*নির্বাণ*
মণি ফকির
মেন্টাল সাবট্র্যাকশন বা মন-বিয়োজন! শুনেছ কখনো?
বললাম: না। বাট সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং। প্লিজ ইলাবরেট।
ওকে, রাতে আমরা যখন ঘুমোতে যাই, শোওয়ার পর, অন্ধকার ঘরে অনেক শব্দ কানে আসে। পারিপার্শ্বিক শব্দ,অ্যামবিয়েন্ট সাউন্ডস। সেগুলোতে মনোযোগ দিলে নির্ধারণ করা যায় কোন শব্দটা সবচেয়ে দূর থেকে আসছে। আর কোনটা সবচেয়ে কাছে। এবার চেষ্টা কর, দূরত্বের ক্রম অনুযায়ী শব্দগুলোকে mentally mute করার। আস্তে আস্তে মনকে নিকটতম শব্দে নিয়ে এস। তারপর সেটাকেও ছেঁটে ফেল। শুধু নিজের শ্বাসের শব্দ পাবে। তুমি যদি কোনো অর্কেস্ট্রা বা ব্যান্ডে পারফর্ম করার সময় নিজের গলা বা বাজনা শুনতে না পাও, তখন এই অনুশীলন তোমায় সাহায্য করবে। নিজের কথা চাপা পড়ে গেলে মানুষ বড় একা হয়ে যায়।
………………………………..
মুনখাগড়া। ঘন জঙ্গল, বড় ঝিল, চারপাশে সাদা রডোডেন্ড্রন ফুলে ভরা গাছ। দূরে বরফের চাদরে ঢাকা হিমালয়। অচেনা অজানা এক মায়াবী জগৎ, যেখানে ভাবার অবকাশ অফুরন্ত। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। জীবন আমায় এক অদ্ভুত বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি মঞ্জিরা।
………………………
পনেরো দিনের নৈঃশব্দ্য চ্যালেঞ্জ। কোনো কথা বলা বারণ। লিখে বা ইশারায় আদান প্রদান করতে হবে। অভি বলেছিল “তোর দ্বারা হবেনা। বকবক করতে এত ভালোবাসিস। ভেবে দেখ। গত ছয় বছর আমার কানের পোকা নাড়িয়ে দিয়েছিস।”
আমিও জানতাম,পারবোনা। অভি আর তুলির সাথে কথা না বলে থাকতে পারিনা। তুলি এত ছোট। ওকে অনেক কষ্টে বোঝালাম আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলা শিখতে যাচ্ছি। বাড়ির সবাই মানা করেছিল। মা বাবা তো কথাই বন্ধ করে দিল। অভিরও অভিমান ছিল, তবে ওই আমার পাশে দাঁড়ালো।
…………………………..
আজ তৃতীয় দিন। এখানে অনেক পাখি, অনেক রঙ বেরঙের পোকামাকড়, প্রাণি। মা কাঠবিড়ালি রোজ বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ঘোরে। দেখে খুব কান্না পায়। তুলির মুখ মনে পড়ে। চুপ করে থাকার সময় এত কান্না পায় জানতাম না। যখন তখন কারণে অকারণে চোখে জল আসে। এখানে কাঁদতে বাধা নেই। শব্দ জলের প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এখানে এসে উপলব্ধি হল। ………………….
আমার চুপ থাকার মেয়াদ শেষের মুখে। আমার খুব ভাল লাগছে, নিজের সাথে সময় কাটাতে। আমার মত অনেকেই আছে। রোজ দেখা হয়, হাসি বিনিময়, কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলিনা। কেই কারো ব্যাপারে নাক গলাই না। মোবাইল বন্ধ। শুধু দিনে একবার বা দুবার মেসেজ করে তুলির খবর নিই আর সবাইকে জানিয়ে দিই যে আমি আজকাল ভালো আছি।
বহুদিন পর অনেক অনেক বই পড়ছি, গান শুনছি – ঘন্টার পর ঘন্টা। এখানে এসে একটা পাহাড়ি ঝোরা আবিষ্কার করেছি। আমি মাঝে মাঝেই ওখানে গিয়ে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। ওখানে এক জন মানুষের সাথে দেখা হয়। কোনো কথা বলেনা, শুধু এক ধরনের পাহাড়ি বাঁশি বাজায়। যার নাম *বিনায়ো* অবশ্য তখন নামটা জানতাম না। দরকার পড়েনি। মানুষটার নাম দিয়েছি, জলফকির।
তবে আমি ছাড়া এই পাহাড়ি নদী কেউ দেখতে পায়নি। পরে যখন সবাইকে এর কথা জানাই সবাই অবাক হয়েছিল। স্থানীয় লোকজন বলল, ও অঞ্চলে কোনো নদী আছে বলে কস্মিনকালেও কেউ শোনেনি তবে একটা বাঁশির শব্দ মাঝে মাঝে শুনেছে কেউ কেউ। হতে পারে আমার মতিভ্রম। কিম্বা অলৌকিক কোনো অভিজ্ঞতা। কিন্ত আমি জানি, আমার মন ব্যাকুল হলে আমি এ নদী দেখতে পাব আর জল ফকিরকেও।
……………………………..
আমি ফিরে এসেছি। আদিম অরণ্য থেকে জন অরণ্যে। এখন আমার কথা বলার অবাধ অবকাশ। অনেক কথা জমে আছে। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিনা। কোনো শব্দই গলা দিয়ে বেরোচ্ছে না। বেচারি তুলি আমার সাথে ইশারায় কথা বলছে। আমার মা বাবা ভয় পেয়ে আমার কাছে চলে এসেছে। অভির কষ্ট হচ্ছে কিন্ত প্রকাশ করছে না। আমার নিজের খুব কষ্ট হচ্ছে। গান গাইতে চাইছি পারছি না। ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই, কোনো প্যানিকে এরকম হয়ে থাকবে। আশ্চর্য, সব থেকে মজার ব্যাপার যে ঐ পনেরো দিন আমার সবচেয়ে শান্তির দিন ছিল।
………………
আজ একমাস হয়ে গেল, গলা দিয়ে অল্প অল্প শব্দ বেরোয়। তুলি আমায় কথা বলা শেখায়। রাত অনেক গভীর। বাড়ির বারান্দায় বসে আছি। অঝোর বৃষ্টি। রাস্তার আলো জলের ধারাকে জড়িয়ে ধরেছে। এক অদ্ভুত মায়াবী প্রেক্ষাপটে আমি আবার ওই *নাম জানিনা* নদী দেখতে পেলাম। জলফকির বাঁশি বাজাচ্ছে। কোনো কথা বলছেনা, কিন্তু আমি তার মোলায়েম কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি। ….. মঞ্জিরা, মঞ্জিরা, মঞ্জিরা…. এই শহরে অনেক বলা না বলা শব্দ জমে আছে। তোর কথার দরকার নেই রে। যেদিন শব্দ শূন্যতা হবে, তুই সেদিন গেয়ে উঠবি।…..
…………………
আজ অনেকদিন পর হঠাৎ গুনগুন করে উঠেছি অজান্তে সেই সুরে যা জলফকির শুনিয়েছিল। আমি উচ্ছ্বসিত। বাড়ির সবাই অনেকদিন পর আজ হাসছে মন খুলে। হঠাৎ আমি জলফকিরকে দেখতে পেলাম, নদীর জলে হাসি মুখে পা ডুবিয়ে বসে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আমি অনুভব করলাম, আর কোনোদিন ওদের দেখতে পাবনা। আমার দু’চোখ দিয়ে নোনা জল নেমে আসছে। আমি কথা ফিরে পেয়েছি। আমি মন- বিয়োজন শিখে গিয়েছি।
…..…… শেষ।
*******************
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত্য চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।