Shadow

‘চারণ কবি’ কনকভূষণ মুখোপাধ্যায় – রাজেশ দত্ত

‘চারণ কবি’ কনকভূষণ মুখোপাধ্যায় : বিস্মৃতির আঁধারে বঙ্গসাহিত্যের আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

 রাজেশ দত্ত

‘চারণ কবি’ কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়কে জানেন? এই প্রশ্নে সাধারণ কবিতাপ্রেমী বাঙালি পাঠক-পাঠিকারা তো বটেই, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অধিকাংশ শিক্ষক ও বিদ্বজ্জন থেকে গবেষক বিদ্যার্থীরাও নিরুত্তর থাকেন। গভীর পরিতাপের সাথে স্বীকার করতেই হয়, আমরা বাঙালিরা এক আত্মবিস্মৃত জাতি। আমাদের সুমহান ও সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড়-মাটি-বীজ হারিয়ে যায় অনাদরে, অবহেলায়। কবি কনকভূষণও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া এমনই এক প্রথিতনামা কবি। বিগত বিশ শতকের প্রথমার্ধে তাঁর কাব্যপ্রতিভার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্যের নিখিল ভুবন। তাঁর ‘চারণ’ ও ‘লীলাময়ী’ কাব্যগ্রন্থ দু’টি ছাড়াও সেকালের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতাবলী পাঠক মহলে বিপুল সমাদৃত হয়েছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। এছাড়াও যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, হেমচন্দ্র বাগচী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী, লীলা দেবী, আশালতা দেবী, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যসাধকদের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর সৌহার্দ্য ও নিবিড় অন্তরঙ্গতা। নিদারুণ আক্ষেপের বিষয়, ১৯৪৫ সালে এক মর্মন্তুদ পথ দুর্ঘটনায় কবির জীবনদীপ নির্বাপিত হয় মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। অকালে খসে পড়া এই ক্ষণপ্রভা নক্ষত্রের সাহিত্যকীর্তি তাঁর অসামান্য কবিসত্তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতাগুলি ভাবনার অনন্যতায়, ভাবে ও ভাষার সৌকুমার্যে অতুলনীয়। তবু তাঁর জীবনাবসানের সাতাত্তর বছর পরে আজও শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে তিনি অপরিচিত ও অবজ্ঞাতই রয়ে গেলেন।
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯০৭ সালে (১৩১৪ বঙ্গাব্দ, তারিখ অজানা) অবিভক্ত বৃটিশ ভারতে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত বর্ধমান জেলার বিরুডিহা গ্রামে। এই গ্রামটি বর্ধমানের পানাগড় ও রাজবাঁধ শহরের মাঝামাঝি জিটি রোডের ডানদিকে অবস্থিত। তাঁর বাবা অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়। ঠাকুরদার নাম ঈশ্বরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কবিপত্নী অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর মেয়ে। তাঁদের তিন পুত্র। বড়ো ছেলে কাঞ্চন কুমার, যিনি বর্তমানে স্বনামধন্য কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বর্ষীয়ান কর্মী হিসেবে সুপরিচিত। মেজ ছেলের নাম শ্যামল কুমার এবং ছোটো ছেলের নাম যুগল কুমার।|
একসময় বিরুডিহা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা ছিল। একবার কবির তিন শিশু সন্তানই একসঙ্গে প্রবল ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো হাওয়া বদলের জন্য তাঁরা গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে চলে যান বেনারসে। সেকালের বারাণসীর মনোরম পরিবেশ তাঁর ভালো লেগে যায়। তিনি সেখানকার নারায়ণনগরে পুরো পরিবারের জন্যে একটি বসতবাড়ি তৈরি করেন। গৃহপ্রবেশ হয়ে গেলেও তাঁর নিজের সেই বাড়িতে বিশেষ থাকা হয়নি। জীবিকার তাগিদে ফিরে আসতে হয় বাংলায়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী ছেলেদের নিয়ে বেনারসেই থেকে যান।
কবি পানাগড়ে মিলিটারি কনট্র্যাক্টরের কাজ করতেন। তাঁর অফিস ছিল বুদবুদ্ -এ। এছাড়া তিনি ‘কুষ্ঠিয়া ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক’-এর বেনারস শাখার ‘ডাইরেক্টর ইন্‌ চার্জ’ পদের দায়িত্বেও ছিলেন।
১৯৪৫ সালে (১৩৫২ বঙ্গাব্দে) মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। কর্মসূত্রে বুদবুদ্ থেকে বর্ধমান যাওয়ার পথে তাঁর মোটরগাড়িটি গলসী সাঁকোর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নীচে পড়ে যায়। তিনি নিজেই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। পরে এই দুর্ঘটনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে জানা যায় যে, গাড়িটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল। আগে থেকেই সেই গাড়ির স্টিয়ারিং-এ গোলযোগ ছিল। কিন্তু সে বিষয়ে তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি। দুর্ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ফ্রেজার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা চলার পরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবির মৃত্যুকালে তাঁর তিন নাবালক পুত্রের বয়স ছিল যথাক্রমে আট, চার এবং দুই বছর। শৈশবে পিতৃহারা হওয়ায় ছেলেরা তাঁদের বাবাকে জ্ঞানত দেখেননি বললেই চলে। কবিপুত্র কাঞ্চন কুমার এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় বাবার স্মৃতিচারণে বেদনাবিধুর স্বরে বলেন,‘আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে বাবাকে খুব অস্পষ্টভাবেই মনে পড়ে। আমরা তিন ভাই মায়ের সঙ্গে বেনারসে থাকতাম, আর বাবা ছিলেন বর্ধমানে। বেনারসের রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরে আমার স্কুল জীবন কেটেছিল। কর্মব্যস্ততার দরুন বেনারসে আমাদের কাছে নিয়মিত আসা-যাওয়া বাবার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠত না। তাই বোধোন্মেষের পরে তাঁর সান্নিধ্য খুব কমই পেয়েছি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, বাবা উদাত্ত কণ্ঠে খুব ভালো গান গাইতেন। তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন।’
কবির পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সেকালের খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক এবং বিশিষ্ট গুণীজনদের পরিচয় ও হৃদ্যতা ছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, হেমচন্দ্র বাগচী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, আশালতা দেবী, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী, লীলা দেবী, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, বর্ধমানের মহারাজকুমার উদয়চন্দ মহাতব্, রবীন্দ্রনাথ সেন, সুরেশ বিশ্বাস, কাদের নওয়াজ, বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিপদ গুহ বিদ্যারত্ন, রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ তীর্থ, সুরেন্দ্রনাথ নিয়োগী, সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, গোপাললাল দে, ইবনে গোলাম নবী, এম. সুলতান, বিজয়প্রসাদ সিংহরায় প্রমুখ। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের এই দীর্ঘ তালিকা থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কবি হিসাবে যশ, খ্যাতি ও সুপরিচিতির বিশাল ব্যাপ্তি আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি। কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন। ১৯৩৬ সালে কবির জ্যেষ্ঠ পুত্র কাঞ্চন কুমারের জন্মের পরে তাঁর নামকরণ ও অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে এঁদের অনেকের কাছ থেকেই আশীর্বাণী এসেছিল। কবিরা তাঁদের প্রাণভরা স্নেহে শুভাশিস বার্তা পাঠিয়েছিলেন সুমধুর ছন্দোবদ্ধ অণু-কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, হেমচন্দ্র বাগচী, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী, লীলা দেবী, রবীন্দ্রনাথ সেন, উদয়চন্দ মহাতব্ প্রমুখদের প্রেরিত এই সেই সব মণিমুক্তোর মতো অমূল্য আশীর্বাদী অণু-কবিতাগুলি সংকলিত করে পরিবারের উদ্যোগে একটি সুন্দর পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখা দু’টি কলি ছিল, ‘জয় হোক্‌ নবজাতকের / সেই চিরজীবিতের’।
কবি কনকভূষণের জীবদ্দশাতেই ১৯৩০ সালের মে মাসে ‘চারণ’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। কবিশেখর কালিদাস রায় (১৮৮৯ — ১৯৭৫) বইটির ভূমিকা লেখেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নে উদ্দীপিত, স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়তাবাদী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ রাজপুতানার গাথা নিয়ে রচিত এই কাব্যগ্রন্থটি বর্ধমান অঞ্চল-সহ অন্যত্র অত্যন্ত সমাদর লাভ করেছিল। বর্ধমান শহরে কবিকে এই কাব্যগ্রন্থ রচনার জন্যে একটি নাগরিক সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, এই বইয়ের নামের সঙ্গে কবির নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। তারপর থেকে তিনি বর্ধমান অঞ্চলে ‘চারণ কবি’ নামেই খ্যাত হন। বর্ধমানের সংবর্ধনা প্রদানের অনুষ্ঠানেও তাঁকে ‘চারণ কবি’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ‘চারণ’ কাব্যগ্রন্থে কবির ১২টি কবিতা সংকলিত হয়েছিল। এগারোটি কাব্যগাথা এবং একটি উৎসর্গপত্রের কবিতা। গাথা কবিতাগুলো হল — (১) মহিমময়ী [ধাত্রী পান্না], (২) কর্ম্মদেবী, (৩) চৈতক-চবুতর, (৪) মান্নার কথা, (৫) এক টুকরো রুটি, (৬) কৃষাণ-বালা, (৭) বায়োজীদ্-বোস্তুমী, (৮) রূপনগরওয়ালী, (৯) কৃষ্ণকুমারী, (১০) গাঁয়ের মেয়ে [দীনু ও মীনুর কথা] ও (১১) শেফালী। উৎসর্গপত্রে কবিতাটির শিরোনাম — ‘শ্রীযুক্ত শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য অগ্রজপ্রতিমেষু’। কবি কালিদাস রায় ‘চারণ’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে এই বইটিতে সংকলিত রাজস্থানের ঐতিহাসিক কাহিনি-নির্ভর কাব্যগাথাগুলোর অকুণ্ঠ প্রশংসা করে তরুণ কবি কনকভূষণকে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে উল্লেখ করেন। কাহিনী-গাথার কাব্যরস সৃষ্টিতে কনকভূষণ রবীন্দ্রনাথেরই অনুসারী বলে তিনি মূল্যায়ন করেন। অতীতের ইতিহাসে রাজস্থানের বীরাঙ্গনা নারীদের নির্ভীকতা, শৌর্য-বীর্য ও আত্মোৎসর্গের মহত্তম আদর্শও কনকভূষণ তাঁর চারণী কাব্যগাথায় উজ্জ্বল রূপে চিত্রিত করেছেন বলে তিনি তারিফ করেন। পরাধীন ভারতবর্ষে বাঙালিদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের জাগরণের লক্ষ্যে কবি কনকভূষণের ‘চারণ’ কাব্যগ্রন্থের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদানকেও তিনি সাধুবাদ জানিয়ে স্বীকৃতি দেন। ‘চারণ’ কাব্যগ্রন্থে কবিশেখর কালিদাস রায়ের লেখা মূল্যবান ভূমিকাটি নীচে উদ্ধৃত করলাম।

পরিচায়িকা

‘‘অতীত যুগের ইতিহাস সকল দেশের কাব্যেই রস-সৃষ্টির উপযোগী উপকরণ দান করিয়াছে। যে দেশে ঐতিহ্যের মহিমা নাই — সে দেশের কাব্য দরিদ্র। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস যতটা মাধুর্য্যের উপাদান দিয়াছে — ততটা শৌর্য্য, বীর্য্য, পৌরুষ ও মনুষ্যত্বের উচ্চাদর্শের উপকরণ দিতে পারে নাই। রাজস্থানের ইতিহাস আমাদের সে অভাব পূরণ করিয়াছে। বাঙ্গালী কবি দেশ-মাতৃকার গৌরবের বিষয় অনুধ্যান করিতে গিয়া কেবল বাংলাদেশের কথা-ই ভাবে নাই — ভৌগোলিক ও ভাষাগত সীমার সংকীর্ণতা সে সহজেই উত্তীর্ণ হইতে পারিয়াছে। বোধ হয় বাঙ্গালীর মত ভারতের কোন জাতি রাজস্থানের ইতিহাসকে এমন করিয়া রস-সৃষ্টির উপকরণ স্বরূপে বিনিয়োগ করিতে পারে নাই।
আমাদের দেশে রঙ্গলাল সর্বপ্রথম রাজস্থানের কাহিনীকে কাব্যের মধ্যে স্থান দেন — তারপর হইতে বহু কাব্য, নাট্য ও উপন্যাস রচনায় রাজস্থানের ইতিহাস প্রচুর উপকরণ দান করিয়াছে। রাজস্থানের কাহিনী লইয়া রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম স্কটিশ ব্যালাডের ভঙ্গিতে গাথা রচনা করেন।
রঙ্গলাল ঐতিহাসিক উপকরণে রস-সৃষ্টি অপেক্ষা মহত্ত্বের আদর্শ সৃষ্টির দিকেই অধিকতর মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গাথা কয়েকটিতে রস-সৃষ্টির দিকেই অধিকতর মনোযোগী হইয়াছেন।
শ্রীমান কনকভূষণ এই গ্রন্থের গাথাগুলিতে রবীন্দ্রনাথেরই অনুসরণ করিয়াছেন এবং রাজস্থানের কাহিনীর সাহায্যে রস-সৃষ্টির চেষ্টা করিয়াছেন। কনকভূষণের এই চেষ্টা বিফল হয় নাই। নবীন কবির পক্ষে ইহা অল্প প্রশংসার কথা নহে।
রস-সৃষ্টির কথা ছাড়িয়া দিলেও এই চারণী গাথাগুলির অন্য মূল্যও যথেষ্ট আছে। লেখক রাজপুতানার নারীর শৌর্য্য বীর্য্য ও আত্মোৎসর্গের চিত্রগুলি বেশ উজ্জ্বল করিয়া-ই ফুটাইতে পারিয়াছেন।
দেশের বর্ত্তমান সময়ে দেশাত্মবোধ জাগরণে এই চিত্রগুলির মূল্য যথেষ্ট। আজ অর্ধশতাব্দী ধরিয়া বাঙ্গালীর জাতীয় চরিত্রগঠনে রাজপুত জাতির ইতিহাস যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছে — বাঙ্গালীর অলস, বিলাসাবসন্ন শঙ্কাতুর জীবনে ইহা নবজীবন সঞ্চার করিয়াছে। ঐ ইতিহাস যত প্রকারে যত রূপে যত ছদ্মে যত ভঙ্গিতে আমাদের পাঠক-সমাজে উপস্থাপিত হয় — ততই মঙ্গল।
কনকভূষণ রাজস্থানের গৌরবময় বৈচিত্র‍্যগুলিকে অভিনব ভঙ্গিতে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়া আমাদের জাতীয় জীবনের কল্যাণ সাধন-ই করিলেন।
আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীগণ এই গাথাগুলি পড়িলে চরিত্রগঠনের সহায়ক নব নব আদর্শ লাভ করিয়া উপকৃত হইতে পারিবে।’’
— শ্রীকালিদাস রায়, ১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৭, কালীঘাট।
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জীবিতকালে প্রকাশিত তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘লীলাময়ী’। দুর্লভ এই বইটি সংগ্রহ করতে পারিনি।
এছাড়াও কবির ৭০টি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা ও গান সংবলিত একটি নোটবই সযত্নে রক্ষা করে রেখেছিলেন তাঁর ছেলেরা। এই কবিতাগুলির মধ্যে বহু কবিতাই সে-সময়ের বিভিন্ন সাহিত্য পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কল্লোল’, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’, ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘বিজলী’, ‘সম্মিলনী’, ‘স্বদেশী বাজার’, ‘পূর্ণিমা’, ‘বিকাশ’, ‘গল্পাঞ্জলী’, ‘নবশক্তি’ ইত্যাদি। এছাড়াও বর্ধমান থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক শক্তি’, ‘মাতৃমন্দির’, ‘উপাসনা’, ‘যুগদীপ’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও তাঁর কবিতা মুদ্রিত হয়। কবির নোটবই থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু কবিতা অপ্রকাশিতও ছিল।
এই কবিতার খাতার বাইরে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবির আরও পাঁচটি কবিতা পাওয়া যায়। ১৯৪৪ সালের জুনে ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘আমার শেষের দিন’ শীর্ষক সাতটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এই দীর্ঘ কবিতামালাটি কবির মৃত্যুর পরে ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে ‘ঐ শেষের দিন’ শিরোনামে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। কবির নামের আগে অবসিত-প্রাণবোধক প্রচলিত চিহ্নস্বরূপ ‘ ৺ যোগ করে কবি যে আর নেই, সেই শোক সংবাদ পাঠকদের জানানো হয়েছিল।
সেকালের বিভিন্ন সাহিত্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা যে-সকল কবিতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য — ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইয়াসিন’, ‘চম্পাইনগর’, ‘জননী ফিরিয়া যাও’, ‘নবীন ভারত জাগো’, ‘পৌষালী’, ‘বৈশাখ’, ‘যাবার বেলায়’ ও ‘শেষের দিন’। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলো হল — ‘আমি যে-প্রবাসী ভাই’, ‘এক টুকরো রুটি’, ‘জমিদার’ ও ‘প্রার্থনা’। ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘আকাশ জুড়ে ঘনায় ছায়া’ ও ‘বন্ধু’ নামে কবিতাদুটি। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘নতুন দিনের আলোক’, ‘বিশ্বের রূপ’, ‘বিস্মরণী’, ‘শরতের উৎসব’ ও ‘শরতের রূপ’ শীর্ষক পাঁচটি কবিতা। ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবির যে কবিতাগুলোর হদিশ পাওয়া গেছে, সেগুলো হল — ‘আঁখি ও রূপ’, ‘কবির চুমা’, ‘কৌলীন্য’, ‘প্রেমের টানে’ (গান), ‘বাউল’, ‘ভাদর-ঝর-ঝর’, ‘মাতৃহারা’, ‘মোহিনী’ এবং একটি রঙ্গকবিতা ‘হাঁচির লজিক’। এছাড়া ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘উদাসিনী’ ও ‘ম্যাক সুইনী’ কবিতাদু’টি, ‘মাসিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শরৎ কি আসিল এখন’, ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আজি নয়নের নীরে’, ‘বসন্তের জাগরণ’ ও ‘সুন্দরের সাধনা’, ‘কুরুক্ষেত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ওগো ভুলে যাই আমি যে অধীন’, ‘গোপন ব্যথা’, ‘পল্লী’ ও ‘রাত্রি’, ‘সম্মিলনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘চাষী’ ও ‘বিদেশী বন্ধু’র প্রতি’, ‘বিকাশ’ পত্রিকায় ‘নিরীহ-জাতি’, ‘স্বদেশী বাজার’ পত্রিকায় ‘কবিতা’, ‘নীলিমা’ ও ‘ফুল’ শিরোনামের কবিতাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। সে-সময় বর্ধমান থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘উপাসনা’ পত্রিকায় ‘সোনার পল্লী মেয়ে’, ‘মাতৃমন্দির’ পত্রিকায় ‘আলো’ এবং ‘যুগদীপ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পল্লী’ কবিতাটির সন্ধান মেলে। বর্ধমানের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘শক্তি’-তে কবির লেখা ‘দারিদ্র্য’ ও ‘নবীনের গান’ শিরোনামে আরও দু’টি কবিতা পাওয়া গেছে। এই সব কবিতার প্রকাশকাল ১৯২৬ থেকে ১৯৪৪ সাল (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৫১ বঙ্গাব্দ) অর্থাৎ কবির ১৯ বছর বয়স থেকে ৩৭ বছর অবধি।
শুধু সাহিত্যসমাজে নয়, তিনের ও চারের দশকে চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা কমল মিত্র কবির কাছের বন্ধু ছিলেন। এছাড়াও কবির বন্ধু ছিলেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। শৈলজানন্দের অনুরোধে তিনি ‘সংসার’ নামে একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি নির্মিত হতে পারেনি। কারণ, গল্পটি শৈলজানন্দের হাতে পৌঁছে দেওয়ার আগেই দুর্ঘটনায় তাঁর জীবনাবসিত হয়। চলচ্চিত্রের জন্যে রচিত এই গল্পের পাণ্ডুলিপিটি কবিপুত্র কাঞ্চন কুমারের সৌজন্যে সংগৃহীত হয়েছে।
কাঞ্চন কুমারের কাছ থেকে আরও জানা যায় যে, কবির মৃত্যুর পর ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মরণে ‘কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘সংহতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই মূল্যবান লেখাটির সন্ধান মেলেনি। বিশিষ্ট ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্য-সংগ্রাহক ও গবেষক মিলন সেনগুপ্ত ব্যথিত চিত্তে লিখেছেন,‘এই অকালে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া কবির কবিতার ভাষা, ছন্দ, ভাব এত সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাংলা সাহিত্যে অপরিচিত একটি নাম। আজ অবধি আমাদের সংগ্রহে আসা কোনো কবিতা সংকলনেই এই কবি বা তাঁর কবিতার উল্লেখ চোখে পড়েনি। এটা কি এই জন্য যে তিনি কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিলেন না? আমরা আশা রাখি যে, এই কবি ও তাঁর কবিতা ভবিষ্যতে বাংলার কাব্যপ্রেমী ও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং বাংলা সাহিত্যে যথাযথ মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠালাভ করবে।’
মিলন সেনগুপ্তের আন্তরিক সহযোগিতা ও পূর্ণদ্যোগে ২০১৩ সালের ১৫ অগাস্ট কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত ৯৭টি কবিতার একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েব-সংগ্রহশালা ‘মিলনসাগর’-এ (www.milansagar.com)। আমরা কৃতজ্ঞ কবির পুত্রদের কাছে, তাঁর সব কবিতা আমাদের ‘মিলনসাগর’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য। তাঁদের অনুমতিক্রমে আমরা ‘চারণ’ কাব্যগ্রন্থের যে কয়টি কবিতা পাওয়া গেছে এবং হাতে লেখা নোটবইয়ে অগ্রন্থিত সব কটি কবিতাই এখানে প্রকাশ করেছি। এই কবিতার পাতার লিংক
http://www.milansagar.com/kobi/kanakbhushan_mukhopadhyay/kobi-kanakmukh.html
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের অমর ও অম্লান স্মৃতির প্রতি অন্তরের অনন্ত শ্রদ্ধায় প্রণাম জানাই।
চিত্র ও তথ্যসৌজন্য: কবিপুত্র কাঞ্চন কুমার , শ্যামল কুমার ও যুগল কুমার এবং মিলন সেনগুপ্ত।
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ছয়টি নির্বাচিত কবিতা
(কবির হাতে লেখা নোটবই থেকে সংগৃহীত। মূল বানান অপরিবর্তিত রূপে মুদ্রিত।)
(১)
চাষী
(‘সম্মিলনী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত, প্রকাশকাল অজানা)
চাষী কয় ব্যাকুলিয়া মোর কথা শোন ধনী ভাই,
তোমাদের চাষ করি তবু মোর দানা পেটে নাই।
বরষার কাদা মাখি ভরিয়াছি তোমার ভাণ্ডার
এক কণা দিলে না’ক তবু রাখিলে না একটু আমার ?
কহিলে মধুর ভাষে, ওরে মধো, কী করিবি ধান ?
আমার গোলাতে তোল্‌ , নিয়ে যাবি পরিলেই টান।
লক্ষ্মী নাই তোর ঘরে অলক্ষ্মীর সদা সেথা বাস
সেথায় বিলায়ে লক্ষ্মী করিব কি নিজ সর্ব্বনাশ ?
অসহায় আমি হায় পথে পথে শুধু যাই ভাবি,
মাটিতে গতর ছেঁচা ও’ ধানে কি নাই মোর দাবি ?
যবে ভাবি অনাহার বাছাদের খাবার কী হবে ?
গরীবের রক্ত চুষে ধনীরা কি চিরধনী রবে ?
ওমনি বিদ্রোহী-মন জ্বালাবারে বিশ্বখানা চায়
সমস্বরে যত দুঃখী ক্ষুধাতুর যারা মৃত প্রায়।
এ’ বিশ্বে বঞ্চিত যারা পায় নাই স্নেহ ভালবাসা,
যাহাদের দগ্ধ-বুকে হানিয়াছে শেল্ সর্ব্বনাশা
নিঃস্ব রিক্ত প্রাণ আর যাহাদের ব্যথাহত বুকে
দারিদ্রের জ্বালা যারা জ্বালিয়াছে দরিদ্রের ভুখে
মৃত্যুর কঙ্কাল তাদের কহি ওঠে সবাকার লাগি
সাম্যের শাসনে বিভু করিয়াছে সবে সম-ভাগী।
কেহ নাই রাজা প্রজা বড় ছোট নিখিল ভুবনে,
আসে নাই বেঁচে কেহ যেচে নিতে কেবল মরণে।
কেহ’ রবে তে’তালায় আরামেতে শুধু বসে বসে!
ভিখারী হইবে কেহ ? দাও দাও ওটা ভেঙ্গে চষে।
না’ হলে দুঃখী ও ধনী এস মিলি করি আলিঙ্গন,
মিসে যাক্ বিশ্ব হতে দরিদ্রের ব্যথিত ক্রন্দন।।
****************************
(২)

জমিদার

(‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত। ৪র্থ সংখ্যা, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ।) 

পল্লীর মোহন-শোভা শুষ্ক আজ মলিন-বিফল,
হাসি নাই কোনোখানে দু’নয়নে তপ্ত আঁখিজল
ঝরিতেছে অবিরাম। বক্ষ দাহ, লাঞ্ছনা-পীড়ন!
রোষদীপ্ত শাসকের বিশ্বত্রাস ভীষণ শাসন
পল্লীর সৌন্দর্য্য হরি জ্বালিয়াছে ব্যর্থ হাহাকার
শ্রীহীন শ্মশানে তার অট্টহাস্য করে জমিদার।।
******************************
(৩)

নিরীহ-জাতি 

(‘বিকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত, অগ্রহায়ণ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ) 

সমাজপতি-বামুনের-পো
মান কি তোমার গেলেই হলো?
ব্রহ্মত্বটা গেলেও সত্য,
মানটা কোথায় যাবে বলো?
বাঁধতে ছাঁদা ফলার দিনে
উড়িয়ে টিকি গামছা হাতে।
এখনো ধাও হরষ-মনে,
দিস্তে কয়েক বাঁধতে পাতে।
পৌরোহিত্যে তুমিই-না সে,
দাতার শ্রাদ্ধ সেরেই ফেলো;
ফলারও হায় ফুরিয়ে গেছে,
তোমার শ্রাদ্ধ ঘনিয়ে এ’লো|
সমঝে চ’লো সমঝে চ’লো।।
******************************
(৪)

কৌলীন্য 

(১০ বৈশাখ, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, বিরুডিহা। ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত) 

বল্লালী খেতাপ মারা বঙ্গ ভরা এই যে কৌলীন্য!
ব্যক্তিরেসে উলঙ্ঘিয়া এঁকে যায় আভিজাত্য চিহ্ন
পুরানো বংশের ভিতে। হোক্না সে মাতাল লম্পট
না থাক ব্যক্তিত্ব তার! বেশ্যাদাস হোক নাসে ঠক,
তবুও জীবনে সেই সাফল্যের মাল্যখানি পাবে
কিশোরী-বালার পিতা সমর্পিতে কন্যা তার
ওই হীন লম্পটের হাতে। দেখিবে না ইহ-পরকাল?
কোন্ অতীত বংশের খ্যাতি চক্ষে তার আঁকি স্বপ্নজাল
রচিবে কুহেলি মায়া! সমাজের ভাঙ্গে নাএ ভুল!
কন্যাদানী স্ফীতবক্ষ-পিতা ভাবে ধন্য মোর কূল
ল আজ জীবন সফল। দীনতার এই আস্ফালন,
সভ্যতারে আবরিয়া মনুষ্যত্বে করিছে পীড়ন,
নারীত্বের অপমান উড়ায়’ সে কৌলীন্য-নিশান,
হেরি এর ছত্রতলে ভূ’লুণ্ঠিত জাতির শ্মশান।।
******************************
(৫)

দারিদ্র্য 

(বর্ধমানের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘শক্তি’তে প্রকাশিত। ১৯ বৈশাখ, ৩৭শ সংখ্যা। সাল অজানা) 

হে’ প্রদীপ্ত বন্ধু মোর! প্রণমি হে’ দারিদ্র্য-দহন!
ভস্ম করি গর্ব্ব-মম, রচিয়াছ প্রেমের শয়ন
আমার অন্তরলোকে। শিখায়েছ তুমি মহারাজ
তৃণাদপি নীচ হতে। পরায়েছ দীনতার সাজ
আমারে উলঙ্গ করি। তুমি মোরে দেখাইলে পথ।
যবে মোর দগ্ধদৃষ্টি, ব্যর্থ আমি, ভগ্ন মনোরথ।
সেদিন আমার বক্ষে, দাগিলে হে ভুখে ভগবান!
তীব্র কষাঘাত হানি তুমি মোর জাগাইলে প্রাণ।।
******************************
(৬)

পল্লী 

(১০ বৈশাখ, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, বিরুডিহা। ‘যুগদীপ’ ও ‘স্বদেশীবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত।) 

শুষ্ক মরুভূর মত পল্লী আজ করিতেছে ধু ধু
স্মৃতির শ্মশানে তার দারিদ্রের অট্টহাস্য শুধু,
আতঙ্কের সাথে সাথে তুলিতেছে ব্যথা শিহরণ
রিক্ততায় পূর্ণ করি। কেঁদে ফেরে মর্ম্মর ক্রন্দন!
প্রশান্ত শ্যামল-বনে জননীর অশ্রুঝরা-আঁখি,
করেনা’ত কাহারে আহ্বান! নীরব-প্রশান্তি আঁকি
সে যেন আঁখির জলে অতীতকে ফিরাবে আবার?
চলেছে বন্দিয়া তাই, দৃপ্ত দুঃখে নমি বারম্বার।
ক্ষুধার্ত্ত মাগিছে অন্ন, জল দাও কহে তৃষাতুর,
লক্ষ যুগ উপবাসী, কর মোদের ব্যথা-দুঃখ দুর।
পুনঃ শুনি চিৎকারিয়া বিজ্ঞাপিছে সমস্বরে চাষী,
কাঁদাবি মোদের যদি তুই কেন সর্ব্বনাশী!
ভুবন ভোলানো রূপে আমাদের করিলি পাগল?
অন্ধকার বৃন্দাবনে আমাদের নিতে অশ্রুজল?
**************************************

রাজেশ দত্ত পরিচিতি
রাজেশ দত্ত একজন প্রাবন্ধিক কবি গীতিকার ও সুরকার সর্বোপরি একজন আপোসহীন যুক্তিবাদী। বর্তমানে চন্দননগরস্থিত বিজ্ঞান ও মানবাধিকার সংস্থা ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’র সম্পাদক। ২০০৫ সালের কলকাতা বইমেলায়  র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন প্রকাশনার উদ্যোগে রাজেশের প্রথম গানের সংকলন গ্রন্থ- ‘মানবতার গান’ প্রকাশিত হয়। উৎস মানুষ, অনীক, টপ কোয়ার্ক, আকিঞ্চন, হেতুবাদী সাময়িকী’, ‘বন্দীবার্তা’, ‘প্রসঙ্গ সমকাল’, ‘বিরুদ্ধতা’,  ‘অন্যদিগন্ত’, ‘আবাদভূমি’, ‘সাগ্নিক’ ইত্যাদি বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে ওনার গানের কথা ও স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে। স্বরলিপি করেছেন অগ্রজা সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা বইমেলায় সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে রাজেশের কথায় সুরে প্রথম গানের অডিও সিডি ও ক্যাসেট ‘পাল্টা স্রোতের গান’ বের হয়। অডিও সিডিটি ছিল সম্পূর্ণ যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জিত একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস। রাজেশের গানের বিষয়বৈচিত্র্য, উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য, কথা ও সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।

1 Comment

  • Chinmoy Chakraborty

    সম্বৃদ্ধ হলাম। খুব যত্ন করে পড়াশোনা করে লেখা। সুন্দর ভাষাবিন্যাস। অভিনন্দন রাজেশ ভাই

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!