অথ মানবজমিন চরিত ……….
সুরজিত সরখেল
“চারো তরফ সন্নাটা ছায়ী হুয়ী হ্যায়
বিরান দিলকী দহলিজমে
আসমাঁ রো রহি হ্যায় ……
না মুনাসিব ইস দুনিয়ামে
কুছ ভী নহী হ্যায়
এতবার এ খামোসী মে
চারোতরফ বদলিয়া বরষ রহি হ্যায় ( বহ্নিশিখা)…….
(চারিদিক বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শূন্য হৃদয়ের
অঙ্গনে অসীমও রোদন করছে। অসম্ভবের এই দুনিয়ায়
কিছুই নেই। এই বিশ্বাসের নিস্তব্ধতায় চারিদিক বর্ষার মেঘে ঢাকা পড়েছে)।
বাস্তবিকই চারদিকেই যেন বিষণ্নতার চড়া মেঘে সাধারণ মানুষের জীবন ঢাকা পড়ে গেছে । মুহুর্মুহু এই নাগপাশের বাঁধন আষ্টেপৃষ্ঠে যেন শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে দিচ্ছে বিষাক্ত যন্ত্রণা ! মানুষ যেন হাসতেই ভুলে গেছে । অথচ প্রতিনিয়তই কত হাস্যোজ্জ্বল মুহূর্ত এবং তার সঙ্গে মানানসই কুশীলব চরিত্ররা আমাদের চারপাশে নক্ষত্র খচিত আকাশের মতই বিস্মৃত হয়ে আছে; খুঁজে আমরা দেখি কি? জীবন সায়াহ্নের শেষে এক ” যাই যাই বিকেলে,যখন পূর্ণিমার চাঁদ চারপাশের দিগন্ত প্রান্তর তার স্নিগ্ধ আলোর বিচ্ছুরণে ভাসিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে; ঠিক তখনই মনে হল যে,সেইসব মুহূর্ত এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রঙ্গিন চরিত্রগুলোকে যদি একটা মালায় গেঁথে ফেলতে পারি; তাহলে এই পূর্ণিমার ভরা চাঁদের উপছে পড়া স্নিগ্ধ আলোর মতন নির্মল হাসি সবার মুখে,সমস্ত শরীর জুড়ে হিল্লোল তুলবে; আর শরতের পুজো পুজো গন্ধমাখা মৃদু হাওয়াতে কাশফুলেরা যেমন মাটিতে প্রায় নুয়ে পড়ে,সেভাবেই বিষণ্ন মানুষগুলো চারিদিক কাঁপানো অট্টহাসিতে না হোক,অন্ততপক্ষে মৃদু হাসির ছোঁয়ায় কিছু মুহূর্তকে জীবন্ত করে রাখতে পারবে । লেখা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেইসব চরিত্র ও মুহূর্তগুলো একে একে ধরা দিতে শুরু করল।
২………….
সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবার বছর খানেক আগে নির্মল আর আমি হাতিবাগানের ” সুরুচি” তে তেলেভাজা খেতে যাব বলে মনস্থ করলাম । আমার সহকর্মী নির্মল ভীষণ প্রাণবন্ত ছেলে। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত ঠনঠনিয়া কালীমন্দিরের কাছে থাকত । অফিস পাড়া থেকে হাতিবাগান,এতটা রাস্তা ঠেঙ্গিয়ে শুধুমাত্র তেলেভাজা খেতে যাব,সেরকম পাগল আমরা দুজনের কেউই নই ! আসলে পুজোর বাজার করতে অনেকেই হাতিবাগান যায়। আর সেইসময় প্রচুর মানুষের সমাগম হয় ঐ এলাকায়। টেরিফিক ট্র্যাফিক জ্যাম হয় । নির্মল বলল ,” এখান থেকে হেঁটে আমার বাড়ি দশ মিনিট। চা খেয়ে,সুরুচির তেলেভাজা খেয়ে,বৌদির জন্য পুজোর বাজার করে বাড়ি যাবেন ৷” দিনটা ছিল শনিবার। পুজোর প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে রাস্তার উপরে।চারদিকের দোকান,স্টল গুলোতে মানুষের ভীড়। খোশমেজাজে হাঁটতে হাঁটতে সুরুচির সামনে এসে গেলাম। পুজোর সময় এমনিতেই রাজা মহারাজাদের মতন মেজাজ থাকে । দোকানের সামনে বেশ ভীড়। সামনেই পুজোর প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে । নির্মল গোটা চারেক করে পেঁয়াজি আর ভেজিটেবল চপের অর্ডার করে বিড়ি ধরিয়ে সামনের বেঞ্চে বসল । আমিও পাশে বসে চপের প্রতীক্ষায়। সুরুচির চপ সত্যিই উপাদেয় । কলেজে পড়ার সময় একবার খেয়েছিলাম । বাড়িতে গিয়ে দুটো নেড়ো বিস্কুট আর চা রোজই তো খাই। আজ একটু স্বাদবদল হলে দারুণ ব্যাপার। বাড়ির জন্য তো নেবোই। সত্যিই মনে আনন্দ হচ্ছিল। একটু গুন গুন করে শ্রদ্ধেয় শ্যামল মিত্রের বিখ্যাত গান ” তুমি কি এমনি করে থাকবে দূরে,আমার এ মন মানে না” গাইতে শুরু করেছিলাম,সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে ওপর থেকে একটা গরম কচুরি, আলুর দম ভর্তি শালপাতায় মোড়া ঠোঙ্গা কোলের ওপর এসে আছড়ে পড়ল,তার পরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল! তরকারির ঝোলে জামা কাপড়,শুধু আমাদেরই না,অন্য খদ্দের দেরও গায়ে এসে পড়াতে; যিনি চপ ভাজছিলেন, ভীত স্বরে বলে উঠলেন,” এই রে,আবার শুরু হয়ে গেল ! দাদারা দয়া করে এই শেডের নিচে এসে দাঁড়ান।এক্ষুনি আরো কিছু এসে পড়বে “, বলতে বলতেই প্রথমে একটা স্টীলের থালা,আর তার সঙ্গে একটা বেলুন চাকি উড়ে এসে দড়াম করে টিনের শেডে এসে পড়ে,রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল! প্রথমে আমরা অবাক,আর স্বাভাবিক ভাবেই বেশ রেগে গেলাম। নির্মলের টাকে চুল ” ওরা থাকে ওধারে ” স্টাইলের! তার ওপর একটা ছোট আলুর টুকরো ঝুলছে! আমার সাদা শার্টের কলার থেকে বুক পকেটের ভেতরে আলুর ঝোল টপ টপ করে পড়ছে! একেবারে “সসেমিরা” অবস্থা! আমরা প্রত্যেকেই এই অনভিপ্রেত ঘটনায় যারপরনাই ভীষণ ক্রুদ্ধ! দোকানি ভদ্রলোক যা বললেন, তা শুনে আমাদের চোখ ছানাবড়া! উপরের দোতলায় যে নিঃসন্তান দম্পতি থাকেন,তাদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ব্যাপারে তুমুল অশান্তি লাগে,আর তারপরেই ভদ্রমহিলা জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। ভদ্রলোক উকিল,আর নিরীহ,আর স্ত্রী পদার্থটি তার হাঁটুর বয়সী! এই গরম কচুরিও এই দোকানের! একটু আগেই ওদের একমাত্র কাজের মেয়েটি এই কচুরির ঠোঙ্গা নিয়ে গেছিল । কিন্তু সেই কচুরির কি করুণ পরিণতি! দোকানদার ভদ্রলোকের করুণ দৃষ্টি মাঝে মাঝে এই ঠোঙা়র ওপরে এসে পড়ছিল ! আমরা যে কজন ওখানে ছিলাম,তারা এর একটা বিহিত করা দরকার ভেবে ওপরে যাবার তোড়জোড় শুরু করলাম । কিন্তু এ ব্যাপারে দোকানদার ভদ্রলোকটির নীরব অভিব্যক্তি দেখে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল! আরো চমক বাকি ছিল। দোতলায় উঠে দেখি,ওনার দরজায় নেমপ্লেটে লেখা আছে ” অ্যাডভোকেট দুলাল পাল,সিটি সিভিল কোর্ট “! বাইরের প্যান্ডেলে তখন তারস্বরে বিদ্রোহী কবি নজরুলের ” লাথি মার, ভাঙরে তালা,যতসব বন্দীশালা…” একেবারে গা গরম করা গান ৩৩ এমপি তে বাজছে। কানে তালা লাগার মতন অবস্থা! আমরা দরজায় নক করতেই একজন মেয়েদের নাইটি পরা পুরুষ মানুষ বেরিয়ে এলেন! আমাদের কারোরই মুখ থেকে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। এটাও আমাদের কাছে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। নির্মলের ক্রুদ্ধ চোখ বিচিত্র মানুষটির সর্বাঙ্গ জরিপ করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভদ্রলোক মিহি গলায় বললেন যে তিনিই দুলাল পাল। আসলে ওনার লুঙ্গিটা নাকি ভিজে, এখনও শুকায়নি! আপনারা ভিতরে আসুন,বলে ভদ্রলোক লজ্জায় হোক,বা ভয়েই হোক,দুদ্দাড় বেগে ঘরের দিকে দৌড় লাগালেন! তবে দ্বিতীয় কারণটাই যে ঠিক,বুঝতে পারলাম,ঘরের ভিতরে এক চাপা বামা কণ্ঠের গর্জনে! ” কতবার করে বলেছি,সায়ার দড়িটা এভাবে গিট্টু মারবে না,আমার নখ ভেঙে যায়; খুলবে কে এখন? নিজের লুঙ্গিটা ক্লিপ দিয়ে আটকেছ,আর আমারটা দড়ির গিট্টু! খুলবে কার বাবার সাধ্যি !কোথায় গেলে? তখন বাইরে মান্না দের গান বাজছে “তুমি আর ডেকোনা,”…. কিন্তু মাইকের দৌলতে মনে হচ্ছে কোন কচি বাচ্চা কাঁদছে! আমরা ভাবছি,কি করতে এখানে এলাম? পুরো মজাটাই মাটি। শুনছি,বামা কণ্ঠের বজ্র নির্ঘোষ “এই অবস্থায় তুমি বাইরে যেতে পারলে!” সেই বিচিত্র মানুষটি কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই ঘরের মধ্যে আর একটা বাসন ভাঙার আওয়াজ পেলাম! নির্মল কে বললাম, ” বাড়ি চল,নির্মল,তেলেভাজা খেতে হবেনা ৷ ” নিচে নেমে আসতেই নির্বিকার মুখ দোকানি,আমাদের হাতে দুটো তেলেভাজা ভর্তি ঠোঙ্গা ধরিয়ে দিল। দাম মিটিয়ে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
এবার আসি নিজেদের বেশির ভাগ সময় বাড়ি ছাড়া যেখানে আমরা,কর্মরতরা কাটাই,সেখানে আমরা বেশ কিছু মজাদার চরিত্র এবং তাদের নিয়ে কাটানো আনন্দে ভরপুর কিছু মুহূর্তের বর্ণনায়। প্রায় প্রত্যেক অফিসেই থাকেন এইসব মজাদার চরিত্রের মানুষগুলো।মজার ব্যাপার হচ্ছে,তাদের নিয়ে যে আনন্দ,ঠাট্টা,মস্করা হচ্ছে,এটা নিজেরাও জানেন এবং তা উপভোগ করেন। সত্যিই,এইসব মানুষগুলোর জন্য আমরা কেউই অফিস দরকার না পড়লে,কামাই করতাম না। এইতো মনে হচ্ছে সেদিনের কথা।দিনটা ছিল সোমবার। অফিসে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার। লেট খেয়ে গেছি। দেখি আমাদের নিরীহ,গোবেচারা অফিসার কালি দার টেবিলের সামনে জটলা। আমাদের অফিসের সবথেকে দুষ্টু বুদ্ধি যার মাথায় সবথেকে বেশি ঘোরাফেরা করে,সেই বাচ্চু( আমরা বিচ্ছু বলি),মোটা সৌম্য,কার্তিক,হারু,বলাই সবাই হাসাহাসি করছে। কালিদা রাগে গজগজ করছেন। ব্যাপারটা হলো রবিবার ছুটির দিন,সৌম্য কালিদার বাড়িতে গিয়ে দেখে কালিদা তার বাচ্চা ছেলে,মেয়ে কে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। বৌদি কালিদাকে ডাকতে যাচ্ছিলেন। সৌম্য বারণ করে ভাল মানুষের মতন চলে আসে বাড়িতে। পরের দিন অফিসে এসে সৌম্য সবাইকে বলে যে,গতকাল ও কালিদার বাড়িতে গিয়ে দেখে যে কালিদা মেয়েছেলে নিয়ে শুয়ে আছে। আসলে,ওর বলবার ধরনটা এতটাই নাটকীয় ছিল,প্রত্যেকেই শুনে হাসতে হাসতে মেঝেতেই বসে পরে আর কি! কালিদা ক্ষেপে গেল। আর একদিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল,কালিদা,কার্তিক কে বললো,অবশ্যই কানে কানে,বারুইপুরের ২ কিলো লিচু নিয়ে আসবার জন্য। নির্দিষ্ট দিনে লিচুও এলো,আর সবার অগোচরে কালি দা,ড্রয়ারে তা রেখে চাবিও দিয়ে দিলেন। লিচুর গন্ধ বিচ্ছুর নাকে এসে ধাক্কা মারায়,ঠিক জায়গায় বিচ্ছু পৌঁছে গিয়ে তার সবখোল চাবি দিয়ে কালি দার ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে ১০/১২ টা বড়,বড় সাইজের লাল লিচু বের করে আবার চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিল। টিফিনের সময়,সবাই যেখানে আড্ডা মারে,সেখানে কালি দাও ছিলেন। প্রত্যেক কে একটা করে লিচু বিচ্ছু দিল। কালি দা হাতে লিচু পেয়ে ধড়মড় করে নিজের টেবিলের দিকে ছুটলেন। আর বিচ্ছুও অফিস থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিরুদ্দেশ! এরপরে শুরু হল কালিদার লম্ফ ঝম্প! আর একদিন,আমাদের সবার হার্ট থ্রব,শিবেন দা,অফিসে সবার আগে এসে বসে থাকেন। সেদিন আমি এসে গেছি,শিবেন দা তখনও আসেননি। আমার উল্টো দিকেই বসেন উনি। প্রায় দৌড়ে অফিসের মধ্যে বিচ্ছু ঢুকলো,আর ঢুকেই আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হেসে,ব্যাগ থেকে ঘুড়ির সুতো বের করে তার মাথায় একটা লোহার আংটার মতন বেঁধে ফেলল। আমাদের অফিসের এক একটা ফ্লোর,সিলিং সবই সাবেকি গড়নের। হেরিটেজ বিল্ডিং। মেঝে থেকে সিলিং প্রায় ১৫/১৬ ফিট হবেই। ওপরে কড়ি বর্গার সিলিং। মোটা মোটা কড়ি বর্গার মধ্যে যেটুকু ফাঁক আছে,তার মধ্যে দিয়ে বিচ্ছু প্রায় পাঁচ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে আংটা ছুড়ে ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে আংটা টা খুলে রেখে ওখানে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে জল ভরে,ব্যাগের মুখটা গার্ডার দিয়ে পেঁচিয়ে বন্ধ করে দিল। তারপরে ব্যাগের সুতোর আরেকটা দিক,উল্টো দিকের স্টোর রুমের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকল। এতক্ষণে আমি বেশ বুঝতে পারছি,কি হতে চলেছে! বিচ্ছু শয়তানি বুদ্ধিতে যেমন তুখোড়,তেমনি যে কোনো খেলাধুলায় ওস্তাদ। একটু পরেই পান চিবোতে চিবোতে শিবেন দা অফিসে ঢুকলো। বাথরুম থেকে হেলতে দুলতে বেরিয়ে নিজের সিটে এসে বসলো। মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রায় সব অফিসেই ভীড় থাকে।একটু পরেই আমাদের অফিসও লোকজনে ভরে গেল। ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরেও মিটিং চলছে। শিবেন দার মাথার ওপরে আজকের পরবর্তী আকর্ষণ ঝুলছে ! কেউ জানে না! এক আমি আর বিচ্ছু ছাড়া। ঠিক বারোটা বাজলো। আর শিবেন দার বারোটা বাজানোর জন্য বিচ্ছু নিজের সিট থেকে উঠে সবার অজান্তে স্টোর রুমে ঢুকে গেল। আমি দেখছি,শিবেন দার মাথার ওপরে ব্যাগটা ধীরে,ধীরে নেমে এল! প্রথমেই ফোঁটা,ফোঁটা জল শিবেন দার টাইপ মেশিনের ওপরে,আর টেবিলের ওপরে পড়ল। শিবেন দার একটু ঝিমুনি এসে গেছিল। সারাদিন তো কোন কাজই করেন না। এরপরে মাথায় বড় বড় জলের ফোঁটা পড়তেই,যেই উনিও পরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছু হাতে ধরা সুতোটা ছেড়ে দিতেই জলে ভরা প্লাস্টিকের ব্যাগ,শিবেন দার মুখের ওপরে এসে আছড়ে পড়ে পুরো চশমা পড়া মুখ,মাথা,জামা,কাপড় সব ভিজিয়ে দিল। বিচ্ছু পগার পার ততক্ষণে ৷ শিবেন দার চিৎকারে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার,সমস্ত লোকজন,শিবেন দার টেবিলে হাজির। সবাই বুঝতে পারছে,কালপ্রিট কে? কোনো প্রমাণ নেই যদিও! ম্যানেজার বাবু,কিছুক্ষণ শিবেন দার হম্বি তম্বি শুনলেন।মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,কে করেছে এটা! আপনি জানেন? দেখেছেন? শিবেন দা ঘাড় নেড়ে না বললেন। আবার,কোনো দিন হয়তো সবাই কাজের মধ্যে আছে;কেউই পেছনে লাগছে না শিবেন দার। আওয়াজ দিতে শুরু করলেন “উরি ব্বাবা”,কি কাজের ধুম,হল কিরে সব!”
সব থেকে মজা হয়েছিল,অফিসের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আমরা সবাই কিছু না কিছু করব। কেউ গাইবে,কেউ আবৃত্তি করবে। শিবেন দাকে আমরা রাজি করালাম অতিকষ্টে। তিনি গাইবেন,কিন্তু সবার শেষে বক্স আর্টিস্টদের মতন। নির্ধারিত দিনে সবাই সেজে গুজে এল। শিবেন দা আসতেই পুরো বিল্ডিং জুড়ে হৈ হৈ! যা একখানা পাঞ্জাবি পরে এসেছেন।অন্যদিনের তুলনায় আজ উনি বেশি গম্ভীর। মাঝে মাঝেই গুন গুন করে রেওয়াজ করছেন। হাতে একটা বড় চাবির গোছা। ওটা বাজিয়ে তাল রাখছেন। শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। সবাই একে একে যে যার মতন গান,কবিতা পাঠ করে গেল। এবার শিবেন দার পালা। আমার ওপরে ভার পড়েছে তদারকি করার। শিবেনদার গানের সঙ্গে কে হারমোনিয়ামে আর তবলায় সঙ্গত করবে,তা ঠিক করে দিয়েছি। শিবেন দা খুব খুশি। প্রথম গানটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক একেবারে কৈ মাছের মতন লাফিয়ে উঠল! শিবেন দা গাইছে,না কাঁদছে বোঝা যাচ্ছেনা! তবে হাতের চাবির গোছার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে! কোন রকমে প্রথম গানটা শেষ করে গম্ভীর ভাবে এক গ্লাস জল খেলেন। তারপরেই শুরু হল “নয়ন ভরা জল গো তোমার”! তবলা মিলছেনা,হারমোনিয়ামে যিনি সহযোগিতা করছিলেন,তিনিও অবাক,কোন স্কেলে বাজছে,কে দেখবে,যিনি গাইছেন,তিনি আর নিজের মধ্যে নেই! একেবারে বাহ্যজ্ঞান শূন্য। ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম,তবলা,সাউন্ড বক্স,অন্য যন্ত্রবাদ্য সব মঞ্চ থেকে অদৃশ্য হলো। সবাই যারা উৎসাহ দিচ্ছিল,তারাও সব এখানে,ওখানে লুকিয়ে পড়ল। শিবেন দা ততক্ষণে চোখ বুজে নজরুলের গানের পরে একটা হিন্দি গানে ঢুকে পড়েছেন! কোন গানের চার লাইন,তো কোন গানের তিন লাইন গেয়েই পরের গান গাইতে শুরু করে দিয়েছেন। কিছুক্ষন পরেই তার খেয়াল হল,যে কেউই তো হাততালি দিচ্ছে না! চোখ যেই খুললেন,দেখলেন,পুরো অফিস ফাঁকা। মঞ্চের অর্ধেক খোলা হয়ে গেছে! খালি চেয়ার আর সামনে একমাত্র শ্রোতা আমাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার! শিবেন দা চিৎকার করে বললেন,”এটা কি হল স্যার!” অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ম্যানেজার বললেন,”শিবেন দা,একটা কথা বলি,আপনি যাই গান না,একটু সুরে গান। আমাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ভদ্রলোকও ভীষণ মজা পেয়েছিলেন সেদিন!”
যাইহোক,এখন সেইসব চরিত্র গুলোর অনেকেই নেই। আছে শুধু স্মৃতিগুলো। মনে পড়লে এখনো মুখে হাসি এসে উপস্থিত হয়। স্মৃতিরাই থেকে যায়;মুহূর্ত গুলো ব্ল্যাক হোলের অদৃশ্য গহ্বরে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেকদিন পরে বিচ্ছু কে দেখলাম। প্রথমে চিনতে পারিনি। এসে জড়িয়ে ধরল। একসঙ্গেই অবসর নিয়েছিলাম দুজনেই। সময়ের পলি চাপা পড়ে ঐরকম দুরন্ত ছেলে,এখন শান্ত,সৌম্য হয়ে গেছে! সময় বোধহয় সবই বদলে দেয়!
******************************************
সুরজিৎ সরখেল পরিচিতি :
১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্ম। ২০১৮ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গীতে একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। সেজমাসী এবং মেজমামা প্রখ্যাত সুরকার স্বর্গীয় হৃদয় রঞ্জন কুশারীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। কলেজ জীবন শুরু হবার পর সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। অফিসে কর্মজীবনের ফাঁকেই শুরু হয় সাহিত্য চর্চা। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।