বেড়িয়ে আসুন তোপচাচি
অদিতি ঘটক
বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। এক জায়গায় বেশি দিন মন টেঁকে না। সব সময় উড়ু উড়ু ঘুরু ঘুরু বাই। এই বাই -ই হালে আমাদের টেনে নিয়ে গেল পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খন্ডে। গেলাম তোপচাচি লেক, পার্শ্বনাথ পাহাড়, ও ছোটবেলায় সহজ পাঠে পড়া উশ্রী নদীর ঝর্ণা দেখতে। এন.এইচ.২ ধরে সোজা তোপচাচি। ধানবাদ পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে আধঘন্টা গেলেই শুরু হয়ে যাবে পাহাড়ের সারি। যেন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। নতুন ঝকঝকে তিন লেনের মাঝ বরাবর রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের সারি কখনো কাছে কখনো দূরে আবার কখনো লুকিয়ে পড়ছে। যেন কোনো বাচ্চা ছেলের টুকিটুকি খেলা। নিবিড় অরণ্য প্রকৃতি ,দেহাতি গ্রাম্য সরল জীবন ঠিক যেন বিভূতিভূষণের একটুকরো আরণ্যক। তোপচাচিতে রয়েছে চারিদিকে পাহাড় ঘেরা একটি লেক। লেকের জলে পাহাড়ের ছায়া সত্যি অপরূপ। ব্রিটিশ আমলে এবং পরবর্তী কালেও এই লেক থেকেই ঝরিয়া অঞ্চলে জল সরবরাহ করা হত। এইখানে ছিল একটি জল শোধনাগার যা এখন বিকল। তোপচাচি লেকের সম্পূর্ণ অঞ্চলটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। লেকের সামনে থেকেই দেখা যায় পর পর সবুজ জঙ্গলে ছাওয়া পাহাড় শ্রেণি , গায়ে সবুজ চাদর বিছানো। শ্রেণির শেষ উঁচু পাহাড়টির উপর অবস্হিত সাদা ধপধপে তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ বা লোকমুখে প্রচলিত পরেশনাথ মন্দির।
আমরা লেকের কাছাকাছি একটি হোটেলে ছিলাম। হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে লেকের সামনে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ২০ মি। লেকের অঞ্চলে ঢোকার মুখে একটি পুলিশ পিকেট করা আছে। সামান্য এগিয়ে পড়ে বজরঙ্গবলি মন্দির। জায়গাটি ওয়াটার ওয়ে মোড় নামে পরিচিত। বাঁদিকে যুব আবাস কিন্তু অবস্থা তথৈবচ। একটা আধটা ছোটখাটো বাড়ি ছাড়া লেকে যাওয়ার পুরো রাস্তাটার দুধারে বড় বড় গাছের সারি যেন কোনো কল্পলোকের কথা মনে করায়। ওখানে মহুয়া, শাল, মেহগনি, অর্জুন ,শিশু ,সেগুন, আকাশমনি প্রভৃতি গাছ দেখতে পাওয়া যায়। লেক ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মনোরম পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। লেকের একদম সামনেই আছে ছোট্ট কৃত্রিম পাহাড় তৈরি করে একটি ছোট্ট হনুমান মন্দির। আর খানিকটা ডানদিক ধরে এগিয়ে গেলে পাওয়া যায় পিকনিক স্পট।বাঁদিক ধরে সেতুর উপর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আর একটু হেঁটে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে তোপচাচি লেকের জলের উৎস বা ঝর্ণা। তবে তা বিরাট বড়সড় নয়। ঝোরা বলাই ঠিক। পিকেট গেট থেকে প্রায় এক কি.মি. হেঁটে একটি চেক পয়েন্ট। চেক পয়েন্ট পেরিয়ে আবার প্রায় এক কিঃমিঃ হেঁটে লেকে পৌঁছনোর মুখে কটি অস্থায়ী প্লাস্টিক ও বাঁশ টাঙানো চা বিস্কুটের দোকান। কোয়ালিটি একেবারে সাধারণ। ওখানে কিছুক্ষণ কাটাতে চাইলে তাই জল ও কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে রাখা ভালো।
পরেশনাথ পাহাড়ের দূরত্ব আমাদের হোটেল থেকে গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের মত। পাহাড়ের নীচে গাড়ি রেখে উপরে ওঠার ব্যবস্থা। ওখানেই খাবার দাবার ও দরকারি ছোটখাটো নানা দোকানপাট ,সুন্দর রাস্তা। মাঝে মাঝে বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছুটা চড়াই ভাঙার পর শুরু হয় শিব, কালী, রাম লক্ষ্মণ, ইত্যাদি দেব দেবীর মন্দির। দেড় কিমি যাওয়ার পরই পেয়ে যাবেন বাইকওয়ালাদের দেখা। সেই বাইকওয়ালারা কিছু টাকার বিনিময়ে পৌঁছে দেয় পাহাড়ের চূড়ায়। ইচ্ছে করলে ডুলিতেও যেতে পারেন। পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা বেশ কষ্টসাধ্য। শারীরিক সক্ষমতা জরুরী কারণ পরেশনাথ পাহাড়ের উচ্চতা ১৩৬৫মি: ঢাল খাড়া। উপরে গিয়ে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখা যাবে সুন্দর শ্বেত পাথরের মন্দির তবে কারুকাজ খুব একটা নেই। মন্দিরের ভেতরে শ্বেতপাথরের বেদিতে পার্শ্বনাথের পদচিহ্ন অঙ্কিত। সেই পদচিহ্নই পূজিত হয়। জৈন গ্রন্থের পাঠে মুখরিত থাকে মন্দির। এখানেও প্রকৃতি দেবী তাঁর সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছেন। শুধু দু চোখ ভরে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করে চক্ষু সার্থক করতে হয়। পাহাড়ের উপরে বেশ হিমেল হাওয়া থাকে। ঠান্ডা লাগে। তাই কনকনে শীতে গেলে ভালোরকম শীতের পোশাক নিয়ে যাওয়া উচিত। পাহাড় থেকে নামাও যায় সেই বাইক বাহিনীর মাধ্যমে বা পদব্রজেই। ওখানে কয়েকটি গ্রামও আছে সেই গ্রামগুলির দেখভাল এই মন্দির ট্রাস্টিরাই করে থাকেন। একটা মজার ব্যাপার হলো ওখানে গেলেই একটা করে চার সাড়ে চার ফুটের শক্ত অথচ হালকা লাঠি কেনা আবশ্যিক। মানে সবাই কেনে। লাঠিটি পাহাড়ে ওঠা নামার জন্য বেশ কার্যকরী।
তোপচাচি থেকে উশ্রী ফলস প্রায় গাড়িতে ঘন্টা দুয়েকের পথ। গিরিডি পাহাড়ে এর অবস্থান। এটি বরাকর নদীর উপনদী। এই জলপ্রপাতটি তিনটি আলাদা ভাগে বিভক্ত প্রায় ১২মি. উঁচু থেকে জলধারা নীচে নেমে আসার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। জায়গাটি ফটো তোলার আদর্শ স্থান। এখানেও পাশে জঙ্গল আছে। প্রকৃতি তার রূপ উজাড় করে নিজেকে মেলে ধরেছে। পাহাড় ন্যাড়া। ব্যাসল্ট শিলা দিয়ে তৈরি।
শুধু ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে নয়।ট্রেন ধরে গোমো হয়েও যাওয়া যায় তোপচাচি। যাওয়া যায় ধানবাদ বা গিরিডি, মধুবন ঘুরেও। সপ্তাহান্তে বেরিয়ে পড়াই যায় ছোটনাগপুর অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত তোপচাচি ও তার আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।।
*************************
অদিতি ঘটক পরিচিতি
গৃহবধূ। নিবাস হুগলি। ভালোবাসা লেখালিখি। গল্প কবিতা, ছড়া, অনুগল্প প্রভৃতি লেখা নানা বাণিজ্যিক ও অবানিজ্যিক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়।