Shadow

প্রকৃতির এক সাচ্চা প্রেমিকের কাহিনী – অজন্তা প্রবাহিতা

প্রকৃতির এক সাচ্চা প্রেমিকের কাহিনী

অজন্তা প্রবাহিতা

এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় আমাদের সবার প্রিয় বন্ধু পাখিপ্রেমী গৌতমের সঙ্গে মুঠোফোনে আড্ডা দিচ্ছিলাম। গৌতম পেশায় শিক্ষাবিদ হওয়াতে যেকোনো বিষয়কেই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারে। ওর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কখনো মনে হয় না সময় নষ্ট করলাম,উল্টে মনে হয় ,কত অজানাকে জানতে পারলাম। সেদিনও ঠিক তাই হলো। কথায় কথায় গৌতম জিজ্ঞেস করলো,”আচ্ছা,তুমি সাচ্চা প্রেমিককে দেখেছো কখনো?”
আমি  হেসে বললাম,”আজকের এই খোলা দুনিয়াতে তুমি সাচ্চা প্রেমিক দেখবার কথা জিজ্ঞেস করছো গৌতম? তাকে দেখা কি সম্ভব? সিনেমায় দেখেছি লায়লা-মজনু ,হীর-রানঝা,সোনি-মাহিওয়াল। কিন্তু রিয়েল লাইফে এমন কাউকে দেখতে পাবো সেকথা কস্মিনকালেও ভাবি নি।”
“আরে, তুমি দেখার চেষ্টা করো না তাই দেখতে পাও না”- ওপাশ থেকে গৌতম বলে উঠলো।
এদিকে আমার বিস্ময়ের শেষ নেই , আজকের যুগে যখন একাধিক সম্পর্ককেই  মানুষ অনায়াসে গ্রহণ করছে ,সেই যুগে দাঁড়িয়ে সাচ্চা প্রেমিককে স্বচক্ষে দেখবার মতো সুযোগ বা ভাগ্য কি আমার আছে ? তাই খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”তুমি দেখেছো ? কে সে ?”
চিরপরিচিত স্টাইলিশ হাসি হেসে গৌতম বললো,”ম্যাডাম,একে তুমিও দেখেছো কিন্তু জানো না যে এ সাচ্চা প্রেমিক।”
“এবার হেঁয়ালি থামাও গুরুজী। বলো সেই প্রেমিকের নাম”,আমি এপাশ থেকে বললাম।
“তার নাম কাক।”- শান্ত স্বরে গৌতম জবাব দিলো।
“কাক ?” রীতিমতো বিস্ময় ভরা  কণ্ঠে আমি বললাম,”ওই হতকুৎসিত কালো পাখিটাকে তুমি বলছো সাচ্চা প্রেমিক? তোমার মাথাটা গেছে। দেখো আর কোনো উজবুক পাও কি না যাকে এই গল্প বলবে।”
গৌতম যে পাখী সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য পছন্দ করে না সে আমার জানা ছিল। কথা বলার সময় যখন ম্যাডাম থেকে অজন্তা হয়ে যাই তখন বুঝতে পারি গুরুজী বেশ অসন্তুষ্ট। ঠিক তাই হলো। ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বরে জবাব এলো,”জানতো অজন্তা,আমাদের মতো মানুষের সবচেয়ে বড় দোষ কোথায়? যে  জিনিসকে আমরা সর্বদাই চোখের সামনে দেখতে পাই তাকে তেমন একটা গুরত্ব দেই না এবং তার গুণও পরখ করি না। অথচ সেই জিনিস যখন চোখের সামনে থেকে সরে যায় তখন আমরা তাকে খুঁজে বেড়াই,তার গুণাবলী মনে করার চেষ্টা করি। কাকের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু কাক। আমরা কাককে চিনি তার চৌর্যবৃত্তি ও কা কা করে ডেকে আমাদের কান ঝালাপালা করে দেবার জন্য। এই কুৎসিত পাখিটার গুণের কথা আমরা কেউ জানতে চাই না বা জানবার চেষ্টা করি না। কাককে পরিবেশের সাফাইকর্মচারী বলা হয় কারণ কাক খায় না এমন খাবার নেই। এরা নোংরা আবর্জনা খেয়ে আমাদের পরিবেশকে দূষণ মুক্ত করে। এই কথা তো সবাই জানে।
কিন্তু,কাক যে অসম্ভব পরিবারপ্রেমী পাখী তা আমরা কয়জন জানি ? কাকের মধ্যে দারুণ রকম রোমান্টিসিজম আছে। স্ত্রী ও পুরুষ কাকে বড্ডো ভাব। এরাও একে অপরের সাথে সময় কাটানোর জন্য মানুষের মতো আড়াল ও নিভৃত স্থান খোঁজে। পুরুষ কাকটি ভীষণ ভালোবাসে তার সঙ্গিনীকে। এরা ভালবাসে জোড়ায় থাকতে।  
সাধারণত কাক চার থেকে পাঁচখানা  ডিম পারে। স্ত্রী কাক বাসায় থেকে ডিম ও পরবর্তী সময়ে বাচ্চাদের যত্ন নেয়। পুরুষ কাক পুরো পরিবারের জন্য খাবার নিয়ে আসে।
কি সুন্দর তাই না ? একদম মানুষের মতো। মা বাড়িতে বাচ্চার যত্ন নেন। বাবারা বাড়ির বাইরে গিয়ে উপার্জন করেন। কাকের জোড়ায় যদি একজনের অকাল মৃত্যু হয় তাহলে অন্যটি মনের দুঃখে মৃত্যু পর্যন্ত একাকী বাস করে। অন্য সঙ্গী খুঁজে নেয় না। এরাও ভালোবাসতে জানে।  কি হলো তাহলে ? কাক “সাচ্চা প্রেমিক” কি না বলো ?
সঙ্গীর মৃত্যু হলে এরা সারাজীবন একাকীত্বকে বেছে নেয়। “
কাকের গুণাবলী শুনে আমিও একটু আবেগপ্রবণ হয়ে বললাম,”সোশ্যাল সার্ভিসেও কাকের নাম সবার ওপরে। কাকের বাসায় কোকিল ডিম পেড়ে যায়। কাক সবই বোঝে। কিন্তু কোথাও যেন নিজের সাহায্য করবার স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। নিজের ডিমের সাথে কোকিলের ডিমেরও যত্ন নেয়, তা দেয়। বাচ্চা হলে তাদের না খাইয়ে মেরে ফেলে না।”
আমার মুখে কাকের প্রশংসা শুনে এবার বোধহয় গৌতম একটু খুশি হলো,তাই বেশ নরম সুরে বললো,”ভাবো তাহলে আমরা কাক বিচ্ছিরি দেখতে,নোংরা খায় এগুলোর আগে কিছু জানবার চেষ্টাই করি নি কোনোদিন। অথচ এই কুরূপ পাখিটারও কত গুণ আছে। যার স্পর্শকে আমরা অশুচি বলে জানি সেই পাখিটাই আমাদের জন্য শুচির কাজ করে যায়। কিন্তু আজকাল কাকের সংখ্যাও কমে আসছে।”
বারে গৌতমের কথায় আমার টনক নড়লো। সত্যিই তো,আজ তিনবছর হয়ে গেলো ব্যাঙ্গালোরে শিফট
 করেছি,একদিনও সকালে কা কা তো শুনলাম না এরমধ্যে আকাশের বুকে একটাও কাক চোখে পড়ে নি।  গৌতমকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললো,”মড়া প্রাণীর শরীরের অবশিষ্ট,পচা গলা উচ্ছিষ্ট খেয়ে এরা বাঁচে। এই মড়া প্রাণীর শরীরে নানারকম ওষুধের বিষক্রিয়া থাকে,সেই বিষক্রিয়াযুক্ত মাংস কাক খায়। ফলে তাদেরও মৃত্যু হয়। অন্য আরেকটি কারণ-দ্রুত নগরায়ণের ফলে প্রতিদিনই বহু সংখ্যায় গাছ কাটা পড়ছে,ফলে এরা বাসা বানাবার জায়গা পায় না। যদিও এদের বাসা গুলো মোটেও সুন্দর হয় না দেখতে,শুকনো সরু ডাল,ঘাস, খড়,কাগজের কুচি আর দুনিয়ার এটাসেটা দিয়ে এরা ঘর বানায় এবং ঘরগুলো খুব একটা মজবুতও হয় না। কোনো কারণে ঘর ভেঙে গেলে ডিম নষ্ট হয়ে যায়।”
মন দিয়ে ওর কথা শুনছিলাম,খুব কষ্ট হচ্ছিলো,মানুষ বড়ই স্বার্থপর। নিজেদের বাসস্থান গড়ার জন্য নির্বিবাদে অন্যদের বাসস্থান নষ্ট করতে বিন্দুমাত্র ভেবে দেখিনা। তাই বোধহয় পৃথিবীর আজ এই দুরবস্থা হয়ে চলেছে। একে একে কত প্রাণী,পাখী ও গাছ এই গ্রহ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। এমনকি এতো বড় প্যান্ডেমিক হবার পরেও আমরা চোখে ঠুলি পরে আছি। কবে যে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ হবে আমরা কেউ জানি না।
তাই বললাম,”আমাদের প্রত্যেককেই সতর্ক ও সদয় হতে হবে,তাই না বলো? যেমন আমরা শান্তিতে বেঁচে আছি  ঠিক তেমনি পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী ও গাছেদেরও বাঁচার উপায় করে দিতে হবে।”
“ঠিক তাই। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে না রাখলে আমরাও বাঁচতে পারবো না। তাহলে,কাকের মধ্যেও যে এক সাচ্চা প্রেমিক বাস করে সেটা বুঝলে ম্যাডাম !” বলে গৌতম হাসতে লাগলো।
“সে আর বলতে। এবার থেকে আমি আশেপাশের পশুপাখিদের প্রতি নজর রাখবো। এক থেকে শুরু করি অদূর ভবিষ্যতে অনেক হবে আশা করি। তোমার তোলা কাকের ছবি থাকলে পাঠিও। ছবিতেই কাক দেখে মন ভরাই।”
“যো হুকুম,ম্যাডাম। গুডনাইট।”
“গুডনাইট গুরুজী। ভালো থেকো। পরের বার অন্য কোনো পাখির গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম।”

কাকের ছবি তুলেছেন শ্রী গৌতম রায়। 
*****************************************

অজন্তা প্রবাহিতা
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।

 

 

 

1 Comment

  • Thank you .
    কুলায় ফেরা ম্যাগাজিনে নিজের লেখা দেখতে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে। আরো আরো এগিয়ে চলুক এই কলম যাত্রা। অনেক শুভেচ্ছা।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!