Shadow

মুক্তি – ব্রতী ঘোষ 

PC: meng.ru

মুক্তি

ব্রতী ঘোষ 

রাসেল স্ট্রিটের এই রাস্তায় কতবার যে এসেছি  কিন্তু কখনো আজকের মতো মনে হয় নি তো !! রাস্তাটা কি অসম্ভব সোজা ভাবে চলে গেছে  রাস্তার দুপাশে কার পার্কিংএ সারি দিয়ে অফিসের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে  মাঝে মাঝে হুস হুস করে চলে যাচ্ছে এক একটা গাড়ি  এখানেই উৎপলের অফিস। কতবারই তো এসেছি এই  অফিসে  এরকম অদ্ভূত তো কোনদিন লাগেনি  কতবারই তো নিউ ইয়ার্সের আগের রাতে পার্কস্ট্রীটে রাত কাটাব বলে বায়না করেছি উৎপলের কাছেকিন্তু কিছুতেই এসব কথায় কান দিতো না  বলতো সব লোক দেখানো ! কিছু করার নেইশুধু সারারাত ধরে মদ খেয়ে স্ফুর্তি করাসে আমার দ্বারা হবে না  তার থেকে চলো দীঘা ঘুরে আসি 
ধুর ! এই এক দীঘা অনেকবার গেছি,আর যাবো না 
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে উৎপলের অফিসের গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে জয়িতা খেয়ালই করে নি 
উৎপলের অফিসটা একটা বেসরকারী অফিস মালিক আগরওয়ালজি মানুষ ভালো  উৎপল চলে যাবার এক মাসের মধ্যেই জয়িতাকে চাকরি দিয়েছেন  টাকা পয়সা দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন জয়িতাকে  অফিসের সব মানুষই চেনা ওর  কতবার  তো এসেছে এখানে  উৎপল থাকতেতবে জয়িতা নিজে  চাকরি করবে,তাও আবার উৎপলেরই অফিসে সেকথা স্বপ্নেও ভাবেনি ও।
অফিসে ঢোকার সাথে সাথেই সুকুমার,ওদের অফিস পিওন খুব খাতির করে জয়িতাকে মালিকের ঘরে নিয়ে গেল  আগরওয়াল সাহেব যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে আবার নতুন করে সব কর্মচারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন বার বার বলে দিলেন কোন অসুবিধা হলেই যেন ওনাকে জানায় জয়িতা  সুকোমলদার পাশেই ওর টেবিল  সুকোমল আর উৎপলের সম্পর্ক ছিল একেবারে দাদা ভাইয়ের  দুজনেই দুজনকে না জানিয়ে কোন কাজ করতো না  জয়িতা যে আজ অফিসে জয়েন করছে সেটা সুকোমলদা জানতেন আগেই  উনিই ওর পাশের টেবিলে জয়িতার বসার ব্যবস্থাটা করেছিলেন  চল্লিশ বছরে পৌঁছে আবার যে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে জয়িতা কোনদিনই ভাবেনি 
সন্ধ্যে প্রায় আটটা বাজে  বাড়ি ঢুকতেই পুপে দৌড়ে এলো মা ! তুমি এতো দেরি করলে ?”
হ্যাঁ সোনাআজ বাস পেতে যে এতোটা দেরি হবে বুঝতে পারি নি রে
আমি ম্যাগি করে খেয়েছি 
দেখি দিকে আয়  সোনা মা আমার !”
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দেয় জয়িতার 
বাহ !! খুব ভালো করেছিস সোনা !!”
মা ! তোমার জন্য চা করবো ?”
এই কটা দিনে কত বড়ো হয়ে গেল মেয়েটা কে বলবে মাত্র দশ বছর বয়স ! সত্যি ! উৎপলের চলে যাওয়া এক ধাক্কায় ওদের মা মেয়েকে অনেকটাই বড় করে দিয়েছে  অথচ এক মাস আগেও এই ঘরের ছবিটা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো  উৎপল অফিস থেকে ফিরলে জয়িতা ব্যস্ত হয়ে পড়তো চা জলখাবার নিয়ে  আর আজ অফিস থেকে নিজে ফিরেছেউৎপলের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায় জয়িতা।
হ্যাঁ রেচা খাবো সাবধানে গ্যাস ধরাস মা 
নাহ ! সামনের মাস থেকে একটা রান্নার লোক আর পুপেকে দেখাশোনা করার লোক রাখতে হবেভাবে জয়িতা  কতবার উৎপলকে বলেছে জয়িতা,একটা রান্নার লোক রাখবার জন্য  উৎপল কানেই তুলতো না সব কথা,পাশ কাটিয়ে যেতবলতো,”তোমার হাতের রান্নার স্বাদই আলাদা,এসব কাজ কখনো রাঁধুনি দিয়ে হয়?”
সারাদিনের রান্না খাওয়া,পুপেকে পড়াশোনা করানো,স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা,এই করতে করতেই কোথা দিয়ে যে দিনগুলো চলে যেত! জয়িতার কতো শখ ছিল গান গাইবার  এখন মনে পড়লেও হাসি পায়  বিয়ের পর সব মেয়েদেরই বোধহয় স্বপ্নগুলোকে বাপের বাড়িতে রেখে আসতে হয় জয়িতাও তাই করেছিল  তাই সব কিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু করেছিল সব  কিছু ঠিকই তো ছিল  কিন্তু নতুন বাইক কেনাটা যে এভাবে কাল হবে উৎপলের,ভাবাই যায় নি ! নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ে জয়িতার 
আজকাল রাতে ভালো করে ঘুম আসে না জয়িতার  পুপে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে  এখন কতো রাত  হবে ? হ্যাঁ,তা রাত দুটো তো বটেই। জয়িতার চোখে ঘুম নেই যদিও বিছানায় শুয়ে প্রথমেই ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু এখন আর ঘুম আসছে না রাস্তার আলোটা জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে  ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে কিছু একটা  ওটা কে? উৎপল ? হ্যাঁউৎপলই তো 
উৎপল ! উৎপল ! তুমি এটা কি করলে ? কারুর কথা শুনলে নাএকবারও আমাদের কথা ভাবলে না ? দেখলে তো বাইকই সব শেষ করে দিয়ে গেল ! তুমি আমার একটা কথা শুনতে না বাইক কিনতে কত বারণ করেছিলাম মনে আছে ? কতদিন তোমাকে বলেছি মাইনে পেয়ে অন্তত পাঁচশো টা টাকা আমাকে হাত খরচা দিও তুমি বলতেযা দরকার বলবে এনে দেবো  এনে দিতেও মিথ্যে বলবো না  কিন্তু সব কিছু কি হাত পেতে চাইতে ইচ্ছে করে উৎপল ?
তোমার মনে আছে উৎপল যেদিন সীমা বৌদি কাছ থেকে একটা শাড়ি কিনেছিলাম তোমার অনুমতি না নিয়ে ? বাড়ি ফিরে শাড়ি কেনার কথা শুনে তুমি কি কান্ডটাই না করেছিলে  রাতে খাওনি পর্যন্ত ! শেষে বাধ্য হয়ে আমি শাড়িটা সীমা বৌদিকে ফেরত দিয়ে এসেছিলাম পছন্দ হয় নি বলে  দুদিন বাদেই অবশ্য তোমার পছন্দ মতো একটা শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছিলে কিন্তু বিশ্বাস করো উৎপল সেদিন সারারাত আমি কেঁদেছিলাম,তুমি টের পাও নি তুমি ভেবেছিলে আমি খুব খুশি হয়েছিতাই তুমিও ভালোবেসে সোহাগে আদরে আমাকে ভরিয়ে দিয়েছিলে  কিন্তু জানতে পারো নিঅথবা জানতে চাওনি যে আমারও ইচ্ছে করে নিজের জন্য বা সংসারের জন্য কিছু কিনতে এই টুকু স্বাধীনতাও কি মেয়েদের থাকতে নেই ? সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম পুপেকে নিজের পায়ে দাঁড় করাবোই  একটা শাড়ি কিনতে বা নিজের শখের জিনিস কিনতে ওকে যেন কখনো কারুর কাছে হাত পাততে না হয়  কি? এত কথা কাকে বলছে ? হঠাৎই যেন চমকে ওঠে জয়িতা। কেউ তো নেই  তবে কি এই কথাগুলো উৎপল কে বলতে চেয়েছিল কিন্তু সুযোগ পায়নি ? তবে কি উৎপলকে   ভালবাসতো না ? নানাতাতো নয় তাই যদি হবে তবে উৎপলকে হারিয়ে, এত নিঃসঙ্গ হয়ে গেল কেন ? উৎপল যে ওকে ভালবাসেনি তাও তো নয় যখন যা চেয়েছে তাই কিনে দিয়েছে দুদিন বাদে হলেও ! তাহলে এত হতাশা ক্ষোভ ওর মধ্যে জমা হয়েছিল ?
সকালে গতানুগতিক কাজে ব্যস্ত থাকলেও গতকাল রাতের ঘটনা বা স্বপ্ন জয়িতা কিছুতেই ভুলতে পারছে না  ঘুরে ফিরেই মনে পড়ছে কথাগুলো  এক মাসের মধ্যে এতটা স্বার্থপর হয়ে উঠল ? উৎপল চলে যাওয়ার কষ্টটা ভুলে গেল ? সংসারের জন্য তো উৎপল কম করেনি,ওকে কম ভালবাসেনি তাহলে এসব কেন ভাবছে  ?
আজ না চাইতেও কত কি যে মনে পড়ে যাচ্ছে  সেদিন ছিল পুপের বন্ধু বাবলির  জন্মদিন  হঠাৎ করে দেবিকা ফোন করে পুপে আর ওকে সন্ধ্যেবেলা আসতে বলল  জয়িতা অনেক বাহানা বানাতে চেষ্টা করল না যাবার  যদিও কারণটা আর কিছুই নয়,হঠাৎ করে যে ওরা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবে,কিন্তু হাতে তো কোন টাকা পয়সা নেই 
কি মজা মা !! বাবলিকে কি দেবো গিফট?”
দাঁড়া সোনা ! আজকে মনে হয় যেতে পারব নাতোর বাবার অফিস থেকে ফিরতে দেরী হবে বলে গেছে 
তাতে কি ? মা ! মা চলো ! প্লিজ চলো!”
জানিস তো বাবা আমাকে একটা টাকাও হাতে দেয় না কি করে যাব বল তো ?”
আমি  জানিনাআমি যাব 
কাঁদিস না বাবু 
সেদিন পুপের কান্না দেখে জয়িতার দুই চোখের জল বাঁধ মানেনি  শুধুমাত্র পুপের জন্য নয় নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে,এমন ভাগ্য করে এসেছে যে নিজের ইচ্ছে মত একটা টাকাও খরচ করার ক্ষমতা নেই  মাঝে মাঝে বিধাতা পুরুষের উপরেও বড় অভিমান হয়  মনে আছে সেদিন পাশের বাড়ির মালতি কাকিমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা ধার করে কোনরকমে মান রক্ষা করেছিল,তাও এই যে টাকা ধার করেছিল সেটা উৎপলের সম্মতি নিয়েই  আজ আবার ঘটনাটা মনে পড়ে দুচোখের কোণ টা জ্বালা করে ওঠে 
আচ্ছা কেন এমন করতো উৎপল ? কতদিন জয়িতা বলেছে যে আমাকে অন্তত মাসে পাঁচশ টা টাকা দিও। আচ্ছা বাড়ির কাজের লোককেও তো সবাই মাইনে দেয় আমাকেও না হয় বাড়িতে রান্নার কাজ করার জন্য মাইনে দিও। উৎপল হেসে উড়িয়ে দিতো  আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যতটা মেয়েদের পুরুষ মুখাপেক্ষী করে রাখা যায় ততই ভালো ৷ পুরুষরা লাটাইয়ের সুতো  ততটাই ছাড়ে যতটা তার প্রয়োজন তার বেশি একদম নয় 
দেখতে দেখতে একটা মাস হয়ে গেল জয়িতা চাকরি করছে  আজ মাসের এক তারিখ। বিকেলে চেম্বারে ডেকে বেতনের খামটা জয়িতার হাতে দিলেন আগরওয়ালজি  বারবার জিজ্ঞাসা করলেন ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সত্যি উনি খুব ভাল মানুষ  নিজের টেবিলে বসে জয়িতা খামটা খুলে দেখলো যা আশা করেছিল তার বেশিই ওকে বেতন দেওয়া হয়েছে  আজ বাড়ি ফেরার পথে মাসের বাজারটা করতে হবে  বাড়িতে অনেক কিছুই বাড়ন্ত  বাড়ি ফিরতে রাত আটটা বেজে গেল  এখন বাজার করা,পুপের স্কুলের মাইনে দেওয়া সবকিছুই ওকে সামলাতে হচ্ছে  মাইনের খামটা নিয়ে উৎপলের ছবির সামনে এসে দাঁড়ায় জয়িতা।উৎপলের চোখের দিকে তাকিয়ে ওর দুচোখ জলে ভরে যায় যেন মনে হয় ওই চোখ দিয়ে কত কথাই উৎপল বলে চলেছে 
কি কেমন লাগছে ? এতগুলো টাকা হাতে পেলে ?”
না উৎপল আমি তো এভাবে টাকা পেতে চাই নি আমি চেয়েছিলাম নিজে কিছু রোজগার করতে কিন্তু তুমি কোনদিন আমাকে কিছু করতে দাও নি এমনকি একটা টাকাও আমার হাতে দিতে চাওনি  কোন খরচার জন্য টাকা চাইলে তা দিতে অবশ্য কিন্তু তার হিসাব কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে  কেন উৎপল? কেন ? কেন এমন ভাবে আমাকে বেঁধে রাখতে ? আজ তুমি নেই অথচ দেখো এই টাকাগুলো তোমার না থাকার কষ্ট আমায় ভুলিয়ে দিয়েছে তুমি হয়তো ভাববে আমি কি লোভীটাকা পেয়ে তোমাকে ভুলে গেছি  না গোনাআমি কিছুই ভুলিনি  তোমার ভালবাসাও যেমন ভুলিনি তেমনই ভুলতে পারিনি তোমার এই খাঁচায় বন্দী করে রাখা জীবন স্বাধীনতা সব মেয়েই চায় উৎপলএমনকি সোনার খাঁচায় বন্দী থাকা পাখিটার উড়তে সাধ হয় 
বেশ তো তুমিতো মুক্তি পেয়ে গেছো এবার ওড়ো
না উৎপল ! এতদিনের বাঁধা জীবনের অভ্যাসে ওড়ার ইচ্ছেটা আমার আর নেই তবে মনের জানলাটা যে খোলা রাখতে পারবো এটাই আমার হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নেবার জন্য যথেষ্ট  আর এটাও তো তোমারই জন্যতোমার বাঁধনে আমাকে বেঁধে রেখেছিলে  আবার তুমি  আমাকে মুক্তি দিয়ে গেলে
*****************************************

ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷ এই পত্রিকাতেই তার লেখার পথ চলার শুরু।

3 Comments

  • Chandra Kanti Dutta

    দারুন লিখেছেন। তবে আমার মনে হয়েছে, অন্তর্নিহিত বক্তব্যটা কিছুটা একপেশে। লেখার ভঙ্গিমা কিন্তু অসাধারণ।

  • Surajit Sarkhel.

    খুব উপভোগ্য লেখা।সাংসারিক জীবনে প্রতিটি মানুষের কিছু অব্যক্ত কথা,ব্যথায় জড়ানো অবস্থায় রয়ে যায়! প্রকাশ পায়না!

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!