সা র প্রা ই জ
প্রত্যুষ সেনগুপ্ত
-আরে? আপনি কে? আপনি আমার প্রোফাইলে ঢুকলেন কীভাবে?
চমকে গেলাম।আজ রবিবার।অফিস নেই।রুমমেট একসপ্তাহের জন্য ছুটিতে। বাড়ি গেছে।গতকাল পর্যন্ত বেশ চাপ ছিলো কাজের।আজ শুধু কুঁড়েমি করব।গাড়িটা সার্ভিসিং য়ে গেছে।সকালে দুবার কফি একবার চা হয়েছে।ব্রেকফাস্ট সারা।রান্না করে চলে গেছে যমুনামাসী।
ল্যাপটপ খুলে এদিক সেদিকের পর ফেসবুক খুলতেই এমন ঝাঁঝালো সওয়াল।বেগতিক দেখে আঙুলগুলোও যেন তোতলাতে থাকে।আমি লিখলাম
-মানে আমিতো কিছুই করিনি।ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট লিস্ট দেখতে গিয়ে কয়েকটা নামে ক্লিক করেছিলাম কাল রাতে।আপনার নামে করেছি কি না সেটা মনে করতে পারছি না।
-কিন্ত আমি কখনোই আপনার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইনি তো?
বুঝতে পারলাম কোথাও একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।আমি মহিলাদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকতেই ভালোবাসি।আমি কিন্ত হিপোক্রিট নই।স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কো এড্। চাকরিতে ও অনেক মহিলা কলিগ।সকলের থেকে সেফ ডিসট্যান্স রেখে চলি।আসলে আমার নজরে তেমন মেয়েই আসেনি। হয় খুব নেকু নেকু নয়তো পুরুষালি।
চোখ রাখলাম ল্যাপটপের পর্দায়।প্রশ্ন এসেছে
-কি হলো? কিছু বলছেন না কেন?হ্যালো?
আমার তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।এদিকে কম্পিউটার চালানোর জ্ঞান খুবই কম।
আমি টাইপ করি
-মানে,আমি এখন কি করব?আপনার নামটি বাদ দেব কিভাবে একটু বলবেন দয়া করে?কীভাবে ডিলিট করতে হয় একটু বলবেন ম্যাডাম?আপনিও আমাকে বাদ দিয়ে দিন।
এটুকু লিখে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো!ল্যাপটপ বন্ধ করতে যাবো,দেখলাম আবার কিছু লেখা এসেছে।
-থাক থাক।বেশি বেশি করতে হবে না।ঢুকেই যখন পড়েছেন, থাকুন। তবে মনে রাখবেন-
-কী?
-শুধুই বন্ধুত্ব।ভার্চুয়ালি যেমন হয়।কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়!প্রেম নিবেদন টিবেদন একদম বাদ।তেমন করলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্লক ও আনফ্রেন্ড করে দেব কিন্ত।
এই সব শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আমার আর করার কিচ্ছু ছিলো না।সেই থেকে পারমিতা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।পারমিতা রায়।শিক্ষিত ও ধনী।দু’চার পোস্টে বুঝতে পারলাম একটু আধ্যাত্মিক গোছের। দান ধ্যান করে প্রচুর।বেশ কিছু দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার খরচ চালায়।মা বাবার একমাত্র সন্তান।তাই একটু আহ্লাদি্নীও।
আমার বাড়ি কলকাতা। চাকরি সূত্রে দিল্লিতে। এক মাল্টিন্যাশনালে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। মাত্র চার বছরে।এখন আমি সাতাশ প্লাস।নীলুর বয়সি।তবে দিকশূন্য পুরে আমার সঙ্গে কেউ থাকে না।আমি থাকি আর এক কলিগের সঙ্গে গুরগাঁওয়ে।
গ্যারেজ সহ দোতলা এক ওয়েল ফার্নিশড বাড়িতে।যা ভাড়া গুণতে হয় সেটা অনেকের মাসিক বেতনের চেয়ে বেশি। প্রোফাইলে দেখলাম মহিলাটি যতই ভারিক্কি ভাব দেখাক না কেন,সবে তেইশ পেরিয়েছে। চুঁচুঁড়ার মেয়ে।এখন আমার মতোই ঘর ছাড়া। কেরলের তিরুবনন্তপূরমবাসিনী।সরকারি চাকরি করে।
দুই।।
প্লেনের কারগো থেকে নামাতে সম্ভবত হাত ফস্কে পড়ে গিয়ে ছিলো। সুরবাণী চেঞ্জারের একটা কোণা একটু তুবড়ে গেছে। খুলে দেখলাম বাঁদিকের বেলোর প্রথম পাটের একটি দিক ভেঙে গেছে।চিত্তরঞ্জন পার্কের দত্তদের মিউজিক মহল থেকে সারিয়ে এনেছি।একদম আগের মত করে দিয়েছে।রবিবার সন্ধ্যায় একটু গান বাজনা প্র্যাকটিস করি। ওল্ড দিল্লি থেকে প্রবীণ শর্মা নামে একজন শিখিয়ে যান। গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দিই। এর মধ্যে দিল্লি কালীবাড়িতে এক অনুষ্ঠানে গেয়েছি। দুটো ভজন,একটা গজল। আর একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। এর মধ্যে পারমিতার সঙ্গে তেমন আর যোগাযোগ হয়নি।আজ দেখলাম বেনারসের গঙ্গায় নৌকায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার একটা পোস্ট। লাইক করলাম।রিসেন্টলি আমি একটা গানের অ্যাপে ঢুকেছি।এরা নাকি তারকা তৈরি করে!অন্তত নামটা সেরকমই। পছন্দের গান গেয়ে যাও,কারাওকে ম্যাজিকে মিউজিক সহ রেকর্ড হয়ে যাবে। একেই নাকি বলে ট্র্যাকে গান গাওয়া!ইদানিং ভৈরবী আমার মাথায় চেপেছে।ভীষণ সুন্দর লাগে এই রাগটি। কোমল রে,গা,ধা,নি তে একটা অদ্ভুত হারমণি তৈরি হয়।রবিঠাকুরের অনেক গান রয়েছে ভৈরবীতে। প্রেম পর্যায়ের “অনেক কথা যাও যে বলে”.., “প্রথম আলোর চরণধ্বনি”… ” আলোকের এই ঝর্ণাধারায়”..এরকম কয়েকটি গান।রবীন্দ্রনাথের গানে আমি খুব খুঁতখুঁতে। এত কমপ্যাক্ট কম্পোজিশন কেউ পাল্টালে খুব খারাপ লাগে।প্রথম আলোর স্থায়ীতে একজন গেয়েছেন প্রথম “সা” আলো “মা”! অথচ স্বরলিপি তে পরিস্কার ‘প্র ‘টা ষড়জে মীড় হয়ে” থ” পর্যন্ত যাবে।সেখানে মধ্যমা থেকে ধরতে হবে।”আলোকেরই ঝর্ণা ধারায় কোমলের জায়গায় শুদ্ধ ঋষভ, ব্যবহার করতে দেখেছি অনেককে। মোটেই ভালো লাগেনি।রবিগানে কপিরাইট উঠে যাবার পর অনেকে ওস্তাদি মারছেন।আবার অনেক কম্পোজার নিজের কম্পোজিশনে রাগে বিবাদী সুর লাগান। এতে মাধুর্য বাড়ে।যেমন আর ডি। বিখ্যাত প্রেমগীত হামে তুমসে প্যায়ার কিতনা তে
প্রথম ও দ্বিতীয় অন্তরায় শুদ্ধ ঋষভ ও শুদ্ধ গান্ধার ব্যবহার করেছেন। তারপর তো ইতিহাস! একদিন ট্র্যাকে হঠাৎ দেখলাম পারমিতার নাম।ছবি দেখে চিনতে অসুবিধা হয়নি।বেশ কয়েকটি গান পোস্ট করেছে। হেডফোন লাগিয়ে শুনলাম।স্তব্ধ হয়ে গেলাম।এ কি কন্ঠ? এতো সুরেলা?এত নিখুঁত নিবেদন? সত্যি বলতে কি সেদিন থেকেই ওর ফ্যান হয়ে গেলাম।নিজেকে ভাবতাম,একটু আধটু গান জানি,রাগ জানি। দেখলাম,পারমিতার কাছে আমি কিচ্ছুটি নয়! ওর গান শুনে কমেন্ট দিতে ও লিখলো
—– -আরে,আপনি নাকি?
কথার শুরু তে “আরে?” বলা পারমিতায় একটা অভ্যেস। সেই থেকে বন্ধুত্বটা একটু শক্তপোক্ত হলো। তবে একটু মতের অমিলও যেন দেখা গেল।ওর একটা অদ্ভুত ব্যাপার।ওর গানের প্রশংসা করলে খুব অসন্তষ্ট হয়! আর হঠাৎ রেগে যায়! মাঝখানে পারমিতা ফোন ধরছিলো না। কমেন্টের জবাব দিচ্ছিলো না।আমি ভাবলাম ওর হলো টা কি? এমনিতে ফোন-টোন করা হয়না। সেদিন ফোন করতেই ঝাঁঝালো উত্তর
– কি বলবেন?সময় নষ্ট করছেন কেন আমার?
আমি লাইন কেটে দিলাম। আমার হোয়াটসঅ্যাপ তিনটে। একটাতে এতো রেগে যাওয়ার কারণ জানতে প্রশ্ন লিখতেই পাল্টা ফোন এলো
–এতগুলো হোয়াটসঅ্যাপ কেন আপনার?
আপনি এভাবে বিরক্ত করেন কেন?
আমি হতবাক। কখন বিরক্ত করলাম? মেয়েদের মন বোঝা শক্ত ব্যাপার। দেবা ন জানন্তি স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম,মনুষ্য কুতাঃ? প্রবাদটি মনে পড়লো।আমার অবস্থা কতকটা ‘খাচ্ছিলো তাঁতী তাত বুনে”..মতন। ক্রোধ বর্ষা অব্যহত করে পরের প্রশ্ন
-আমাকে কতটুকু চেনেন। কতটুকু জানেন? আমার দুশো ছত্রিশ জন হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধু আছে। তার মধ্যে আপনি একজন।এর বেশি কিছু নয়। আমি মহিলা হলে বলতাম হে ধরনী দ্বিধা হও।সীতা যেমন বলেছিলেন। রাম বা অর্জুন এরা কেউ একথা বলেননি কেন কে জানে! আমি শুধু জবাব দিলাম
গত দু বছর আপনাকে দেখছি। যেটুকু চিনেছি তাতে খারাপ কিছু পাইনি।আর শুধু দুশো চৌত্রিশ কেন,আমাকে হাজারের মধ্যেও মেশাতে পারেন। আপনাকে বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবিনি।নমস্কার।
সাইনআউট করেদিলাম।এর পর পাক্কা ছ’মাস ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ খুলিনি।অফিস,গান,বেড়ানোতে ব্যস্ত ছিলাম।ছুটি নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলাম গত মাসে। আর এরমধ্যে আমার জীবনের একটা অন্যতম ব্যাপার ঘটে গেছে। সে এক গল্প।রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,সুনীল,শীর্ষেন্দু, তরুণ মজুমদার মিলিয়ে সে এক টান টান অ্যাকশন চিত্রনাট্য। পরে একসময় খুলে বলা যাবে।এর মধ্যে গত রাত দশটায় একটা ফোন এলো
–একটু কথা বলা যাবে?
বুকটা ধড়াস করে উঠলো। পারমিতা!
বলুন,বলুন। আনন্দে চিৎকার করে উঠতেই সম্বিত ফিরলো!যাঃ পারমিতা কী সব ভাববে।সঙ্গে সঙ্গে গলা নামালাম। যতটা সম্ভব কোমল করে বললাম
-আমি কি মন্ত্রী না সেলেব?আপনি যখন তখন,যত খুশী কথা বলতে পারেন।
-আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটায় দিল্লি নামব। অফিসের কাজে। চার দিনের প্রোগ্রাম। যন্তর মন্তরে সরকারি গেস্ট হাউসে থাকছি।
তিন।।
নয়াদিল্লি এয়ারপোর্টের দুনম্বর গেট দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখলাম পারমিতাকে। একটা ঢাউস চাকা লাগানো ব্যাগ ঠেলে আনছে।ছিপছিপে লম্বা শরীরে নীল জিনস আর ধবধবে সাদা টি শার্ট। অবাক হলাম ওর প্রায় কোমর ছোঁওয়া লম্বা কোঁকড়ানো কালো চুলের ঢল দেখে।ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। কপালে,মুখে কিছু অবাধ্য এলোমেলো চুল। সলিলের বর্ণনায়.. তোমার চুলের মত মেঘ সব ছড়ালো,চাঁদের মুখের কাছে জড়ালো!”যে কোনও মানুষের মন হারানোর মতন ব্যাপার!আমার মনও হারাচ্ছিলো একটু হলেই। গণ পিটুনির ভয়ে আঁকড়ে রাখলাম মনটাকে!দূর থেকেই দেখলাম,ছবিতে যা দেখায় তার থেকে অনেক সুন্দর। আমাকে দেখেই হাত তুললো।আমার খুব আনন্দ হচ্ছিলো ভার্চুয়াল বন্ধুকে সামনে দেখে।ও কে যা একটা সারপ্রাইজ দেব না! ওর ঠিক পেছনে নস্যি রঙের স্যুট পড়া লম্বা এক যুবক। ওর ব্যাগটাও ঢাউস। পারমিতা পিছন ফিরে ব্রাউন স্যুটকে কিছু বললো। আঙুল দিয়ে আমাদের দেখালো। একটু কাছে এলে পারমিতাকে দুচোখ ভরে দেখতে পেলাম। শ্যামাঙ্গী। খুব ঝকঝকে মুখমন্ডল। মুখে হাসি। সুতপা কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো!বললো
-এই যে মশাই? চোখ দেখি সরেই না!
আজ আমার ছুটি। আগেই নিয়েছি। আজ সারাদিন আমার প্রোগ্রাম। নতুন কেনা এস ইউ ভি’টা নিয়ে বেরিয়েছি। গত সাতদিন যেন স্বপ্নের মধ্যে উড়ছি। এর পর প্রায় অপ্রত্যাশিত ভাবে পারমিতার ফোন। ভার্চুয়াল বন্ধুকে এবার সামনা সামনি দেখা যে কত আনন্দের,বোঝাতে পারবো না। আমাকে পায় কে!
সুতপা কিন্ত বাঙালী মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা। ফর্সা। একটু যেন তুলতুলে। আমি পাঁচ সাত।ওর হাইট পাঁচ পাঁচ। জলপাই রঙের সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কে মানিয়েছে বেশ। পারমিতার হাইট একটু বেশী।
পারমিতা সোজা সুতপার হাতে হাত মেলালো। জড়িয়ে ধরলো দুজন দুজনকে। আমি কিছু বলতে চেষ্টা করতেই পারমিতা বলে উঠলো-আমার সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছে মশাই। আপনি না বললে কি হবে। এবার অবাক হলাম সুতপা সোজা লম্বা ব্রাউন স্যুটের হাত ধরে আমাকে বললো
-লেট আস ইনট্রোডিউস আওয়ার সেল্ভস্। আমি সুতপা চট্টোপাধ্যায়। ওয়াইফ অব সুগত চট্টোপাধ্যায় অ্যালিয়াস ভ্যাবলা। আর ইনি হলেন মিষ্টার অভিজিৎ রায় চৌধুরী, হাসব্যান্ড অব মিসেস পারমিতা রায় চৌধুরী। আমাদের মতন এঁদেরও সদ্য বিয়ে হয়েছে। উইদাউট প্রিপারেশন। একদম ভিনি ভিডি ভিসির মতন। আমি ভ্যাবলার মতন হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ডাক নাম ভ্যাবলা,এটা সুতপাকে কে বললো? আর পারমিতা কে সারপ্রাইজ দেব? তার কি হবে? উল্টে আমিই! অগত্যা ওদের তিন জনের তীব্র হাসিতে আমিও গলা মেলালাম!
***************************************************
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।