শ্রুতি
ডাঃ সুচন্দ্রা মিত্র চৌধুরী
সুশোভন বসু ভয়ানক পাংচুয়াল । আর হবেনই বা না কেন? ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছেন দুন স্কুলে। যখন বয়স মাত্র ছয়, তখন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান। মাকে ঠিক করে মনেই করতে পারে না। কলকাতার একটা ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়াশোনার পর,দুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়। সেখানে থেকেই টুয়েলভ পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে ইংলিশ অনার্স পাশ করে চলে যান বিদেশে, সেখানে এম বি এ পাশ করে দেশে ফিরে একটি এম এন সি তে যোগ দেন । এখন সেই অর্গানাইজেশনেরই সি ই ও।
জেভিয়ার্সে পড়ার সময়, শ্রীতমার সাথে আলাপ এবং সম্পর্ক। শ্রীতমার,সুশোভন এর বাড়িতেও যাতায়াত ছিল।বাবা শ্রী পঙ্কজ বসু, সব সময় ছেলেকে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। উনি বুঝতে পারতেন, ওর একটা দিক সবসময়ই কম, মা নেই। কিন্তু সুশোভন কিছুই কাউকে বুঝতে দেয় না। ওর খুব আবছা মনে পরে, বাবা ছোটবেলায় বকলে ও যখন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে দৌড়ে যেতো, মা আদর করে, চোখের জল মোছাতে মোছাতে বলতেন—
-” ছিঃ তুমি না ছেলে! ছেলেদের কাঁদতে আছে কখনও?” সেই ছোটবেলার কথা আজ আবার মনে আসছে। সত্যিই বোধহয় পুরুষদের চোখের জল দেখাতে নেই। যতই কষ্ট হোক অন্তরে!সুশোভন,ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে, বাবা ভীষণ মাকে মিস করতেন,তাইতো ক্লাবে, পার্টিতে গিয়ে বন্ধু, বান্ধবীদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে ড্রিংক করে বাড়িতে ফিরতেন। নিবারণ কাকা, ওদের বাড়ির কেয়ার টেকার, বাবাকে ধরে নিয়ে এসে, বিছানায় শুইয়ে দিতেন। তারপরই বাবা অঝোরে কেঁদে চলতেন, তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়তেন। সকালে উঠে বাবাকে আর রাতের সাথে মেলানো যেতো না। রাগী, রাশভারী এক ব্যক্তিত্ব। ছেলের ছোট-খাটো সব বিষয়ে নজর। স্কুল থেকে ছুটিতে যখন বাড়িতে আসতো, বাবা-ই গাড়ি ড্রাইভ করে, সুশোভনকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতো। মা খুব বেড়াতে ভালবাসতো।
পঙ্কজ বাবু, কিছুতেই সেকথা কাউকেই বুঝতে দিতে চাইতেন না। এমনকি সুশোভনকেও নয়। তখন ছোট ছিল তাই সেভাবে বাবার ব্যথা না বুঝলেও, বড়ো হওয়ার পর, সবটাই বুঝতো। বুঝতো তাঁর হৃদয়ের ক্ষত, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহুর্তে রক্ত চুঁয়ে পড়ছে। বড়ো যন্ত্রণা! যে যন্ত্রণা কাউকে দেখানো যায় না, কাউকে বলে বোঝানোও যায় না।
ঠিক যেমন সুশোভনের হয়, শ্রীতমা, কোনো এক এন আর আই কে বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর থেকে। শ্রীতমাকে সেই মুহুর্তে বিয়ে করতে পারে নি সুশোভন, শ্রীতমা বারবার বলা সত্বেও। কার দোষ বা দোষ নয়, এ নিয়ে কখনও ভাবে নি সুশোভন। কিন্তু অন্তরে সবসময়ই একটা ব্যথা অনুভব করে, শ্রীতমার কথা মনে পড়লেই। শ্রীতমা আর কোনোদিনও সুশোভনের সাথে যোগাযোগ করে নি। এদেশে আর কখনও এসেছিল কিনা তাও জানেনা।
না ।সুশোভন আর বিয়ে করে নি। তবে এতোবড় কোম্পানির একজন সি ই ও, তার যে অনেক গুণগ্রাহী থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এবং প্রায় প্রত্যেকেই সুশোভনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টাও করে। সুশোভনও তাদের সাথে সময় কাটায়, ড্রিংক করে,কারো কারোর বাড়িতেও যায়, কিন্তু কিছুতেই ঘনিষ্ঠ হতে পারে না। ঘনিষ্ঠ হতে গেলেই শ্রীতমাকেই মনে পড়ে আর তখন আবার শুরু হয় অন্তরে রক্ত ক্ষরণ।
প্রায়ই বিদেশ যেতে হয় সুশোভনকে। আমেরিকা এবং ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই যেতে হয়েছে, কোম্পানির বিভিন্ন কন্ফারেন্সে।
সুশোভনের বয়স এখন ষাট ছুঁই ছুঁই। কিন্তু বোঝা যায় না। চেহারা খুবই সুপুরুষ। স্মার্ট, কথা কম বলে আর মহিলাদের সঙ্গে খুব সমীহ করে কথা বলে।এককথায় খুবই আ্যাট্রাক্টিভ। স্বভাবতই বেশিরভাগ মহিলাই সুশোভনের প্রেমে হাবুডুবু খায় আর পুরুষরা মুখে কিছু না বললেও ভীষণ জেলাস।
কিন্তু সুশোভন কোথায় যেন অন্যান্য পুরুষদের থেকে আলাদা। ও ভালভাবেই জানে ওর সম্পর্কে ওর কাছের মহিলা এবং পুরুষদের এই মনোভাবের কথা। কিন্তু সুশোভন কখনোই এইসব বিষয় উপভোগ করে না। তাই বোধহয় আরও বেশি করে সবাই ওর কাছে আসার চেষ্টা করে। সবসময়ই ও সব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি এবং মহিলা-পুরুষ বেষ্টিত হলেও অন্তরে সে একা আর যখনই এটা অনুভব করে তখনই অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হয় যা পৃথিবীর কেউ জানতে পারে না, বুঝতেও পারে না।
এবার প্যারিসে যাওয়াটা ক্যান্সেল করবে ভেবেছিল। এখন এসব ট্যুর আর ভালো লাগে না। একটু বোরিং লাগে আজকাল। এতগুলো বছর ধরে তো এই চলছে। না,এইবার আর যাবে না, কোনো এম ডিকে পাঠাবে, এমনই ভাবলো সুশোভন। কিন্তু কথায় আছে না -ম্যান প্রপোজেজ,গড ডিসপোজেজ। ঠিক তাই হলো, এম ডির মা এক্সপায়ার করেছেন, তাই তিনি ছুটিতে। অগত্যা সুশোভনকেই যেতে হলো। সুশোভন, মনে মনে ঠিক করে ফেললো, এই ট্রিপটাই লাস্ট, আর ও কোনো অফিসিয়াল ট্যুরে যাবে না। যে ক’দিন আছে, ইন্ডিয়ায় কাজ করে রিটায়ার্ড করবে আর সেরকম হলে ভলান্টারি রিটায়ারমেন্টও নিতে পারে।
এবার পনেরো দিনের ট্যুর। ক’দিন বেশ ভালোই কাটলো। কনফারেন্স, সেমিনার এসবের পরে প্রত্যেক দিনই মিউজিক কনসার্ট, ব্যালে তার সাথে গালা ডিনার আর ড্রিংকস। না, একঘেয়ে এসব আর ভালো লাগে না। কনফারেন্সের পর প্রত্যেক দিনই সুশোভন বেরিয়ে পড়তো ডিনার করে, পায়ে হেঁটে এধার-ওধার ঘুরে বেড়াতে। ফিরে এসে হালকা করে সেমিক্লাসিকাল বা গজল শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তো।
সেদিনটা ছিল বাইশে জুলাই। অভিশপ্ত এই দিনে শ্রীতমা ওকে ছেড়ে গিয়েছিল। রোজকার মতো হাঁটছিল, সামনে একটা রেস্ট্ররেন্ট। ভাবলো ওখানে গিয়ে একটু বসা যাক। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ও গিয়ে বসতেই একজন ওয়েট্রেস এসে ইংরেজিতে জানতে চাইলো ,
– “হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট”?
সুশোভন কিছুক্ষণ মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“আর ইউ ইন্ডিয়ান?
– ইয়েস।
– হুইচ স্টেট?
– ওয়েস্ট বেঙ্গল । সুশোভন অবাক হয়ে, উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো,
– কোন শহর?
মেয়েটি সুশোভন কে আরও অবাক করে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললো কলকাতা।সুশোভন একেবারে হতবাক!মেয়েটি বললো, “আপনি বাঙালি,না? সুশোভন বলল, “হ্যাঁ এবং আমিও তোমার শহরের।”মেয়েটি বলল, “না কলকাতা আমার মা-বাবার শহর হলেও আমার নয়। আমি এই শহরেই জন্মেছি এবং বড়ো হয়েছি। তাই প্যারিসই আমার শহর। আপনার কি লাগবে, বললেন না?”
সুশোভন, একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পরেছিল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কফি হবে?”
-ব্ল্যাক অর উইথ মিল্ক অ্যান্ড সুগার?”
– “ব্ল্যাক অ্যান্ড উইদাউট সুগার”। মেয়েটি ওকে বলে চলে গেল।
সুশোভনের মনটা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেল। বুকের ক্ষতটা কেমন চিনচিন করছে। একটু একটু করে পুরনো দিনের কথা মনে পরে যাচ্ছে। না না এসব কি ভাবছে! এরমধ্যে মেয়েটি কফির ট্রে থেকে কফি টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু নেবেন না?”সুশোভন বললো, না, আমি ডিনার করে হাঁটতে বেড়িয়েছি। আর কিছু লাগবে না।মেয়েটি আচ্ছা বলে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎই সুশোভন ডাকলো, শোনো, তোমার নাম তো জানা হলো না।
মেয়েটি একটু হেসে বলল, “শ্রুতি।”
– “আচ্ছা তোমার, মা-বাবা দুজনেই কলকাতার?”
– “হ্যাঁ। তবে আমি আমার বাবাকে দেখি নি, আমার জন্মের আগেই মারা যান।”
– “ওহ ভেরি স্যাড।”
– “তুমি তাহলে তোমার মায়ের সাথেই থাকো?”
– “এতদিন তাই-ই ছিলাম। এখন ল্যান্ডলেডির সাথে থাকি।”
– “কেন তোমার মা?”
– “তিন মাস আগে মারা গেছেন।” সুশোভন আরও দুঃখিত হলো। হঠাৎই জানতে চাইলো, “তোমার মা-বাবার নাম কি?
– “বাবার নাম শ্রী সুশোভন বসু, দাদুর নাম পঙ্কজ বসু আর মায়ের নাম শ্রীতমা বসু”। এই বলে শ্রুতি বললো, “আমার ডিউটি শেষ, এবার আমি বাড়ি যাবো। এখন আসি। এখানে থাকলে আবার আসবেন।” শেষের কোনো কথাই সুশোভনের কানে যায় নি। এতদিন বুকের যে ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তো, এখন যেন সেখান থেকে রক্ত গলগল করে বেরোতে লাগলো! চিৎকার করে শ্রুতিকে ডাকতে থাকলো, শ্রুতি শুনে যাও আমার কথা…… গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোলো না।।
****************************************