আমি সুতপা। বাবা-মায়ের দুই সন্তানের আমি প্রথম। আমার একটা ছোট বোন আছে। তার নাম অনুতপা। আমার শৈশব কাটে মুম্বইয়ে, দাদু-দিদার কাছে। আমার যখন তিন মাস বয়স, তখন মা আমায় রেখে ফিরে যান আমার বাবার সংসারে। পাঁচ বছর পরে আমায় নিয়ে আসা হয় আমার পৈতৃক বাড়িতে। কিন্তু আজকের কথা আমায় নিয়ে নয়। এ কাহিনী আমার মায়ের জীবনের কাহিনী। একটা বয়সের পর থেকে মা কিছুটা আমার বন্ধু হয়ে গেছিলেন। মানে, সেই আমলে, যতটা ফ্রি হওয়া যায়। তখন মা’র কাছেই মা’র নিজস্ব কিছু কথা শুনেছিলাম। কিছু অনুভূতির কথা। সেই কথাই আজ বলতে এসেছি।
রেখা অল্প বয়স থেকেই, “বিবাহ” নামক বস্তুটি কে একদম পছন্দ করত না। কোনদিনই বিয়ে করতে চায়নি সে। চেয়েছিল উচ্চশিক্ষা নিয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করতে। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে এই আবদার মানা হবে কেন? তাই যথা সময়ে, তার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়। রেখা সুন্দরী ছিলনা মোটেই। তবে সুশ্রী ছিল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েটি পড়াশোনা তে ছিল খুবই ভালো। শুধু পড়াশোনাতে-ই নয়, ঘরের কাজেও সে ছিল ভীষণ পটু। স্কুলে এবং পরবর্তীতে কলেজেও শিক্ষিকা বা অধ্যাপক/অধ্যাপিকা নাহলে তার পরিচিতি ছিল ভালো ছাত্রী হিসাবে। স্বভাবতই তাঁদের বিশেষ স্নেহের পাত্রী ছিল সে। তার ইচ্ছে ছিল ফিজিক্সে মাস্টার্স করে থিসিস করে পোস্ট-ডক করার। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় এক। অনার্সের পরীক্ষা চলাকালীন বাড়ির চাপে পাত্রপক্ষের সামনে ইন্টারভিউ দিতে হাজির হতে হলো। যথারীতি উদরপূর্তি করে তাঁরা “মেয়ে কালো” অজুহাত জানিয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বিদায় হলো। রেখার কোমল মনে প্রথম ক্ষতটা তৈরি হলো। ছাত্রধরা-র মতো এরপরে শুরু হলো পাত্রধরা। ফি হপ্তা একদল না একদলের সামনে সেজেগুজে তাকে বসতেই হতো। আর, নিজের থেকেও বেশি কষ্ট হতো বাবা-মায়ের জন্য। প্রতিবার পাত্রপক্ষ অপছন্দ করার পর রেখার মন ক্ষতবিক্ষত হতো বাবা-মায়ের কষ্ট দেখে। সইতে সইতে অবশেষে রেখা রুখে দাঁড়িয়েছিল। যখন কলকাতায় পাত্রপক্ষকে দেখানোর জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সে প্রতিজ্ঞা করে এবং বাবা-মায়ের কথা আদায় করে যে এবারে বিফল হলে আর কোনওদিন বিয়ের নাম তাঁরা করবেন না। রেখা মাস্টার্স কমপ্লিট করবে, স্বাবলম্বী হবে। কিন্তু কথায় আছে না, “জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে!!” সেইবারেই রেখাকে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে ফেলে। অতএব, বিয়ে করতেই হল রেখাকে। বিবাহিত জীবন সে সুগৃহিণীর মতই চালাচ্ছিল কারণ, ঘর সংসারের কাজে সে পটু ছিল। তাই তার শ্বশুরবাড়িও খুব খুশি ছিল তাকে পেয়ে।
কালক্রমে মুম্বইয়ে পিত্রালয়ে রেখা কন্যা সন্তানের মা হলো। বাড়িশুদ্ধু সবাই খুব খুশি। ক’মাসের মাথায় শিশুকন্যাকে বাপের বাড়িতে রেখে সে ফিরে গেল নিজের বাড়ি। টানা পাঁচ বছর মেয়ে বড় হচ্ছিল বম্বেতে, তার দাদু-দিদার কাছে। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সে ওখানেই। বাবা-মা’র কাছে ফিরে এসেছিল সে দীর্ঘ পাঁচটা বছর পরে।
কন্যা বাড়ি আসার পরের বছর রেখার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। বড় মেয়ে সুতপার স্কুল শুরু হয়ে গেছিল ততদিনে।
সুতপা যত বড় হচ্ছিল, ততই উপলব্ধি করতে শুরু করলো, অন্যান্য বন্ধুদের মায়েরা তাদের সুন্দর করে চুল বেঁধে স্কুলে পাঠাতেন, কিন্তু তার মা কখনোই সেটা করে দিতেন না। অনভ্যস্ত হাতে সে নিজেনিজেই চুল বাঁধত, যেটা দুপুরের দিকে খুলে পিঠে ছড়িয়ে যেত। প্রতিদিন বাঁধা চুল নিয়ে বেরিয়ে, বাড়ি ঢুকত খোলা চুলে। রেখা সব দেখেও না দেখার ভান করে থাকত। এতে সুতপা খুব তাড়াতাড়ি আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছিল। রেখা সুন্দর সেলাই করত। সেলাই করতে করতে সুতপার সাথে নানান কথা বলতো। বড় হয়ে সুতপা বুঝেছিল, মায়ের সেই না দেখার ভান ছিল সুচিন্তিত পদক্ষেপ, যাতে সে দ্রুত আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে। তাই বলে রেখার কর্তব্যে গাফিলতি ছিলনা বিন্দুমাত্র। সংসারের খুঁটিনাটি গুছিয়ে করতে সে পটু ছিল। কিন্তু তার চাওয়া ছিল অন্য। সে চায় আরও আরও শিক্ষিত হতে। স্বাবলম্বী হতে। স্বামীর রোজগারে দিনাতিপাত ছিল তার নাপসন্দ। সুতপা দশম শ্রেণীতে ওঠার আগে অব্দি রেখা নিজের জগৎ নিয়েই বেশি থাকত। অনুতপা খুব বেশি জ্বালাতন করত বলে রেখা বাধ্য হতো ওকে দেখাশোনা করতে।
সে অন্য মায়েদের মত নিজের সন্তানদের নিয়ে মেতে থাকত না। সে তার কর্তব্যে কখনো কোন ঘাটতি পড়তে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু পরে যখন সুতপার “বন্ধু” হয়ে উঠেছিল সে, প্রায়ই মেয়ে কে বলতো কোনও দিনই ওর সংসার করতে ভাল লাগেনা। যা করে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কর্তব্যের খাতিরে জোর করে করে। তার স্বাধীনচেতা মন নিজের অসুস্থতার কথাও স্বামীকে বলতে বাধা দিত। অনুতপা যখন দশম শ্রেণীতে, তখন সে প্রায় উত্থানশক্তিরহিত। কোনরকমে তাকে রাজি করিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে বড্ড দেরী হয়ে গেছিল। কর্কট রোগ তখন ছড়িয়ে গেছে সারা শরীরে। সে স্বামীকে ডেকে বলেছিল, মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে। সেই টাকা ভেঙে আমার বৃথা চিকিৎসা করাতে যেওনা। আমার আর বড় জোর তিনমাস। তাই, এই ক’টা দিন আমায় আমার ঐ দক্ষিণের ঘরে কাটাতে দাও। সুতপা তার মা কে খুব বুঝতো। সে তার উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত রেখে শেষের দিনগুলো মায়ের সেবাযত্ন করে কাটাতে বাড়ী ফিরে আসে।
আজ মা নেই। খুব কষ্ট পেয়ে, চলে গেছেন। মুক্তি পেয়েছেন অনিচ্ছার জীবন থেকে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি মা যেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত জীবনে জন্ম নেন।
আমি ঊর্মি সরকার। সাধারণ এক গৃহবধূ। কোনদিন লেখালেখি করিনি। খুব বই পড়তে ভালবাসি। এখন অখন্ড অবসর আমার হাতে, তাই বন্ধুদের উৎসাহে কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
*******************************************
ঊর্মি সরকার পরিচিতিঃ
গৃহবধূ। খুব বই পড়তে ভালবাসেন এবং অবসর সময়ে লেখালিখি করেন।
অনাকাঙ্খিত জীবন – ঊর্মি সরকার
5 Comments
Comments are closed.
হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
অসংখ্য ধন্যবাদ 🙏
খুব সুন্দর! বড্ড চেনা👍
অজস্র ধন্যবাদ 🙏
খুব সুন্দর গল্পটি! বড্ড চেনা👍