উত্তরাধিকার
অদিতি ঘটক
—“নাম– নাম কি?”
লোকটা ফোলা মুখ নিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথায় দীপ্তেশ এর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। কি বলছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। আবার দীপ্তেশ বলে,”নাম, নাম কি?” এবার তার সুর একটু কড়া।
লোকটা এবার ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথায় হাত দিয়ে তার উসকোখুশকো চুলটা চুলকোয়। বোকা বোকা হেসে অতীতের পাতা ঘেঁটে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া কোনো কিছুকে হাতড়ায়। তারপর হাতড়ে, হাতড়ে যেন বহুদিন আগে ডুবে যাওয়া, শ্যাওলা পড়ে হড়হড়ে হয়ে যাওয়া কোনো কিছুকে তুলে আনে। বলে,”নগেন, ছার, নগেন বেরা।”
তার ভাঙাচোরা, ফোলা মুখে একটা আত্ম প্রসাদের হাসি। লাজুক মুখে বলে,”ও নামে তো এখানে কেউ ডাকেনি ছার। তাই মনে ছিলনি”
হাবিলদার বিনয় মুখ বেঁকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলে,”তোমায় তাহলে কি নামে ডাকব চাঁদু? মানে এফ. আই. আর. এ কি নাম থাকবে ? নামের পাশে ব্রাকেটে অন্য নাম গুলো লিখতে হয় তো।”
লোকটা ব্যাঙ্গটা ঠিক ধরতে পারলো না বা পাশ কাটিয়ে গেল বোঝা গেল না।
“বাবু আমার বাঁশি। আমার বাঁশিটা খুঁজে দেন বাবু।” লোকটার গলায় একরাশ অনুরোধ ও উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ল।
দীপ্তেশ আবার কড়া গলায় জিগ্গেস করল,”কি কর ?”
“আজ্ঞে,বাঁশি বাজাই।”
বিনয় আবার ফুট কাটে “কলির কেষ্ট !”
লোকটা একটা অদ্ভুত আশা আর উদাসীনতা নিয়ে দীপ্তেশের দিকে তাকিয়ে। বিনয়ের হুল ফোটানো কথা গুলো ওর সস্তার ছেঁড়াখোঁড়া ছিটের জামা ভেদ করে তামাটে, জিরজিরে চামড়ার ভেতর দিয়ে হয়ত ঢুকছে না। অথবা এই রকম অপমান লোকটা রোজই সহ্য করে। করে করে ওর রোগা চেহারার চামড়া এইসব জ্বালা ধরানো, চিড়বিড়ে কথাগুলোকে রোদ,বৃষ্টি,হাওয়ার মত স্বাভাবিক মনে করে।
–হুম,কোন দলের? মানে বাইক না লরি?
আজ্ঞে? লোকটা প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
বিনয় আবার ব্যঙ্গ করে ওঠে,”বুঝতে পারছো না চাঁদু, স্যার জিজ্ঞেস করছেন তুমি কোন দলের? উত্তর দাও।” শেষ দুটো কথা বিনয় ধমকের সুরে বলে।
লোকটা ভয়ে গুটিয়ে যায়।
দীপ্তেশ কড়া ভাবটা বজায় রেখেই বলে,”তুমি কাদের সাথে এসেছিলে ?”
লোকটা তার বোকা বোকা চাহনিটা আবার ওদের দিকে মেলে ধরে বলে,”বাঁশীটা ছার—”
বিনয়,দীপ্তেশ এর কানে কানে বলে, ছাড়ান দিন স্যার। হয় পাগল না হয় ঘোড়েল। সহজে কিছু বেরবে না। এখানে আর কিছু করা যাবে না।
দীপ্তেশ জিজ্ঞেস করে, তোমার বাড়িতে কেউ আছে?
লোকটা মাথা দোলায়।
খবর দেব কিভাবে? কোনো ফোন নম্বর?
লোকটা ভেবে ভেবে একটা ফোন নম্বর বলে।
চন্দনা আজ দুটো বাড়ির মাইনে পেয়েছে। বেশ কিছুটা মুরগির মাংস কিনেছে। আগে টিকলি ইস্কুলে যেত। সপ্তাহে একদিন ডিম,মাসে একদিন মাংস বাঁধাধরা। দু বছর তো হতে চলল ইস্কুল যাওয়া নেই তাই মিড ডে মিলও নেই। ডিমও নেই,মাংসও নেই। কত আর ছোলা চিবানো যায়। আলেকালে সোয়াবিন অবশ্য জোটে। লোকটাও রোজ রাতে কোনো রকমে দুটো রুটি গিলে চলে যায়। দুপুর বেলা ফিরে এসে ধীরে সুস্থে আরাম করে মাংস ভাত খাবে। ইস্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে টিকলি রোজ মায়ের সঙ্গে কাজের বাড়ি যায়। মায়ের হাতে হাতে কাজ করে। একটা এগারো বছরের মেয়েকে তো আর পাঁচমিশিলি বস্তির ঘরে একা রেখে আসা যায় না।
চন্দনা চার নম্বর বাড়ির বৌদিকে বলে,মাংসটা একটু তোমার কিচেনে সিংকের সেলাবের পাশে রাখছি বৌদি। একটু দেখো। আমি কলতলা থেকে বাসন মেজে এসে ঘরটা মুচে দেচ্ছি। টিগলি ততক্ষনে ঝাড়টা দে নিগ। ফোনটা বেজে উঠতেই চন্দনা ভাবে আজ লেট হয়ে গেছে। পাঁচ নম্বর বাড়ি থেকে ফোনটা নিশ্চয় এলো। চন্দনা হাঁক পেড়ে মেয়ে টিকলিকে বলে, “টিগলি… ও টিগলি ফোনটা ধরে বল,মা কাজে বেরুউছে। পনের মিনিট পরে আসতেছে।”
টিকলি ফোনটা ধরে কথা বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যায়। ছুটে মায়ের কাছে আসে। বলে,”কে জানি কি সব বলতেছে। তোমায় দিতি বলল।”
ফোনটা ধরে চন্দনা ভয় ও কৌতূহল মেশানো গলায় হ্যালো বলে। আস্তে আস্তে তার মুখ পাংশু হয়ে যায়। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কলতলা থেকে ঘরে ঢুকে চন্দনা হুতাশ করতে থাকে। “আমার কি হবে গো,এই মানুষরে নে না আমি পারিনি।” কাজের বাড়ির বৌদিকে বলে,”পুলিশ ফোন করছিল গো। টিগলির বাপরে কারা খুব মারচে। মানুষটা এহন হসপিটালে ভর্তি। পুলিশই ভর্তি কইরেচে। আমার কি হবে বৌদি? ওরা বাড়ির লোগকে যেতি বলল। আমি আসতেছি বৌদি। টিগলিরেও নে গেলাম।”
হন্তদন্ত হয়ে চন্দনা টিকলিকে নিয়ে রওনা দেয়। একটা ফাঁকা টোটো পেয়ে তাতে উঠে পড়ে। ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখে একরাশ স্মৃতি ভিড় করে আসে। সেই সোঁদর বনের চড় জেবন। ঘোড়ামারা দ্বীপের সেই ভাঙা গড়ার ধুকপুকানি শব্দ বুকে নিয়ে গড়ে ওঠা অনিশ্চিতেরর ঘর সংসার। তবুও তো সেই দোলাচলের জীবনে হাসি ছেল। আনন্দ ছেল। একরাশ স্বপ্ন ছেল। মানুষটা তার এক ছটাক জমি চাষ করে আর ঘর ছাওয়ার কাজ করে ভাত কাপড়ের অভাব তো ঘুচ্চে ছেল। মাথার উপর নিজের ঘর বলার মত ছাদও ছেল। মানুষটা অবসরে কত সোঁদর বাঁশী বাজাত। শউরের কাছ ঠেঙই শেককে ছেল। গপ্পো ছলে বাপ ঠাউরদার কতা পুরনো দিনের ছেলে বেলার কত কতা কইত। কি সোঁদর ছবির মত দিন ছেল। লোকটা বাঁশি বাজালে যেন সুরের সুম্মুদুড়ে ডুবে যেত চন্দনা। লোকটা বলত,”উঁহু বাবা এ যে সে বাঁশি লয়। এ হল গে আমার বাপ ঠাউরদার সম্পত্তি। বংশের জিনিস। বুঝলি চন্দনা।”সেই লোকটাই রাক্ষুসী ঝড়ের গ্রাস থেকে বাঁচার পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারলনি। পারলনি মেনে নিতে তার ছাওয়া ঘরের চাল ভেঙে পড়ে বেন্দ্যাবনের পোয়াতি বউটার অপমৃত্তু। টিগলি তেখন পেটে। চন্দনার ভয় করত খুব এই বুঝি বউটা টিগলিরে ছিনয়ে নেয়। তবু ও বুঝতে দেয় নে। কিন্তু চোখের সামনে মানুষটা বদলে যেতে লাগল। কম ডাগতার, কবরেজ, তাগা, তাবিজ, মানত করেনি চন্দনা। হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছে পীর বাবার থানে। এমনকি চন্দনা গেরাম ছেড়ে চলে আসে। পেত্থমে ডাইমন হারবার। তারপর ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে এই কলকেতার কাছের বস্তি। টিগলি তেখন সাড়ে চার বচ্ছরের। তবুও পরিবত্তন কিচ্ছুটি হয় নে। সেই রাত বিরেতে বেইরে পড়া,লোকের বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করা আর সক্কাল হলেই চা মুড়ি কোনো রগমে নাকে মুখে গুঁজে বাঁশি নে বেরোয় পড়া। নিজের আবার এডটা সোঁদর পানা নামও দেছে লোগটা ‘গপ্পো ধরা’। চন্দনা এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও হেসে ফেলে। মানুষটার যত্ত আজগুবি কান্ডি। বলে রেতের বেলা দেয়লের গা ঠিনে কত্ত রগমের গন্ধ বেরোয়। কোনটা ঝাল,কোনটা নোনতা,কোনটা,কষা,কোনটা মিষ্টি,কোনটা পেঁকো। সক্কাল বেলা মুখ ধুয়ে উপোস ভেঙে তারপর সে গুলান বাঁশির সুরে হাওয়ায় উড়ায় দিতি হয়। নাইলে মানষ গুলানের ব্যাথা বাড়ে। অন্যলোকে যেন সেসব ব্যাথার কথা শুইনে সেই একই ভুল যেন না করে।
মানুষটার এই সরল বিশ্বাস চন্দনা ভাঙতে পারেনি। কাল রাতেও তাড়াহুড়ো করে কোনও রগমে রুটি দুটো খে লোগটা বেরোয় গেল। আজ ফোন আল হসপিটালে। পুলিশ কি চোর ভেবে পিটোয়চে! কি জানি। উৎকণ্ঠায় চন্দনার দম আটকে যায়। কি জানি খুব মেরে বোধহয় হসপিটালে ভত্তি করায়চে। কাঁদতে কাঁদতে চন্দনা আর টিকলি হসপিটালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দিকে এগোয়। একঝাঁক বুম, ক্যামেরা ওদের দিকে তাক করা। মিডিয়া প্রশ্ন করে,”আপনারা গপ্পো ধরার বাড়ির লোক? আপনাদের কি মনে হয় এমন কাজ কে করতে পারে?
একজন নিরীহ মানুষকে কারা এভাবে মারতে পারে। উনি তো বাঁশি শুনিয়ে পরিবার প্রতিপালন করেন। মানে রোজগার করেন।” নানা ধরনের প্রশ্ন। নানা ব্যাখ্যা। নানা জল্পনা।
টিকলি দৌড়তে দৌড়তে বাবার কাছে যায়। বাবার ফোলা মুখ চোখের দিকে তাকিয়ে সামান্য ঘাবড়ে গিয়েও উৎসাহ চেপে না রাখতে পেরে বলে,”জানো বাবা! আমাদের না টিভিতে দেখাবে। এইমাত্তর আমাদের ছবি নিল। আমাদেরকে কত কথা বলল। তোমার কথা জিগ্যেস করল। আমরা নামী লোক হয়ে গেলাম না বাবা। ইস্কুল খুললেই আমি বন্ধুদের বলব। এখন বাড়ি গিয়েই রাজু, সোনা, মামনি, রিনি সালমা, জুবিন সবাইকে বলব। আমার কি আনন্দ হচ্ছে। টিভিতে দেখানো লোকগুলোর মতো আমরাও নামী লোক।
পুলিশ অফিসার দীপ্তেশ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে আসতেই লোকটা বলে ওঠে ছার,বাঁশীটা আর খুঁজতে হবে না ছার। টিগলি আর কোনওদিনও সত্যিকার খাঁটি গল্প বলতে পারবেনি ছার। ও ওর উত্তরাধিকার হারায়ে ফেলছে ছার। গপ্পো ধরার গলার হাহাকার বাতাসে ভেসে ভেসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
****************************************
অদিতি ঘটক পরিচিতি
গৃহবধূ। নিবাস হুগলি। ভালোবাসা লেখালিখি। গল্প কবিতা, ছড়া, অনুগল্প প্রভৃতি লেখা নানা বাণিজ্যিক ও অবানিজ্যিক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়।