একটি মৃত্যু ও অতঃপর
সুরজিত সরখেল
“একদিক থেকে বুঝলে,তোমার মা মারা গেছে ভালই হয়েছে! তুমি এবার ম্যাচিওরড্ হবে!” কথাটা শুনে ভীষণ শক্ খেল সাম্য।কোন সুস্থ মানুষের মুখ থেকে এই কঠিন,নির্মম সময়ে এই রকম নির্লজ্জ দৈববাণী বেরোবে,কল্পনাও করতে পারেনা সে।প্রায় ১১/১২ দিন লড়াই করার পরে হাসপাতালে মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।মা বাবা দুজনেরই করোনা পজিটিভ হয়েছে।যেহেতু বহুদিন ধরেই মা সুগার,কিডনির জটিল রোগে ভুগছিল; মাকে নিয়েই ভয় ছিল বেশি।যদিও সেরকম দেখে বোঝার উপায় ছিলনা। অ্যাম্বুলেন্সে করে আসার সময় মুখের ওপর অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিচ্ছিল বারবার।বলছিল আমার লাগবেনা। কোভিড হাসপাতালে ঢোকার আগে বলেছিল বাবাকে কাঁদতে বারণ করিস; দুশ্চিন্তা যেন না করে। আমি তো ফিরে আসবোই! তোকে সিভিল সার্ভিস ক্র্যাক করতে হবে। আমি ফিরে এসে তোর স্যারদের বাড়িতে এনে রান্না করে খাওয়াব। প্রায় একসপ্তাহ লড়াই করতে করতে,কাউকে বিন্দুমাত্র বুঝতে না দিয়ে,সবাইকে অন্ধকারে রেখে আলোর দেশে,ঘুমের দেশে মা চলে গেল। বাবাও অতিমারীতে আক্রান্ত হয়েছে মাকে শুশ্রূষা করতে গিয়ে। আজ যদি বাবা সুস্থ থাকত, তাহলে এই দুরবস্থায় পড়তে হতনা। খুব ভোরে যখন খবরটা হাসপাতাল থেকে এল,বাবার সেই বুকফাটা আর্তনাদ এখনও কানে লেগে আছে। আর যেদিন মাকে নিতে অ্যাম্বুলেন্স এল; সেদিন ওই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাবা,গাড়ির ড্রাইভার,আর তার সহযোগী মিলে চারজন হিমশিম খেয়ে কোনরকমে মাকে গাড়ির মধ্যে ঠেলে তুলে দেবার পর বাবাকে দাদুর ফটোর দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে বলতে শুনেছিল; ওকে ফিরিয়ে এনো।নাহলে আমাকে পাবেনা। সব লন্ডভন্ড করে দেব।চিৎকার না বলে,আর্তনাদ বলাই ভাল।চোখ থেকে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। এই কয়েকটা দিন আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে,সকালবেলায় ঐ মর্মান্তিক সংবাদ শোনার পর থেকেই ও এক অপ্রত্যাশিত আঘাতের যন্ত্রণায় বোবা হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই কাঁদতে পারছেনা সাম্য! অবিশ্রান্ত ঝড় বৃষ্টি হয়েই চলেছে ভোরবেলা থেকে। একইরকমভাবে ওর মনের মধ্যেও তুলকালাম ঘূর্ণিঝড় হয়েই চলেছে। মা এখন “বডি” হয়ে গেছে। একটু আগেই হাসপাতাল থেকে ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল,বডি কি আপনারা নিয়ে যাবেন? শুনে কোন কথাই বলতে পারেনি সাম্য। শুধু ফ্যালফ্যাল করে ঐ ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়েছিল।গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছিল।মনে পড়ে যাচ্ছে স্কুল হোক,কোচিং ক্লাস হোক( বিভিন্ন স্যারদের), বা ক্রিকেট শিখতে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরের ক্লাবে মার সঙ্গে যাওয়া। জন্মদিনে পায়েস,মাংস,রান্না করে খাওয়ানো,ভাইফোঁটার সময় সব ভাই বোনেরা একসঙ্গে মিলে তুমুল আনন্দ করে বাড়ি যাবার সময় হলে ভীষণ মনখারাপ হয়ে যেত।সবকিছুই মা সামাল দিত। মনে পরে যাচ্ছে দাদুর বাড়িতে কালী পুজোর দিন সকালে গিয়ে খিচুড়ি প্রসাদ নিয়ে বাড়িতে ফিরে সবাইকে খাইয়ে মুখে একটা অসম্ভব আত্মতৃপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠত মায়ের। স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়াতে হাতড়াতে বুকের মধ্যে একটা অসম্ভব ঘূর্ণিঝড় উঠছে মাঝে মাঝে।চোখেমুখে বাষ্প জমা হচ্ছে। সাম্য বুঝতে পারছে একটা অদম্য কান্নার ঝোঁক; যেটা অনেকক্ষণ ধরেই ওকে হাসপাতালের সংকীর্ণ,জলে ডোবা চাতালটার ওপর ঠেলে ফেলতে চাইছে চিৎ করে; ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল শৈশবের সেই স্মৃতির মুহূর্তখানি; যখন সদ্য নার্সারিতে ভর্তি হয়েছিল সাম্য। মায়ের সঙ্গে বাড়ির কাছেই স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে ঠাকুরের মন্দিরের কাছে জ্বলন্ত ধুনুচি থেকে কৌতূহলবশত একটা জ্বলন্ত নারকোলের ছোবড়া তুলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল যন্ত্রণায়। মা বাবা ঠাম্মা ছুটে এসেছিল।ঠাম্মা কোলে তুলেই বেসিনের কল খুলে পুড়ে যাওয়া জায়গায় জলের ধারা দিতে দিতে বলছিল; কেঁদোনা ভাই।তুমি না পুরুষ মানুষ! তখন এসব ওর বোঝার বয়স নয়।মনে রাখার কথাও নয়! একই কথা আজকে বডি হয়ে যাওয়া মার মুখেও শুনেছিল সাম্য। যখন সি এ বির আন্ডার হাইট টুর্নামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের একজন স্পিন বোলারের একটা লোপ্পাই বলকে প্রবল আক্রোশে মাঠের বাইরে ফেলতে গিয়ে আউট হয়ে সনৎ স্যারের যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে মাঠের বাইরে এসে একটা নিরিবিলি জায়গায় দুই হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে কাঁদছিল,ঠিক তখনই মা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কেউ যাতে না শুনতে পায় এমন মৃদু স্বরে বলছিল,কাঁদিস না বাবু,তুই না ব্যাটাছেলে! এরপরের খেলায় এই ভুলটা আর করবিনা,কেমন? সাম্যর সামনে দিয়ে আরও একটা” বডি” বাড়ির লোকজনেরা গাড়ি করে নিয়ে গেল। শান্তনু স্যারও ওকে খবর দিয়ে দিয়েছে যে করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ বাড়ির লোকজনেরা নিয়ে যেতে পারবে। গভর্মেন্ট সার্কুলার জারি করেছে। ওর দুই কাকা,আর ওদের একজন বন্ধু দূরে ওর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে। অবিশ্রান্ত ঝড় বৃষ্টি হাসপাতাল চত্বরকে তছনছ আর জলমগ্ন করে ফেলেছে। থেকে থেকেই গুমরে উঠছে সাম্য।খুব স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত স্মৃতির ভাঁড়ার ওর চোখের সামনে ধীরে ধীরে পরতের পর পরত খুলেই চলেছে। মার কাছেই শুনেছিল ও। দাদু মারা যাবার সাতদিন আগেই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন সাতদিনের বেশি উনি বাঁচবেন না। তাই ঘটেছিল। এই সাতটা দিন সবাই ঘুমিয়ে পড়লে অন্ধকার ঘরে বাবার চোখে বৃষ্টি নামত। এই দেড় বছরের মধ্যে কতগুলো কাছের মানুষদের চলে যেতে দেখল সাম্য।দাদু,দিদুন,ছোটমামা,ছোট পিসে,ঠাম্মা,আর শেষে মা।শোকের দহন জ্বালায় এক একটা মানুষ এক একরকম ভাবে দগ্ধ হয়! কারোর সঙ্গে কারোরই মেলেনা। প্রত্যেকটা যন্ত্রণার অভিঘাত,ভাষা আলাদা আলাদা। প্রত্যেকের যন্ত্রণার প্রকাশভঙ্গীও আলাদা! ছোট মামা মারা যাবার পর মা চুপ করে ছোটমামার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকত। চোখের কোণ দুটো জলে ভরে যেত। একদিন মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করছিল, ছোড়দা মারা যাবার পর আমি প্রাণভরে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছিনা! আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এটা কি আমি অন্যায় করছিনা! প্রশ্ন না আক্ষেপ এটা সাম্য বুঝতে পারছিল না। অদ্ভুত লাগছিল শুনতে! বাবা সুন্দর করে মাকে বুঝিয়ে বলল যে প্রতিটা মানুষের শোকযন্ত্রণার প্রকাশভঙ্গি এক হতে পারেনা। তুমি তো অন্তর থেকে কাঁদছ! এযে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা! শুনতে শুনতে মার দুচোখ জুড়ে শ্রাবণের ধারা! আজ সকালে বাবাকে বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখে এসেছে সাম্য। সত্যিই কান্নার কোন জাত,ধর্ম হয়না। “এই নাও,রসগোল্লা খাও” বলে একটা মাটির ভাঁড় বড়কাকা ওর হাতে দিল।ভয়ানক ক্ষেপে গেল সাম্য। একে মা বাবার জন্য এই সাতটা দিন ভীষণ দুশ্চিন্তা আর বিশেষ করে মাকে এই কটা দিন একেবারেই কাছে না পাওয়া; সকালে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতন এই দুঃসংবাদে মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে ও; তার ওপরে অসম্ভব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মনে পড়ে গেল দাদু মারা যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত ৪৫/৪৬ বছর ধরে নিজের সন্তানের মতন আগলে রাখা,নিজের বাড়িতে নিজেদের পছন্দ মাফিক জায়গা দেওয়া, স্কুল,কলেজ,চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া; এতকিছু একজন বড়ভাই হিসেবে বাবা তার কাকাদের জন্য করার পরেও যেদিন মা বাবা দুজনেই করোনা আক্রান্ত হল,পরের দিনই কাকভোরে সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল! অ্যাম্বুলেন্সে মাকে তোলার জন্য একজনও ছিলনা। অথচ মা তার বিবাহিত জীবনের ৩০ টা বছরের একটা দিনও এদের কাছ থেকে শান্তি,সম্মান তো দূর,চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছে প্রতি মুহূর্তে। আসলে বাবা চেয়েছিল সবাই একসঙ্গে থাকবে,তাই মা ও বাবার চাওয়াটাকে সম্পূর্ণ মর্যাদা দিতে সম্মত হল! কিন্তু পৃথিবীর সব লোক এদের উদ্দেশ্য জানলেও বাবা, মা চলে যাবার আগে পর্যন্ত এদের অবিশ্বাস করেনি।মা চলে যেতেই কি উল্লাস এদের শরীরী ভাষায়! “নাও,নাও,খাও! তুমি আমার চোখ দিয়ে জগৎ দেখবে! তোমার বাবার এখনও জগৎ দেখা বাকি রয়ে গেছে! এই বিবেক শূন্য,অসম্ভব আত্মম্ভরিতায় পূর্ণ অমানুষ বড়কাকাকে দেখে সাম্য কি করবে,কি বলবে,ভেবেই পাচ্ছেনা! একসময় মনে হল হাতের ভাঁড়টা ছুঁড়ে মারে মুখের ওপর! বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল তখনই। সংযত করতে চাইল নিজেকে।অসম্ভব ক্রোধে চিৎকার করে উঠল,”এইমুহূর্তে আমার সামনে থেকে সরে যাও”! এইসময় একবার মাকে দেখার জন্য ওর মনটা আকুলিবিকুলি করে উঠল। সামন্ত জেঠু মাকে দেখার জন্য পি পি কিটস,বডি নিয়ে আসার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছে। ও দৌড় লাগাল সিড়ির দিকে। যে ঘরে মা শুয়ে আছে,সেখানে পৌঁছনোর জন্য। কিন্তু ওকে আটকে দেওয়া হল। নীচ থেকে একটা অস্পষ্ট কোলাহল ওর কানে এসে পৌঁছল। এইসময় সামন্ত জ্যেঠুর ফোনও পাচ্ছেনা। বুঝতে অসুবিধা হলনা,ওর অভিভাবক হয়ে যারা এসেছে,তারা ওর মাকে সৎকার করা দূরের ব্যাপার; মায়ের মুখটাও শেষবারের জন্য দেখতে দেবেনা! সাম্য চেতনা হারিয়ে ফেলার মুহূর্তে যেন শুনতে পেল, ঠাম্মার সেই কথা “ভাই,তুমি না পুরুষমানুষ! শক্ত হও! দোতলার ঘরে বাবার গলায় বহুশ্রুত রবি ঠাকুরের গানের কলি ভেসে আসছে যেন……” নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে,রয়েছ নয়নে নয়নে………।
************************************************
সুরজিৎ সরখেল পরিচিতি :
১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্ম। ২০১৮ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গীতে একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। সেজমাসী এবং মেজমামা প্রখ্যাত সুরকার স্বর্গীয় হৃদয় রঞ্জন কুশারীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। কলেজ জীবন শুরু হবার পর সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। অফিসে কর্মজীবনের ফাঁকেই শুরু হয় সাহিত্য চর্চা। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।