Shadow

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার শোভাযাত্রার ইতিকথা – অনির্বাণ সাহা 

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার শোভাযাত্রার ইতিকথা

অনির্বাণ সাহা 

সরস্বতী নদীর পূর্বে ও ভাগীরথী নদীর পশ্চিমে অর্থাৎ সরস্বতী ও ভাগীরথী নদীর মধ্যভাগে অবস্থিত এই চন্দননগর। মনে করা হয় ভাগীরথী বা গঙ্গার চাঁদের মত বাঁকের থেকেই এই শহরের নাম হয়ে উঠেছে চন্দননগর। এই শহরের ইতিহাস বহু প্রাচীনকাল থেকেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বহু শক্তি এই শহরে তাদের শাসনকালে আধিপত্য চালিয়েছে, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ বছর এই শহর ছিল ফরাসিদের অধীনে। ফরাসিদের অধীনে থাকাকালীন সময়ে ফরাসিদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মধ্যেও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ও উল্লেখ্য।
চন্দননগর শহরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলনের  সঠিক তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা কিছুটা গৃহীত সত্য এবং কিছুটা লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো চতুর্দশ শতকে মহোমহোপাধ্যায় শূলপাণি লিখিত “ব্রতকালবিবেক” গ্রন্থে, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বৃহস্পতি রায় মুকুটের লিখিত “স্মৃতিরত্ন হার” গ্রন্থে, শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণি কর্তৃক রচিত “কৃত্যন্তত্ত্বার্নব” গ্রন্থে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পূজার তিথি এবং প্রচলনের পূঁথিগত প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সকল তথ্য পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭২৮-১৭৮১) সময়কালের প্রায় ৪০০ বছর আগেও বাংলার বুকে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন ছিল। অন্তরা মুখার্জি কর্তৃক সংকলিত “Chandernagore mon amour : The Citadel of the Moon” নামক বইটিতে প্রকাশিত পূর্বা চ্যাটার্জীর লেখা “জগদ্ধাত্রী পূজা : ঔপনিবেশিক পুরাণকথা” নামক প্রবন্ধটি থেকে জানা যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চম উত্তরপুরুষ মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের (১৮১৯-১৮৫৭) সময়কার কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান তথা বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় মহাশয় (১৮২০-১৮৮৫) কর্তৃক রচিত “ক্ষিতিশ বংশাবলী চরিত” (১৮৭৫) গ্রন্থে তিনি বলেছেন “রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় জগদ্ধাত্রী ও অন্নপূর্ণা পূজা প্রচলন করেন”। এখান থেকেই ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত ঘটে। কারণ পূর্বের তথ্যগুলি পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজার পুনঃপ্রচলন ঘটানো হয় ১৭৬২ সালে। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবক্তা হলেন তৎকালীন ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী । কিন্তু কিছু তথ্য বিচার বিবেচনা করলে এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মারা যান ১৭৫৬ সালে। ড: বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত “জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ” বইটি থেকে ও ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দাদা রাজারাম চৌধুরীর বংশের  পুত্রবধূ শ্রীমতি মাধুরী চৌধুরীর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই শহরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন ১৭৬২ সালে। তাহলে একজন মৃত ব্যক্তি তার মৃত্যুর ৬ বছর পর কি করে একটি শহরের পূজার প্রচলন করতে পারেন ? এই প্রশ্নটা আজও রয়ে গেছে। আবার ড: বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত “জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ” বইটি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক দেওয়ান দাতারাম সুর চন্দননগরের অন্তর্গত গৌরহাটি অঞ্চলে তার বিধবা কন্যার বাড়িতে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন ১৭৬২ সালে। যা ছিল চন্দননগরের প্রথম পারিবারিক জগদ্ধাত্রী পূজা। আবার চন্দননগরের চাউলপট্টি অঞ্চলে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী জানতে পারা যায় যে, এই অঞ্চলের তৎকালীন চালের ব্যবসায়ীরাই (কিছুজনের মতে কৃষ্ণনগরের চাল ব্যবসায়ীরা একবার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কৃষ্ণনগরে ফিরতে না পেরে এখানকার ফরাসি সরকারের অনুমতি নিয়ে চাউলপট্টিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন) এখানে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। আবার চন্দননগরের “আদি মা” হিসেবে খ্যাত চাউলপট্টি জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটি তাদের পূজার বর্ষ ৩০০ বছর বলে উল্লেখ করেন, যার অর্থ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর অনেক আগেই চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হয়েছে। যে তথ্যটিও সঠিক নয়। তাহলে উপরিউক্ত আলোচনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবক্তা ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী নয়। বরং কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক দেওয়ান দাতারাম সুর এবং চন্দননগর শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার বয়স ২৫৯ বছর ।
চন্দননগর শহরের এক ইতিহাস অনুসন্ধানী অভিজিৎ সিংহ রায়ের মহাশয়ের লেখা একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, James Darmesteter নামক এক ফরাসি লেখক তাঁর বইতে আঠারো শতকের আশির দশকে উল্লেখ করেন যে, এই শহরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি করতে মোট ১১ টাকা এবং এই বিশাল আকার মূর্তিকে অলংকার দিয়ে সুসজ্জিত করতে মোট ১১০ টাকা খরচ হতো। যা তৎকালীন সময়ে যথেষ্ট ব্যয়বহুল বলেই মনে করা হতো। বর্তমানে এই খরচ প্রায় লক্ষাধিক।
এই শহরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন,এই পূজার শোভাযাত্রা আজ বিশ্ববন্দিত এবং এক আলোচিত ঘটনা। এই শোভা যাত্রার ইতিহাসও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান যে, চন্দননগর শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা শুরু হয় মোটামুটি ১৮ শতকের মধ্যভাগে বা তার কিছু আগে। ১৮৫৪ সালে রেলপথ চালু হওয়ার পর এই শহরের জগদ্ধাত্রী পূজা এবং নিরঞ্জন শোভাযাত্রা দেখতে বাইরে থেকে বহু মানুষ আসতো। ফলস্বরূপ এই শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার সমৃদ্ধি ও জৌলুস অনেক বেড়ে যায়। জনসমাগম বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূজাকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন স্থানে ওই চার দিনের জন্য গড়ে উঠতে থাকে ছোট-বড় বিভিন্ন স্টল। অর্থনৈতিকভাবে শহরের পূজা কমিটিগুলি কিছুটা হলেও লাভবান হতে থাকে। যার প্রভাব ধীরে ধীরে প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রাতেও প্রতিফলিত হতে শুরু করে। “চন্দননগর হেরিটেজের” ডিরেক্টর শ্রীযুক্ত কল্যাণ চক্রবর্তী মহাশয়ের থেকে জানা যায় যে, এই শহরে ১৯০০-১৯০৫ সালের অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কিছু আগে, তার জৌলুস বিশেষভাবে প্রতিফলিত করে। তৎকালীন সময়ে সারা শহরে পুজোর সংখ্যাও ছিল সীমিত তার মধ্যে আরও কম সংখ্যক পূজা কমিটি এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করত। সেই সময় জগদ্ধাত্রী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিকে কাঁধে করে সারা শহর ঘোরানো হত। প্রতিমাকে কাঁধে বহন করার জন্য বাহকরা আসত গঙ্গার ওপার থেকে। এই বাহকরা মূলত জুটমিল বা ইটভাটার শ্রমিক বা মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ হতো। তবে পরবর্তী কালে সরাসরি কাঁধে নেওয়ার বদলে আসে বাঁশের খাঁচা। শোভাযাত্রার দিন প্রতিমা নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার সময় রাস্তার দু’ধারে বা বাড়ির ছাদে মহিলারা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং বাহকরা “ভেলে লেগে যা … ভেলে লেগে যা …” বলে আওয়াজ করত। আর সেই আওয়াজ শোনা মাত্র ফুল ছড়িয়ে মাকে বরণ করা হতো। সেই ফুল ছড়িয়ে পড়ে রাস্তাগুলো হয়ে উঠত পুষ্পরঞ্জিত। সে দৃশ্য এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটাত। আবার অনেকে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া ফুল মায়ের আশীর্বাদ স্বরূপ নিজেরা সংগ্রহ করে সারা বছর বাড়িতে রেখে দিত। তারও পরবর্তী সময় ট্রলি এবং বর্তমানে বড় বড় লরি করে জগদ্ধাত্রী মায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমা সারারাত ধরে শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়।
রাতের এই শোভাযাত্রার প্রাথমিক পর্বে  আলোর অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে পিতলের গামলায় ঘুঁটের আগুন জ্বালিয়ে সেগুলি মাথায় বা হাতে করে প্রতিমার আগে আগে সারিবদ্ধ ভাবে যাওয়া হতো। দিন পরিবর্তনের সাথে সাথে বাঁশের মাথায় কাপড় লাগিয়ে কেরোসিনে ভিজিয়ে মশালের মত করে জ্বালিয়ে শোভাযাত্রায় আলোর জন্য ব্যবহার করা হতো। এই মশাল মূলত তৎকালীন জমিদারদের পাইকদের হাতে ও কাঁধে থাকতো, তারাই সারারাত প্রতিমার সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করতো। মশালের আলোর পরে শোভাযাত্রায় আলোর অভাব পূরণ করতে ব্যবহার করা হতো পেট্রোম্যাক্স আর তার পরবর্তী সময়ে অ্যাসিটিলিন গ্যাস ও ডেলাইটের আলো। তবে এই শোভাযাত্রায় এই দুই ধরনের আলোর ব্যবহার খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অ্যাসিটিলিন ও ডেলাইটের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে এলে শোভাযাত্রার আলোক সজ্জায় প্রচলন ঘটে হ্যাজাকের। এই হ্যাজাক বাহকরাও শুধুমাত্র এই অনুষ্ঠানের জন্য উড়িষ্যা থেকে আসতো কিছু পয়সা উপার্জনের উদ্দেশ্যে। প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকে একটি করে ও তার পরবর্তী ক্ষেত্রে বাঁশের খাঁচা তৈরি করে তাতে হ্যাজাকগুলিকে বেঁধে সেই খাঁচাটিতে বাহকরা কাঁধে করে নিয়ে সারারাত ধরে শহর প্রদক্ষিণ করত। সেই যুগের শোভাযাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রীযুক্ত সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন : “সন্ধ্যার পর গ্যাসের আলোয় সজ্জিত হইয়া প্রতিমাগুলি স্ট্র্যান্ড রোডের বারদোয়ারীতলায় সমবেত হইত এবং বাহকেরা নিজ নিজ প্রতিমাগুলি ঘুরাইত এবং নাচাইত”। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এই শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার শোভাযাত্রার আলোকসজ্জাও পরিবর্তিত হতে শুরু করে। চন্দননগর শহরে বিদ্যুতের প্রচলন হয় ১৯২৪ সালে। আর জগদ্ধাত্রী পুজোর মন্ডপে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। তারই সূত্র ধরে ১৯৪৮ সালের জগদ্ধাত্রী পূজার শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক টিউবের আলো। এই টিউবগুলো মূলত হত হল্যান্ড ফিলিপসের টিউব যা তৎকালীন সময় যথেষ্ট মূল্যবান। প্রাথমিক পর্বে টিউবগুলিকে হাতে বা কাঁধে বহন করা হলেও খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাঁশের খাঁচা করে শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা হতো। সেই সময় শোভাযাত্রায় প্রতিমাকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো ২০০ওয়াটের ল্যাম্প। তাতে জড়ানো থাকতো রঙিন কাগজ। এই রঙিন আলো শোভাযাত্রায় মাতৃ প্রতিমাকে করে তুলত অপরূপা। অনেক সময় শুধু প্রতিমাই নয় শোভাযাত্রায় আলোকসজ্জার জন্য বাহকদের হাতে থাকতো এই ল্যাম্প। তৎকালীন সময়ে এই টিউব এবং ল্যাম্পের বৈদ্যুতিক সংযোগ ঘটাতেন শহরের আলোক শিল্পীরা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রভাস কুন্ডু, দেবেন সরকার, শ্রীধর দাস, বাবু পাল প্রমুখ। কয়েক দশক কেটে যাওয়ার পর ১৯৭৮-৮০ থেকে শুরু হয় ৬.২ টুনি বাল্বের কাজ। চন্দননগরের চারমন্দিরতলা জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটি শহরের বুকে প্রথম ৬.২ টুনি বাল্বের কাজ শোভাযাত্রায় প্রচলন করে । তখন ট্রলিতে বা লরিতে বাঁশের খাঁচা করে ৬.২ টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো হতো। এছাড়াও নির্দিষ্ট স্ট্রাকচারে টুনি বাল্বগুলো সারিবদ্ধ ভাবে লাগিয়ে শোভাযাত্রায় প্রতিমার সামনে নিয়ে যাওয়া হতো। এই টুনি বাল্বের আলো হতো সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল। যা বহু মানুষকে শোভাযাত্রার প্রতি আরও বেশি করে আকর্ষিত করেছে। কিন্তু এই টুনি বাল্ব জ্বলার সময় খুব বেশি উত্তপ্ত হত ও তাপ বিকিরিত করত ফলস্বরূপ এই বাল্বের খুব কাছাকাছি যাওয়া যেত না। ঠিক দুই দশক পর ২০০৩ সালে ব্যাটারি চালিত এল.ই.ডি. আলো পুনরায় সেই চারমন্দিরতলা জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটি কর্তৃক জগদ্ধাত্রী পূজার শোভাযাত্রা প্রথম ব্যবহৃত হয়। আলোকসজ্জার এই মিনিয়েচার কলাকৌশল এই শহরের নিজস্ব সম্পদ। বর্তমানে এল.ই.ডি.-এর মাধ্যমে জগদ্ধাত্রী পূজার চারদিনের আলোকসজ্জায় এবং শোভাযাত্রায় সারাবছরের দেশী-বিদেশী বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীকে প্রদর্শন করানো হয়।
চন্দননগর ও পার্শ্ববর্তী চুঁচুড়া শহর বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল। তারই সূত্র ধরে এই সংস্কৃতির বেশ কিছুটা প্রভাব জগদ্ধাত্রী পুজোর নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় পড়েছিল। শুধুমাত্র আলোকসজ্জায় নয় এই শোভাযাত্রায় বিভিন্ন রকমের সং ও থাকতো মানুষের মনোরঞ্জন ও শোভাযাত্রার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। তৎকালীন সময়ে সং শিল্পীরা বিভিন্ন সাজে নিজেদের সজ্জিত করে সারারাত প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় তাদের কলাকৌশল প্রদর্শন করত। এইসময়ে এই সং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী, আঞ্চলিক কাহিনী, সাময়িক কিছু ঘটনা উঠে আসতো মানুষের সামনে যা তৎকালীন সময়ে শোভাযাত্রার এক নিরবিচ্ছিন্ন অংশ ছিল। এই সংশিল্প  সেই সময়ের চুঁচুড়া শহরে বিখ্যাত ছিল। মূলত এই শহর থেকে সংশিল্পীরা তাদের কলা-কৌশল প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়ে আসত। দিন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই সংশিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে, অবশেষে প্রায় বিলুপ্ত হয়।
শোভাযাত্রায় আলোকসজ্জা এবং সংশিল্পের সঙ্গে থাকতো ঢাকের বাদ্যি, কীর্তন ও ধুনুচি নাচ। ঢাকের গগন বিদারী তীব্র আওয়াজে সারা শহর সারারাত জাগত প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রার সঙ্গে,  মাকে শেষ বারের জন্য বিদায় জানানোর উদ্দেশ্যে। নিজ নিজ প্রতিমার সামনে সারিবদ্ধ ভাবে প্রতিটি দল থাকত এবং নিজেদের কলা-কৌশল প্রদর্শনের মাধ্যমে শোভাযাত্রাকে এক আলাদা উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেত। পুরনো সৌন্দর্যকে ও রীতিনীতিকে ফিরিয়ে এনে বর্তমানেও বেশকিছু পুজো কমিটি তাদের জগদ্ধাত্রী পূজার নিরঞ্জন শোভাযাত্রায় সং এবং কীর্তনের ব্যবহার করেন। বারোয়ারি পূজা কমিটি গুলি বর্তমানেও শোভাযাত্রায় ঢাকের ব্যবহার করে থাকে, এছাড়াও অনেকে ক্লাবব্যান্ডের ব্যবহার করে থাকে।
আরো একটি তথ্য না বললে শোভাযাত্রার ইতিকথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেটি হল প্রাথমিক পর্বে চন্দননগর শহরের গুটিকয়েক বারোয়ারিই এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করত । চন্দননগর শহরের ক্ষেত্রসমীক্ষক এবং শান্তিনিকেতনের আদলে এই শহরের বুকে “বসন্ত উৎসবের” প্রণেতা শ্রীযুক্ত অজিত মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের থেকে জানা যায় যে, সেই সময়কার শোভাযাত্রা তালডাঙ্গা অঞ্চল থেকে জি টি রোড দিয়ে বর্তমানের লিচুতলা অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু জি টি রোড থেকে লিচুতলা ও বেশোহাটা মুখের মোড়টি খুবই সংকীর্ণ হওয়ায়, আলো এবং প্রতিমা নিয়ে ঘুরতে খুবই অসুবিধা হতো। সেই কারণে আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর পূর্বে “চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পূজা কেন্দ্রীয় কমিটির” সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে এই শোভাযাত্রার পথ কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। লিচুতলার পরিবর্তে বারোয়ারীগুলি তাদের আলোকসজ্জা ও প্রতিমা নিয়ে জি টি রোড থেকে জ্যোতির মোড় দিয়ে ঘুরে কবি ভারতচন্দ্র রাস্তা দিয়ে তালডাঙ্গার দিকে এগোতে থাকে।
এই শহরের বুকে প্রথমে বারোয়ারি পুজো গড়ে উঠেছে তার নিজস্ব ছন্দে। প্রথমে চন্দননগরের চাউলপট্টি ও তার অনেক পরে ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলা ইত্যাদি পুজোগুলিকে কেন্দ্র করে বড় বড় মূর্তির প্রচলন শুরু হয়, পরবর্তীতে সুসজ্জিত প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে এই শোভাযাত্রা ছিল বিচ্ছিন্ন। রেললাইন চালু হওয়ার পর বাইরে থেকে আগত দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তেমনি শোভাযাত্রায় এক সক্রিয় অংশ বাইরে থেকে আসতে শুরু করে কিছু রোজগারের আশায় । অনেকে আবার আসেন তাদের বিভিন্ন প্রসার ও প্রচারের জন্য। ফলস্বরূপ বারোয়ারীগুলির মধ্যেও ধীরে ধীরে একটা প্রতিযোগিতার ভাব লক্ষ্য করা যায়  যা শোভাযাত্রার জৌলুসকে প্রভাবিত করে । জগদ্ধাত্রীর শহর চন্দননগরের এই শোভাযাত্রা একটা চলমান মেলার রূপ নেয়। শোভাযাত্রার আলোর বিবর্তন হয়। অন্যান্য বিষয়বস্তুর মধ্যে বাজনা, সংসহ বেশকিছু রীতিনীতিরও পরিবর্তন ঘটে। ফলস্বরূপ শোভাযাত্রার রূপ পালটে যায়, বদলে যায় বিষয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটে আধুনিকতার।
চন্দননগরের এই ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৫৬ সালে গড়ে ওঠে “চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পূজা কেন্দ্রীয় কমিটি”। চন্দননগর স্বাধীন হবার পর বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে শোভাযাত্রাও একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসে কেন্দ্রীয় কমিটির সমবেত উদ্যোগের ফলে। প্রারম্ভিক পর্বে চন্দননগর থেকে ১৮টি এবং পার্শ্ববর্তী ভদ্রেশ্বর থেকে ৪টি পূজা কমিটি এই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। বর্তমানে ১৭১টি পূজা কমিটি সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রীয় কমিটির সুপরিকল্পনায় ও পরিচালনায় চারদিন ধরে শহরের বুকে দেবী হৈমন্তীকার আরাধনা ও নিরঞ্জন শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্র :
— জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ – অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
— চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী – কল্যাণ চক্রবর্তী ও লিপিকা ঘোষ।
— Chandernagore mon amour : The Citadel of the Moon” – Edited by Antara Mukherjee.
— চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটির ৬৬-তম বর্ষের একটি ক্রোড়পত্র।
— চন্দননগর শহরের এক ইতিহাস অনুসন্ধানী শ্রীযুক্ত অভিজিৎ সিংহ রায় মহাশয়ের একটি প্রতিবেদন।
— অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতায় মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
— “চন্দননগর হেরিটেজের” ডিরেক্টর শ্রীযুক্ত কল্যাণ চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতায় মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
— চন্দননগর শহরের ইতিহাস অনুসন্ধানী, লেখক শ্রীযুক্ত শুভ্রাংশু কুমার রায় মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতায়
ধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
— চন্দননগর শহরের ক্ষেত্রসমীক্ষক এবং শান্তিনিকেতনের আদলে এই শহরের বুকে “বসন্ত উৎসবের” প্রণেতা
শ্রীযুক্ত অজিত মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতায় মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
— ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দাদা রাজারাম চৌধুরী পরিবারের বর্তমান পুত্রবধূ শ্রীমতি মাধুরী চৌধুরী মহাশয়ার সাথে
আলাপচারিতায় মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
— চারমন্দিরতলা জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটির এক সদস্যের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
— তেমাথা শিবতলা জগদ্ধাত্রী পূজা সমিতির এক সদস্যের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
*************************************

অনির্বাণ সাহা

(ক্ষেত্রসমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক)

 

 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!