শিউলি তলার রূপকথা
মণি ফকির
এই মাঠ টার নাম কি রে?
শিউলি তলার মাঠ, দিদি।
ওমা কি সুন্দর নাম। তোদের কি নাম রে?
আমি তারক, ও উমা, এ কালাচাঁদ।
হাহা, দারুন নাম তোদের। আচ্ছা তোরা এখন যা, আমি ঘুরে আসছি। বেশি দূর যাস না। একসাথে ফিরব।
রোজ ভোরে এই কচি কাঁচার দল, ভোরের পাখির মত কিচিরমিচির করে আমার ঘুম ভাঙায়। তারপর এদের সাথে বেড়িয়ে পড়ি চড়তে। দুদিকে সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝখানে একফালি রাস্তা। অদ্ভুত সুন্দর এক জায়গা। যত দূর চোখ যায়, মন কেমন করা সবুজ। চার দিকে অপার নিস্তব্ধতা। আমি চলতে চলতে অনেক দূর চলে এসেছি। আমার খুব ভালো লাগছে। কারণ আমার ফেরার তাড়া নেই। কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো নেই। কোথাও ফিরে যাওয়া নেই। শুধু চলা আছে। হঠাৎ একটা গাছে হাত লাগল, পাতা গুলো গুটিয়ে গেল। এদের নাম টাচ মি নট। কিন্তু বাংলায় কি যেন বলে কিছুতেই মনে পড়ছেনা।
“লজ্জাবতী”, একটি মোলায়েম পুরুষ কণ্ঠ কানে এলো।
চমকে তাকালাম। একজন কাঁচাপাকা চুল, চাপ দাড়ি মানুষ স্মিত হেসে তাকিয়ে।
আপনি তো রায় কুটির এ এসেছেন।
বললাম হ্যাঁ। আপনি চেনেন আমায়।
না, তবে আপনাকে কদিন ধরে রোজ দেখি। বুনো কুল দের সাথে ঘোরেন।
বুনো কুল?
ঐ, বাচ্চা গুলোকে আমি ঐ নামেই ডাকি।
আপনি কি এখানেই থাকেন?
হ্যাঁ, অনতিদূরে আমার ডেরা। যাবেন?
চলুন।
আপনি কি করেন?
তেমন কিছু না। তবে এই বুনো কুল দের ওপর আমি একটা ফিল্ম বানাচ্ছি।
ও আপনি ছবি বানান বুঝি?
বানাই না, লিখি, আঁকি ও। তবে শুধুমাত্র নিজের জন্য। কমার্শিয়াল কারণে না।
বাঃ। আমার নিজের ধৈর্য্য নেই, নইলে একটা ছবি বানানোর ইচ্ছে আমার খুব। আপনার কাজ আমায় দেখাবেন?
কথা দিতে পারছি না। তবে ডেরা অবধি পৌঁছনোর পর দেখাতেই পারি। আচ্ছা আপনার পায়ের নিচে লালমাটি ভেজা ভেজা কেন জানেন?
শিশির?
কিছু টা। তবে কাছেই একটা নদ আছে। নাম রূপ-শিউলি। তার জল তলা দিয়ে বয়ে।
অন্তঃসলিলা?
একদম। অনেক অন্তঃসলিলা নদ, নদী আছে, সবাই ফল্গু হতে পারেনি। চুপচাপ বয়। তবে এই নদ মাটির উপর ও নীচে দিয়ে বয়ে।
নদ বলছেন! তার মানে পুরুষ নদী?
হ্যাঁ। যদিও বয়ে যাওয়ার কোনো লিঙ্গভেদ নেই। তবে নদ বলার কারণ আছে।
কি নাম এই নদের।
রূপ-শিউলি।
আরে অদ্ভুত নাম তো। তারমানে উভলিঙ্গ জল ধারা। অর্থাৎ নদ ও নদী দুই বলা যায়।
হুম। তবে ঠিক সেটা কারণ নয়। এর একটা গল্প আছে। যদিও তা খুব বেশি কেউ শোনেনি। শুনবেন নাকি?
অবশ্যই।
আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। রূপ ছিল এক মৃৎশিল্পী। হাতের কাজ ছিল অদ্ভুত তার। যাই গড়ত মনে হত জীবন্ত। কাউকে তার কাজ বিক্রি করতো না। এক মনে সৃজন করে যেত। একদিন এখানে এক কুয়াশা ঢাকা ভোরে তার সাথে শিউলির দেখা। শহরের মেয়ে, এখানে ওদের বাড়ি ছিল। ছুটি ছাটায় আসতো। রূপ কারো সাথে বিশেষ কথা বলত না। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে, শিউলির সাথে নিজের থেকে কথা বলল। তার পর যা হয়। ওদের মধ্যে প্রেম এলো। এমন প্রেম যা শুধু কল্পনায় সম্ভব, বাস্তবে না। ওরা একসাথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত। অনেক নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করে, শিশুর মত খিলখিলিয়ে হাসত। শিউলি জীবনে আসার পর থেকে, রূপের কাজে আলাদা জৌলুস এল। রূপ নিজের গড়া মূর্তি, ভাস্কর্য, শিউলিকে দিয়ে দিত মাঝে মাঝে।
একদিন ওরা ঠিক করল পালিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে কোথাও। সেদিন দীপান্বিতা শ্যামা পূজার রাত। রূপ এসে দাঁড়িয়ে রইল নির্ধারিত জায়গায়। কিন্তু শিউলি আর এলো না। শোনা যায় রূপ সেদিনের পর থেকে রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকতো শিউলির অপেক্ষায়। ঝর ঝর করে কাঁদতো। তারপর চলে যেত নিজের ডেরায়। আস্তে আস্তে রূপ কাজ করা বন্ধ করে দিল। একদিন রূপ এল যথারীতি, কিন্তু আর ফিরে গেল না। তাকে আর তারপর দেখা যায়নি। একদিন শিউলি এল। খালি পায়ে দৌড়তে দৌড়তে। ঠিক সেখানে যেখানে তাদের দেখা করার কথা ছিল। এসে কি দেখল জানেন?
কি?
ওখানে একটা ছোট্ট নদী। এই নদীটা আগে ছিলনা। কতবার তারা এসেছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর সেই নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে রইল। সে হঠাৎ অনুভব করতে পারল যে তার জন্য অপেক্ষা করে করে রূপ নদী হয়ে গেছে। সে অনুভব করতে পারল রূপ কে। সে রোজ এসে বসে থাকতো নদীর জলে পা ডুবিয়ে। তারপর একদিন হঠাৎ আর শিউলি কে খুঁজে পাওয়া গেলনা। কারা দেখেছিল, নদীর পারে একটা ফুলে ভরা শিউলি গাছ। তখন থেকে এই নদীর নাম রূপ শিউলি। আর মাঠের নাম শিউলি তলার মাঠ।
অদ্ভুত সুন্দর গল্পটা। কিন্তু মানুষ কি আদৌ ভালোবেসে গাছ বা নদী হয়ে যেতে পারে?
কেন পারবেনা। আচ্ছা এবার দেখুন।
ওমা কখন যেন নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। খেয়াল করিনি। হঠাৎ চোখ আটকে একটা গেল একটা ফুলে ভরা শিউলি গাছের দিকে। ওহ্। এই তাহলে রূপের শিউলি। আমি আরো কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। নির্বাক অথচ বাঙ্ময় একটি গাছ। মানুষ যদি কথা না বলত, কি হত? গাছেরাও কথা বলেনা।
হঠাৎ পিছন ফিরে একটা কথা বলতে গিয়ে দেখি, লোকটা নেই। একি, ভূত নাকিরে বাবা। নামটাও জিজ্ঞেস করা হল না। কিন্তু আমি হঠাৎ অনুভব করতে পারলাম হয়ত ওর নামও রূপ। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন সময় দেখলাম তারক দৌড়ে আসছে আর চেঁচিয়ে ডাকছে “ওওও দিদিই, ও শিউলি দিদিই চলে এসোওওওও ফিরতে হবে। টোটো এসে গেছে।”
আমি এগোতে থাকলাম। এবার ফেরার পালা। কিন্তু আবার আসতে হবে আমায়। থেকে যাওয়ার জন্য।
টোটো তে বসে মনের মধ্যে গুনগুন করতে লাগল কয়েকটা কথা
“তোমার আমার গল্পগুলো,
অল্প কথায় বেড়ায় উড়ে,
রূপ শিউলির ঘাটে,
শিউলি তলার মাঠে
“*******************************************
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।