হা ঈশ্বর ।।
(সব চরিত্র কাল্পনিক)
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
-‘বাবা, দেখেছ আজকের নবজীবন টাইমসে ডাঃ গোডবোলের লেখাটা? লিখেছেন, ‘হে ঈশ্বর, আমার অপরাধ নিয়ো না। যদি তুমি থেকেই থাক কোথাও, আমার এ বিদ্যে-বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা সব তোমারই দান। সেই বিদ্যে-বুদ্ধি দিয়ে আমি তোমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে পারছি না, সে অক্ষমতার দায় কিন্তু তোমার। একেবারে নতুন ধরনের কথা, তাই না?’
সদ্য জার্নালিজমে দীক্ষিত মেয়ের সঙ্গে ভাল তর্ক করতে পারেন না বরোদার অবধেশ মন্দিরের পুরোহিত প্রধান কৈলাসপতি ত্রিবেদী। তাই তিনি সোজা কথা বলে দিলেন- ‘পিপীলিকা পক্ষ ধরে মরিবার তরে। এই ঔদ্ধত্যের শাস্তি ঈশ্বরই তাকে দেবেন।’
-‘বাবা, কথাটা কিন্তু ওরিজিনালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের নাস্তিক নায়কের উক্তি। তবে একটা কথা, ডাঃ গোডবোলে কিন্তু নাস্তিক নন। তিনি ঈশ্বর মানেন। কিন্তু মানেন না দেবতা, স্বর্গ-নরক, পুনর্জন্ম, পাপ-পুণ্য বা এ বিষয়ে বেদ-উপনিষদে যা বলা হয়েছে সে সব। তিনি কলকাতার বিখ্যাত দার্শনিক ডাঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের ছাত্র ছিলেন। তাই মনে করেন যে বেদ-বেদান্তে যে অসংখ্য দেবতার বর্ণনা আর যজ্ঞ-প্রণালীর বর্ণনা আছে তা মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য জাগতিক সমস্যা বা সৃষ্টি রহস্যের একটা কাল্পনিক সমাধান।’
-‘দেখো মা, দর্শন-টর্শন আমিও একটু-আধটু পড়েছি। শঙ্করের অদ্বৈতবাদের আমি বিরোধী নই। তবে ঐ নাস্তিক বাঙ্গালী গুলোর সাথে থেকে একজন মারাঠা ব্রাহ্মণের মতিচ্ছন্ন হবে একথাও মেনে নেওয়া যায় না।‘
-‘কিন্তু বাবা, উনি প্রতিটি কথার যুক্তি দিয়ে…’
– ‘থামো’, এবার গর্জে উঠলেন কৈলাসপতি। ‘ওই বিধর্মীগুলোকে আমার জানতে বাকি নেই। জানো, টেগোর ব্রাহ্ম ছিলেন আর সুকুমারী খ্রীষ্টান। ওরা তো সনাতন ধর্মের কুৎসা করবেই। তাছাড়া বাঙালি জাতটার তো কোনকালেই বর্ণভেদ, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে কোনও সংস্কার ছিল না। ওরা গোমাংস খায়, ওদের ব্রাহ্মণরা, বিধবারা পর্যন্ত আমিষ খায়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর আর ডিরোজিও সাহেব এদের মাথাটি খেয়েছেন। ওরা আবার সনাতন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কী কথা বলবে! আমি বলছি গোডবোলে শাস্তি পাবে, বিধাতার চরম শাস্তি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।‘
বাবার মেজাজ দেখে আর কথা বাড়াল না শৈলজা। ভয়েই চুপ করে গেল।
ইদানীং কদিন ধরে মন্দিরের গুপ্তকক্ষে মাথায় লাল কাপড় বাঁধা কিছু উগ্র আর গোঁড়া হিন্দুভক্তের আসা-যাওয়া, বাবার সঙ্গে দিনের পর দিন তাদের পরামর্শ কিন্তু শৈলজার নজর এড়ায় না। ইতিমধ্যে গোডবোলে নবজীবন পত্রিকা ও মহারাষ্ট্র টাইমসে লিখে ফেলেছেন আরো গোটা তিনেক বলিষ্ঠ রচনা, সবই ধর্মের ধ্বজাধারী দালালদের উদ্দেশ্যে। তাতে বাদ যায়নি ভণ্ড সাধুদের কাণ্ডকারখানা, ধার্মিক সংগঠনগুলোর কালো টাকার পরিমাণ, গণেশ-মূর্তির দুগ্ধপান থেকে মাহিমে সমুদ্রের জলের মিষ্টতার রহস্য বা মক্কায় হজযাত্রীদের স্ট্যাম্পীডের ঘটনা- কোন কিছুই।
সাপের লেজে পা দিলে সাপ কি ছেড়ে কথা কয়? একদিন সকালে জগিং-এ বেরিয়েছিলেন ডাঃ গোডবোলে, ঘরে ফিরল তাঁর মৃতদেহ পুলিশের গাড়ি চড়ে। দুজন মোটর-বাইক আরোহী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে তাঁর কপালে।
সেদিন বিকেলে নবজীবনের সম্পাদকের ফোন এল শৈলজার কাছে। ‘মিস ত্রিবেদী, এই ঘটনাটার উপর একটা স্পেশ্যাল রিপোর্ট চাই। পরপর তিনজন রেশনালিস্ট খুন হলেন দেশের বিভিন্ন জায়গার, প্রকাশ্য দিবালোকে। ডাঃ দাভোলকার, ডাঃ কালবুর্গি, ডাঃ গোডবোলে তো বটেই, প্রয়োজনে বাংলাদেশের সম্প্রতি-নিহত ব্লগারদের আর শ্রীলঙ্কার যুক্তিবাদী ডাঃ কোভুরের কেসটাও তুলনায় নিয়ে এসো। পারলে কলকাতার যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের সাথেও কথা বলে দেখো।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে এডিটার ফোন রাখলেন।
উত্তেজিত শৈলজা নিজেও। অল্প দিনের সাংবাদিক জীবনে এরকম হাই-প্রোফাইল কেস সে কখনও হ্যান্ডেল করেনি। সেই সন্ধ্যেতেই সে ছুটল সয়াজীবাগের ধার ঘেঁষে ডাঃ গোডবোলের বাসায়। তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এক সৌম্য সুদর্শন যুবক, নাম জানা গেল মুকুন্দ গোডবোলে। তিনি নিজেই জানালেন যে তিনি মহারাজা সয়াজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বর্গত ডাঃ মধুসূদন গোডবোলের কনিষ্ঠ পুত্র, বছর তিন হল এম-এস-ইউ তে সংখ্যাতত্বের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়েছেন।
-‘বাবার পরিচয় তো নিশ্চয় আপনার অজানা নয়’, সোজাসুজি মূল প্রশ্নে এসে পড়লেন মুকুন্দ, ‘আর তদন্ত যা করার সে তো পুলিশেই করবে। তাহলে আপনার ভূমিকাটা এখানে কিসের?’
-‘আপনার কথা ঠিক। আমার কাজ খুনের তদন্ত করা নয়, যদিও সেটা জানা বা লোককে জানানোটা আমাদের নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে আমাদের মেন কনসার্ন হল যেভাবে একের পর এক যুক্তিবাদী যিনি ধর্মান্ধতা বা অন্ধবিশ্বাস, তথাকথিত ধর্মগুরুদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজে ব্রতী হয়েছেন তাঁদেরকে এক এক করে খুন করা হচ্ছে-এ আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আমরা কি এখনও নিজেদেরকে সভ্য-পরিচয় দেওয়ার যোগ্য আছি, না প্রস্তর-যুগের অসভ্য-বর্বরতার দিকে ফিরে যাচ্ছি?’
-‘না মিস ত্রিবেদী, নিওলিথিক-চ্যাল্কোলিথিক মানুষদের অসভ্য-বর্বর বলার কোনও অধিকার আমাদের নেই। তারা হত্যা করত নিতান্তই জৈব প্রয়োজনে। তাদের ধর্ম বলে কিছু ছিল না, তাই ধর্মান্ধতার কোনও প্রশ্নই আসে না। জানেন, আমার বাবা টেগোর থেকে পড়ে শোনাতেন-
“ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।…….
পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা-
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা!”
-‘তবু কারা আপনার বাবাকে মেরেছে বলে আপনার মনে হয়?’
– ‘তা বলতে পারব না, তবে দুজনেরই মাথায় লাল ফেট্টি আর কপালে সিঁদুরের টিপ ছিল।’
চকিতে চমকে ওঠে শৈলজা। মনে পড়ে মন্দিরে কিছু সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা। মুহূর্তে সবকিছু যেন পরিষ্কার হয়ে যায় চোখের সামনে। কোনমতে একগ্লাস জল চায় সে মুকুন্দের কাছে।
– ‘আমি স্ট্যাটিস্টিক্সের কিছুই বুঝিনা, প্রফেসর গোডবোলে, কিন্তু সামান্য পরিচয়ে আপনাকে যেটুকু দেখলাম তাতে মনে হল আপনি আপনার বাবার একজন যোগ্য উত্তরসূরী, গর্ব করতে পারেন তাঁকে নিয়ে। আমার কিন্তু সে সৌভাগ্য হল না ‘- শৈলজা কথাটা বলেই ফেলল।
– ‘ তা কেন, আপনি একজন শিক্ষিতা মহিলা, সঙ্গত কারণেই আপনার যুক্তিবাদী হওয়ার, গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে ওঠার অধিকার আছে। আর এ ব্যাপারে আমি যদি বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারি, সে আমার সৌভাগ্য বলে মনে করব। আপনি প্লীজ এ ব্যাপারে কোনও দ্বিধা রাখবেন না।‘
বাড়িতে ফিরে ভারাক্রান্ত মনে শুয়ে পড়ল শৈলজা। পরদিন ঘুম ভাঙ্গল রোজকার মত বাবার গলায় সন্ত নরসি মেহেতার রচিত ভজন শুনে-
“বৈষ্ণব জন তো ত্যয়ন কহিয়ে জে
পীড় পরায়ে জানে রে –
পরদুখে উপকার করে তোয়ে
মন অভিমান না আন রে।।”
আজ কিন্তু বাবার গলায় এই গান তার কাছে ভণ্ডামির নামান্তর বলেই মনে হল। প্রবলপ্রতাপ পুরোহিত কৈলাসপতি ত্রিবেদী এখনও জানেন না যে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের জন্ম হয়েছে তাঁরই অজ্ঞাতসারে, তাঁরই চোখের সামনে। আর ক’দিন পরে বুঝি বা তার জন্যেও কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ ঈশ্বরকে বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো তাঁরই।।
***************************************
পল্লব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের খনিজ তৈলক্ষেত্রে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। বিহারের, অধুনা ঝাড়খণ্ড, যে অঞ্চলে তিনি মানুষ সেখানে ‘নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা পরিধান’ হলেও একসময় বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চার আবহ ছিল। সেই শিক্ষা থেকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায় ও বিগত কয়েক বছরে অবসর, জয়ঢাক, ম্যাজিক-ল্যাম্প, ছুটির ঘন্টা, আদরের নৌকা, ঋতবাক ইত্যাদি নেট-পত্রিকা ও যুগ, ট্রৈনিক, বোম্বে-ডাক ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায়, ক্যাফে-টেবল প্রকাশিত শরদিন্দু স্মৃতি-সংখ্যায় লিখে আসছেন। তাঁর প্রকাশিতব্য গল্প সংগ্রহ ‘আড্ডা আনলিমিটেড’ ও ‘বরাহ-নন্দন ও অন্যান্য গল্প’- দুটিই এখন যন্ত্রস্থ।