রক্তদান
কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)
“আজ ঝুমরি পড়তে আসেনি কেন রে ? সামনেই তো পরীক্ষা।”
“স্যার,আজ কাল দুদিন ও আসবে না বলেছে। শহরে যাবে। রেল লাইনের একটু পরেই বিশাল বড় চৌধুরী বাড়ি। ওখানে রক্তদান হবে। আর বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে। দুদিন ধরে চলবে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা। ও ওখানে অংশগ্রহণ করবে। তাই …..” বর্ণিল একটু ভেবে ভেবে বলল।
“ও ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ তো পনেরোই আগষ্ট।”
স্টেশনের পাশ দিয়ে যে লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে সেখান থেকে মিনিট পনেরো কুড়ি হাঁটলেই জোড়া দীঘি পড়ে। সেই দীঘির পাশেই বহুদিনের ঐতিহ্যশালী চৌধুরী বাড়ি। এই বাড়ির অতীত গরিমা আজও মানুষকে প্রভাবিত করে।
দীঘির ঐ পাড়ে একটা দুটো মাঠ পেরোলেই যে কাঁচা পাকা ঘরগুলো চোখে পড়ে সেখানে বহু মানুষের বাস। ওখান থেকে দিনে পাঁচ বার নামাজের শব্দ আসে। ছেলেদের মাথায় অনেকের ফেজ টুপি। মেয়েদের মুখে কারো কারো বোরখা। ঈদের দিনে গান ভেসে আসে।
একটা সময় যেকোন পুজো পার্বণে দীঘির ওপাড় আর এপাড় মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের গলা জড়িয়ে আনন্দ করত। নাচাগানা চলত। একটা সম্প্রীতির গন্ধ বেরোত আকাশে বাতাসে।
হঠাৎ একটা দামাল ঝড় সব কিছু শেষ করে দিল।
১৯৯২এর ৬ই ডিসেম্বর। বাবরি মসজিদ ভাঙার আঁচ এসে পড়ল দুই পাড়ে। থমকে গেল সব কিছু। একটা বৈরীর প্রাচীর তৈরী হল। যদিও মন কষাকষি ভাবটা মনেই ছিল। কোন মারামারি বা গণ্ডগোল হয়নি। তবে বহুদিন ছিল এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। দুই সম্প্রদায় একে অপরের কাছে ঘেঁষা তো দূরে থাক কেউ কারোর সাথে কথা পর্যন্ত বলত না।
বেশ কিছু বছর থেকে সম্পর্কের মোড় অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করে। মসজিদ পাড়ার নাফিসাবানুর মেয়ে থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত হয়। প্রচুর রক্তের দরকার হয়। সেদিনটাও ছিল পনেরোই আগষ্ট। সকাল থেকেই শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টির দাপট। ঝুমরির বন্ধু ঐ মসজিদ পাড়াতেই থাকে। সে-ই চৌধুরীবাড়ির মেজ বৌ ঝর্ণাকে খবরটা দেয়। ঝর্ণা আর আফসানার ব্লাড গ্রুপ একই। বি নেগটিভ। খুব রেয়ার।
ঝর্ণা নিজেই ঐ বৈরীর প্রাচীরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রক্তদান করে। আর প্রাণে বেঁচে যায় আফসানা। সেই শুরু।
পরের বছর ঐ দিনেই ঝর্ণা নিজ উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবসের দিনে ব্লাড ডোনেশান ক্যাম্পের আয়োজন করে। সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এগিয়ে আসে ছোট ছোট জাতীয় পতাকা হাতে। সবাই একসাথে মঞ্চে গেয়ে ওঠে –
” মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে…..
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা
বন্দীশালার ….
সেদিন অনেক রকম অনুষ্ঠান হয়।
সেই দিন থেকে আদিবাসী ঝুমরির মনে স্বাদ জাগে রক্ত দান করার। চোখে স্বপ্ন দেখে ঐ পবিত্র দিনে কিছুএকটা করার।
ঝুমরির সম্প্রদায় ওকে চৌধুরীবাড়িতে ঢুকতে বাধা দেয়। কারণ চৌধুরীদের পূর্ব পুরুষ একটা সময় আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিয়েছিল। অত্যাচারও করেছিল।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। ঝর্ণাও মারা গেছে। সেইভাবে আর স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়না। দীঘির ও পাড়ের লোকও আর আসে না।
তবে এবারটা সকলের থেকে আলাদা। এবার রমজান মাস পড়েছে। প্রবল বৃষ্টিতে দীঘির ও পাড় ভেসে গেছে। তাই ও পাড়ার মানুষ চৌধুরী বাড়ির আশে পাশেই আশ্রয় নিয়েছে। রমজান মাসে সকলের চিন্তা ছিল কি করে রক্তদান হবে। চৌধুরী বাড়ির নাতনিই সব পথ বাতলে দিয়েছে।
এ বছর ঝর্ণার দশম মৃত্যু বার্ষিকী। তাই আয়োজন একটু বেশী। এদিকে পুজো চলে আসছে। সেপ্টেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে পুজো। চৌধুরী বাড়ির দুর্গা দালানেই চলছে নামাজ।
আজ বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন। চৌধুরী বাড়িতে সাজো সাজো রব।
ঝুমরি সারারাত ধরে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটা পড়েছে, পাঠ করবে সেইজন্য।
খুব সকালে ট্রেন ধরবে বলে বেরোতেই এক কাণ্ড। ট্রেন মিস করেছে। আজ ছুটির দিন ট্রেন কম। পরের ট্রেন তিন থেকে চার ঘন্টা পরে। অন্য ট্রেন গুলি গ্যালোপিং। মনে আশা ছিল আজ রক্তদান করে পবিত্র হবে। তাই রেল লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে রক্ত দেবে বলে। ট্রেনের অপেক্ষাতে বসে থাকলে রক্তদান হবেনা।
অনেক বেলা হয়ে গেছে। তেরো কিলোমিটার পথ অনেকটাই হেঁটে ছুটে পেরিয়ে এসেছে। আর মাত্র দুই কিলোমিটার বাকি। হঠাৎ দেখে একটি অন্ধ ভিখারী একতারা বাজাতে বাজাতে চলে আসছে। লাইন বরাবর। ওর একতারা দেশাত্মবোধক গানের সুর তুলেছে। ওদিকে ওর পিছন থেকে পাশের লাইন ধরে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে ডাউন ট্রেন। আর একটু দেরী করলেই ঝুমরি বাঁচাতে পারত না অন্ধ লোকটিকে। ঝুমরি কি ভাগ্য সে অন্ধ লোকটিকে দেখতে পেয়েছিল। তাই নিজের জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্ধ ভিখারীকে বাঁচিয়ে দেয়।ভিখারীটি বাঁচল বটে,ঝুমরি বাঁচল না। সারা শরীর রক্তে লেপ্টে রেল লাইনের ধারে পড়ে থাকল। ঝুমরির রক্তদানের স্বাদ মিটল। তবে অন্যভাবে।
* বিদ্রোহী কবিতার লাইন –
“ …… …..আমি বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শ্রান্ত
…… ……. ….. আমি বেদুইন …….. “
হৃদয়ের অলিন্দে গুমরে কেঁদে উঠল।
চৌধুরী বাড়িতেই আজ অনেকেই রক্ত দিল। শুধু একজন ছাড়া। সন্ধ্যেতে দুর্গাদালানে নামাজ পড়ার পর হল দেশের বীর শহীদদের জীবনী অবলম্বনে নাটক।
ঝুমরির মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের পর মর্গে পাঠানো হল। ঝুমরির খবর যখন চৌধুরী বাড়িতে আসল তখন গোধূলী সূর্য লাল আভা ছড়াচ্ছে। নীল মেঘের ক্যানভাসে রবির লাল রশ্মি রক্তের মতন ছড়িয়ে পড়ছে। সেই অন্ধ ভিখারীটি ভাবলেশ হীন। তখনও তার একতারা গেয়ে চলেছে –
“ …… ………
….. …….লেখা আছে অশ্রু জলে ……. “
****************************************************
রঞ্জিত মল্লিক পরিচিতিঃ
বহরমপুর শহরের বাসিন্দা,কর্ম সূত্রে এখন দমদমে থাকেন। খুব ছোট থেকে লেখালিখি শুরু। বারো ক্লাসের পর থেকে লেখার প্রতি একটা মোহ জন্মায়। এক সময়ে ইংলিশ স্টেটসম্যানে লিখতেন। বহু পত্রিকা ওনার লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে ও ফেসবুকে লেখেন। ভবিষ্যতে একক বই লেখার ইচ্ছে পোষণ করেন।