Shadow

শারদ যামিনী – কল্যানী মিত্র ঘোষ

শারদ যামিনী 

কল্যানী মিত্র ঘোষ

পিয়া : একি,আবার তুমি স্কুলের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছ? কতবার তোমাকে বলেছি যে আমাকে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় কোনো দিদিমণি দেখে ফেললে আমার গার্জিয়ান কল হবে। কেন এরকম করো? সামনে আমার টেস্ট, এই সময় বাড়িতে অশান্তি হলে কি হবে ভাবতে পেরেছো?
বাবুয়া : কি আর হবে,সোজা আমার বাড়ি নিয়ে চলে যাবো তোকে, মা তো সব জানেই, শুধু বাবাকেই যা একটু …
পিয়া : লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিয়েছ,সারাক্ষণ হয় মাঠে ফুটবল খেলছ আর নইলে পাড়ার মোড়ে আড্ডা। আচ্ছা,একটুও কি সিরিয়াস হবে না? আমার মা বাবা কি দেখে এই সম্পর্কটা মেনে নেবে শুনি?
বাবুয়া: সব ঠিক হয়ে যাবে বস্,তুই খালি আমাকে লেঙ্গি মারিস না। ওই জি ব্লকের আকাশ দেখি হেব্বি তোকে ঝারি মারে। মানে আমাকে একবার কাটাতে পারলেই ও তোর পায়ে এসে ডাইভ দেবে দেখে নিস।
পিয়া: হিংসে হচ্ছে?
বাবুয়া: এই তোর ব্যাগ টা কি ভারী,দে আমাকে দে,এতটা হাঁটা …
পিয়া : ওটাই বাকি আছে। তোমাকে দিয়ে মাল বওয়াবো।
বাবুয়া: তো কি হয়েছে? তোর কষ্ট হচ্ছে,দেখতে পাচ্ছি হাঁপাচ্ছিস!
পিয়া: এই সরে এসো শিগগীর,ওই ও ফুটে সমর কাকু আসছে,সন্ধ্যেবেলায় বাবার সঙ্গে লাইব্রেরীতে আড্ডা মারবে আর সব বলে দেবে। তুমি জোরে জোরে হেঁটে এগিয়ে যাও। উফ্,আমি আর পারিনা,সারাক্ষণ বুক ধক ধক করে।
বাবুয়া: তুই একটা আস্ত ভীতুর ডিম। একটু সাহস আন্ না মনে!
পিয়া: আমি অত হিন্দী সিনেমা দেখিনা। যাও এগিয়ে যাও বলছি।
পিয়া পাশের একটা দোকানের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
বাবুয়া : ও সমর কাকু,এদিকে কোথায়?
কাকু: আরে বাবুয়া! তুমি এই বিকেল বেলায় এখানে কি করছ? উচ্চ মাধ্যমিক এসে গেল তো!
বাবুয়া: কাকু! পুজোও তো এসে গেল,পড়ায় মন বসছে না। আচ্ছা চলি কাকু।
পিয়া দোকানের আড়াল থেকে বেরিয়ে হাঁটা দেয় ঊর্ধ্বশ্বাসে,বাবুয়া কে আর দেখতে পায়না,যাক বাবা নিশ্চিন্ত। আরও পাঁচ মিনিট হাঁটার পর পঞ্চানন তলার গলিতে ঢুকতে পারে,বেশ নিরিবিলি রাস্তাটা। অনেকটা দূরে পাড়ার মুখে প্যান্ডেলের শেষ কাজটুকু চলছে। আর তিনদিন পরেই ঠাকুর এসে যাবে। বাতাসে পুজোর গন্ধ,এই সময়টা মনটা বড্ড খুশী খুশী লাগে। সব সময় বাবুয়া দা কে কাছে পেতে ইচ্ছে করে,অথচ ও সামনে এলেই মনে হয় যেন ও চলে গেলেই ভালো হয়। নিজেকে ঠিক বুঝতে পারেনা পিয়া। ওর ক্লাস টেনের বন্ধুরা অনেকেই প্রেম করছে,কিন্তু ও নিজে কি করছে সেটাই এখনও পরিষ্কার নয়। নিজেকে বাবুয়াদার বউ হিসেবে কল্পনা করতে বেশ হাসি পায়,আবার বাবুয়াদা কে দু দিন না দেখলেও চোখে অন্ধকার দেখে। সন্ধ্যেবেলা পিয়া সবে অঙ্ক নিয়ে বসেছে এমন সময় কলিং বেল টা বেজে উঠলো। বাবা খুলে দিতেই ড্রইং রুমে হই চই। বাবুয়া দা আর উত্তম দা,একসঙ্গে,
“কাকু আপনাদের বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে টুনি বাল্বগুলো ঝোলানো হবে প্রতিবারের মতন,অসুবিধা নেই তো?”
বাবা: না না,ক টা তো মোটে দিন,কিন্তু মাইক টা একটু কম করিস বাবা,প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়।
ওরা চলে গেছে তবুও পিয়ার বুক ধড়ফড় থামছে না,কি দরকার ছিল বাবুয়াদার আসার? আর কেউ ছিলোনা ক্লাবের? খুব বকে দিতে হবে। হুড়মুড় করে পঞ্চমীর রাত এসে পড়লো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে পিয়া বুঝতে পারলো মা দুর্গা মন্ডপে প্রবেশ করলেন। এই কদিন ঘরে ঘরে শুধু আনন্দ আর ভালোবাসা ভরে থাকবে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার ঘুমিয়ে পড়লো পিয়া।
ভোরবেলায় মাইকে বাজছে,
“আধেক ঘুমে নয়ন চুমে …”
পিয়া ভাবে,একি এ তো আমার প্রিয় গান,তবে কি বাবুয়া দা এতো সকালেই প্যান্ডেলে? ও তো জানে আমার সব পছন্দ,অপছন্দের কথা।  তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে বারান্দায় উঁকি দিতেই চোখাচোখি বাবুয়া দার সঙ্গে,উফ্ এমন করে তাকায় না! কান টা গরম হয়ে যায় পিয়ার,আর গালে নিশ্চই রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। এই এক বিপদ তার,মনের ভাব লুকোতে চাইলেও সম্ভব হয় না। ছুট্টে ভেতরে চলে আসতে গিয়ে অনুভব করে একজোড়া চোখ চুম্বকের মতো তাকে অনুসরণ করছে।
ষষ্ঠীর সন্ধ্যে,পিয়া একটু বান্ধবীদের সঙ্গে বেরোবে,প্ল্যান আছে। টুসকি দের গাড়ি ওকে আর সিমি কে তুলে নেবে,কাছাকাছি কটা ঠাকুর দেখে রাত দশটার মধ্যেই ওরা ফিরে আসবে। পিয়া পরেছে একটা লং ড্রেস পীচ ফলের রং,হাই হিল জুতো,পিঠ অবধি ঢেউ খেলানো চুল,মুখে হাল্কা প্রসাধনী,কানে বেশ বড় সাইজের রিং। বাড়ির সামনে গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই,
“মা আসছিইই..”,বলে তিন চারটে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে নীচে নেমে যায় পিয়া। গাড়িতে ওঠার সময় খেয়াল করেনা যে প্যান্ডেলের ভেতর থেকে বাবুয়া তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে।
তিন বন্ধু দারুণ মজায় ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে টুকটাক মুখ ও চালায়,এগ রোল আর কোল্ড ড্রিংক। টুসকির ড্রাইভার কাকু কিন্তু ওদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। বাবু বাগানের ঠাকুর দেখে ওদের আর আশ মেটেনা। কি অপূর্ব প্যান্ডেল সজ্জা আর তেমনই মায়ের মূর্তি। বিভিন্ন পোজে তিন বন্ধু ছবি তোলে। তিনজনকেই পরীর মতো সুন্দর লাগছে। দেখতে দেখতে সাড়ে নটা বেজে গেলো,রাস্তায় এবার মানুষের ঢল নেমেছে,ঝলমলে পোশাক পরা বিভিন্ন বয়সী মানুষ আনন্দের সাগরে গা ভাসিয়েছে। ড্রাইভার কাকু ওদের তাড়া দিয়ে গাড়ীতে তুলে নিলেন। ঠিক দশটার একটু আগেই পিয়ার বাড়ির কিছুটা আগে গাড়ি টা থামলো,কারণ ইতিমধ্যে ওদের পাড়ার ঠাকুর দেখার জন্য বেশ ভালোই ভিড় হয়ে গিয়েছে। পিয়া বলল বাকি পথটুকু হেঁটেই চলে যাবে,চারিদিক আলোয় আলো,তাই ভয়ের কিছুই নেই। বন্ধুদের বাই বলে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরেই বাবুয়া দা কে দেখতে পায়,ওর দিকেই আসছে। খুব কাছাকাছি এসে মৃদুস্বরে বলে,
“কোথায় গেছিলি বিকেল থেকে? আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোর জন্য। একটু এদিক টা আয়। “পিয়া ইতস্ততঃ করতে থাকে,
“কোথায় ? না গো রাত হয়ে গেছে,বাড়ি যেতে হবে। কেউ দেখে ফেলবে!”
“উফ্,সেই এক কথা,সবাই আমাদের দেখবে বলে হাঁ করে বসে আছে,নাকি? আয় বলছি,ওই ওদিক টায় চল,একটু আড়াল রয়েছে।”
খুব রেগে গিয়ে বলে বাবুয়া।
পিয়াও বাধ্য মেয়ের মতো গুটি গুটি ওকে অনুসরণ করে। কি বলবে রে বাবা! পবনের পান গুমটি র ঝাঁপ বন্ধ,পুজোর আলোর নরম ছায়া গুমটির পিছন দিকটা মায়াবী করে তুলেছে। সেইখানে বাবুয়া অন্য মানুষ হয়ে যায়,এখন আর সে ওই ছটফটে পাগলাটে বাবুয়া নয়,গলার স্বর গাঢ়,পিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। পিয়া চোখ নামিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলতে পারেনা,তারপর বাবুয়া বলে,
“চোখ টা বন্ধ কর।”পিয়া সভয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“বলছি তাই।”
“না আমার ভয় করে।”
“তুই কি কখনোই আমাকে বিশ্বাস করবি না? প্লীজ চোখটা বন্ধ কর।”
গলার স্বরে কি যেন জাদু মাখানো,মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ বুঁজে ফেলে পিয়া,আর অমনি ওর মনের ভেতর নিকষ কালো অন্ধকার দেয়ালে একটাই মুখ ভেসে ওঠে,বাবুয়া দা! নিবিড় করে, একান্ত নিজের করে তাকে অনুভব করে পিয়া। মনে হচ্ছে নিজের থেকেও সে বাবুয়া দা কেই বেশী বিশ্বাস করে,ও যা খুশী দুষ্টুমি করুক এখন,পিয়া কিচ্ছু মনে করবে না। অপেক্ষায় থাকে পিয়া। হঠাৎ অনুভব করে চুলের পেছনে বাবুয়া দার হাতের আলতো স্পর্শ,আর তারপরই,
“নে, এবার তাকা।”
“ওমা,কি?? কি এটা? এটাতো একটা হার,ওহ মাই গড,সো প্রিটি!! পেন্ডেন্ট টা সোনার নাকি? ইশ কেন দামী জিনিস কিনেছ? কি যে করোনা!”
“বেশ করেছি। পুজোয় আমার ভালোবাসার মানুষ কে আমার টিউশনির টাকা জমিয়ে,অন্যান্য সেভিংস ভেঙে যা ইচ্ছে করেছে দিয়েছি। আর বেশী ফ্যাচফ্যাচ না করে বাড়ি ঢোক দেখি। শোন, ভবিষ্যতে কোথাও গেলে দয়া করে একটু বলে গেলে আমি আর তীর্থের কাকের মতো বসে থাকি না প্যান্ডেলে! আমারও বন্ধু বান্ধব রয়েছে,বুঝেছিস? বাই দা ওয়ে,উফ্,কি দুর্ধর্ষ লাগছে রে তোকে!”
সদ্য পাওয়া হারটা গলায় চিকচিক করতে থাকে,কিন্তু পিয়া তার চেয়েও দামী কিছুর সন্ধান পেয়ে গেছে,তার নাম বিশ্বস্ততা। পিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েই আবার পিছু ফিরে তার বাবুয়াদার দিকে তাকায়,
“রিটার্ন গিফট্ কি নেবে?”
“ইইঃ,বেশী পাকা। যা ভাগ এখান থেকে।”
জোর পায়ে হাঁটা লাগায় পিয়া,প্যান্ডেলে ঢাক বেজে ওঠে,ষষ্ঠী শেষ হয়ে সপ্তমী পড়তে চলেছে বুঝি!
সমাপ্ত
***************************************

কল্যানী মিত্র ঘোষ পরিচিতি :
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে বসে বাংলার জন্য মন কেমন থেকেই লেখালেখির শুরু ২০১৮ সাল থেকেই নিয়মিত। ভূগোল নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে কাজ করার পর আমেরিকা তে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু ২০০৩ থেকে। 

 

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!