Shadow

পুরুষ অন্তরে ব্যথা – শুভজিৎ বসু

PC Concordia

পুরুষ অন্তরে ব্যথা

শুভজিৎ বসু 

বিক্রমশেখর বসু চৌধুরী নামটা উচ্চারণে এক উচ্চণ্ড নাদের সঞ্চার হয়। নামটা কানে এলে এক গম্ভীর জমিদারী ও আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ব্যঞ্জনা আসে। তাই ভদ্রলোক নিজে নামটা  সহজ করে অতি সাধারণ বিক্রম বসু করে ফেলেছেন। তাঁর রায়বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত পূর্বপুরুষদের ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের ফলে বেড়ে ওঠা জমিদারীর আভিজাত্য ধীরে ধীরে ক্ষীয়মাণ হতে হতে ১৯৫০ সাল নাগাদ জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায়  স্তিমিত হয়ে আসে। তাই বিচারবুদ্ধির প্রাজ্ঞতায় ওই পুরনো উপাধির কথা বলেন তো নাই ই, উপরন্তু নামের সংকোচন ঘটিয়ে নিজেকে সাধারণ পর্যায়ে অবনত করতে উদ্যোগী হন। তাঁর পিতামহ গত হয়েছেন বহুদিন। তাঁর দুই পুত্রের একজন বিলেতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আর অপর পুত্র অর্থাৎ বিক্রমের পিতা বালীগঞ্জ প্যালেসে এক প্রাসাদোপম অট্টালিকায় কিছুদিন আগে অবধি থাকতেন। সেরিব্রাল স্ট্রোকে তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। তিনি তাঁর এই পুত্রকে ত্যাজ্য করে সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং এক জনহিতকর ট্রাস্টের হাতে সঁপে দিয়েছেন। সে কাহিনী ক্রমশ: প্রকাশ পাবে। বিক্রমের মাতুলালয় কলকাতার শোভাবাজার এক বনেদি পরিবার। তাঁদের একমাত্র কন্যা সুনেত্রা যেমনি বিদুষী তেমনি সুন্দরী। দুই বাড়ির ই আদরের মেয়ে।
বিক্রম এখন কিছুই উপায় করেন না। করতে চাইলেই বহু কিছু অনেক পারিশ্রমিকে করতে পারেন। তিনি করবেন না। জীবন সম্বন্ধে অনাসক্তি আসলেও আসতে পারে। তবে তার প্রকাশ নেই। একটু  অন্যরকম লাইফ উপভোগ করতে কলকাতার উত্তর পূর্বের সদ্য গজানো আধুনিক এক স্মার্ট সিটি রাজারহাট নিউটাউনের এক ফ্ল্যাটে থাকেন। নিজের বলতে কেউ নেই। বাড়িতে দু তিনজন কাজের লোক আছে। তারাই সব। আত্মীয় যাঁরা আছেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ না থাকায় আর প্রায় কোন সম্পর্ক নেই। উচ্চ-অনুচ্চ, ইতর-ভদ্র, ধনী-নির্ধন প্রত্যেকের সাথে সমভাবে মেলামেশায় কোন আপত্তি রাখেন না। বিপদে আপদে স্থানীয় বাসিন্দারা আইনি সাহায্য চাইলে তাঁদের সাহায্য করতে চেষ্টা করেন। আর বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সঙ্গে তো আছেন ই।
সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে একসময় বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাজমহল ছিল বাংলার রাজধানী। ধারে ভারে তখন রাজমহল উত্তুঙ্গ আসনে। ইতিহাসকে বর্তমান চোখে দেখতে বিক্রম রাজমহলে আসেন। গৌড়, পাণ্ডুয়া, কোচবিহার, হেতমপুর ও বিষ্ণুপুর সহ রাঢ় বাংলার অনেক স্থান মন ও মননের তাগিদে আগেই ঘুরে এসেছেন। রাজমহল ঘুরে ফিরে সাহেবগঞ্জ থেকে ট্রেনে কলকাতা ফিরছেন। পূর্ণ জ্যোৎস্না রাত্রি। আকাশে তারার ভিড়। ছোট্ট ছোট্ট  মেঘগুলো আনন্দে ছোটাছুটি করছে। জ্যোৎস্নালোকে কাশগুলোকে হেলতে দুলতে দেখা যাচ্ছে। রাত হলেও চোখের স্বাভাবিক অপূর্ণতাকে ঢেকে দূরের নির্জন, মায়াবী প্রকৃতিকে বিক্রম কল্পনালোকে উপলব্ধি করছেন। চোখ বস্তুকে দৃষ্টিতে আনে। আর অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সাহচর্যে সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ  অবয়ব উদ্ভাসিত হয়। বিক্রম বহুদিনের বিপত্নীক। তাঁর আদরের গুণবতী স্ত্রীর কথা খুব মনে পড়ছে। রবি ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্র এগার বছর বয়সে কলেরায় মারা যায়। ঠিক তার পরের দিন রবি ঠাকুর সাহেবগঞ্জ থেকে এই লাইনেই ট্রেনে জোড়াসা়ঁকো ফিরছেন। ওটিও জ্যোৎস্না রাত ছিল। কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর সংবাদে অন্তরের মর্মস্থল  দুঃখে ফেটে পড়ছে। কিন্তু তাঁর অভিব্যক্তি বাইরের কাছে প্রকাশ পাচ্ছে না । নিজের দুঃখ নিজের কাছেই থাকুক -এই মনোভাব প্রত্যক্ষ হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সংসারে অনেক প্রিয়জনের মৃত্যু তিনি দেখেছেন। মৃত্যুর অনিবার্যতার বোধ ওঁনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্থিতধী  হতে। যথার্থ জ্ঞান, অভিজ্ঞতার বিস্তার ও নানা ঘাত প্রতিঘাত  মানুষকে মানবিক করতে সাহায্য করে। । জ্যোৎস্নার এই আলোকোদ্ভাসিত রাতে বাইরের অনেক কিছু  প্রতীয়মান। এত বড় আঘাত প্রিয় কবি পেলেও তার কোন হেলদোল অন্য কারোতে প্রকাশ নেই। গাছপালার নেই। আকাশ বাতাসের নেই। রাতের সরীসৃপ বা শিয়াল হায়নার নেই। ঘুমন্ত পাখি কেউ জাগে নি। মনে এল মৃত্যুটাও প্রকৃতির এক অংশভাগ। তাই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একনাগাড়ে ঘটলেও এই ঘটনা ছন্দোবদ্ধ প্রকৃতিরই আর এক ক্ষুদ্র উপাদান। তা রবিঠাকুর আরো সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। এই রসে জারিত হয়ে আবেগকে অন্তরের মধ্যে কঠোরভাবে বন্দি করে জোড়াসাঁকোয় কবি ফিরলেন। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ সামনে এসে দাঁড়ালে একবারের জন্য শুধু নয়নাশ্রু দেখা গেল। এই অনুরূপ ভাবনায় বিক্রম ও জীবনে আক্রান্ত । বহু সাংসারিক দুর্ঘটনা ও অপ্রাসঙ্গিকতার কবলে তিনিও পড়েছেন। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। হারিয়ে যান নি। । যত ই হোক না কেন আনন্দধারা যে বইছে ভুবনে। তাই সব দুর্বলতাকে উৎপাটিত করে সেই আনন্দধারায় নিজেকে মেলে ফেললেন। ট্রেন কখন জোরে কখন আস্তে এগিয়ে চলেছে। আর বিক্রমের পুরনো দিনগুলো ভেসে ভেসে আসছে।
ওর বাবা বিক্রমকে দার্জিলিং এর বিখ্যাত কনভেণ্ট স্কুলে ভর্তি করে দেয়। উদ্দেশ্য সাহেবি আদবকায়দায় অভ্যস্ত  করানো। ইতিহাসে গ্রাজুয়েট হল। কলকাতায় ফিরতেই বাবা ইউ পি এস সি পরীক্ষার কোচিংএর জন্যে দিল্লি পাঠালেন। ইতিহাসের সঙ্গে পল সায়েন্স থাকায় আই এ এস বা আই পি এস হতে সুবিধা হয়। কিন্তু দু’বছরেও হল না। বাবার অঢেল টাকা। বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠালেন। ওখানে পড়াশুনা জোর কদমে চলছে। আভিজাত্য ভরা জীবন। শুধু তো পয়সা নয়, শরীরে কয়েক পুরুষের নীল রক্ত বইছে। অনেক সুন্দরী মহিলার সংস্পর্শে এল। এইরকম একজন অক্সফোর্ডে পল সায়েন্সের ছাত্রী এ্যানি। উত্তরের এডিনবরায় বাড়ি। পরিচয় আর তার সাথে নিবিড় মেলামেশা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে পরিণয় হলো বলে। এই ঘটনা বিক্রমের বাবা ও মায়ের যথেষ্ট আনন্দের কারণ। এ্যানি শুধু ব্লু আইড ওম্যান নন, অত্যন্ত সংস্কৃত, মার্জিত ও ধনী পরিবারের মেয়ে। বসু চৌধুরী পরিবার এই তো চায়। প্রেমের অন্তিম পর্যায়ে  দুজনে এল। একে অপরকে গভীরভাবে চায়। এ্যানির শরীরে স্কটিশ রক্ত। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, বড় হয়েছে তার ভবিষ্যতের চিন্তা তাকেই করতে হবে। পাশ্চাত্য সমাজে এটাই রীতি। পেরেণ্টস কখন বড় ছেলে বা মেয়ের পার্সোনাল স্পেসে ঢোকে না। এ্যানি প্রখর বুদ্ধিমতী। বিক্রমের ইতিহাসের জ্ঞান থাকলেও এ্যানি ওঁকে স্কটল্যান্ড- ইংল্যান্ড সংঘাত, তাদের মানসিক ইনকম্প্যাটিবিলিটি বা উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে মূল আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মানসিক দূরত্ব অথবা এই ব্যাপারে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক দুটি ভাগের পারস্পরিক বিরূপতা সবকিছু শেয়ার করাচ্ছে। বিক্রমও ভারতীয় সভ্যতার প্রাক বৈদিক যুগ, বৈদিক যুগ, মধ্যযুগ, মুঘল যুগ, ব্রিটিশ  রাজত্ব এবং স্বাধীনোত্তর যুগ সম্বন্ধে পূর্বাপর বলছে। তাঁরা দুজনেই দুজনের বিদ্যাবুদ্ধির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তা তাঁদের আচার আচরণে প্রকাশ পেত। ভালোবাসার হাওয়ার তীব্রতা যখন ঝোড়ো হাওয়ার মতো বইছে, ঠিক সেই সময় এক ব্রিলিয়াণ্ট প্রোজেক্ট-মিটিগেশন অফ এথনিক ভায়োলেন্স ইন নাইজেরিয়া এল। নাইজেরিয়ায় যে ধর্মে ধর্মে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সংঘটিত হচ্ছে  এবং বিপুল সংখ্যায় গণহত্যা হচ্ছে তার সম্বন্ধে বিশদ গবেষণা হবে। ইউনাইটেড নেশনস্ এই ব্যাপারে এগিয়ে এসে এই কর্মভারটা গ্রহণ করেছে । লাগোসে গবেষণাটি হবে। একটা চ্যালেঞ্জিং রিসার্চ। অনেকের সাথে  এ্যানিও আবেদন করল। এ্যানিস ও আরো দু’জন নির্বাচিত হল। খুশির ব্যাপার বটে তবে এই সুখবর কী ওদের একসাথে থাকার পথকে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না? এ্যানি ও তাই চিন্তিত। তবে ও এটা হাতছাড়া করবে না। বিক্রম অসহায়ভাবে বাস্তবটা বুঝে নিল। এ্যানি বিক্রমকে জানাতে ও ভিতরের ব্যথা বুঝতে না দিয়ে বলে,”কংগ্রাটস্। বাট ইউ মাস্ট জয়েন দ্য রিসার্চ প্রজেক্ট ইন নাইজেরিয়া। দেয়ার শুড হ্যাভ নো সেকেণ্ড থট।”
এ্যানি ওঁর অন্তরের করুণ আর্তনাদ শুনতে পেল। তাছাড়া ওঁ নিজেও তো কষ্ট পাচ্ছে। যা হোক, এ্যানি কম করে তিন বছরের জন্য নাইজেরিয়ার লাগোসে চলে গেল। মাস দুয়েকের মধ্যে ব্যারিস্টারি পাস করে বিক্রম ও কলকাতায়। তাঁর হৃদয়ভাঙার কথা বাবা, মাকে কিছু বুঝতে দিল না । যেন জীবনে এগোনোর এগুলো এক একটা বাস্তব ও মানসিক ধাপ। আর যেভাবেই হোক তা পেরোতে হয়। তবে সত্যি কথা হল যে বিক্রমের হৃদয়গহ্বরটি শূণ্য হয়ে গেল। এ্যানিকে ভোলা অত সহজ নয়।
এইবার কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করল। মামাতো বোন সুনেত্রা ওদের বালীগঞ্জের বাড়িতে যায়, বিক্রম ও শোভাবাজারে আসে।  সুনেত্রা বিক্রম থেকে দেড় বছরের ছোট। দর্শনে মাস্টার্স করে পি এইচ ডি করছে। সুনেত্রা ওদের নির্দোষ ব্রেক আপের ব্যাপারটা জানত। আঘাত পায় ভেবে এই ঘটনাকে  কখন আলোচনায় সেভাবে আনে নি। দুজনে এত বেশি আড্ডা মারত যে ওঁরা যে ভাই বোন, ব্যাপারটা ভুলে যেত। এইভাবে চলতে চলতে ওঁরা দুজন দুজনের প্রতি ভালো লাগালাগির পর্যায়ে চলে আসছে। ঠিক হচ্ছে না জেনেও ওঁরা আরো কাছাকাছি চলে আসছে। হয়ত বিধির বিধান। “সুনেত্রা তুই কি বুঝতে পারছিস যে কী হতে চলেছে !”- বিক্রম বলে। “হ্যাঁ রে কেন বুঝব না, তোর আগেই বুঝতে পেরেছি।”- সুনেত্রা
**********************
লেখক পরিচিতি
শুভজিৎ বসু এম এস সি (এজি) পাশ করে ব্যাঙ্কের অফিসার পদে চাকরি জীবন ১৯৮৩ সালে শুরু করেন। গত ২০১৯ সালে ব্যাঙ্কের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে  অবসর নেন। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর চাকরিতে থাকাকালীন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। অবসর গ্রহণের পর থেকেই তিনি বস্তুত লেখালেখিতে মন দেন। চাকরি জীবনের পূর্বে তিনি প্রধানত কবিতা লিখতেন। বর্তমানে উনি নিম্নোক্ত ঠিকানায় বাস করেন।

 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!