,সেই গ্রামে রক্ত গঙ্গা? শুনেই সজলের বুকের ভেতর একটা অজানা আতঙ্ক ডানা ঝাপ্টে উঠলো।
মুসলিম মহল্লাতেও একই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। যে বুকে ভালবাসা জমেছিল,সেখানে বারুদের গন্ধ। বিস্ফোরণ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। যারা গায়ে গা লাগিয়ে জড়াজড়ি করে লতাপাতার মতো বেড়ে উঠেছে,হঠাৎ যেন সেই লতাপাতা বিষ নিঃশ্বাসে নুয়ে পড়েছে।
দু’পক্ষই যখন যুদ্ধের প্রহর গুনছে,ঠিক তখনই সবার অলক্ষ্যে সজল বাবু চলে গেল গ্রামের মাঠ ঘাট পেরিয়ে,রেল লাইনকে বাঁয়ে ফেলে লাল মাটির রাস্তা ধরে একেবারে কালী মায়ের মন্দির সংলগ্ন পুকুর পাড়ে। তাঁর নাস্তিক বাবা বলতেন,’অশান্তি হলে মায়ের মন্দিরে গিয়ে বসবি,সব দুশ্চিন্তা মুছে গিয়ে প্রশান্তি পাবি।‘ এখানে এলে সজল মানসিক শান্তি পায়। দিশা খুঁজে পায়। এখানেই ডেকে পাঠিয়েছে নাজ এর বাবা রহমতকে। কখন যে সন্ধ্যা শেষে রাত নেমেছে টেরও পাননি সজল বাবু। পুকুরের জলে চাঁদের সন্তরণ দেখতে দেখতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছে এমন সময় অদূরে রহমতকে দেখেই সজল ডাক দিল–“রহমত আয়।“ শান বাঁধানো সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসেই রহমত বলে উঠলো,“এটা কি হলো সজলদা?”
“তোর মেয়ে আর আমার ছেলে আগে ফিরে আসুক কলকাতা থেকে, প্রকৃত ঘটনা আমরা তো কেউ কিচ্ছু জানি না।“
“সবাই বলছে ওরা পালিয়ে গেছে,আমি এটা একদমই বিশ্বাস করি না,আমার মেয়ে তন্ময়কে ভালোবাসতেই পারে কিন্তু আমাকে না বলে সে পালিয়ে যাবে না। ওরা তেমন ছেলে–মেয়েই নয়। কিন্তু গ্রামের লোকে তো বিশ্বাস করছে না। একেই বলে যার বিয়ে তাঁর মনে নেই, পাড়া পড়শির ঘুম নেই।“
কথাটা শুনে সজল না হেসে পারলো না। “আসলে কি জানিস,এক শ্রেনীর লোক থাকেই,ঝামেলা বাধাবার জন্য। এতেই যে তাঁদের সুখ রে!”
রহমত বলল,“একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা এই নিয়ে পড়ে থাকবো? তাহলে জাতি এগোবে কিভাবে? স্বাধীনতা মানে কি?”
“আচ্ছা দুজনেই ফোন অফ করে রেখেছে কেন,সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
“এই তো বলতে বলতেই ফোনে রিং হচ্ছে,চুপ কর রহমত…।“
“বাবা ফোন করেছো কেন?”
“কোথায় আছিস?”
“নাজকে নিয়ে কলকাতায় এসেছি। কেন বলতো?”
“কেন গিয়েছিস সেটাই জানতে চাইছি।“
“কি হয়েছে তোমার বলো তো বাবা? কন্ঠস্বরটা কেমন শোনাচ্ছে।“
“কি হয় নি সেটাই বল?”
“একটু খুলে বল বাবা, বুঝতে পারছি না।“
“আচ্ছা কবে ফিরবি?”
“এই তো স্টেশনে, সকালের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবো।“
“বাড়ি ফিরেই সব শুনিস,এখন রাখ।“
“কি হয়েছে বলো না,টেনশন হচ্ছে তো!”
“নাজকে নিয়ে কলকাতা গিয়েছিস এটা গ্রামের মানুষ ভাবছে তুই ওকে নিয়ে পালিয়ে গেছিস,বিয়ে করেছিস বলে, প্রচার হয়েছে। তাই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই….!”
“ভালো তো, নাজ এর মতো উচ্চ শিক্ষিতা সুন্দরী বৌমা পাবে তুমি,আর কি চাও বাবা?”
“ঠাট্টা রাখ,সত্যি করে বল?”
“বাবা,আমি অনিমেষ চ্যাটার্জীর নাতি, তোমার মনে নেই, দাদু নিজের হাতে সুবর্ণা পিসিকে প্রফেসর সালামের হাতে তুলে দিয়েছিলেন? তুমি তাঁরই সন্তান হয়ে কি সব ভাবছো বসে বসে? তাছাড়া নাজ এর মতো মেয়ে পেলে আমি সত্যিই ধন্য হয়ে যাবো, এই নাজ তুই আমাকে বিয়ে করবি? করিস তো বাবার সঙ্গে কথা বল।“
“তুমি না? কি হলো জেঠু? আমি নাজ বলছি।“
“না কিছু বলছি না মা,বাড়ি ফিরে আয়। সাবধানে আয়। রাখছিরে।“
ফোনটা কেটে দিয়ে,“রহমত শুনলি তো সবটা? গ্রামের মানুষের এই পাগলামি বরদাস্ত করা যায়? পরিষ্কার গুলি করে শেষ করে দেব বাঁদরগুলোকে…!”
***************************************
নাজির হোসেন বিশ্বাস পরিচিতিঃ
নাজির হোসেন বিশ্বাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। পেশায় রাজ্য সরকারের স্কীম, স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পের, প্রকল্প সহায়ক। লেখালেখি সেই স্কুল জীবন থেকে। পত্রপত্রিকায় কিছু কবিতা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ভালো গল্প কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক।