কুঁড়ে ঘরে ঝান্সী কি রানী
ভারতী ভট্টাচার্য
“আরে.. আরে.. আরে.. করিস কি ! করিস কি ! ঠাকুরের আসনটা ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁটিয়ে দিচ্ছিস যে ! ছি..ছি..ছি ছুঁয়ে ধরে একাকার করে দিলো গো,বলি তোর আক্কেলটা কি রে রমা ? রোজ একই কথা তোকে কত বার বলবো বল দেকিনি ? আর তোর বৌদির এখন কোন বাপের শ্রাদ্ধ আটকে আছে যে তোকে একটু নজর রাখতে পারে না? নিজের বাপ্-মাকে তো কবেই খেয়ে এসেছে,বাকি আছি আমি। তা আমাকে খাবার জোগাড় করছে বুঝি? কি কুক্ষণে এই অলক্ষুণে মেয়েটাকে আমার ছেলেটা দয়া দেখিয়ে বিয়ে করে এনেছিল| সবে মাত্র স্নানটা সেরে এসেছি,কই একটু শ্রদ্ধা ভরে ঠাকুরকে ডাকবো,তারও একটু উপায় নেই ! বলি নবাবনন্দিনীর কানে যাচ্ছে না কিছু? কালা হলে নাকি? দয়া করে একবার দেখে যাও,তোমার অনাসৃষ্টি ননদিনীটি,কি অনাচার করেছে !!!”
শাশুড়ির চিৎকার শুনে রেবতী রান্না ঘর থেকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,”মা,কি হয়েছে বলুন ?”
শাশুড়ি – ( মুখ ঝামটা দিয়ে )”বলি মহারাণী কি করছিলেন?”
বৌমা – (মাথা নিচু করে) “আজ্ঞে আপনার ছেলের জল খাবার তৈরী করছিলাম |”
শাশুড়ি – (হাত উপরে উঠিয়ে)”আমাকে আর আমার ছেলেকে উদ্ধার করেছো মা লক্ষ্মী,বলি রোজ যে রমা সকালে আমার কাজ আরো বাড়িয়ে দিয়ে যায় সেদিকে একটু নজর দিতে পারো না? এখন গঙ্গা জল দিয়ে আসনের সব কিছু আমায় ধুতে হবে,এই বুড়ি মানুষটার যে কত কষ্ট হয় সেটা বুঝতে পারো? তুমি এমন কী রাজভোগ আমার ছেলের জন্য বানাচ্ছ শুনি? একটু জলখাবার করতে তোমার সারা সকাল লেগে যায় !”
বৌমা নিরুত্তর |
রমা – (ঠাকুমাকে ঝাড়ু তাক করে) “বৌদি আমাকে নজর দেবার দরকার মনে করে না বলে দেয় না,কারণ সে জানে আমি ঠিক কাজ-ই করছি | আর তুমি বলছিলে না বৌদি রাজভোগ বানাচ্ছে কি না? না না রাজভোগ নয়,তোমার জানোয়ার ছেলের জন্য জানোয়ারের ভোগ বানাচ্ছে,নাহলে যে বৌদিকে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে | রোজ দেখে দেখে আমার চোখে ছানি পড়ে গেছে | তোমারই ছেলে তো,এর থেকে ভালো আর কি হবে ! বেচারা অভাগী অনাথ বৌদির, তোমাদের ফরমাইশ না খেটে উপায় কি !”
ঠাকুমা – (লাঠি হাতে নিয়ে )”চুপ কর মুখপুড়ি,তোকে আর আগুনে ঘি দিতে হবে না ।নিজের ঘর বলে তো কিছু নেই, অন্যের ঘরও ভেঙে শেষ করে দিতে চাইছিস? অশিক্ষিত, ছোটলোক মেয়ে মানুষ একটা !”
রমা – (মুখ ঝামটা দিয়ে বললো) “জানিনে বাপু তোমার শিক্ষা কারে কয় ! রোজ সকালে আসনে বসে,অং রং বং কি সব আওড়াচ্ছো,এদিকে পূজা করতে করতে ঘরের লক্ষ্মীকে যা নয় তাই বকছো,এ কেমন পূজা! তোমার ভগবান কি তোমার পূজা নেয়? এরপরও ক্ষান্ত হও না,পূজা সেরে পাড়াপড়শীর কাছে বৌদির নামে কোঁচা ভরে বদনাম করে আসো | রাতের বেলা তোমার সামনে ছেলে মদ খেয়ে এসে বৌদিকে মারধর করে, তার বেলা তোমার শিক্ষা কোথায় যায় শুনি?”
অবস্থা বেগতিক দেখে রেবতী রমাকে টেনে বললো,”ছাড়ো না রমাদিদি,যাও কাজ শেষ করো,আজ আর অন্য বাড়ি কাজে যাবে না? বেলা হয়ে গেলো যে !”
রমা বৌদির হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে বললো,”সব কিছু ছাড়তে ছাড়তে তো আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছ বৌদি,দশ বছর হলো বিয়ে হয়েছে,একটা ছেলেমেয়ে পর্যন্ত হলো না, তোমাকে নিয়ে এই বাড়িতে কারো কোনো চিন্তা আছে? দাদা তোমাকে শুধু ঘরের কাজের জন্য আর এই দজ্জাল বুড়িটাকে দেখার জন্য এনেছে | দেখবে একদিন তুমি এইভাবে কুকুরের মতো খাটতে খাটতে শেষ হয়ে যাবে।”
ঠাকুমা – (ঝাঁঝিয়ে কর্কশ স্বরে) বললেন,”সকাল সকাল মুখ ঝামটা দিয়ে দিনটা শুরু করিস না,ভালো হবে না বলে দিচ্ছি,এখন আমায় পূজা করতে দে | পরকালের ব্যবস্থা করতে হবে তো | অবশ্য তোকে কেন বলছি,তোর মতো ছোটলোক এইসব কি করে বুঝবে,যে কিনা দশটা ছেলের সাথে সারাক্ষণ ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়,আর নিজের নারায়ণরূপী স্বামীকে কষ্ট দেয় | স্বামী পরম ঈশ্বর,তোর বৌদির নারায়ণ হলো আমার ছেলে বুঝলি ?”
রমা – (মুখ বেঁকিয়ে) “ঝাঁটা মারি অমন নারায়ণের মুখে, আমি বৌদি না | স্বামী মদ খেয়ে অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে রাসলীলাতে মেতে থাকলে কোনো দোষ নেই আর মেয়ে মানুষ অন্য ছেলের সাথে কথা বললেই পতিতা হয়ে যায় তাই না? কেন সে ভালো বন্ধু হতে পারে না? আমি তো ছোটলোক,অশিক্ষিত,কিন্তু তোমরা তো নিজেকে ভদ্দর লোক বলো,এই কি তোমাদের ভদ্দর লোকের নমুনা? ঘরের লক্ষ্মীকে কষ্ট দিয়ে পাথরের লক্ষ্মীকে পূজা করে ভাবছো তোমার স্বর্গ বাস হবে? আমি বলি কি এইসব ভণ্ডামি ছেড়ে ঘরের লক্ষ্মীর চোখের জল মুছিয়ে দাও,দেখবে তুমি সশরীরে স্বর্গে যাবে,তোমার আর কোনো পূজার দরকার পড়বে না | ইহকাল-পরকাল এমনিই পার হয়ে যাবে | জীবে প্রেম করে যেই জন,সেই জন সেবিছে ঈশ্বর | এই কথাটা আমি বৌদির কাছে শিখেছি |”
ঠাকুমা -(তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে) বললেন,”পোড়ামুখী আমাকে শিক্ষা দিতে এসেছে,এখন ঘরের ঝিয়ের কাছে থেকে আমায় শিক্ষা নিতে হবে ! কলিকাল,কলিকাল ঘোর কলিকাল ! না না আর সহ্য করতে পারবো না….এই শোন্ পোড়ামুখী,কাল থেকে তুই আমার বাড়ি কাজ করতে আসবি না,ছেলেকে বলে আমি তোর আসা বন্ধ করবো,নাহলে আমার সংসার তুই আগুন জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিবি |”
রমা – (বুক টান করে) বললো,”সে তুমি যা খুশি করতে পারো, কিন্তু আমি বৌদিকে এই নরক থেকে বের করবোই |”
আর বাক্য ব্যয় না করে বাসন কটা মেজে রমা হন হন করে বেরিয়ে গেলো |
সেদিন রাত দশটা বাজে | মদ খেয়ে টাল্লি হয়ে রমার ঠাকুমার সুবোধ ছেলে ঘরে ফিরলো এবং রোজকার মতো বৌয়ের চুল মুঠি ধরে টেনে এনে বুকে,পিঠে,পেটে,একটার পর একটা লাথি মারছে,কিন্তু তখন শাশুড়ির কোনো সাড়াশব্দ নেই | মেয়েটি নিচে পড়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে কিন্তু তবু জানোয়ারটার কোনো কষ্ট হচ্ছে না,দাঁত বের করে খিক খিক করে হাসছে … |
ঘরের দরজা খোলাই ছিল। সেই সময় হাট্টা-গাট্টা দুটি ছেলে ঘরে ঢুকেই জানোয়ারটাকে বেধড়ক কিল চড় লাথি মেরে আধমরা করে ছাড়লো,ঘরে ভূমিকম্পের মতো কম্পন অনুভব করে মা দৌড়ে এসে আজ উল্টো দৃশ্য দেখে হতবাক ! ঠাকুমাকে দেখে ওনার সামনে এসে ছেলে দুটি বললো,”যদি আর কোনোদিন বৌদির গায়ে তোমার ছেলে হাত তোলে তবে ছেলের লাশ তোমার হাতে দিয়ে যাবো |”
পেছন থেকে রমা এসে বৌদিকে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,”কাল থেকে তোমায় আর কেউ মারবে না,তুমি আর ভয় পাবে না বৌদি | রোজ রোজ কেউ তোমায় বাঁচাতে আসবে না | নিজেকে যত গুটিয়ে রাখবে তত তোমাকে দুর্বল ভেবে সবাই তোমার উপর অত্যাচার করবে | কামড় দিতে না পারো ফোঁস তো করতে পারো ! তোমার জন্য একটি পার্লারে আমি কাজ দেখে রেখেছি,কাল সকালে এসে আমি তোমায় নিয়ে যাবো | তখন সাহস করে কিন্তু আমার সাথে যেতে হবে| দশ বছর ধরে কেন তুমি এই অকথ্য অত্যাচার সহ্য করছিলে?”
রেবতী রমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,সবাই যে রমা দিদি হতে পারে না,আর আমার মতো বৌদি না থাকলে রমাদিদির সৃষ্টি হবে কি করে? তবে কাল আমি যাবো রমা দিদি |”
রমা খুশি হয়ে বললো ঠিক আছে,এখন তুমি নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো | আমার একটু কাজ বাকি আছে ….”
রমা বৌদিকে নিজের ঘরে পাঠিয়ে ঠাকুমার ঘরে এসে পূজার আসন ছোঁয়ার ভান করে চিৎকার দিয়ে বললো,”বুড়ি তুমি যদি কাল থেকে বৌদিকে এতটুকু জ্বালাবে,তাহলে ছেলেকে এবং তোমার ঠাকুরকে একসাথে হারাবে | সোজা নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসবো | তুমি তো আমাকে চেনো,যা বলি করেই ছাড়ি |”
ঠাকুমা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,”তোর পায়ে পড়ি মা, অমন করিস না লক্ষ্মীটি,কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন আমার বৌমাকে কষ্ট দেব না |”
রমা– “আর তোমার ছেলে ?”
ঠাকুমা — “সে-ও দেবে না |”
রমা – (আসন ছেড়ে দিয়ে) ছেলে দুটোকে বললো,”এই চল রে,অনেক রাত হলো,তোরা আজ বাড়ি যা,মনে রাখিস কাল আবার পশ্চিম পাড়ার বৌদিকে আর এক জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচাতে হবে | চল চল …..”
****************************************
লেখিকা পরিচিতিঃ ভারতী ভট্টাচার্য একজন ব্যবসায়ীক মহিলা এবং লেখক। বর্তমানে বাসস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম শহরে।